কার্তিকের সংক্রান্তি নিষিদ্ধপল্লীর মাদার্স ডে

নভেম্বরের মাঝামাঝি, কার্তিক মাসের শেষ দিন| অর্থাত্ কার্তিক সংক্রান্তি| ওই তো  সন্ধের ছায়াটা দ্রুত কুয়াশা ওড়না জড়িয়ে নিল|  সেই ওড়নার ফাঁক দিয়ে এখনও দেখা যাচ্ছে গোধুলির রং মাখা আকাশের মুখ| একটু পরেই বরফের মতো চাঁদ জ্যোৎস্নার স্বচ্ছ ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে দেবে| নিষিদ্ধপল্লীর গলিটার মুখে ছাতিমের গাছটা থেকে নেশা ধরানো গন্ধ মাতাল করে দিচ্ছে| যেন একটু পরেই জমে উঠবে মেহফিল|

কিন্তু না, নিষিদ্ধপল্লীতে আজকের রাতটা একটু অন্যরকম| আজ মেহফিল নয়, বরং সেখানে দেবতার আসন পাতা হবে| সেই দেবতা — যিনি নিজেই অনাহূতের মতো ধরা দেন মানুষের দুয়ারে| যাঁর পুজোয় ভক্তিকে ছাপিয়ে যায় সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস| আরাধনার মিশে থাকে কামনা| সন্তান কামনা| এই সন্তানকামনাতেই কার্তিক পুজোয় মেতে ওঠে যৌনকর্মীরা| মাতৃত্বের উপাচারে পুজো পান মাটির ঠাকুর—কার্তিক ঠাকুর|

কার্তিক ঠাকুরের পরনে কোঁচানো ধুতি,গায়ে রংচঙে চাদর, মুখে বাহারি গোঁফ, মাথায় বাবরি চুল| কালীপ্রসন্ন সিংহ হুতোম প্যাঁচার নক্সায় লিখেছেন, উঁচুগতি কার্তিকের মতো বাউরি চুল | মানে বেশ একটা ফুলবাবু’ গোছের চেহারা’ |   

কেউ কেউ বলেন কার্তিক ঠাকুরের মতো ফুলবাবু পেতেই যৌনকর্মীরা কার্তিক পুজো করেন| আবার অনেকে বলেন, যৌনকর্মীদের মধ্যে প্রথাগত বিবাহের সুয়োগ কম থাকে বলেই তাঁরা আইবুড়ো কার্তিক’ তাদের আরাধ্য দেবতা| তবে জনশ্রুতি যা-ই থাক কার্তিক পুজোর আচার দেখে মনে হয়, নিষিদ্ধপল্লীর মেয়েরা কার্তিককে সন্তান হিসেবেই পুজো করেন| কার্তিক পুজো নিষিদ্ধপল্লীর বহুল আড়ম্বরের পুজো| 

সাধারণত যৌনপল্লীতে যাঁরা অনেকদিন ধরে সন্তানহীন বা যাঁরা একটু বেশ সুন্দরী তাদের বাড়ির দরজায় কেউ কার্তিক ঠাকুর বসিয়ে দিয়ে যায়| চলতি ভাষায় যাকে বলে কার্তিক ফেলা| যাঁর ঘরে ঠাকুর ফেলা হয়, তাঁকে বলা হয় কার্তিকের মা| পুজোর দিন এই কার্তিকের মা গঙ্গায় ঘট ডুবিয়ে জল আনেন| কার্তিক ঠাকুরের সামনে উপাচার হিসেবে রাখা হয় ঘুড়ি-লাটাই, লাট্টু, মাটির পুতুল, ব্যাটারিচালিত গাড়ি ছোটদের আবদারের সামগ্রী|মধ্যরাত থেকে চার প্রহরে পুজোর প্রথা রয়েছে| গৃহস্থের ঘরে যেমন চার প্রহরে শিবপুজো হয় শিবরাত্রির দিনে, নিষিদ্ধপল্লীতেও তেমনই চার প্রহরে কার্তিক পুজোর প্রথা রয়েছে| প্রত্যেক প্রহরের শেষে পুজোর প্রসাদ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে নতুন করে পুজোর নৈবেদ্য সাজানো হয়| পুজোর শেষ পর্বে আরতি ও যজ্ঞের আয়োজন থাকে| সাধারণত কার্তিক পুজোর দিনে নিরামিষ খিঁচুড়ি, ফল, মিষ্টি নিবেদন করা হয়| ইঁট দিয়ে মাটির উনুন বানিয়ে কাঠ জ্বালিয়ে খিঁচুড়ি রান্নার পর্ব চলে| পুজোর শেষে সকলে মিলে ভোগ-প্রসাদ খায়| এরপর নাচ-গানের আসর বসে| 

সাধারণত নিষিদ্ধপল্লীর ঘরে যে কার্তিক পুজো হয়, সেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার থাকে না| তবে এবার সেই নিয়মে ব্যতিক্রম ঘটেছে উত্তর কলকাতার নিষিদ্ধপল্লী, সোনাগাছিতে| এবার সেখানে কার্তিক পুজো করা হচ্ছে একেবারে প্রকাশ্যে, বারোয়ারিতলায়| যে পুজোর আয়োজন করছে সেখানকার যৌনকর্মীদের সন্তানদের নিয়ে তৈরি আমরা পদাতিক নামে সংগঠনটি| যে পুজোয় আমন্ত্রিত হচ্ছেন রাজ্যের মন্ত্রীরাও|

এইভাবেই যৌনকর্মীরা তাঁদের ঘরের লুকনো অন্ধকার থেকে বাইরে আসতে চাইছেন| পুজোর প্রদীপের আলোয়, ধুপ-ধুনোয়, নৈবেদ্যে-প্রসাদে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিষিদ্ধপল্লী কার্তিকপুজোও আর পাঁচটা পুজোর মতোই মর্যাদা পাচ্ছে| এই পুজো নিয়েই তো যৌনকর্মীদের মাতৃত্বের কামনা স্বীকৃতি পেয়ে থাকে| এই পুজোর মধ্যেই তাদের জীবনের যন্ত্রণা রুক্ষতা ঢাকা পড়ে যায় মাতৃত্বের কোমলতায়|

সেটা বোঝা যায় কার্তিক পুজোর পরের দিন| সেদিন কার্তিক ঠাকুরকে নিয়ে সবাই মিলে শোভাযাত্রা করে যান গঙ্গার ঘাটে| কার্তিক ঠাকুরকে বিসর্জনের রীতি নেই| তাই সবাই মিলে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে কোনও উঁচু জায়গায় রেখে আসেন কার্তিক ঠাকুরকে| সেই সময়ে তাঁদের চোখ জলে ভিজে ওঠে| সেই জলেই ছায়া ফেলে নারীর অন্তর্নিহিত মাতৃত্ব| এই সমাজে ঘর পায় না যারা, কার্তিক পুজোর দিনে মাটির ঠাকুরের মধ্যে তারা মাতৃত্বের আবাহন করেন| এভাবেই কার্তিক পুজোর দিনটা হয়তো বা নিষিদ্ধপল্লীর যৌনকর্মীদের কাছে হয়ে ওঠে দ্য মাদার্স ডে|

ছবি- সৌরভ দত্ত