‘চল রে মনা…বেরিয়ে পড়ি।’
ঘুম ভাঙতেই বলল সনাতন। মাঝেমধ্যেই বলে। কখনও বলে ‘খিচুড়ি হলে বেশ হতো’, কখনও ‘গঙ্গাস্নান হয়নি কতদিন’, কখনও ‘গুরু দর্শন করতে হবে’। ভোররাতের ভাঙা ঘুমে ইচ্ছেগুলো হানা দেয়। কেন যে দেয় সনাতন জানে না। তবে যতক্ষণ না ইচ্ছের সদগতি হচ্ছে ততক্ষণ শান্তি নেই। কাজেও মন বসে না। কাজ মানে নামগান করে মাধুকরী বা ভিক্ষে। চাল, ডাল, আনাজ যা জোটে একসঙ্গে ফুটিয়ে জগাখিচুড়ি। সেবা করতে মন্দ লাগে না। শরীরে বাস করেন ঈশ্বর, তাঁরই সেবা। একটু নুন আর তেল জোগাড় হলে জমেও যায় বেশ। কদাচিৎ মাছ জুটলে তো মহাভোজ। গরম ভাতের সঙ্গে মাছের ঝোল যেন অমৃত। জাতিবৈষ্ণব বা জাতবোষ্টমদের সবকিছুই চলে। গৌড়ীয় গোঁড়ামি নেই, নেই সহজিয়াদের সহজ নিয়মও।
সনাতনের সঙ্গে সম্পর্কটা যেকী, সেটা আজও ঠাহর হল না মেনকার। সনাতনের মনা। প্রথম প্রথম মেনকা বলে ডাকলেও, কখন যে মনা হয়ে গেল বুঝতেও পারেনি। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আঁচিলের মতো আপনা হতেই একাত্ম হয়ে গেল। মালাচন্দন বা বিয়ের তাগিদও অনুভব করল না। দুজন যুবক-যুবতী কোন অধিকারে একসঙ্গে বসবাস করবে, সে প্রশ্নও তুলল না কেউ। সবাই যেন জানতই, ছকুরডাঙা গ্রামে সনাতনের কুঁড়েয় একসময় মেনকা এসে উঠবেই। সনাতনের কথা শুনে আধো-ঘুমে মেনকা বলল, ‘দাঁড়াও না…অত তাড়ার কী আছে…’
আজ দিনটা একটু অন্যরকম। কীর্তনীয়া রামকৃষ্ণর দলের সঙ্গে এক শ্রাদ্ধবাড়িতে সঙ্গত করতে হবে। পেটপুরে খাওয়ার সঙ্গে মিলবে দক্ষিণাও। সনাতনের গলা বরাবরই ভাল, তবুও কাজে লাগানোর চেষ্টা করেনি কখনও। তিন পুরুষের বৈষ্ণব, বাপ-ঠাকুর্দার মতো নামগান আর মাধুকরী করেই জীবন কাটিয়ে দিল। মেনকার গলাও মন্দ নয়। গায়ও দরদ দিয়েই। তাই মাঝেমধ্যেই রামকৃষ্ণের মতো কীর্তনীয়ারা কদর দেয়, জোটে উপরি রোজগার।
ভোর-ভোর বেরিয়ে পড়ার কথা। যেতে হবে অনেকটা পথ। বাধা পড়ল ইচ্ছেডানায়, ‘কারিগরের সঙ্গে একবার দেখা হওয়া দরকার।’
সনাতন নির্বিরোধ, নিরীহ মানুষ। মনে প্যাঁচ-পয়জার নেই, কারও সাতে-পাঁচে থাকে না, ঝগড়া-বিবাদ দুরস্ত। গ্রামের দুর্গা, কালী বা শীতলা পুজোতে অপরিহার্য। ভূত-খাটুনি খাটে। ঈদ বা মহরমেও সমান অংশীদার। হাসপাতাল, শ্মশানযাত্রা, বা মুমূর্ষু রোগীর সেবায় এক পা বাড়িয়েই আছে। তবুও সৎ, উদার, পরোপকারী, ধর্মনিরপেক্ষ তকমাগুলোও যেন ঠিক জুতসই নয়। অথচ এগুলো ছাপিয়ে আর কিছু মনেও আসে না মানুষের। তবে একবাক্যে সবাই স্বীকার করে, সনাতন মানুষটা সত্যিই অন্যরকম। সেই অন্য রকম বলেই কি আগুপিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অবলা উদ্ধারে? রক্ষা তো করেইছিল, দিয়েছিল আশ্রয়, নিরাপত্তা, সোহাগ। মেনকা অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছিল দেবতাকে। সেই যে জুড়ল, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেও ছাড়াছাড়ি হল না। ছেড়ে যাবেই বা কোথায়? দেবতা সান্নিধ্যেই তো অধিক নিরাপত্তা।
গাঁয়ে গাঁয়ে এখন নানা পার্টির দৌরাত্ম্য। এ বলে ‘আমরা ছাড়া বাঁচতে পারবি না’, তো ও বলে ‘হক আদায় করতে হলে আমাদের সঙ্গে আয়। কে যে কার সঙ্গে পাকিয়ে তালগোল। এলাকা দখলে রাখতে বা দখলে নিতে কাজিয়া, খুন, জখম, ধর্ষণ। বারমহল ছাড়িয়ে পার্টির আনাগোনা অন্দরমহলেও। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-পড়শি, কেউ কারও নয়। যে যার স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। স্বার্থে আঘাত লাগলেই পাল্টা আঘাত।
–‘তাড়াতাড়ি ওঠ মনা…ভোর হল বলে।’
–‘দাঁড়াও না…’, মেনকার জড়ানো গলা। সারাদিনের খাটা-খাটনির পর শরীর যেন বিছানা ছাড়তেই চায় না। অর্ধেক চোখ খুলে বলল,
–‘আজ সেই কীর্তনের বায়না আছে না?’
–‘আছে…তবে ওখানে গিয়ে আর কাজ নেই’, সনাতন নিস্পৃহ।
এবার পুরো চোখ খুলতেই হল। জড়তাও কাটল কিছুটা। উদ্বিগ্ন গলায় মেনকা বলল,
–‘তা হলে কোথায় যাবে?’
গিয়েছিল শ্যাওড়াতলার মেলায়। তখন গগন দাসের সাধনসঙ্গিনী। যুবতী বিধবাকে ফুঁসলোতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি গগনের। যৌবন সামলাতে মেনকা তখন হিমসিম। তাই বাউলের দেহসাধনার সঙ্গী হতে মুহূর্তেও দ্বিধা করেনি। জেনেবুঝেই ঘাড়ে নিয়েছিল কুলটা অপবাদ। গায়ক হিসেবে অঞ্চলে গগনের ভালই নামডাক। বায়নাও জোটে প্রচুর। মেনকাও গাইতে শুরু করল একসময়। উপচে পড়া আসর, করতালির বন্যা, কড়কড়ে নোট, বছর কয়েক মন্দ কাটল না। গগনের দেহসাধনাও জীবনে নিয়ে এঢ়ল নতুন জোয়ার। ভাঁটাও এল নিজ নিয়মে। অতিরিক্ত গাঁজার নেশায় গগনের গলা বসে যেতে লাগল। কমতে লাগল রোজগার। কখন যে ধার-দেনায় নাক অবধি ডুবে গেল টেরও পেল না। দেহসাধনাতেও আর মন নেই। সামর্থ্যও নেই। হাঁসফাঁস অবস্থা সামলাতে মেনকাকে বেচে দেবার ফন্দি আঁটল গগন। গাঁয়ে-গঞ্জে যুবতী মেয়ের খরিদ্দারের অভাব নেই। উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে নিয়ে এল শ্যাওড়াতলার মেলায়। গগনের হাবভাব, অচেনা লোকের আনাগোনা, মনে কু ডাকল মেনকার। আড়ি পেতে শিউরে উঠল। অন্ধকার মাঠ পেরিয়ে লাগাল ছুট। পিছু নিল খদ্দের-সহ গগন। ধরেও ফেলল একসময়। তখনই যেন মাটি ফুঁড়ে দেবতার আবির্ভাব। কোনওমতে ওদের হাত ছাড়িয়ে মেনকা ঝাঁপিয়ে পড়ল সনাতনের বুকে। বিষয়টা বুঝতে পেরেই আর দেরি করেনি সনাতন। দুজনকে কাত করে মেনকাকে ঘাড়ে ফেলে দৌড় লাগিয়েছিল। নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়নি শয়তানগুলোর। ভোরের আলোয় মেনকা দেখল পাকা রাস্তায় চলে এসেছে। সনাতন জানতে চাইল,
–‘কোথায় যাবে এখন?’
–‘যে দিকে দু’চোখ যায়।’…
–‘মানে?’, উঠে বসল মেনকা। ‘কীর্তনের আসরে যাবে না?’
— ‘না…চল রামকেষ্ট আসার আগেই আমরা বেরিয়ে পড়ি’, সনাতন ব্যস্ত।
–‘রামকেষ্ট কিন্তু গোঁসা করবে খুব। আর হয়তো ডাকবেও না কখনও’, সতর্ক করল মেনকা।
–‘সে না ডাকে ডাকুক। তুই চল এখন…’, সনাতনের মস্ত তাড়া।
–‘টাকাগুলো পেলে সুবিধে হতো। ঘরের চালটা অ্তত সারানো যেত’, মেনকা নাছোড়। নামগান করে পেট ভরলেও, বাসস্থানটাও তো ঠিক থাকা চাই।
–‘সে পরে ভাবব’খন, এখন তুই চল দিকি’, তাড়া লাগাল সনাতন।
–‘কিন্তু যাবেটা কোথায়?’
মেনকার কাছে এই ধরনের যাত্রা নতুন নয়। তিরিশ বছর ধরেই দেখছে। বিস্তর হ্যাপা। ট্রেনে অসুবিধা হয় না। খঞ্জনি বাজিয়ে গান গেয়ে এ-কামরা ও-কামরা করেই পথ পার করে দেওয়া যায়। চেকারবাবুরা ভাবে ভিখিরি, সামনেই নেমে যাবে। মাঝিরা অবশ্য জেনে-বুঝেই পারানির কড়ি মাফ করে। সমস্যা শুরু হয় বাসওয়ালাদের নিয়ে। ওইটুকু বাসে কাঁহাতক আর গান চালিয়ে যাওয়া যায়? বাধ্য হয় ধরা পড়তে। কেউ কেউ নামিয়ে দিলেও বেশিরভাগই শেষমেশ দয়া করে। কিন্তু ভ্যানওয়ালাদের কাছে কোনও জোরাজুরিই খাটে না। তখন হাঁটা ছাড়া গতি নেই। এভাবেই কেন্দুলি, অগ্রদ্বীপ, নবাসন, সোনামুখী, গঙ্গাসাগর, ঘোষপাড়ার মেলায়। মাঝেমধ্যে বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে গুরুদেবের বাড়ি যাওয়াও আছে। কিন্তু এখন ভরা বর্ষা। মেলা-মচ্ছবেরও সময় নয়। দিন পনেরো আগেই গুরুপাট থেকে ফিরেছে। তা হলে কোথায় যেতে চায় মানুষটা?
–‘মহাপ্রভু এও বলেছিলেন, মোর জাতি মোর সেবকের জাতি নাই। কিন্তু আসলে কী হল? জাতপাত যেমন ছিল তেমনই রইল। সুযোগ বুঝে কিছু বামুন, গৌড়ীয় বৈষ্ণব বনে গেল। আগের মতোই ছড়ি ঘোরাতে লাগল নিচু জাতের বৈষ্ণবদের ওপর। কোনওদিন দেখেছিস কোনও ব্রাহ্মণকে শূদ্র বৈষ্ণবের কাছে দীক্ষা নিতে? যে বৈষ্ণবদের তৃণ হতে দীন হবার কথা, তারাই রেষারেষি দলাদলিতে জড়িয়ে পড়ল। সহজেরা আলাদা হল বটে, কিন্তু তারাও কি ভেদাভেদের উপরে উঠতে পারল?’
–‘এ গাঁয়ে আর মন টিকছে না রে। চারিদিকে এত হিংসা, হানাহানি। সবাই যেন সবাইয়ের শত্তুর বনে যাচ্ছে।’
–‘সে তো সব গাঁয়েরই এক অবস্থা। লাভ কি ঠাঁইনাড়া হয়ে?’, মেনকার বাস্তব যুক্তি।
–‘তবু তো মনটা একটু অন্যরকম হবে। গতকাল ইদু শেখের মৃত্যুটা দেখার পর থেকেই মনটা কেমন যেন আনচান করছে। দু’দণ্ডও তিষ্ঠতে পারছি না। জলজ্যান্ত ছেলেটাকে চোখের সামনে কোপাল! অত রক্ত জীবনে দেখিনি রে মনা…’, সনাতনের হাহাকার।
–‘পুরুষমানুষের মন এত নরম হলে চলে?’ মনে এলেও বলল না মেনকা। সনাতনের গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, ‘দ্যাখো আমি বলি কি…আজকের গাওনাটা গেয়ে নাও। হাতে দু’পয়সা আসুক, তারপর না হয় কোথাও যাওয়া যাবে।’ সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে লাভ কী?
–‘অত টাকার মায়া করিস না তো। টাকা কি সঙ্গে যাবে?মনটাই যদি দু’দণ্ড শান্তি না পেল তবে বেঁচে থেকে লাভ কী?’
গাঁয়ে গাঁয়ে এখন নানা পার্টির দৌরাত্ম্য। এ বলে ‘আমরা ছাড়া বাঁচতে পারবি না’, তো ও বলে ‘হক আদায় করতে হলে আমাদের সঙ্গে আয়। কে যে কার সঙ্গে পাকিয়ে তালগোল। এলাকা দখলে রাখতে বা দখলে নিতে কাজিয়া, খুন, জখম, ধর্ষণ। বারমহল ছাড়িয়ে পার্টির আনাগোনা অন্দরমহলেও। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-পড়শি, কেউ কারও নয়। যে যার স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। স্বার্থে আঘাত লাগলেই পাল্টা আঘাত। সনাতনের সহ্য হয় না এই খুনোখুনি। একেকটা খুনের খবর শোনে আর উদাস চোখে আকাশ পানে চেয়ে থাকে। কখনও নিঝুম রাতে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে। কিন্তু শুধুমাত্র খুনোখুনি এড়াতেই মানুষটা বেরিয়ে পড়তে চায়, বিশ্বাস হল না মেনকার। গেল হপ্তাতেই তো রমেন মাস্টার খুন হল। তখন তো এসব কিছু বলেনি? সন্দিগ্ধ মেনকা সনাতনের চোখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল,
–‘আমাকে সত্যি কথাটা বলো তো?’
–‘আসলে কি জানিস… কারিগরকে একবার দেখার বড্ড সাধ জেগেছে।’
তাজ্জব বনে গেল মেনকা। বলে কি মানুষটা! বিস্মিত চোখে বলল,
–‘ভগবানকে আবার দেখা যায় নাকি?’
–‘যাবে না কেন? আমার বাড়িতে আমাকে দেখা যায় না?’, সনাতনের সরল যুক্তি।
–‘তা বলে ভগবানকেও দেখা যাবে!’মেনকার বিস্ময়ের ঘোর আরও বাড়ল। মানুষটা সোজা, সরল। কিন্তু এ কি মাথা খারাপের লক্ষণ নয়?
–‘যাওয়াই তো উচিত। সৃষ্টিকর্তাকে তো সৃষ্টির মাঝেই দেখতে পাওয়া উচিত’, সনাতনের দৃঢ় বিশ্বাস।
–‘তবে যে গুরুদেব বলেন, ভগবান মানুষের মধ্যেই আছে। মানুষের সেবা করলেই তেনাকে পাওয়া যায়’, মেনকা যুক্তি সবল করতে চাইল। মানুষটার মাথা থেকে উটকো চিন্তা তাড়ানো দরকার।
–‘আরে ধুর…ওসব কথা তো জোর করে বলা। বামুনদের উলটো সুরে গাইবে বলে বলা। বেদ, বেদান্ত মানবে না বলে বলা। তা ছাড়া মানুষের মধ্যে যদি ভগবান থাকত, তা হলে কি চারিদিকে এত হিংসা হানাহানি হতো? দিনকে দিন লোকে অধঃপাতে যেত?’, সনাতনের পাল্টা যুক্তি।
চুপ করে গেল মেনকা। নানারকম লোকের সঙ্গে সনাতনের ওঠাবসা, জ্ঞানগম্যিও বেশি। হয়তো ঠিকই বলছে। তবুও গুরুদেবকে ভুল বলে মানতে চাইল না। সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ছুড়ল, ‘তাহলে কি গুরুদেব ভুল বলেন?’
–‘ভুল বলবে কেন? তা হলে তো অদ্বৈত, নিত্যানন্দ, চৈতন্যও ভুল। আসলে ব্যাপারটা তা নয় রে। ওসব কথা হচ্ছে মুখ্যু, নিচু জাতের মানুষকে বামুনদের অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্য বলা। সেই জন্যই তো মহাপ্রভু বলেছিলেন, “অমানিনা মান দেন”! অর্থাৎ যাদের কোনও মান নেই তাদের মান দিতে, যাতে তারা জোট বাঁধতে পারে। দিশেহারা না হয়ে বামুনদের সঙ্গে লড়াই দিতে পারে’, সনাতনের ব্যাখ্যা।
–‘তাই?’, মেনকা যেন কথার ফেরে পড়ে গিয়েছে।’
–‘মহাপ্রভু এও বলেছিলেন, মোর জাতি মোর সেবকের জাতি নাই। কিন্তু আসলে কী হল? জাতপাত যেমন ছিল তেমনই রইল। সুযোগ বুঝে কিছু বামুন, গৌড়ীয় বৈষ্ণব বনে গেল। আগের মতোই ছড়ি ঘোরাতে লাগল নিচু জাতের বৈষ্ণবদের ওপর। কোনওদিন দেখেছিস কোনও ব্রাহ্মণকে শূদ্র বৈষ্ণবের কাছে দীক্ষা নিতে? যে বৈষ্ণবদের তৃণ হতে দীন হবার কথা, তারাই রেষারেষি দলাদলিতে জড়িয়ে পড়ল। সহজেরা আলাদা হল বটে, কিন্তু তারাও কি ভেদাভেদের উপরে উঠতে পারল? তাদের মধ্যেও কি জাতের ভেদ নেই? আমরা নিচু জাত, কোনও নিয়মের তোয়াক্কা করি না বলে আমাদেরও কি দুরছাই করে না?’, সনাতনের ক্ষোভ।
–‘তা হলে বলতে চাও মানুষের ভেতর ভগবান বাস করেন না?’ বিহ্বল মেনকার প্রশ্ন।
–‘না রে মনা, না। এত ভেদাভেদের মধ্যে কখনও ভগবান বাস করতে পারেন না। সেই জন্যই তো সব ছেড়ে-ছুড়ে বেরিয়ে পড়তে চাইছি’, সনাতনের উদ্দেশ্য।
–‘ক’দিন ধরেই তোমাকে দেখছি ওই কালীমন্দিরের ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে গুজুর-গুজুর করতে। উনিই তোমার মাথাটা খেলেন, না কি?’, মেনকার সন্দেহ।
হেসে ফেলল সনাতন। –‘না রে মনা… এসব আমারই মনের কথা। খামোখা অন্যকে দোষ দিয়ে কী লাভ বল?’
থম মারল মেনকা। জুতসই কোনও জবাব মাথায় এল না। তবুও পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য বলল, ‘কিন্তু এত বড় বিশ্বসংসারে কোথায় খুঁজবে তেনাকে?’
–‘তা জানি না। তবে খুঁজব… মন, প্রাণ দিয়ে খুঁজলে কি আর পাব না?’, সনাতনের সরল বিশ্বাস।
–‘কী যা তা বলছ! খুঁজলেই বুঝি তেনাকে পাওয়া যায়?’
–‘যায় কি যায় না সেটা বোঝার জন্য তো আগে খুঁজতে হবে। নে নে ঝটপট কর। রামকেষ্ট ব্যাটা এসে পড়লে সব মাটি হয়ে যাবে’, সনাতন তাড়া লাগাল।
–‘আমার মাথায় কিন্তু কিছুই ঢুকছে না। তেনার নাগাল পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা’, মেনকা রাশ টানতে চাইল।
–‘তোর মোটা মাথায় ঢুকবেও না। এই চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্র, সব তো তেনার হাতেই তৈরি। দেখভালও তিনিই করেন। তাই চলতে ফিরতে কি আর দেখা হবে না? একসময় না একসময় ঠিক হয়ে যাবে’, সনাতনের বলিষ্ঠ যুক্তি।
–‘তা তেনাকে যদি দেখতে পাও-ও, তাতে লাভটা কী হবে শুনি?’, মেনকার আপ্রাণ বাধা। শেষ বয়সে একি ভীমরতি হল মানুষটার!
–‘লাভ নেই? বলিস কী রে মনা! জন্ম সাত্থক হয়ে যাবে রে’, সনাতন আপ্লুত। যেন সত্যিই দেখা পেয়ে গিয়েছে।
–‘কী চাইবে তেনার কাছে?’, মেনকা উৎসুক। বিশ্বাস করতেও যেন মন চাইছে। জবরদস্ত কোনও বর পেলে বাকি জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারে।
–‘চাইব আবার কী? শুধু জিজ্ঞেস করব, মানুষের মধ্যে এত হিংসা কেন দিলেন তিনি? মুক্তির কোনও উপায় নেই?’, সনাতন দ্বিধাহীন।
–‘কিন্তু…তোমাকে চিনবে কী করে?’, বাগড়া দিল মেনকা।
সামান্য কটা প্রশ্ন, যাতে নিজেদের চেয়ে অন্যের লাভই বেশি, তার জন্য অত হ্যাপা পোয়ানোর কোনও মানে হয়?
–‘নিজের বাপকে চিনতে পারব না? কথা একখান বললি বটে! তিনিই তো আমাদের পরম পিতা রে’, চোখ বুজে এল সনাতনের।
–‘হ্যাঁগো… সত্যি যাবে?’, মেনকার ভীত জিজ্ঞাসা। দু’জনেরই বয়স হয়েছে, উদ্দেশ্যহীন যাত্রার ধকল যে পুরোমাত্রায় হবে সন্দেহ নেই।
–‘যেতেই হবে রে মনা। মানুষের অধঃপাতে যাওয়া আটকাতেই হবে। তা ছাড়া জীবনের বাতি নিভল বলে। যাবার আগে একবার দেখে যাব না, কার বাড়িতে এতদিন বাস করলাম’, সনাতনের আকুল আকাঙ্ক্ষা।
আবার চুপ মারল মেনকা। বুঝল বুড়োর মাথায় ভূত যখন চেপেছে, তখন যেতে হবেই। না গিয়ে উপায়ও নেই। একসঙ্গে পথ চলা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তল্পিতল্পা গোটানো হল। সখা-সখী চলল ঈশ্বর সন্ধানে।
জল কাদা পেরিয়ে মোরাম রাস্তায় উঠতেই সূর্যদেব উদয় হলেন। সনাতন একদৃষ্টে কিছুক্ষণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আপন মনে হাঁটা লাগাল। গাছ-গাছালি, ফুল, ফল, পাখি, পুকুর সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছে গভীর মনোযোগে। কারিগর যে কোথায়, কী রূপে প্রকট হবেন জানা নেই। তবে স্থির বিশ্বাস, তার উপস্থিত নিশ্চিত টের পাবে। অন্তর-বাহির দৃষ্টি একত্রিত করে তাই সর্বদা সজাগ। আনন্দ, মুগ্ধতায় অক্লান্ত অন্বেষণ। কিন্তু ভারী শরীর নিয়ে মেনকা নাজেহাল। কোমরের ব্যথাটাও চাগাড় দিচ্ছে। খানিক বিশ্রাম নিতে চাইলেও, কথা বুড়োর কানে যাচ্ছে না। বিভোর হয়ে পথ চলেছে।
পথের ধারে বিরাট উই ঢিপি। সামনে একটি বছর বারোর ছেলে সাপ ধরার চেষ্টা করছে।
খেঁকিয়ে উঠল সনাতন, ‘কী হচ্ছে কি? সাপের কামড়ে মরবি নাকি?’
খিলখিল করে হেসে উঠল ছেলেটি, ‘মরব কেন গো দাদু…ও আমার কিচ্ছু করতে পারবে না।’
মিষ্টি মুখখানা দেখে বড় মায়া হল মেনকার, ‘তোর নাম কী রে? থাকিস কোন গাঁয়ে?’
–‘আমার নাম ভগবান। লোকে বলে ভগা। বাড়ি নিশ্চিনপুর’, ভগা হাসিমুখে বলে।
–‘দ্যাখ মানুষের কাণ্ড! ভগবানকে ভগা বানিয়ে ছেড়েছে’, মেনকার দিকে তির্যক দৃষ্টি হানল সনাতন।
–‘নিশ্চিনপুর তো অনেক দূর। এখানে কী করছিস তুই?’, জিজ্ঞাসা না করে পারল না মেনকা।
–‘গোরু চরাতে এনেছি গো। সাঁঝের বেলা ফেরত দেব’, ভগার হাসিমাখা উত্তর। –‘তা তোমরা যাচ্ছ কোথায়?’
–‘তাতে তোর কী দরকার রে?’ ধমক দিল সনাতন। আসল উদ্দেশ্যটাই মেনকা বলে দিলেই বিপদ। যদি সঙ্গে যেতে চায়? কর্তার কাছে নিরিবিলি যাওয়াই ভাল।
–‘তোর বাপ কী করে?’, মেনকার বড্ড ভাল লেগেছে ছেলেটিকে।
–‘বাপ তো নেই। গেল বছর খুন হয়ে গেছে। মা আছে, ক্ষেতে মজুর খাটে’, আচমকাই ভগার হাসিমুখে ভাঁটা।
ভ্রূ কুঁচকে মেনকার দিকে তাকাল সনাতন, ‘দ্যাখ তোর মানুষের খেল। এই বয়সেই ছেলেটাকে বাপহারা করে ছেড়েছে। এর পরেও বলবি মানুষে ভগবান আছে?’
–‘জানো তো দিদা, মা’র না খুব অসুখ। ওই শরীরেই মা কাজে যায়। বলে কাজ না করলে খাব কী? আমাদের তো কেউ নেই’, ভগার কঠিন বাস্তব।
–‘চল রে মনা…’, তাড়া লাগাল সনাতন। সারল্যে বিষাদছায়া অস্বস্তিকর।
–‘সাবধানে থাকিস বাবা! মাকে দেখিস…’, মেনকা ছলছল।
সনাতন পা চালাল। ছেলেটির জন্য খারাপ লাগলেও, করার কিছু নেই। মানুষের যা মতিগতি, ঝাড়েবংশে নির্বংশে না হয়ে ক্ষান্ত হবে না। কারিগর সহায় না হলে ঘোর দুর্দিন।
একসময় জোর করেই সনাতনকে থামাল মেনকা। বসে পড়ল বিলের ধারে। লোকে বলে বউ-মরা বিল। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে, অতিষ্ঠ হয়ে অনেক বউই মরেছে এখানে। স্নান সেরে মুড়ি-বাতাসা বের করল। সনাতনের স্নানের তাগিদ নেই। মুড়িও খেল দু’চার গাল। একদৃষ্টে জলের দিকে চেয়ে রইল। মাছেরা আপন মনে খেলা করছে। সাধকরা মাছের মতো চোখ কামনা করে। পলকহীন চোখে নির্নিমেষ প্রত্যক্ষ করতে চায় ঈশ্বরলীলা। বাউল-ফকিররা মনে করে নারীর ঋতুকালে ভেসে আসে ঈশ্বররূপী মহামীন, অধর মানুষ। চেষ্টা চালায় সেই অধর মানুষকে ধরবার। কে পারে বা পেরেছে, সনাতন চাক্ষুষ করেনি কখনও। তবু বিশ্বাস করতে মন চায়। ওই মাছগুলোর মধ্যেই হয়তো তিনি আছেন। আকুল হৃদয়ে খুঁজতে লাগল কারিগরকে। তাঁর হেকমতেই তো দুনিয়া চলছে।
–‘চল রে মনা… এবার যাই।’
উঠে পড়ল সনাতন। আবার চারিদিক আকুল হৃদয়ে পর্যবেক্ষণ করতে করতে পথ চলা। সাতমুড়া গ্রামে এসে থামতেই হল। গ্রামের শুরুতেই বিরাট বট গাছ। সাতটা মোটা ঝুরি নেমে এসে মাটিতে সেঁধিয়ে গিয়েছে। লোকে বলে গাছটার বয়স নাকি দু’হাজারেরও বেশি। আগে দেখলেও তেমন কিছু মনে হয়নি সনাতনের। আজ যেন নতুন করে দেখল। কারিগরের কেরামতিতে অবাক বনে গেল। গাছটা কি জেনে বুঝেই মাটিতে ঝুরি গেঁথেছে, নাকি ভগবান পরম মমতায় ঝুরিগুলোকে গেড়ে দিয়েছে মাটির ভিতরে? যেটাই হোক, সবই কারিগরের হেকমতি। নইলে গাছটা এত বছর খাড়া তো থাকতই না, মাটি থেকে পর্যাপ্ত খাদ্যও জোগাতে পারত না নিজের বিরাট শরীরটার জন্য। সামান্য একটা গাছের জন্য ঈশ্বরের এই মমতায় সনাতন মুগ্ধ, আপ্লুত। গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে পেতে চাইল ঈশ্বর-সান্নিধ্য।
গাছের গোড়ায় একটা কোটর মতন। চোখ পড়তেই মুখ ঘোরালো সনাতন। বছর দুয়েক এক পাগলি আস্তানা গেড়েছে। অর্ধ উলঙ্গ হয়ে সারাদিন বিড়বিড় করে আর হাত দুটো এলোপাথাড়ি ছুড়ে কী যেন তাড়ায়। কেউ খেতে দিলে খায় নয়তো ঠায় বসে থাকে। পিছন ঘুরতেই শিশুর কান্নার আওয়াজ পেল সনাতন। পাগলি তো একাই থাকে, বাচ্চা এল কোথা থেকে? তা হলে কি কারও বাচ্চা চুরি করে এনেছে? পূর্ণ করতে চাইছে অপূর্ণ মাতৃত্ব? নজর ঘোরাতেই হল। দেখল পাগলির কোলে মাস খানেকের একটি শিশু। পাগলি শান্ত, মায়াময় চোখে উন্মুক্ত করেছে স্তন। শিশুটিও পরম নিশ্চিন্তে আহরণ করছে প্রকৃতি সুধা। মাথা ঝাঁঝাঁ করে উঠল সনাতনের। অবোধ পাগলেরও রেহাই নেই? তখানি নির্দয়, বিকৃত মনস্ক হলে মানুষ এমন করতে পারে!
মন শান্ত করতে নামগান শুরু করল সনাতন। মেনকাও গলা মেলাল। গাইতে গাইতে পটাশপুর। রাধা-গোবিন্দ মন্দিরে সবে শেষ হয়েছে নিত্যভোগ। মেনকার জোরাজুরিতে বসতেই হল। অথচ খাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই সনাতনের। সকাল থেকেই সজাগ হয়েও কারিগরের দেখা মিলল না। কোথায় যে ব্যস্ত রয়েছেন আন্দাজ করাও মুশকিল। যদি সত্যিই দেখা না মেলে? এত কষ্ট বিফলে যাবে? বিফলে গেলে নিজের হয়তো খুব একটা ক্ষতি হবে না, কিন্তু মুক্তির পথ বাতলানো হবে না দিশাহীন মানুষগুলোকে। মারামারি, হানাহানি করেই লোপ পাবে। সেও কি সহ্য হয়? খিচুড়ি লাবড়া পায়েস নাড়াচাড়াই সার হল, মুখে উঠল না কিছুই। মনে পড়ল পাগলির কথা। খাওয়া জুটল কিনা কে জানে। বাপহারা ভগাও রোদে পুড়ে সামান্য ক’টা টাকার জন্য অন্যের গরু চরাচ্ছে। ওরও কি খাওয়া হল?
কালিকাপুর শ্মশানের আগুন নেভেনা কখনও। কোনও না কোনও চিতা জ্বলছেই। এখানেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল সনাতন। লোকজনের মাঝে থাকাটাই নিরাপদ। অশ্বত্থতলায় সিমেন্টের বেদির উপর প্লাস্টিক পাতল। শুতে না শুতেই মেনকা গভীর ঘুমে। সনাতনের চোখে ঘুম নেই। একদৃষ্টে আগুনের দিকে তাকিয়ে। ওই লেলিহান শিখার মধ্যেও তো কারিগরের সন্ধান মিলতে পারে।
–‘আমি বলি কি… আজ এখানেই ঠাঁই গাড়ো’, খাওয়ার পর আধ-শোয়া মেনকা বলল। আগে যে ক’বারই বেরিয়েছে একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল। কিন্তু এবার যেন ছন্নছাড়া যাত্রা। গন্তব্য তো নেই-ই, কোথায় রাত কাটাবে সে ঠিকানাও নেই। একে বর্ষাকাল তায় দিনকাল ভাল না, পথে যদি কোনও বিপদ হয়?
–‘এ ভর-দুপুরে ঠাঁই গাড়বি কি রে? চল চল, এখনও অনেক পথ বাকি’, সনাতনের তাড়া। শুধু শুধু সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।
–‘আজ রাতটা থাকি না এখানে। সাঁঝেরবেলায় দিনু গোঁসাই গান করবে, একটু শুনে যাই’, মেনকার যাত্রা এড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা।
–‘সে তো কতবার শুনেছিস। নতুন করে আর কী শুনবি?’ সনাতনের বোধগম্য হয়নি বায়নার কারণ।
–‘তবুও…’
–‘তা হলে তুই থাক, আমি যাই। আমাকে অত আলসেমিতে পায়নি’, হাঁটা লাগাল সনাতন। ঈশ্বর দর্শনের চেয়েও গোঁসাইয়ের গান বড় হল?
অগত্যা উঠতেই হল মেনকাকে। দিতেই হল সখা সঙ্গ।
সন্ধ্যার মুখে পৌঁছল কালিকাপুর। এখানেই গোরা ডাকাতের কালীমন্দির। দু’শো বছরেরও বেশি পুরনো। খুবই নাকি জাগ্রত দেবী। মন্দিরের পাশেই মহাশ্মশান। দূরান্তের মানুষও ভিড় করে দাহকরবার জন্য। হযতো ভাবে এভাবেই প্রায়শ্চিত্ত হবে প্রিয়জনের। সনাতন ভেবে পেল না, ভগবান একই সঙ্গে কী করে মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারেন ডাকাত এবং গৃহস্থের। জীবনে মন্দির, বিগ্রহ, ধর্ম, উপধর্ম, অনেক কিছুই দেখল। শুনল পাঁচালি, বচন, শাস্ত্র, ব্রতকথা। মন ভরল না কিছুতেই। বিশ্বাস হল না ঈশ্বরকে কোথাও আবদ্ধ করা যায়। অথচ কেন যে আগে কোনওদিন ঈশ্বরের সঙ্গে মোলাকাতের ইচ্ছাটা জাগেনি, ভেবে পেল না সনাতন। কারিগরের কাছে উপায় জেনে অনায়াসেই তো বাঁচানো যেত অনেকগুলো দুর্মূল্য প্রাণ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেও আফশোস করল না সনাতন। তাঁর ইচ্ছেতেই তো সবকিছু চলছে। তিনি মনে করছেন এই সময়টাই উপযুক্ত, তাই হয়তো ইচ্ছেটা জাগিয়েছেন। কারিগরের উদ্দেশ্য খানিকটা ধরতে পেরে উজ্জীবিত হল সনাতন, ‘দেখা তা হলে হচ্ছেই!’
কালিকাপুর শ্মশানের আগুন নেভেনা কখনও। কোনও না কোনও চিতা জ্বলছেই। এখানেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল সনাতন। লোকজনের মাঝে থাকাটাই নিরাপদ। অশ্বত্থতলায় সিমেন্টের বেদির উপর প্লাস্টিক পাতল। শুতে না শুতেই মেনকা গভীর ঘুমে। সনাতনের চোখে ঘুম নেই। একদৃষ্টে আগুনের দিকে তাকিয়ে। ওই লেলিহান শিখার মধ্যেও তো কারিগরের সন্ধান মিলতে পারে।
ভোর রাতে কান্নার আওয়াজ। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সনাতন। ক্লান্তিতে কখন যে ঘুম এসে গিয়েছিল টেরও পায়নি। কান্নার উৎস খুঁজে হতবাক। ভগা! তাড়াতাড়ি মেনকাকে তুলল, তারপর দৌড়ে গেল ভগার কাছে। মেনকাকে দেখেই ডুকরে উঠল ভগা। মেনকাও জড়িয়ে ধরল ভগাকে। সনাতন মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। পড়শিদের কাছে জানাল, ক্ষেতে কাজ করতে করতেই মারা গিয়েছে ভগার মা। অপুষ্ট শরীরে যুঝতে পারেনি রোগের সঙ্গে। মুখাগ্নির সময় হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল ভগা। মেনকা আগলে রাখল নিজের ছেলের মতোই। চিতায় আগুন ধরতেই ভগা শান্ত, উদাস। একদৃষ্টে মায়ের সৎকার দেখতে দেখতে সনাতনকে প্রশ্ন করল,
–‘আচ্ছা দাদু… মায়ের সঙ্গে ভগবানও পুড়ে যাচ্ছে?’
–‘না রে পাগল, ভগবানকে পোড়ানো যায় না’, ভগার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল সনাতন।
–‘তা হলে মায়ের ভেতর যে ভগবান ছিল সে কোথায় গেল?’, ভগার সরল প্রশ্ন।
–‘মানুষের ভেতরে ভগবান থাকে না রে’, সনাতনের সান্ত্বনা।
–‘তুমি কী করে জানলে? তুমি কি তোমার ভেতরটা দেখেছ কোনওদিন?’
আচমকা যেন তড়িদাহত হল সনাতন। নিজের ভেতরটা তো সত্যিই দেখা হয়নি কোনওদিন। চিরকাল তো অন্যের দিকেই তাকাল, অন্যের দোষগুণ বিচার করল, নিজের সম্পর্কে কিছুই তো জানল না। নিজের মনেও কি কণামাত্র স্বার্থপরতা, হিংসা, ঘঋণা, ঘাপটি মেরে নেই? এই যে মনাকে নিজের মতে চলতে বাধ্য করেছে, সেটা কি স্বার্থপরতা নয়? রামকেষ্টকে দেওয়া কথার খেলাপও তো প্রবঞ্চনা। তাই নিজের মধ্যে যে ভগবান নেই, তাই বা বলে কী করে? আকাশে রং লাগছে। সনাতনের মনের রংও পাল্টাতে লাগল।
–‘চল ভগবান ঘর যাই…’
সৎকার শেষ হতেই ভগার হাত ধরল সনাতন। মেনকাও মাতৃস্নেহে জড়িয়ে ধরল ভগাকে। অনাথ শিশুটির গতি হওয়াতে পড়শিরাও খুশি। যদিও সনাতনের কাছে ভগা আর শিশু নয়। হয়তো অজান্তে, তবুও খুলে দিয়েছে মনের জানলা। দেখিয়েছে পথের দিশা। পথ প্রদর্শককেই তো গুরু বলে। এবার গুরুর প্রদর্শিত পথেই খুঁজবে ঈশ্বরকে। দেখা মিললে জানাবে মানুষের মন থেকে স্বার্থপরতা, হিংসা, ঘৃণা দূর করবার আকুল বাসনা।
সৃষ্টি-স্থিতি-লয় যাঁর মূল অভীষ্ট, গড়ে ভাঙা, ভেঙে গড়াই যাঁর নিত্য খেলা, সেই বোহেমিয়ান ঈশ্বর কি শুনবেন আটপৌরে আর্তি? নির্মল, সজীব, সুন্দর করবেন মনুষ্য অন্তরাকাশ?
শনিবারের চিঠি, জানুয়ারি, ২০১৮
অঙ্কনঃ দেবাশীষ দেব