টোকিও৷ জাপান৷ জুন ২৯, ১৯৯৩৷ ক’দিন ধরে আকাশ মেঘলা৷ বৃষ্টি হয়নি৷ তবে হতে পারে যে-কোনও মুহূর্তে৷ টোকিও শহর ছাড়িয়ে পূর্বদিকে এগোলে গায়ে গায়ে জড়িয়ে থাকা বাড়িগুলো একটু ফাঁকা হয়ে আসে৷ শহরতলির এই অংশের নাম ক্যামিডো, কোটোওয়ার্ড৷
এই ক্যামিডোর পরিবেশ দপ্তরের ফো আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত৷ রিসেপশনে থাকা মেয়েটি এই নিয়ে পাঁচজনের কাছে একই অভিযোগ শুনল৷ এলাকায় মারাত্মক দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে সকাল থেকে৷ কেউ বাড়ির জানলা দরজা খুলতে পারছে না৷ বন্ধ ঘরেও রেহাই নেই৷ ঘরের ভেতরেও সেই বাজে গন্ধ৷ গা গুলিয়ে উঠছে৷
পাঁচ নম্বর ফোন কোনও এক মাঝারি বয়সের মহিলার৷
‘আপনি ঠিক কোনখান থেকে বলছেন?’ মেয়েটি জানতে চায়৷
‘এই তো নার্সিংহোমের ঠিক পরেই যে ফ্ল্যাট, তার পাঁচতলা থেকে৷’
‘আশ্চর্য!সবকটা ফোন আপনার বাড়ির আশপাশ থেকেই এসেছে৷’
‘আরও ফোন এসেছে?তা সত্ত্বেও আপনারা চুপ করে বসে আছেন৷’
মেয়েটি ভদ্রমহিলাকে শান্ত করে, ‘না, না, আমরা এর মধ্যেই ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছি৷ লোক পাঠানো হয়েছে আপনাদের এলাকায়৷ তাঁরা খোঁজ করছেন দুর্গন্ধের কারণ৷’
‘যত তাড়াতাড়ি পারেন এই ভয়ঙ্কর গন্ধ থামান৷ আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি৷’
‘আমরা চেষ্টা করছি৷ একটু ধৈর্য ধরুন৷’
‘কাজ না হলে আমি আবার ফোন করব৷ আপনারে হেড অফিসে খবর দেব৷’ মহিলা ফোন ছেড়ে দিলেন৷
রিসেপশনের মেয়েটিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে৷ খানিকক্ষণ আগে এক ভদ্রলোক রীতিমতো হুমকি দিয়েছে৷ কী হচ্ছে কে জানে!
সেদিন ওই পাঁচজনই অভিযোগ করেছিলেন৷
ঘণ্টাখানেক পরে ক্যামিডোর পরিবেশ দপ্তরের অধিকর্তার কাছে ফোন করেন তদন্তকারী দলের ইনচার্জ মি. ইউতাকা৷ ‘স্যার, আমি ইউতাকা বলছি, আমরা এখানে প্রাথমিক তদন্তের কাজ করে ফেলেছি৷’
‘কী পেলেন আপনারা?কোথা থেকে গন্ধ আসছে?’
‘স্যার, আউম সিনারিকিও-র বাড়ি থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে৷’
‘ওরা আবার এসব কী করছে?অকারণে মানুষকে বিরক্ত করার মানে কী!’
‘স্যার, ওরা আমাদের সঙ্গে কোনও সহযোগিতা করছে না৷ দেখা করতে চেয়েছিলাম৷ কিছুতেই রাজি নয়৷’
‘অত্যন্ত বিপজ্জনক একটা দল৷ ধর্মের নামে এরা যা খুশি করতে পরে৷— আপনারা বাড়িটায় চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি শুরু করুন৷ কোনও সন্দেহজনক ব্যাপার ঘটলেই জানাবেন৷’
‘ঠিক আছে স্যার৷’
(২)
ক্যামিডোর বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই নজরে পড়ে আটতলা এক বিশাল বাড়ি৷ ধূসর রঙের বাড়িটায় জানলাওয়ালা দেওয়াল৷ প্রতিটা জানলায় কালো কাঁচ৷ এ বাড়ি হল জাপানের উগ্র ধর্মীয় সংগঠন আউম সিনারিকিও-এর সদর দফতর৷ বাড়ির ভেতরের কোনও ব্যাপার দেখতে পাওয়া যায় না৷ কেন না, জানলাগুলো সবসময় বন্ধ৷ তবে বোঝা যায়, ভেতরে চলেছে নানারকম ব্যস্ততা৷ লোক আসছে, যাচ্ছে৷ গেটের সামনে অহরহ গাড়ি থামছে৷
আউম সিনারিকিও-এর প্রতিষ্ঠাতা শোকো আসাহারা এখানেই থাকেন৷ এই মানুষটিকে জাপান সরকারও ঘাঁটাতে চায় না৷ শোকো আসাহারার একটাই স্বপ্ন৷ এই পৃথিবীকে শাসন করবে তাঁর সংগঠন আউম সিনারিকিও৷
‘তোমাদের কাছে আমার দাবি, প্রাণ দাও৷ তোমাদের রক্তের প্রতিটা ফোঁটায় এমন শক্তি ভর করবে, যা এই দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকেও হারিয়ে দেবে৷’ দু’হাত তুলে গর্জন করে ওঠেন আসাহারা৷
শিষ্যের দল মাথা নামিয়ে বাড়ানো দু’হাতে অভিবাদন করে তাদের গুরুকে৷
‘মনে রেখো, আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বা শত্রুতা করার মানে হল জাপানের আত্মার সঙ্গে প্রতারণা করা৷ – তার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি৷’
শিষ্যরা চুপ করে থাকে৷ তারা জানে আসাহারা কতটা নির্মম শত্রুর কাছে৷ এই বাড়ির গোপন ঘরে রয়েছে কিছু হতভাগ্য মানুষ যারা দল ছেড়ে যাবার সাহস দেখিয়েছিল৷ এদের কেউ কেউ অন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মানুষ, যারা আউম সিনারিকিও-এর এমন হানাহানির কাজ পছন্দ করে না৷
পুলিশ এদের কাজকর্মের ওপর কড়া নজর রেখেছে৷ তবে প্রমাণ না থাকায় এদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চালানো সম্ভব হয়নি৷ এরা অন্যায় কাজগুলো করে একেবারে গোপনে৷
(৩)
আমরা ফিরে যাই আবার ১৯৯৩ সালে৷ পরের দিন অর্থাৎ ৩০ জুন৷ আজ একচল্লিশখানা অভিযোগ৷ এবার অনেকেই লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছে৷
ওপর থেকে মি. ইউতাকার কাছে নির্দেশ এল, ‘আপনাকে পুরো দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ আপনি চেষ্টা করুন, যাতে আজই আউম সিনারিকিও-এর বাড়িতে তল্লাশি চালানো যায়৷’
মি. ইউতাকার কথা আমরা প্রথমেই জেনেছি৷ এই দপ্তরের বহুদিনের কর্মচারী৷ চটপটে, বুদ্ধিমান৷ খুব কর্মঠও৷ থাকেন ক্যামিডোর পাবলিক লাইব্রেরির কাছে৷ ওঁর বাড়ি থেকে খুব দূর নয় আউম সিনারিকিও-এর আটতলা বাডি৷ আজ সকালে ওঁর ওখানেও খানিকটা দুর্গন্ধ পাওয়া গেছে৷
মি. ইউতাকা ওঁর দল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন৷ গাড়ি এসে থামল আউম সিনারিকিও-এর বন্ধ সদর দরজার সামনে৷
মি. ইউতাকা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে ডোরবেলে চাপ দিলেন৷ একবার দু’বার, তিনবার৷
প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর রঙিন কিমানো পড়া একজন মোটা মতো লোক দরজা খুলে ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন করে, ‘কী চাই?’
মি. ইউতাকা পকেট থেকে আইডেনটিটি কার্ড বার করে দেখান, ‘আমি পরিবেশ দপ্তর থেকে আসছি৷ গত দু’দিনে ছেচল্লিশখানা অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে৷ আপনাদের এই বাড়ি থেকে ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে এলাকায়৷ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে–’
মি. ইউতাকাকে মাঝপথে থামিয়ে লোকটা বলে, ‘একেবারে বাজে কথা!— মিথ্যে অভিযোগ করছেন৷’
‘কাল থেকে আমরা এ বাড়ির ওপর নজর রেখেছি৷ আমরা নিশ্চিত, এই দুর্গন্ধের উৎস আপনাদের এই বিল্ডিং৷’
মি. ইউতাকা ওঁর সহকারীকে ডেকে কয়েকটা টেস্ট টিউবে এই কালচে আঠালো তরল সংগ্রহ করে নিলেন৷ সেদিন অবশ্য আর কিছু করা গেল না৷ তবে সারাদিন বাড়ি ঘেরাও করা ছিল৷ আউম সিনারিকিও জানাল তারা পরের দিন থেকে কুলিং টাওয়ার ব্যবহার করবে না৷ সরকার পরিষ্কার জানিয়ে দিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি খালি করতে হবে৷’
‘দেখুন মিস্টার,আমরা একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চালাই৷ আমাদের সুনাম যথেষ্ট৷ এমন এক প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে বাজে কথা বলতে আপনাদের বুক কাঁপল না? আমাদের মহান গুরু যদি এক কথা জানতে পারেন, আপনাদের মারাত্মক বিপদ ঘটে যাবে৷’
‘তাই নাকি!ভয় দেখাচ্ছেন?— আমি শোকো আসাহারার সঙ্গেই কথা বলতে চাই৷ আমায় ভেতরে আসতে দিন৷’
‘অসম্ভব!আমাদের এই পবিত্র প্রতিষ্ঠানে একমাত্র নিজস্ব সদস্যরাই ঢুকতে পারে৷’
‘দেখুন,আমি সরকারি কাজে এসেছি৷’
‘সেসব বুঝি না!আমাদের বিরক্ত করবেন না৷’ কথা শেষ হওয়া মাত্র লোকটা জোরে দরজা বন্ধ করে দিল৷
‘স্কাউন্ড্রেল,তোমাদের আমি দেখে নেব!’ মি. ইউতাকা রেগে চেঁচিয়ে ওঠেন৷
গাড়ি থেকে অন্য সহকর্মীরা নামে৷ তারা বলে,‘জোর করে ঢুকব নাকি?পেছনের দরজা তেমন মজবুত নয়৷’
মি. ইউতাকা হাত নেড়ে বারণ করেন, ‘আপনাদের আগে আইনি পথে চেষ্টা করতে হবে৷’
(৪)
১লা জুলাই, ১৯৯৩৷ আজ ভোর রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে ঝিরঝির৷ উত্তর-পূর্ব থেকে জোরে বাতাস বইছে৷ ঠান্ডাও বেড়েছে৷
ক্যামিডোর ওই এলাকার মানুষের সকালের ঘুম ভেঙে গেল এক প্রচণ্ড আওয়াজে৷ দেখা গেল, আউম সিনারিকিও-এর ছাদে বিশাল কলসির মতো দেখতে হলুদ রঙের দুটো কুলিং-টাওয়ারের একখানা থেকে সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে সজোরে৷ সঙ্গে সেই বিকট গন্ধ৷
আতঙ্কে মানুষ ঘরে ঢুকে সব দরজা জানলা বন্ধ করে দেয়৷ কেউ কেউ গাড়ি চালিয়ে এলাকা ছাড়ে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে কিছু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে৷ হাসপাতালে ছোটে অ্যাম্বুলেন্স৷ লোকের বিরক্তি এখন পাল্টে গেছে ভয়ে৷
আজ পরিবেশ দপ্তরের ওই ছোট্ট অফিসে হইহই কাণ্ড৷ অনেক আগেই অফিস কর্মীরা হাজির৷ এরই মধ্যে একশো আটখানা অভিযোগ এসে গিয়েছে৷
মি. ইউতাকা ওঁর সিনিয়র অফিসারদের ঘরে ঢুকে বলেন, ‘স্যার আমরা এভাবে চুপ করে বসে থাকতে পারি না! আপনি পুলিশকে জানান৷ তারপর পুলিশ ফোর্স নিয়ে আমরা ওই বদমাশদের ডেরা ভাঙব৷’
‘আমি যোগাযোগ করছি৷ আপনি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ুন মি.ইউতাকা৷’
‘হ্যাঁ স্যার, ওই এলাকায় আমি আবার যাচ্ছি৷ আজ একটা ব্যবস্থা করতেই হবে৷’
মি. ইউতাকা যখন এলাকায় পৌঁছলেন, আউম সিনারিকিও-এর আটতলা বাড়ি ঘিরে প্রচুর লোকের ভিড়৷ উত্তেজনাও যথেষ্ট৷ কয়েকজন অল্পবয়স্ক ছেলে ওই বাড়ির বন্ধ জানলায় ঢিল ছুঁড়ছে৷ আশ্চর্য, ভেতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই৷ দরজা খুলল না৷ কোনও জানলা সামান্য ফাঁকও হল না৷
‘মি.ইউতাকা, আপনি একবার এদিকে আসুন৷— একটা ব্যাপার আপনাকে দেখাতে চাই৷’ ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েকজন বলে ওঠে৷
‘হ্যাঁ, অবশ্যই৷–চলুন৷’
ওরা মি. ইউতাকাকে নিয়ে গেল বিরাট বাড়ির এক কোণে৷ ছাদের কুলিং টাওয়ার চুঁইয়ে চ্যাটচ্যাটে তেলের মতো কালো তরল গড়িয়ে পড়ছে সেখানে৷
‘এই দেখুন, কী হতে পারে এই জিনিস?’ প্রশ্ন করে আতঙ্কিত মানুষজন৷
‘এ ব্যাপারে আমি বিশেষ কিছু বলতে পারব না৷ তবে অবশ্যই আমরা নমুনা নিচ্ছি৷ বিশেষজ্ঞদের কাছে তা পাঠানো হবে৷’
জানা গেল এই বিষাক্ত গ্যাসের নাম ‘সারিন’৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হিটলার বাহিনী এই বিষাক্ত নার্ভ গ্যাস বানিয়েছিল৷ আজ তা নানা হাত ঘুরে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পৌঁছেছে৷ মাত্র আধ মিলিগ্রাম সারিন একজন মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে মৃত্যু ডেকে আনে৷ তবে পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে এই প্রথম এমন বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দেওয়া হল৷ নজিরবিহীন এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত মারা গেল ৮ জন৷ ৭৫ জনের অবস্থা খুবই খারাপ৷ ৭০০ জনের বেশি হাসপাতালে ভর্তি৷ অন্তত ৫০০০ যাত্রী অসুস্থ৷
মি. ইউতাকা ওঁর সহকারীকে ডেকে কয়েকটা টেস্ট টিউবে এই কালচে আঠালো তরল সংগ্রহ করে নিলেন৷ সেদিন অবশ্য আর কিছু করা গেল না৷ তবে সারাদিন বাড়ি ঘেরাও করা ছিল৷ আউম সিনারিকিও জানাল তারা পরের দিন থেকে কুলিং টাওয়ার ব্যবহার করবে না৷ সরকার পরিষ্কার জানিয়ে দিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি খালি করতে হবে৷’
১৬ জুলাই, ১৯৯৩, মি. ইউতাকা এই প্রথম আউম সিনারিকিও-এর বাড়ির ভেতর পা রাখলেন৷ সঙ্গে বিরাট দল৷ পুলিশ, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ৷ সন্ত্রাস-বিরোধী বিশেষ কম্যান্ডো৷ পরিবেশ দপ্তরের উঁচু পোষ্টের কয়েকজন অফিসার৷
গোটা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল৷ কোনও সন্দেহজনক জিনিস পাওয়া গেল না৷ পুরো বাড়ি ঝকমকে, তকতকে৷ যদি কোনও ষড়যন্ত্র হয়েও থাকে, তার চিহ্ন ভালভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে৷ স্বাভাবিক কারণেই মি. ইউতাকা হতাশ হলেন৷
এলাকার সমস্ত অসুস্থ মানুষ অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যে ভাল হয়ে ওঠে৷ ফলে তাদের অভিযোগও ফাইল-চাপা পড়ল৷ কিছুদিন পর পুরো ঘটনাই মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেল৷
ব্যতিক্রম বোধহয় মি. ইউতাকা৷ উনি যেন বিষয়টা নিয়ে কোনওমতেই স্বস্তি পেতেন না৷ ওঁর খালি মনে হতো একটা ষড়যন্ত্রের বন্ধ দরজা উনি দেখতে পেয়েছেন৷ যা খোলার চাবি ওঁর হাত থেকে হারিয়ে গিয়েছে৷
(৫)
তারপর প্রায় দু’বছর কেটে গেছে৷ টোকিও আবারও৷ ২০ মার্চ, ১৯৯৫৷ সাত সকালেই টোকিও শহরে বিরাট ব্যস্ততা৷ তুমুল ভিড়৷ যানজটের জন্য বিখ্যাত এই শহরে অনেক বড়লোক, বড় চাকুরে লোকজন শহরতলিতে গাড়ি পার্ক করে পাতাল রেলে যাতায়াত করে৷ কামরা উপচানো ভিড় নিয়ে নানা স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ছিল ঘড়ির কাঁটা ধরে৷ তাজুকিজি স্টেশনে হঠাৎই কয়েকটা ট্রেনের ভেতর মানুষের চোখ মুখ জ্বলতে থাকে৷ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়৷ সঙ্গে প্রচণ্ড কাশি৷ ভিড়ের মধ্যে কেউ বমি করতে থাকে৷ কেউ জ্ঞান হারায়৷ একটু বাতাসের জন্য ভিড় ঠেলে নামার চেষ্টায় প্রচণ্ড হুড়োহুড়ি পড়ে যায়৷ অসুস্থ, আতঙ্কিত মানুষের আর্তনাদে পুরো পরিবেশ পাল্টে গিয়েছে৷ মানুষ প্ল্যাটফর্মে নেমে চোখে হাত দিয়ে যন্ত্রণায় গড়াগড়ি খেতে থাকে৷ রুমাল ভেজানোর জল খুঁজতে দৌড়য় দলে দলে মানুষ৷
ততক্ষণে খবর পাওয়া গেল তিনটে সাবওয়ের পাঁচখানা ট্রেন আর পনেরোটা স্টেশনে একই কাণ্ড৷ অনেকেই দেখতে পেয়েছে প্লাস্টিকের ব্যাগ বা বাক্সে পা পড়তেই বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে ট্রেনের ভেতরে বা প্ল্যাটফর্মে৷
পুলিশ, দমকল, এমারজেন্সি স্কোয়াড— সবাই ছুটে আসে৷ প্রশাসন মুহূর্তে সারা দেশে সতর্কবার্তা ছড়িয়ে দেয়৷ অসুস্থ অজ্ঞান মানুষদের গ্যাস মুখোশ পরিয়ে পাতাল রেলের ভেতর থেকে বাইরে আনা হয়৷ টিউব রেলের বাইরে তখন রাস্তায় ছুটে যাওয়া অসংখ্য অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের আওয়াজ৷ টোকিওর সবক’টা হাসপাতালে বিশেষ চিকিৎসা শিবির চালু হযেছে৷
জানা গেল এই বিষাক্ত গ্যাসের নাম ‘সারিন’৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হিটলার বাহিনী এই বিষাক্ত নার্ভ গ্যাস বানিয়েছিল৷ আজ তা নানা হাত ঘুরে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পৌঁছেছে৷ মাত্র আধ মিলিগ্রাম সারিন একজন মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে মৃত্যু ডেকে আনে৷ তবে পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে এই প্রথম এমন বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দেওয়া হল৷ নজিরবিহীন এই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত মারা গেল ৮ জন৷ ৭৫ জনের অবস্থা খুবই খারাপ৷ ৭০০ জনের বেশি হাসপাতালে ভর্তি৷ অন্তত ৫০০০ যাত্রী অসুস্থ৷
কারা করল এমন কাজ?
তদন্তে বেরিয়ে এল এক জঙ্গি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নাম৷ ‘আউম সিনারিকিও’!
হ্যাঁ, এই লেখার শুরুতে আমরা এদের কথাই বলেছি৷ এবার গোটা দুনিয়ার মানুষ জানতে পারল এই ভয়ঙ্কর দলের বিষয়ে৷
গ্রেপ্তার করা হল পৃথিবীর স্বঘোষিত প্রভু শোকো আসাহারা-কে৷ খোঁজখবর শুরু হল৷ মামলার তদন্ত এগোতে থাকল৷
হঠাৎই সেই ক্যামিডোর ভুলে যাওয়া দুর্গন্ধ-রহস্যের ওপর থেকে পর্দা সরে গেল৷ তারিখ মে ২৩, ১৯৯৬৷
কী জানাল ওই অপরাধ মনস্ক আউম সিনারিকিও-এর সদস্যরা?
ওরা জবানবন্দি দিল, ‘হ্যাঁ, আমরাই ১৯৯৩ সালের ওই তিনদিন ক্যামিডো এলাকার বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম ‘ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস’ জীবাণু৷’
এই জীবাণু ভয়ঙ্কর অ্যানথ্রাক্স রোগের কারণ৷
এই খবর জানামাত্র জাপান সরকারের অন্দরমহলে শুরু হল আরেক চাঞ্চল্য৷ সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ পড়ল ক্যামিডোর সেই ঘটনার কাগজপত্রের৷
সত্যি বলতে কী, ১৯৯৩ সালে তদন্তকারী দলের কেউ জীবাণুর বিষয়ে কোনও সন্দেহ করেনি৷ সন্দেহ না করার সঙ্গত কারণও ছিল৷ কেন না রুগিদের শরীরে যেসব উপসর্গ দেখা দিয়েছিল, তার কোনওটাই অ্যানথ্রাক্স রোগের লক্ষণ নয়৷ এমনকী এলাকার কিছু পোষা বেড়াল, কুকুর ও পাখির যে অসুস্থতা ঘটেছিল, তার সঙ্গেও অ্যানথ্রাক্স রোগের মিল পাওয়া যায়নি৷ তাই জীবাণু সংক্রান্ত কোনও পরীক্ষাও করা হয়নি সে সময়৷
আউম সিনারিকিও তাদের আটতলা বাড়ির ছাদে বসানো কুলিং টাওয়ার থেকে স্প্রে করে যেভাবে রোগজীবাণু ছড়িয়েছিল তাতে সত্যিই ভয়ানক বিপদ ঘটতে পারত৷ অথচ তেমন কিছু ঘটেনি৷
তবে কি এরা তদন্তকারী দলকে মিথ্যে বলে বিভ্রান্ত করতে চাইছে?
এ বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা দেবার জন্য তাই ডাক পড়ল বিশেষজ্ঞ মাইক্রোবায়োলজিস্ট বা জীবাণুবিদের৷
সরকারের তরফে যোগাযোগ করা হল ডা. হিরোশি তাকাহাসির সঙ্গে৷ টোকিও শহরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইনফেকশাস ডিজিজের এমিডেমিওলজিস্ট ডা. তাকাহাসি এ ধরনের জীবাণু সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন৷
দায়িত্ব হাতে পেয়েই ডা. তাকাহাসি যোগাযোগ করলেন ক্যামিডোর পরিবেশ দপ্তরের অফিসারদের সঙ্গে৷ দেখা গেল জাপানেও লাল ফিতের মাহাত্ম্য কিছু কম নয়৷ প্রথমে তো তারা এত পুরনো বিষয় নিয়ে ভাবতেই রাজি নয়৷
ডা. তাকাহাসি জানান, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই৷ আমায় সময় দিন৷’
নির্দিষ্ট দিনে পরিবেশ দপ্তরে পৌঁছলেন ডা. তাকাহাসি৷ মিটিংয়ে উনি বলেন, ‘দেখুন, এই বিশেষ ঘটনা এখন এক আন্তর্জাতিক গুরুত্ব পেয়েছে৷ আউমের লোরো স্বীকার করেছে ওরা ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস জীবাণু ছড়াবার চেষ্টা করেছিল৷ যদি আমরা বিষয়টা প্রমাণ করতে পারি তবে তা অ্যানথ্রাক্স রোগ ছড়াবার প্রথম ঘটনা হবে৷ সামরিক বাহিনীর কাছেও এর গুরুত্ব যথেষ্ট৷’
‘দেখুন, ডা.তাকাহাসি, আপনারা বিজ্ঞানী৷ আপনাদের বেশির ভাগ সময় কেটে যায় ল্যাবরেটোরির চার দেওয়ালের মধ্যে৷ আপনাদের হয়তো জানা নেই, এইসব দল বড় বড় কথা বলে মানুষদের ভয় পাওয়ায়৷ নিজের যা ক্ষমতা তার থেকে বেশি জাহির করে৷’
‘হয়তো আপনার কথাই ঠিক৷ কিন্তু এও তো সত্যি যে, এই মানুষগুলো কিছুদিন আগে সারিন গ্যাস দিয়ে নিরীহ মানুষ মেরে বুঝিয়ে দিয়েছে এদের ক্ষমতা৷ ভবিষ্যতের কথা ভেবে এ কাজটা আমাদের করতে হবে৷’
‘আমাদের কিছুদিন সময় লাগবে৷’
‘বেশ তো, সময় নিন৷’
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪২১
ক্রমশ