কলকাতা ফুটবলে প্রায় সূর্যাস্ত নেমে আসছে‍

কলকাতা ফুটবলের ঐতিহ্য ও গরিমা বলতে যা বোঝায়, তা এখন একেবারে তলানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে৷ অতীতে আমরা গর্ব করে বলতাম, কলকাতা ফুটবল— আমাদের আবেগ, আমাদের প্রাণ৷

তাই তো ভোর না হতেই মন চঞ্চল হয়ে উঠত ময়দানে ছুটে যেতে৷ প্রিয় দলের খেলা দেখবার জন্যে ছিল কী আকুতি! সে এক স্বপ্নের উন্মাদনা৷ মাঠেই পরিচিত হয়ে যেত কত বন্ধুদের সঙ্গে৷ সবারই একটা ঠিকানা ছিল ময়দান৷ তারপরে খেলার শেষে কত কথা—কত আড্ডা গ্যালারিতে বসে৷ আবার কখনও বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে‍ কত আলোচনা৷ দলের প্রতি কত আনুগত্য৷ সময় কোথা থেকে হারিয়ে যেত তার ভ্রূক্ষেপ থাকত না৷ রাত গড়িয়ে যেত, তার হুঁশ থাকত না৷ ফুটবল বন্ধুদের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে যেত৷ এটাই ছিল কলকাতা ফুটবলের সংস্কৃতি৷ 

সেই ফুটবল সংস্কৃতি এখন কোথায় হারিয়ে গেছে৷ এখন আর ফুটবল নিয়ে দর্শকরা হাহুতাশ করেন না৷ প্রিয় দল হারলে সমর্থকদের মন ভারাক্রান্ত হয় না৷ চোখে জল আসে না৷ কোনওরকম অনুতাপ না৷ কষ্ট অনুভব হয় না৷ তবুও কলকাতা ফুটবল ব্যাঙের পথ চলার মতো করে চলছে৷ শীতঘুম কবে যে ভাঙবে, তা কারও জানা নেই৷ পরিকাঠামো নেই৷ নেই কোনও পরিকল্পনা৷ নেই সঠিক পরিষেবা৷ কিন্তু কেন কলকাতা ফুটবলের এই দৈন্যদশা দেখা দিল, তা নিয়ে কারো কোনও ভাবনা নেই৷ পরিবর্তন আনার জন্যে আইএফএ-র কোনও ইতিবাচক চিন্তাধারা নেই৷ কলকাতা ফুটবলের যে সর্বনাশ ডেকে আনা হচ্ছে, তা নিয়ে কর্মকর্তারা একেবারে নীরবতা পালন করেন৷ আসলে চেয়ারের প্রতি এত মোহ! একবার যদি চেয়ার হারিয়ে যায়, তাহলে তো আর প্রচারের মুখ থাকবেন না৷ সে যে কী কষ্ট, তিনি ছাড়া অন্য কেউই বুঝতে পারবেন না৷

একসময় ক্যালকাটা ফুটবল লিগ এশিয়া মহাদেশের যে কোনও ফুটবল লিগকে ছাপিয়ে যেত৷ আর মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের ডার্বি ম্যাচের দর্শকসংখ্যা তো ঈর্ষার কারণ হত অন্য দেশের কাছে৷ তাই তো কলকাতা ফুটবল লিগ বিশ্ব-ফুটবলে অন্য জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল৷ এমনকী দলবদলের সময় সমর্থকদের উন্মাদনা অন্য দৃশ্যপট রচনা করত৷ সেসব এখন অতীত৷ কলকাতা ফুটবল প্রায় জাদুঘরে জায়গা করে নেওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছে৷ হয়তো অনেকেই বলবেন, কলকাতা ময়দানে এখন আধুনিকতা এসেছে৷ রং বদলে গেছে৷পুরনো চিন্তাধারার কোনও জায়গা নেই৷ কিন্তু এটাই কি সমাধানের পথ?

২০১৯ সালের কলকাতা ফুটবল লিগ

কলকাতা ফুটবল লিগের খেলা বলতেই সোনালি দিনগুলির কথা বারবার উঁকি‍ দেয়৷ তিন প্রধানের সঙ্গে অন্য ক্লাবের খেলা থাকলেই সকাল থে‍কেই ছোটাছুটি শুরু হয়ে যেত৷ কে আগে লাইন দিয়ে টিকিট কাটবে৷ আবার কে ছুটে গিয়ে ক্লাবের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ডে-স্লিপ নেওয়ার অনুরোধ সেরে ফেলতে পারবে৷ সেই আন্তরিকতা এখন কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না৷ আসলে কলকাতা ফুটবল লিগ এখন জেলা লিগে পরিণত হয়েছে৷ যার ফলে খেলা দেখার ইচ্ছা হারিয়ে গেছে৷ কারণ সেইভাবে সমর্থকরা কলকাতা ছেড়ে জেলার মাঠে গিয়ে দলকে সমর্থন করতে উৎসাহিত হন না৷ ফলে গ্যালারি ফাঁকা থেকে যায়৷

তারপরে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মহমেডান স্পোর্টিং ক্লাব তাদের রিজার্ভ বেঞ্চের ফুটবলারদের নিয়ে দল গঠন করে৷ যার ফলে দলের গরিমা হারিয়ে গেছে৷ আবার কখনও বড় দলগুলো হুঙ্কার দেয়, খেলব না বলে৷ আইএফএ-র কর্মকর্তারা কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো এই মনোভাবে বিভোর হয়ে থাকেন৷

অবশ্য কলকাতা ফুটবল লিগ বলতে যা বোঝায়, তা এখন হয় না৷ লিগ খেলার অর্থ ডিভিশনে যতগুলো দল থাকে তারা প্রত্যেকেই একের বিরুদ্ধে খেলে থাকে৷ যার ফলে তিন প্রধানের সঙ্গে খেলাটা ছোট দলগুলোর কাছে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিত৷ সেই খেলাতে অনেক সময় নতুন তারকাকে খুঁজে‍ পাওয়া যেত৷ খবরের শিরোনামে জায়গা করে নিতেন কোনও ছোট দলের ফুটবলার৷ এখন সেই আশা-স্বপ্ন হারিয়ে গেছে৷ প্রিমিয়র ডিভিশনের ২৬টা দলকে দুটো ভাগে ভাগ করে খেলা হয়৷ তারপরে গ্রুপের প্রথম ৬টি দলকে নিয়ে আবার পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হতে হয়৷ তাই অনেক দলের সাক্ষাৎই হয় না তিন প্রধানের সঙ্গে৷ যার ফলে ফুটবলারদের আগ্রহ আগের মতো দেখতে পাওয়া যায় না৷ ক্লাবের কর্মকর্তারাও সেইভাবে দল গঠনের দিকে নজর দেন না৷ ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় তা দিয়ে ফুটবলারদের মনে জায়গা করে নিতে পারে না৷ কর্মকর্তারা এখন তিন মাসের জন্য ফুটবলারদের সঙ্গে চুক্তি করেন৷ কিন্তু এখন তিন মাসের মধ্যে কলকাতা ফুটবল লিগ শেষ হয় না৷ যার ফলে অনেক দল তিনমাসের পরে খেলবে না বলে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয় আইএফএ-কে৷ এবারই তো কলকাতা ফুটবল লিগ শুরু হয়েছে ২৫ জুন থে‍কে‍–এখনও তার শেষ হওয়ার কোনও হদিশ নেই৷ গড্ডালিকা প্রবাহের মতো কলকাতা লিগ চলছে তো চলছে৷ 

তারপরে আইএফএ-র কর্মকর্তারা ইচ্ছে‍মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে‍ সমালোচনার মুখে পড়তেই ভোলবদল করেন৷আইএফএ-র এই হঠকারিতায় কলকাতা ফুটবলের ঐতিহ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে৷ মরচে পড়ে যাচ্ছে‍৷ তবুও আইএফএ নির্বিকার৷ প্রায় সূর্যাস্ত নেমে আসছে কলকাতা ফুটবলে৷ কবে যে সূর্যোদয় হবে, এই অপেক্ষায় দিন গুনতে হবে৷