কবি ও বিজ্ঞানীর সখ্যতার কথা সর্বজনবিধিত। কিন্ত কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার পিছনে জগদীশচন্দ্র বসুর প্রভাবের কথা তেমনভাবে পন্ডিতমহলে আলোচিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথকে পিতা হিসেবে রথীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের সবচাইতে বেশি সময় পেয়েছিলেন তাঁদের জীবনের শিলাইদহ পর্বে। রথীন্দ্রনাথের ভাষায়- “এই নির্জনতার মধ্যে দিদি আর আমি বাবা ও মাকে আরো কাছাকাছি পেলুম।” রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কিন্ত তিনি বিকশিত হয়েছিলেন শিলাইদহ অঞ্চলে। সেখানেই তিনি অনুভব করেছিলেন আমাদের দেশ ‘গ্রামে গাঁথা দেশ।’ শিলাইদহে কবির সাহিত্যিক লেখক বন্ধুদের নিয়মিত আসা-যাওয়া লেগেই থাকত। তাঁদের মধ্যে কবির যে বিশিষ্ট বন্ধু নিয়মিত আসতেন শিলাইদহের বাড়িতে, তিনি জগদীশচন্দ্র বসু। শহরের জটিলতা ও কোলাহল থেকে প্রকৃতির কোলে কবি ও বিজ্ঞানীর মনের আদান প্রদানের অন্যতম আশ্রয় ছিল পদ্মার চর।
রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন জগদীশচন্দ্র প্রতি সপ্তাহে শনিবার দিন শিলাইদহে আসতেন তারপর দু-রাত কাটিয়ে সোমবার কলেজের কাজে আবার ফিরে যেতেন। রবীন্দ্রনাথের কাছে জগদীশচন্দ্রের আবদার ছিল নতুন গল্প পড়ে শোনানোর। রবীন্দ্রনাথও প্রতি সপ্তাহে অপেক্ষা করতেন জগদীশচন্দ্র কবে আসবেন আর তিনি নতুন গল্প পড়ে শোনাবেন। আর রথীন্দ্রনাথের অপেক্ষার কারণ তাঁর আত্মস্মৃতিতে লেখা আছে “বাবা যেমন উদগ্রীব হয়ে জগদীশচন্দ্রের আগমনের প্রতীক্ষা করতেন, আমারও তেমনি ঔৎসুক্য কম ছিল না। আমার সঙ্গে তিনি গল্প করতেন, নানারকম খেলা শেখাতেন- ছোটো বলে উপেক্ষা করতেন না।”
রথীন্দ্রনাথের জগদীশচন্দ্রের মতো বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছিল। কিন্ত রথীন্দ্রনাথ তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী ও অর্জিত বিদ্যার প্রায়োগিক রূপদান করতে পারেননি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বভারতীর একজন বড়মাপের কেয়ারটেকার। বিশ্বভারতীর জন্য রথীন্দ্রনাথের যাবতীয় স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল।
এখানে লক্ষনীয় রথীন্দ্রনাথ যেন সমস্ত শিশুদের মনের কথা বলেছেন। এত বড় বিজ্ঞানী অথচ শিশুদের সঙ্গে শিশুদের মতো করে মিশতেন। তাই রথীন্দ্রনাথ পরেই লিখেছেন- ” আমি তাঁর স্নেহপাত্র হতে পেরেছি বলে আমার খুব অহংকার বোধ হত। আমি মনে মনে কল্পনা করতুম বড়ো হলে জগদীশচন্দ্রের মতো বিজ্ঞানী হব।” রথীন্দ্রনাথের স্বপ্নপূরণ হয়েছিল। যদিও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার পথিকৃৎ বিজ্ঞানী রথীন্দ্রনাথ চাপা পড়ে গিয়েছিলেন আমৃত্যু ‘রবি রথের সারথি’র কাজ করতে গিয়ে। রথীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রের সান্নিধ্য থেকে তাঁর বিজ্ঞানী হবার রসদ কুড়িয়েছিলেন। আবার তাঁর চোখ ফোটাতে সাহায্য করেছিল খেলার ছলে জগদীশচন্দ্রের দেওয়া মূল্যবান কিছু শিক্ষা। যেমন বর্ষার সময় যখন পদ্মার বালির চরের উপর কচ্ছপ ডিম পাড়ত তখন কীভাবে কচ্ছপের ডিম খুঁজে বের করতে হয় তা হাতে-কলমে রথীন্দ্রনাথকে শিখিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র। দেশ বিদেশের অসংখ্য অজানা গল্প শোনাতেন জগদীশচন্দ্র রথীন্দ্রনাথকে। গল্প কথক রথীন্দ্রনাথের হয়ে ওঠার পিছনে পিতা ও পরিবারের প্রভাবের পাশাপাশি জগদীশচন্দ্রের বলা গল্পগুলোও বোধহয় শিশু রথীর মনে দাগ কেটেছিল। রথীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন-“জগদীশচন্দ্রের গল্পের ভান্ডার ছিল অফুরন্ত। তাঁর প্রকাশভঙ্গিও ছিল ভারি সুন্দর ও সরস।গল্প বলার মধ্যে যথেষ্ট হাস্যরস থাকত বলে তাঁর কাছে গল্প শুনতে খুব ভালো লাগত, কৌতূহল জেগে উঠত, ক্লান্তিকর কখনো মনে হত না।” জগদীশচন্দ্র স্বাস্থ্যের উন্নতির কলাকৌশলও শিখিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথকে। রথীন্দ্রনাথ বলছেন, “স্নানের পূর্বে আমাকে দিয়ে তিনি বালির মধ্যে কয়েকটি গর্ত করিয়ে রাখতেন। সকলকে এক- একটি গর্তের মধ্যে আকন্ঠ বালি চাপা দিয়ে শুয়ে থাকত হত। যখন সমস্ত শরীর গরম হয়ে প্রায় আধসিদ্ধ হয়ে উঠত তখন পদ্মার ঠান্ডা জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হত। তিনি বলতেন এতে স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি হয়।” কবি যেমন জগদীশচন্দ্রকে তাঁর নতুন সৃষ্টির কথা শোনাতেন তেমনি বিজ্ঞানীও তাঁর উদ্ভাবিত নতুন যন্ত্রের কথা বলতেন। আর শ্রোতা রথীন্দ্রনাথ, সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীর আলোচনা থেকেই পুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন লেখক ও বিজ্ঞানী হিসেবে।
রথীন্দ্রনাথের জগদীশচন্দ্রের মতো বিজ্ঞানী হবার স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছিল। কিন্ত রথীন্দ্রনাথ তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী ও অর্জিত বিদ্যার প্রায়োগিক রূপদান করতে পারেননি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বভারতীর একজন বড়মাপের কেয়ারটেকার। বিশ্বভারতীর জন্য রথীন্দ্রনাথের যাবতীয় স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল। তাই বিশ্বভারতীর জন্য তিনি জগদীশচন্দ্র বসুর প্রতিষ্ঠানে তাঁর বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, “আমার সমস্ত শক্তি ও সময় বিশ্বভারতীর কাজে উৎসর্গ করতে আমি বদ্ধপরিকর। অন্য কাজে হাত লাগাবার মত উদ্ধৃত্ত সময় তো আমার একেবারেই নেই।” সেদিনকার অনেক সুবিধালোভী রবীন্দ্রপরিকর ঠাকুরবাড়ির ‘কর্ণ’ রথীন্দ্রনাথকে বোঝার চেষ্টা করেননি বা করতে চাননি। কিন্ত জগদীশচন্দ্র ঠিক বুঝেছিলেন রথীন্দ্রনাথের আত্মত্যাগ।