তিরিশতম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব — বাংলার মাটিতে বিশ্ব সিনেমার সামিয়ানা

তিরিশে পা রাখা কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন হল বুধবার, ৪ ডিসেম্বর, ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহে| এই তিরিশ বছরের প্রাপ্তবয়স্কতায় পোঁছতে বেশ কিছু লক্ষ্য থাকে| তিরিশ বছর মানে, শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আরও প্রসারিত হওয়া, নিজের সম্ভারকে বহুগুণিত করা এবং বহির্বিশ্বে সম্মানিত হওয়া| অর্থাৎ বৃহত্তর, উন্নততর এবং উজ্জ্বলতর হওয়া| উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে এসে এবারের উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান গৌতম ঘোষও এ ব্যাপারে সহমত| এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব – এককথায় বিগার, বেটার, ব্রাইটার| ১৯৯৫ সালে প্রথম কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের সভাপতি গৌতম ঘোষ তিরিশ বছর পরে ফিরে এসে জানালেন তাঁর এই হালফিল পর্যবেক্ষণের কথা|

আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় চলচ্চিত্র উৎসবের ইতিহাস কিন্তু খুব পুরনো| ১৯৩২ সালে প্রথম চলচ্চিত্র উৎসবের সূচনা হযেছিল ভেনিসে| মার্কিন ছবি ডক্টর জেকিল এবং মিস্টার হাইড| কান ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালে| এই ফেস্টিভ্যাল থেকেই ছবি বাছাই এবং পুরস্কার প্রদানের প্রচলন হয়| বিশ্ব সিনেমাকে ভারতের মাটিতে প্রথম এনেছিল ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ ইন্ডিয়া(ইফি)|যার পোশাকি নাম গোয়া ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল| কেন্দ্রীয় সরকারের ইফি এখন আর বিভিন্ন শহরে সিনেমার পসরা সাজায় না| মুম্বই আকাদেমি অফ মুভিং ইমেজ সংস্থা মায়ানগরী মুম্বইতে, কেরালাতেও ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয় সরকারি উদ্যোগে| ন’য়ের দশকের মাঝামাঝি, বাম জমানায়, এই রাজ্যে কলকাতা চলচ্চিত্র শুরু হয়| কিন্তু সেই সময়কার ফেস্টিভ্যাল ছিল বিদেশি সিনেগন্ধী, বড় বেশি অভিজাত| মূলত সেরিব্রাল ‘সিনেমাবোদ্ধা’ লোকজনের আনাগোণা ছিল সেখানে| ২০১১ সালের পর থেকে এই আয়োজন তার অভিজাত-উন্নাসিক মোড়ক খসিয়ে ফেস্টিভ্যাল থেকে হয়ে উঠল উৎসব| যেখানে প্রবেশের জন্য একমাত্র সিনেমাবোদ্ধা হতে হয় না, শুধু সিনেমাপ্রেমী হলেও চলে| কারণ প্রেমের আবশ্যিক শর্ত যে শুধুমাত্র বুদ্ধি নয়, নির্ভেজাল ভালোবাসাও হতে পারে| তাই বর্তমান সরকারের সময় থেকে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার হচ্ছে| তাদের পায়ের ধুলো মাটির গন্ধ মেখে এই কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র এই তিরিশতম বছরে হয়ে উঠেছে ‘বাংলার মাটিতে, বিশ্বের ছবি’| এবারের চলচ্চিত্র উৎসবের মোটিফ থেকে কার্ড, টাইটেল ক্লিপিংস – সবই কেমন মাটিতে মাখামাখি|উৎসবের থিম সং-এর গীতিকার এবং সুরকার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়|যাঁর কথায় ‘এই পৃথিবী একটাই দেশ’|গানটি গেয়েছেন নচিকেতা চক্রবর্তী|

কলকাতার তিরিশতম চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বলিউড সিনেমার পক্ষে শত্রুঘ্ন সিনহা, ভারতের ক্রিকেট আইকন, বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার কলকাতার ‘দাদা’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়| টলিউডের একঝাঁক অভিনেতা, পরিচালক, প্রশাসনিক প্রতিনিধিদের নিয়ে রীতিমতো চাঁদের হাট বসেছিল উদ্বোধনী দিনে| ছিলেন ইরান, আফগানিস্তান, পোল্যান্ড, জার্মানির সিনে জগতের প্রতিনিধিরা| এবারের চলচ্চিত্র  উৎসবের জুরির দায়িত্বে আছেন যাঁদের অনেকেই| এদিনের উদ্বোধনী মঞ্চে বক্তব্য রাখেন আর্জেন্টিনার চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অধ্যাপক পাবলো জাস্টিনো সিজার| রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পের বন্ধুত্বের ওপর যাঁর তৈরি সিনেমা কিছুদিন আগেই যা তৈরি হয়েছে| সিজার জানালেন আর্জেন্টিনা ও ভারতের সিনেমার সাদৃশ্যের কথা|

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্তরিকতার প্রশংসা করলেন সৌরভ গাঙ্গুলি| গৌতম ঘোষের অন্তর্জলী যাত্রার মুখ্য অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাও এদিন আবেগপ্রবণ মমতাময়ী আয়রন লেডি মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসায়| এভাবেই তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী মঞ্চ এদিন ভরে রইল ঘরোয়া মেজাজে|

প্রথামাফিক প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে উৎসবের সূচনা লগ্নের পরে, মঞ্চে উপস্থিত আমন্ত্রিতদের বরণ, মুখ্যমন্ত্রীর কথায় -সুরে এবং ডোনা গঙ্গোপাধ্যায়ের কোরিয়োগ্রাফিতে দীক্ষামঞ্জরী’র নৃত্যালেখ্য পরিবেশনা, জন্ম শতবর্ষে তপন সিনহা স্মারক পত্রিকার উদ্বোধনের পর্বের পরে উদ্বোধনী মঞ্চে বক্তব্য রাখেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় | যিনি বিশ্বাস করেন, সিনেমার নেই কোনও সীমানা| যাঁর অভিমত, প্রতিভায় টলিউড বলিউড এমনকী হলিউডের সমকক্ষ| পাহাড়-নদী-জঙ্গলের প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা এই বাংলা| তাই এখানে এসে সিনেমা বানানোর জন্য তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরও আহ্বান জানালেন| যেখানে বাংলার অভিনয় প্রতিভাকেও পাশে পেতে পারেন তাঁরা| বাংলাকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদা দেওয়ার আবেদনই এদিন রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে| তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমা দিয়ে উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়।

প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলার মাটিতে বিশ্ব সিনেমার সামিয়ানার নীচে জমায়েত হবে মানুষ ৫ থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত| উনত্রিশটি দেশের ১৭৫ টি সিনেমা দেখানো হবে শহরের কুড়িটি ভেনুতে| দেখার সুযোগ মিলবে ১0৩ টি নতুন ছবি, যা এখনও কোনও প্রতিযোগিতায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি| এবছরের উৎসবের ফোকাস কান্ট্রি ফ্রান্সের একুশটি সিনেমা দেখানো হবে, যার মধ্যে চারটি মহিলা পরিচালকের সিনেমাও রয়েছে| জার্মানি থেকে আসা বিখ্যাত পরিচালক জাফর পানাহির ‘দ্য উইটনেস’ ছবিটিও এবারের আকর্ষণ| ইতালির সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় গৌতম ঘোষের ম্যাগনাম ওপাস ‘পরিক্রমা’ সিনেমার প্রিমিয়ার হবে এবারের উৎসবে| থাকবে বেঙ্গলি প্যানোরামা, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে ইনোভেশন ইন মুভিং ইমেজেস, ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ, নেটপ্যাক অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি নানার বিভাগের বিভিন্ন সিনেমা| এছাড়া সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আপ বালকি-এর সত্যজিত রায় স্মারক বক্তৃতার আসরে সিনেমা নিয়ে চর্চায় শান দিতে পারবেন সিনেমাবোদ্ধারা| আবার তপন সিংহ, অরুন্ধতী দেব, হরিসাধন দাশগুপ্ত, মার্লিন ব্র্যান্ডো, আক্কিনেনি নাগেশ্বর রাও, সের্গেই পারাজানভ, মার্চ্চেল্লো মাস্ত্রোইয়ান্নি প্রমুখ শতবর্ষে পোঁছনো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদেরও শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন থাকছে তিরিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে|

এভাবেই উৎসব আঙিনায় ঘাম ঝরানো জীবিকার মানুষ থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসের কর্মী সকলেই তাঁদের মন আর মগজের খোরাক খুঁজে নিতে উৎসবের সামিয়ানার নীচে মিলতে পারে| মিশতে পারে সিনেমাবোদ্ধা আর সিনেমাপ্রেমী| সার্থক হয়ে উঠতে পারে উৎসবের থিম সঙে বলা গানের কলি- ‘বাস্তব আর কল্পনা/এ যেন এক গতিধারা/এ যেন জলে মেশে তেল’|