“বিমলের একগুঁয়েমি যেমন অব্যয়, তেমনি অক্ষয় তার ঐ ট্যাক্সিটার পরমায়ু। সাবেক আমলের একটা ফোর্ড, প্রাগৈতিহাসিক গঠন…দেখতে যদি জবুথবু, কিন্তু কাজের বেলায় বড়ই অদ্ভুতকর্মা বিমলের এই ট্যাক্সিটি। বিমলের কাছ থেকে একটা আদুরে নাম পেয়েছে এই গাড়ি- জগদ্দল।”
এক কথায়, সর্বাঙ্গে সময়ের কশাঘাত সত্ত্বেও সহজে হার মানেনি বিমলের জগদ্দল। সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’ গল্পে ‘বিমল’ আর তার ‘জগদ্দল’ -এর কাহিনি যেন মানুষ আর যন্ত্রের মধ্যে ‘সিমবায়োসিস’-এর এক অনবদ্য সমীকরণ! তবে জগদ্দলের হদিশ শুধু গল্পের পাতাতেই মেলে না। ইতি উতি তাদের সন্ধান মেলে বাস্তবেও। আর জগদ্দলের পরমায়ু অক্ষয় করতে এখনও অনলস পরিশ্রম করে চলেছেন, হাতে গোণা এমন মানুষও আছেন কেউ কেউ। যেমন, সন্দীপ মুখার্জি।
গত তিন দশক যাবৎ তিনি অবিরত ব্যস্ত রয়েছেন এমন একটি কাজে, যার জুড়ি মেলা ভার। তা হল, ‘অযান্ত্রিক’-এর ‘জগদ্দল’-এর মতো সময়ের ভারে জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়া গাড়িগুলির শরীর স্বাস্থ্য ফিরিয়ে, সেগুলিকে আবার পক্ষীরাজ ঘোড়ার মত টগবগে, চাঙ্গা করে তোলা। সন্দীপবাবুর কথায়, ‘কলকাতায় এখনো শ’পাঁচেক এই ধরনের ভিনটেজ কার আছে। বেশ কিছু সচলও আছে। মালিকরা সেগুলিতে নিয়মিত যাতায়াত না করলেও, শখে-আহ্লাদে কখনো কখনো চড়েন। যেমন ‘দ্য স্টেটসম্যান’ আয়োজিত ভিনটেজ কার রালিতে অংশ নেওয়ার সময়। কিন্তু যতই হোক সেগুলির তো বয়স হয়েছে। ফলে সারাই মেরামতির কাজটা খুবই জরুরি। আর কোনও কোনও গাড়ি ভিতরে-বাইরে প্রায় একেবারেই বেহাল। সেগুলিকে তন্দুরস্ত করে তোলা রীতিমতো চ্যালেঞ্জের কাজ। এবং একই সঙ্গে সেটা যে রীতিমত ব্যয়সাপেক্ষও। কারণ, কোনও কোনও গাড়ির ‘রেনোভেশন’ বাবদ প্রায় দশ বারো লাখ টাকাও খরচ হয়।’
তাহলে সেক্ষেত্রে গাড়ির মালিকের পকেটের রেস্তটাও খুবই জরুরি বিষয়। সত্যি বলতে কী, পুরনো আমলে কজন মানুষই বা পারতেন ‘মোটর গাড়ি’ কিনতে। পরাধীন ভারতে সাহেবসুবোরা বাদে দেশীয়দের মধ্যে একমাত্র খুবই ধনী বা অভিজাত শ্রেণির মানুষরাই গাড়ি কিনতেন। যেমন, রাজা মহারাজা, জমিদার, বড় আমলা, ধনী ব্যবসায়ী, ব্যারিস্টার, নামী ডাক্তার এঁদেরই সেই ক্ষমতা ছিল। আর তখন সব ব্র্যান্ডের গাড়িই ছিল বিদেশী। ফলে আজকের দিনে যখন ওই সব গাড়ির আগাগোড়া সারাই এর কাজে হাত দিতে হয়, তখন বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি করতেই হয়। তার জেরে বিলের অঙ্কটা অনেকটাই বেড়ে যায়। এটাই সন্দীপবাবুর ব্যাখ্যা।
আদতে লাভলক স্ট্রিটের বাসিন্দা সন্দীপবাবু এখন তাঁর কাজের সূত্রে থাকেন ই এম বাইপাস লাগোয়া কালিকাপুরে। এই বাড়ির কাছেই তাঁর গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ। এমনকী তাঁর বাড়ির সামনেই রাখা একাধিক ভিনটেজ কার পথচলতি মানুষের নজর কাড়ে। বাড়ির মধ্যেই এক চিলতে গ্যারেজেও পুরোদমে চলছে পুরোনো গাড়িগুলোর নয়া রূপটানের কাজ। সেটাও দেখার মতোই।
সন্দীপবাবুর গ্যারেজ যেন ঐতিহ্যের যন্ত্রাগার। যা মনে করিয়ে দেয় ঋত্বিক ঘটকের সেই ‘অযান্ত্রিক’ সিনেমার কথা। কোনো গাড়ির কংকাল প্রাণপ্রতিষ্ঠার অপেক্ষায়। কোনোটি প্রাণ পেয়ে হুংকার দিতে উৎসুক। সন্দীপবাবুর বাড়ির গ্যারাজে রয়েছে ফোর্ড T 1919(সেডান)গাড়ি। এই গাড়ি দুইভাবে স্টার্ট দেওয়া যায়। সেলফ স্টার্ট ও ডায়নামো। দুটি রাস্তাই খোলা আছে। যেমন গাড়ির ইঞ্জিন চাবি দিয়ে চালু করা যায়, সেই প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা রয়েছে। আবার চাইলে, গাড়ির বাইরে থেকে হ্যান্ডেল ঘুরিয়েও ইঞ্জিন চালু করা সম্ভব। এককথায়, ম্যাগনেটো ও সেলফ স্টার্ট, দুভাবেই গাড়ি চালু করা যায়। গাড়ির ভিতরটিও বেশ প্রশস্ত।
সন্দীপবাবু জানালেন, পুরোনো অনেক গাড়িতেই সওয়ারীদের এইভাবে বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে স্বস্তিতে বসার সুযোগটা ছিল। তাঁর এই মন্তব্যের রেশ ধরে মনে পড়ে যায় সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে বনেদি বাঙালি ভদ্রলোক রমেন মল্লিকের সেই স্মরণীয় সংলাপের কথা। যেখানে সিনেমা জগতের এনসাইক্লোপিডিয়া রমেনবাবু, ব্যোমকেশ ও অজিতকে সঙ্গে নিয়ে সুনয়না নামের এক হারিয়ে যাওয়া অভিনেত্রীর সন্ধানে যেতে যেতে বলছেন—“কি লেগ স্পেস আমার গাড়িতে দেখেছেন?” সেই গাড়ি যে ১৯৩৫ সালের মডেল, সেকথাও জানিয়েছিলেন তিনি। তাঁর আপসোস, আধুনিক মডেলের,…“গাড়িতে আরাম করে বসতে গেলে হাঁটু ঠেকে যায়”। দুঃখ করে এটাও বলেছিলেন রমেনবাবু, আজকাল মানুষের মনটাই হয়ে গিয়েছে সংকীর্ণ। সঙ্গে সঙ্গে ব্যোমকেশের জবাব, “আর সঙ্গে পকেটও!”
ইংরেজ আমলে অবিভক্ত ভারতে রাজা মহারাজাদের রোলস রয়েস বিলাসিতার কথা সবাই জানে। তাঁদের মর্জি মাফিক গাড়ি কোম্পানি রোলস রয়েসে নানা ধরনের নয়া জিনিসপত্রও সংযোজন করত। রাজাদের শখ মেটানো তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এই সব গাড়িও তো সেই জামানার। আসলে তখনো মানুষের জীবনে ব্যস্ততা ছিল। কিন্তু তার মধ্যেও একটু রয়েসয়ে, স্বস্তিতে জীবনটা উপভোগ করার ব্যাপারটাও ছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা, বিলাস বৈভবের সাথে রুচির মেলবন্ধনটাও থাকত। সেই জীবন দর্শনের প্রতিফলন তো পুরোনো এইসব গাড়ির গড়ন পেটনে পড়তে বাধ্য। সন্দীপবাবু যেন যন্ত্রের অন্তরের কথাই শোনাচ্ছিলেন।
এই মুহূর্তে আরও একটি গাড়িতে হাত লাগিয়েছেন সন্দীপবাবু। সেটি ফোর্ড কোম্পানির। বানানো ১৯২৫ সালে। ‘কূপে’ গোত্রের মাথার ছাদ খোলা এই গাড়িতে চালক সহ আরও একজন সওয়ারি বসতে পারেন।তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কতগুলি পুরোনো গাড়িকে ফের চাঙ্গা করে তুলেছেন তিনি? সন্দীপবাবুর হিসেব অনুযায়ী অন্তত চল্লিশটা তো হবেই। সেই সব গাড়ির কোনোটি ১৯৩৬ -এর অস্টিন রুবি, ১৯২৮ -এর ফোর্ড ট্যুরর কোনটি বা ১৯৫৩ সালের মরিস মাইনর ও আরো নানা ধরনের।
এই ধরনের কাজে আগ্রহী তিনি হলেন কী করে? সেই আখ্যানও কম চমকপ্রদ নয়। সন্দীপবাবুর দাদু রায়সাহেব ননীলাল মুখার্জি ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সিভিলিয়ান। একসময় আলিপুর জেলের জেলারের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। মুখার্জি বাড়িতে বেবি অস্টিন বা প্লিমথ এর মতো একাধিক মডেলের গাড়ি ছিল। অল্প বয়স থেকেই সেই সব গাড়ি চালাতে অভ্যস্ত ছিলেন সন্দীপবাবু। তাঁর কথায়, ‘নিজের গাড়ি থাকলেই তার যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই হয়। আর পুরোনো গাড়ির প্রযুক্তি তো একটু ভিন্ন রকমের। ফলে সেভাবেই শিক্ষানবিশী হয়ে গিয়েছিল আমার। চাকরি জীবনে নানা ব্যস্ততার মধ্যেই পুরোনো গাড়ির সেই নেশাটাই একটা পেশায় পর্যবসিত হয়েছিল।’
এই গাড়িগুলি কখন যেন সন্দীপবাবুর পারিবারিক সদস্য হয়ে গিয়েছে। এইসব পুরোনো গাড়িগুলির সঙ্গে সন্দীপবাবুর সম্পর্ক যেন “আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী”-এর মতো।