একদিনে দেখে নিলাম সোনমার্গ, এবার যাব গুলমার্গ এবং ওখানে রাত কাটাবো। এখন থেকে আমরা সঙ্গে সারাক্ষণের জন্য গাড়ি রাখছি যেটা পহেলগাঁও অবধি ঘুরিয়ে দেবে। ড্রাইভার ফিরোজ ওর ট্র্যাভিয়েরা নিয়ে সাতসকালেই হাজির। গুলমার্গ পৌঁছতে খুব জোর ঘন্টা দেড়েক লাগবে। ট্যাংমার্গ হয়ে যেতে হবে। ওখানে ড্রাং ঝর্ণাটা দেখার কথা ছিল কিন্তু নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে দিল মিলিটারি। গোটা কাশ্মীর জুড়েই এবার দেখলাম ছেয়ে রয়েছে এরা। ট্যাংমার্গ থেকেই চড়াই শুরু, মনে পড়ে গেল দশ বছর আগে এই জায়গায় গাড়ি বদল করে চাকায় চেন লাগানো অন্য গাড়ি নেওয়া, গামবুট ভাড়া করা তারপর বরফে ঢাকা রাস্তা বেয়ে আটকে থাকা সার সার গাড়ির পিছনে রীতিমত যুদ্ধ করে গুলমার্গ পৌছনোর কথা। শেষমেষ ওপরে গিয়ে এক হাঁটু বরফে ডুবে থাকা উপত্যকাটা দেখে মনে হয়েছিল খুঁজলে এখানে এক আধটা এস্কিমোদের ইগলু কিংবা নিদেনপক্ষে খেলে বেড়ানো দু-চারটে পেঙ্গুইন নিশ্চয়ই চোখে পড়বে। এবার আমরা এসেছি গরমকালে, সবুজে সবুজ গুলমার্গ দেখতে। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। ফলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে ওঠার রাস্তাটা অদ্ভুত মায়াময় লাগছিল। ওপরে পৌঁছে আগে হোটেল খোঁজার পালা। এদিকে আমি চারদিকের দৃশ্য দেখে উত্তেজনা সামলাতে পারছি না। একপাশে সারসার প্রচুর হোটেল, ফিরোজ গাড়ি থামালো ‘ওয়েলকাম’-এর সামনে।
এটাই নাকি মোটামুটি সস্তাগণ্ডার। রিসেপশনের লোকটির চেহারা এবং ব্যবহার দুটোই সুন্দর, বেশ হাসিমুখে একপ্রস্থ দরাদরি করে ঘর দিল। কিন্তু ঘরে কে থাকে, কোনোরকমে মালপত্তর রেখেই বেরিয়ে পড়লাম রাজা হরি সিংহের প্রাসাদ দেখতে। ব্যাপারটা আসলে বড়সড় কটেজের মতো আরও উঁচু একটা পাহাড়ের ওপর। দেখলাম গাড়িতে গাড়িতে ছয়লাপ, প্রচুর ভিড়। সামনের বারান্দায় জুতো খুলে ঢুকতে হল। দেওয়ালে টাঙানো রাজার ফোটো, তেনার ব্যবহারের জিনিসপত্র, ঝাড়বাতিওলা মস্ত হলঘর, খাবার ঘর ইত্যাদি দেখে বিদায় নিলাম। গুলমার্গের মূল অংশে রয়েছে বিশাল ঢেউ খেলানো গলফ কোর্স, যতদুর চোখ যায় মনে হবে সবুজ কার্পেট, ঠাসা পাইনের জঙ্গল, পিছনে বরফের ছোপ লাগানো পাহাড়ের সারি। অদ্ভুত চোখ জুড়োনো প্যানারমিক দৃশ্য, মনে হয় যেন এক রঙিন ক্যানভাস বসানো রয়েছে সামনে। এরই ফাঁকে গোল হয়ে গাড়ির রাস্তা ঘুরেছে। গলফ কোর্সের সীমানা বরাবর। তবে আমরা আপাতত হেঁটে বেড়াব ওই কার্পেটের ওপর দিয়ে ভিউ পয়েন্ট অবধি। উঁচু থেকে দেখা যায় সবুজের বুক চিরে আঁকাবাঁকা মাটির পথ গেছে এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। ঘোড়ায় চেপে চলেছে বহু লোক। এখানে ওখানে ভেড়ার পাল নিজেদের মধ্যে গুঁতোগুঁতি করে চরে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে মনে হবে সবুজের মধ্যে ঠিক যেন খাবলা ওঠা এক টুকরো ধুসর কিছু নড়াচড়া করছে। রাজেশ খান্না-মুমতাজের সেই ‘জয় জয় শিবশঙ্কর’ খ্যাত শিব মন্দিরটিও রয়েছে। তবে সম্প্রতি আগুন লেগে তার এখন ভগ্নদশা। এরা বলল শর্ট সার্কিট, হবেও বা! রাতে থাকব, ফলে হাতে ঢের সময়, ধীরেসুস্থে স্কেচ খাতা বের করলাম। সামনে চাদর বিছিয়ে বসে পিকনিক করছিল একটা কাশ্মীরি পরিবার, দুটো লোক উঠে এল আমার আঁকা দেখতে, দুজনেরই দাড়ির বহর চার্লস ডারউইন সাহেবকে হার মানায়। রাজৌরি থেকে এসেছে এরা, ভারি সাদাসিধে মানুষ, একজন ফারুখ, অন্যজন আমজাদ খান। বললাম বিখ্যাত নাম তো! ছোট করে দুজনের মুখ এঁকে দিলাম, ভিড় করে এলো ওদের মেয়েরা, সাত থেকে পনেরোর মধ্যে চারজন, মাঝারিটার কোলে আবার একটা পুঁচকে ছেলে। ফুলের মতো সুন্দর দেখতে সবাই। মনে হল এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে এদেরই মানায়। বাদাম আর নানারকম মশলা মেশানো চা যার নাম কাওয়া বা কাঃওয়া। কাশ্মীরে খুব চলে, শরীর গরম রাখতে এর জুড়ি নেই। বড় ফ্লাস্কে করে এই কাঃওয়া নিয়ে ঘুরছে লোকে, কাপ পিছু তিরিশ টাকা, সঙ্গে বিস্কুট গোছের কাশ্মীরি কুলচাও রয়েছে। এদের একজনকে ডেকে নিলাম, শিড়িঙ্গে চেহারার আব্দুল কাইউম মালিক।
গুলমার্গ থেকে বেশ দূরে কুঞ্জর-এ ওর বাড়ি। হাড়ের রোগ ধরেছে তাই চাষবাস ছেড়ে এখন রোজ ১২০ টাকা খরচা করে এখানে এসে চা বেচে বেড়ায়। আমাদের হোটেলের কাছেই একটা বড় চত্বর ঘিরে পরপর রেস্টুরেন্ট আর নানা রকম দোকানপাট রয়েছে। ফিরোজ আমাদের এক চক্কর ঘুরিয়ে ওখানে নিয়ে গেল। পথে পড়ল রোপওয়ে বা এদের ভাষায় গন্ডোলার জায়গাটা। এতে চড়ে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া যায়। সারা বছর বরফে ঢাকা খিলনমার্গ অবধি। আমরা গতবার এখানে এসে টিকিট কেটে দিব্যি ফাঁকায় ফাঁকায় ঘুরে এসেছি, এবার হল না, ঘোরতর সিজন বলে বহু আগে থেকেই সব টিকিট খতম। ফিরোজের কথামতো আমরা গিয়ে বসলাম ভাট ভেজিটেরিয়ান ধাবায়। কাশ্মীরের টুরিস্ট প্রধান জায়গাগুলোতে কট্টর নিরামিষাশীরা বেশি আসে। ফলে সহজে আন্ডা-গোস্ত মেলে না বললেই চলে। সব দোকানের সামনে ছাতার তলায় টেবিল চেয়ার পাতা। আমরা লাঞ্চে বললাম রুটি, সবজি,আর চানা মশালা। গুলমার্গ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল, সন্ধ্যা অবধি মাইলের পর মাইল ধরে ছড়িয়ে থাকা সবুজ ঢালু ঘাসের পরিপূর্ণ নির্জনতায় ওঠানামা করলাম। শীতে এই অঞ্চলে স্কি করতে আসে সবাই। সুর্যাস্তের লাল আভায় ধিরে ধিরে ঝলসে উঠল চারদিক। বহুক্ষণ কাটিয়ে আধো অন্ধকারের মধ্যে হোটেলে ফেরা হল। তারপর গভীর রাতে জানলা দিয়ে মুগ্ধ চোখে দেখলাম বাইরে পাহাড়ের বরফে জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি। এ সব দৃশ্য কখনও ভোলার নয়। পরদিন শ্রীনগরে ফেরার পথে ঘুরে নিলাম দুধপত্রি।
গুলমার্গের পর তেমন আহামরি কিছু লাগল না। ঘোড়ায় চেপে বাচ্চা-বুড়ো সবাই চলেছে পাহাড়ের ওপর দুধসাদা জলের পুকুর দেখতে। আমাদের অত শখ নেই। তাও ঘোড়াওয়ালারা ছিনে জোঁকের মত লেগে রইল। একপাশে ঘন জঙ্গলের গা ঘেঁষে বেশ কিছু কাঠের লম্বাটে ধরনের ঘর বা কোঠা বানিয়ে থাকে এরা। একটায় রয়েছে সৈয়দ বিন দিন্দা ও তার জরু, ওর একটা স্কেচ করলাম। পাশে দাঁড়িয়ে দিন্দা্র মন্তব্য ‘খুব তালিম হ্যায় আপকা’।
গিন্নি ততক্ষণে ওর জরুর সঙ্গে ভাব জমিয়ে দুপুরে খাবার দাওয়াত পর্যন্ত আদায় করে ফেলেছে। কিছু একটা তো খেতেই হবে, সেই বুঝে ফিরতি পথে গাড়ি থামালো ফিরোজ। রাস্তার দু ধারে ছাতার তলায় সার দেওয়া ছোট ছোট খাবারের দোকান। একটা চালায় বছর কুড়ির মাহি ও তার বাবা ফারুখ আহমেদ। মা মারা গিয়েছে কিছুদিন আগে। বেচারা মেয়েটির জন্য দেখলাম চিন্তায় থাকে আমাদের ফিরোজ। সর্সো দা সাগ, পেঁয়াজের চাটনি আর আচারের সঙ্গে হাতে গরম মকাই কি রোটি বানিয়ে দিল মাহি, কাঠের বেঞ্চে বসে জমিয়ে খাওয়া হল। এই সর্সে, মাকাই সব কিছু এখানেই ফলায় এরা। হাসিখুশি চনমনে মাহির ছবি তোলা আছে, দেখতে বসে ওদের ওই ছোট্ট দোকানটার কথা খুব মনে পড়ে।
অঙ্কনঃ দেবাশীষ দেব