বাঙালি বাবুর মেম বিবি

মানবেন্দ্রনাথ-ইভলিন

আমরা তাঁর পিতৃদত্ত নামটি ভুলে গিয়ে তাঁর অন্যতম ছদ্মনামেই তাঁকে সবিশেষ চিনে চলেছি৷ আমরা আর মনেই করি না মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (১৮৮৭-১৯৫০) আসল নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য৷ সি. মার্টিন, হরি সিং, মি. হোয়াইট, ডি. গার্সিয়া, ডা. মাহমুদ, মি. ব্যানার্জি‍— নানান ছদ্মনামের মধ্যে মানবেন্দ্রনাথ রায় এই বাঙালি নামটিতেই তিনি জগৎপ্রসিদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন৷ আঠারো বছর থেকেই ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মানবেন্দ্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই ইংরেজদের প্রবল শত্রু জার্মানদের কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্য নিয়ে দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনায় অন্যতম অগ্রণী পুরুষ৷ এই কাজের জন্য তাঁর আঠাশ বছর বয়সে তিনি বাটাভিয়া রওনা হন৷ ভারতে ফিরে এলেও আবার তিনি ফিলিপাইন, জাপান, চিন, সানফ্রানসিসকো, মেক্সিকো, বার্লিন, রাশিয়া প্রভৃতি দেশ পরিভ্রমণ করেন তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য৷ এই সূত্রে তিনি গঠন করেন রাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটিক পিপলস্ পার্টি৷ 

এই রকম একটা অস্থির জীবনযাপনের সময় আমেরিকার ২৪৫ রামোনাতে ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকেন৷ এখানেই তাঁর সঙ্গে শ্রীমতী মুখোপাধ্যায় আলাপ করিয়ে দেন এক আমেরিকান তরুণী ইভলিনের সঙ্গে, পালো অল্টোতে৷ লস এঞ্জেলস থেকে ড. জর্ডনকে ১৯১৬-এর আগস্ট মাসে ইভলিনের লেখা একটি চিঠি থেকে এই প্রথম আলাপের কথা জানতে পারি৷ কিন্তু সুস্থিরভাবে প্রথম ভালবাসার জীবন কাটানোর জো ছিল না রায়ের৷ আমেরিকার গোয়েন্দাদের চোখ সর্বদা তাঁকে‍ অনুসরণ করে চলেছিল৷ বাধ্য হয়ে ধনগোপালের আশ্রয় ছেড়ে তাঁকে‍ উঠে যেতে হল সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখে, লস এঞ্জেলসের হোটেল লেইটনে৷ ততদিনে দু’জনের পারস্পরিক নির্ভরতা এতখানিই বেড়ে গিয়েছিল— ইভলিন শুধু এই হোটেলে মানবেন্দ্রনাথের থাকার ব্যবস্থা করেই স্বস্তি পাননি, তিনি নিজেও তাঁর সঙ্গে‍ থাকতে শুরু করে দিলেন৷

ইভলিন ট্রেন্ট (১৮৯২-১৯৭০), মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট৷ ১৯১৫ সালে তিনি যখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তখনই আলাপ হল রায়ের সঙ্গে‍— তখন তিনি তেইশ বছরের পূর্ণ যুবতী৷ সারা শরীর জুড়ে যৌবনের ঢল৷ গলায় সিস্টার নিবেদিতার মতো একছড়া মালা৷ একমাথা ব্যাকব্রাশ করা কালো চুল, চোখে বুদ্ধির দীপ্তি আর কিউপিডের সৌন্দর্য নিয়ে মানবেন্দ্রকে অস্বীকার করবেন কোন তরুণী৷

কিন্তু প্রেমের পথে চিরকালই কাঁটা-বিছানো থাকে৷ ইভলিনের এক ভাই ইভলিনের এই মেলামেশা একেবারেই পছন্দ করছিলেন না, একেবারে ফেউ-এর মতো তাঁদে‍র পিছনে লেগে তাঁদের জীবন ওষ্ঠাগত করে তুলেছিলেন৷ বাধ্য হয়ে ইভলিনকে মাঝেমাঝেই মানবেন্দ্রকে ছেড়ে থাকতে হচ্ছিল বিরহ ব্যথা সহ্য করে৷ তখনও তাঁরা বিবাহিত হননি৷ এসময় লালা লাজপত রায়ও আমেরিকায় ছিলেন৷ তাঁর স্মৃতিকথায় তিনি এই পর্বটি খুব ভালো করে গেছেন৷ এ বিষয়ে‍ তাঁর ভূমিকার কথাও উল্লেখ করে বাংলা অনুবাদে তার একটু উদ্ধার করি:

‘ইতিমধ্যে এম, এন, রায় এসে পৌঁছলেন৷ জানলাম যে তিনি একজন পলাতক বিপ্লবী, আমেরিকায় এসে আশ্রয় নিয়েছেন৷ তাঁর সম্বন্ধে আগ্রহটা আমার খুবই বেড়ে গেল৷ যখন শুনলাম যে তিনি যখন ক্যালিফোর্নিয়ায় ছিলেন তখন একটি আমেরিকান মেয়েকে ভালবেসেছিলেন এবং মেয়েটিও তাঁর ভালবাসায় সাড়া দিয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল৷কিন্তু মেয়েটির আত্মীয়দের এ বিবাহে মত ছিল না৷ মেয়েটি তখন আত্মীয়স্বজন পরিত্যাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে এবং রায়ের অনুগামিনী হয়ে রায়ের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে জড়িয়ে নেয়৷ মেয়েটি ছিল লেল্যান্ড স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ছাত্রী৷ আর তার এক ভাই নিউইয়র্কের এক সওদাগরী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত৷ এই প্রেমে পড়ার অপরাধে নিউইয়র্কে যে‍-সব হিন্দু ছেলে ছিল তারা এবং সেই সঙ্গে চক্রবর্তীও এম. এন. রায়কে দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক বলল, অনেকে তাঁকে‍ প্রকাশ্যেই গালিগালাজ দিতে শুরু করল৷ মেয়েটি একদিন তার প্ৰিয়তমের খোঁজ নেওয়ার জন্য চক্রবর্তীর বাসায় গেলে চক্রবর্তী মেয়েটিকে অপমান করল৷ এইসব সংবাদ যে মুহূর্তে আমার কানে এল, রায় ও মেয়েটির প্রতি আমি আমার সহানুভূতি ও সমর্থন জ্ঞাপন করলাম৷ রায় অবশ্য তাদের বিয়েটা না হওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গে দেখা করেনি৷ দেখা হওয়ামাত্র আমি তাদের আমার ঘরে ডেকে নিয়েছিলাম, এবং আমরা আমাদের ভাব বিনিময় শুরু করেছিলাম৷ রায় ছিল যাকে বলে একেবারেই কপর্দকশূন্য৷ আমি তাকে মোট ৩৫০ ডলার দিয়েছিলাম, এর মধ্যে শ্রীমতী রায় আমার কিছু কাজ করে দিয়ে ৫০ ডলার শোধ দিয়েছিল৷ এরপরই রায় একটি চাকরি জোগাড় করে নেয়৷’

ইভলিন ট্রেন্ট (১৮৯২-১৯৭০), মানবেন্দ্রনাথ রায়ের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট৷ ১৯১৫ সালে তিনি যখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তখনই আলাপ হল রায়ের সঙ্গে‍— তখন তিনি তেইশ বছরের পূর্ণ যুবতী৷ সারা শরীর জুড়ে যৌবনের ঢল৷ গলায় সিস্টার নিবেদিতার মতো একছড়া মালা৷ একমাথা ব্যাকব্রাশ করা কালো চুল, চোখে বুদ্ধির দীপ্তি আর কিউপিডের সৌন্দর্য নিয়ে মানবেন্দ্রকে অস্বীকার করবেন কোন তরুণী৷ ধনগোপালের স্ত্রী নিজে আমেরিকান৷ অতএব ইভলিনের মাথাও তিনি‍ ঘুরিয়ে দিলেন রায়ের সঙ্গে‍ আলাপ করিয়ে দিয়ে৷ ইভলিনের চব্বিশ বছরের বয়সটাকে এই কৃত্তিকায় সুদর্শন মানুষটি একেবারে এলোমেলো করে দিলেন৷ কেন জানি না, প্রায় তিরিশ ছুঁই ছুঁই বয়সেও রায়ের জীবনে কোনও নারী এসে বাসা বাঁধতে পারেননি৷ হযতো ইভলিন অন্যদের থেকে আলাদা৷ নইলে বিশ্বযুদ্ধের রাজনীতিতে যুক্ত একটা আমেরিকান মেয়ের প‍ক্ষে একজন ভারতীয়কে বিয়ে করতে চাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল৷ সেটাই ইভলিন ঘটিয়ে দিলেন৷ তিনি কোনও রাজনীতিককে বিয়ে করতে চাননি৷ চেযেছিলেন একটা পুরুষকে‍— একটা পূর্ণ মানুষকে বিয়ে‍ করতে৷ নিজে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত— কিন্তু ভালবাসাকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাননি৷ অথচ তিনি একটা রাজ‍নৈতিক বাতাবরণেই বড় হয়ে উঠেছিলেন৷ স্বভাবতই একটু সীমিত দাম্পত্য জীবন তাঁর প্রার্থিত হতে পারে না৷ কিন্তু রায় যে তাঁকে‍ একটা উত্তেজনাকর, অ্যাডভেঞ্চারের জীবন উপহার দিযেছেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, এক নাম থেকে ভিন্ন নাম নিয়ে৷ তাঁরা দু’জনে যুদ্ধবিমর্দিত দুর্গম পথ বেয়ে রাশিয়ায় চলে এসেছেন ১৯১৯-২০ কাল পর্বে৷ একেবারে উন্মাদ৷ রায় তাঁর কালো ঢেউ-খেলানো চুলের সঙ্গে কৃষ্ণবর্ণকে মিলিয়ে আর ইভলিন সূক্ষ্ণ বস্ত্রে যৌবনকে উন্মুক্ত করে প্রেমপাগল৷ রাশিয়াতে গিয়ে ইভলিনও ছদ্মনাম নিয়েছেন— শান্তি দেবী৷ কিন্তু অন্নচিন্তা চমৎকারা৷ ইভলিন কম্যুনিস্ট ইউনিভার্সিটি অফ দি টয়লার্স অফ দি ইস্ট-এ পড়ানোর চাকরি নিয়েছে‍ন৷ তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ভারতীয়ের সংখ্যা ১৮ এবং এক ছাত্র জগৎবিখ্যাত সাম্যবাদী—ভিয়েতনামের হো-চি‍-মিন৷

ইভলিন ছবি ভালবাসাতেন, শিল্পীদেরও ভালবাসতেন৷ এই ছবির স্বপ্ন নিয়েই তাঁর ছোট্ট সংসার, সুখী সংসার বার্লিনে৷ কত গুণী ভাল বন্ধুরা মাঝে মাঝেই আসেন৷ ১৯২৪ সালে তাঁরা প্যারিসে চলে এলেন৷ এর আগে বার্লিনে থাকার সময়ই ইভলিন রায়ের রাজনৈতিক দূতের কাজ করে এসেছেন৷ এখানেও তাই৷ বস্তুত সারাজীবন ধরেই এই দম্পতি রাজনৈতিক ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে পরস্পরের পরিপূরক৷ এই বধূটি সম্পর্কে অবশ্য মুজফফর আহমেদ লিখে গেছেন—‘ড. ভুপেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে তিনি শুনেছিলেন ইভলিন আসলে একজন ব্রিটিশ কন্যা এবং ব্রিটেনের চর৷’ জানি না রাজনীতি কী বস্তু৷ কিন্তু ইভলিন যে আমেরিকান ছিলেন এ নিয়ে সংশয়ের কোনও কারণ নেই৷ 

এমনিধারা জীবন চলছিল৷ রায় রাডিক্যাল হিউম্যানিটি আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, পত্রিকা প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু কী যে সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল৷ রায় ভারতে এলেন৷ ইভলিনের সঙ্গে আর যোগাযোগ রইল না৷ খুব ইচ্ছে করত ইভলিনের— রায় একবার তাঁকে‍ ডাকুন৷ কিন্তু তা আর হয় না৷ ১৯৩১ সালে মানবেন্দ্রনাথ রায়কে যখন বোম্বাই শহরে গ্রেপ্তার করে ছ’মাসের জন্য কারাবাস করতে পাঠায় ব্রিটিশ সরকার, তখনও প্রতিবাদ করেন ইভলিন রায় (ট্রেন্ট নন আর তখন)৷ E.R সংক্ষিপ্ত নামে নিউইয়র্কের ‘রেভোলিউশনারি এজ’ পত্রিকায় নিবন্ধ রচনা করেছিলেন ইভলিন৷ নিশ্চয়ই রায়ের নজর এড়িয়ে যায়নি৷ কিন্তু আমরা কোনও প্রতিক্রিয়ার কথা শুনতে পাইনি৷ শুধু অপে‍ক্ষা করতে হল আমাদের ১৯৫৪ সাল অবধি‍— প্রায় চল্লিশ বছরের একটা সম্পর্কের এমন পরিণতি ঘটতে৷ কিছু বিষয়ের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না৷ ব্যাখ্যার জন্য অপে‍ক্ষা না করাই সম্ভবত ভাল৷ শুধু সাক্ষী রইল ১৯২৩ সালের জুন মাসে প্রকাশিত একটি ইংরেজি বই— দু’জনের নামে লেখা৷ ইভলিন আবার বিয়ে করেছিলেন এবং বিয়ে করেছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়ও৷ সুতরাং এই হিসেবটা আর না করাই ভাল৷ কিন্তু এটা সম্ভবত অস্বীকার করা যাবে না ১৯৭০ সালে দুটো চোখ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ইভলিন তাঁর রায়ের কথা ভোলেননি৷

মানবেন্দ্রনাথ— এলেন গটসচক

এর পরে রায়ের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল ইউরোপীয় কৃষক সমিতির সম্পাদিকা শ্রীমতী এলেন গটসচকের সঙ্গে৷ এ সময়ে রায়ের রোজগারের উৎস ছিল ইংরেজি থেকে জার্মানে অনুবাদ৷ এই মহিলা সেই সব অনুবাদের কাজগুলো জোগাড় করে এনে দিতেন৷ এ সময়ে রায়ের প্রাণভয়েরও একটা সম্ভাবনা গড়ে উঠেছিল৷ মিস এলেন বিষয়টি জানতেন৷ তাঁর যত্ন এবং সাবধানতায় রায় বিপদ থেকে উত্তীর্ণ হয়েই চলছিলেন৷ রায় গ্রেপ্তার হলেন একসময়৷ লন্ডনে তাঁকে‍ ছাড়ানো, তাঁর মামলার তদ্বির করা— সব দায়ই এলেন মাথা পেতে নিযেছেন৷ এমনকী টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য পর্যন্ত৷ সাত বছর ধরে জেলে থাকার যন্ত্রণা একা মানবেন্দ্রনাথই ভোগ করেননি, এলেনও তাঁর অংশীদার ছিলেন৷

ইভলিনের সঙ্গে আইনগতভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগেই রায় সম্ভবত এলেনকে আর আলাদা হয়ে থাকতে দিলেন না৷ তাঁর আপাতশূন্য হৃদয়ে ঠাঁই দিলেন পাকাপাকি করে৷ তাঁকে‍ বিয়ে করে নিলেন৷ সালটা ১৯৩৭৷ কত বই, কত লেখা, শর্টহ্যা্ন্ডে‍ কত লেখাই লিখে রাখা৷ সময়মতো খেতে দেওয়া, শরীর খারাপ হলে যত্ন নেওয়া—রায়কে বাঁচিয়ে‍ রাখা— এলেন তো জানতেনই তাঁর পবিত্র কর্তব্য৷ এলেন একদিনও রায়কে ইভলিনের অভাব বুঝতে দেননি‍— রায়ের সমস্ত সত্তার সঙ্গে নিজের সত্তা একেবারে‍ মিলিয়ে‍-মিশিয়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করে৷

কিন্তু এত করেও শেষ রক্ষা করা যায়নি৷ ১৯৫০ সালেই মানবেন্দ্র তাঁকে‍ ছেড়ে চলে গেলেন৷ কিন্তু স্বামীর সমস্ত কাজের মধ্যে জড়িয়ে থেকে তিনি স্বামীর স্পর্শ পেতে লাগলেন৷ মানবেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত The Radical Humanist পত্রিকার সম্পাদনার ভার নিজের হাতে তুলে নিলেন৷ স্বামীর প্রতিষ্ঠিত দেরাদুনের The Indian Radical Humanist-এরও সম্পাদিকা থেকে স্বামীর রাডিকাল হিউম্যানিস্ট মুভমেন্ট ও মানবতন্ত্রী আন্দোলনকে প্রসারিত করতে থাকলেন৷ রায়ের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত যাবতীয় মুদ্রিত চিঠি ও পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ প্রকাশের জন্য গড়ে তুললেন একটা আর্কাইভ— M.N. Roy Archives৷ বিশ্বজুড়ে এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশ্বপরিক্রমা করে এসেছেন৷ এবং খুবই বেদনার কথা এই ‘ভারতীয়’, মহিলা আততায়ীর হাতে ১৩ ডিসেম্বর ১৯৬০ সালে নিহত হলেন৷ তাঁর হৃদয়ের প্রসারতার কথা ভেবে অভিভূত হই, যখন শুনি তাঁর সপত্নী ইভলিনের মৃত্যুসংবাদ শুনে তিনি সমবেদনা প্রকাশ করেন৷ আমি জানি না এদেশে জাত কোনও মহিলা এমনতর উদার হতে পারতেন কিনা!

উপসংহার 

আমি সকলের কথা বলতে পারিনি, বলতে চাইনিও৷ প্রবন্ধের পরিসর তাতে বেড়ে যেত৷ নইলে মধুসূদনের পর যিনি প্রথম বিদেশি‍নীকে ঘরে আনেন সেই ডাক্তার সূর্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তীর বিয়ের কথা অথবা লালবিহারী দে’র পার্শি কন্যা (যদিও এদেশে‍) বাচ্চুভাইকে বিয়ের কথা বলতাম৷

এখন যে বিদেশিনীদের এদেশের বধূ হয়ে ওঠার কথা বললাম— তাঁরা কোনও অংশেই এদেশীয় বধূদের চেয়ে কম সাধ্বী ছিলেন না৷ এমন অত্মসমর্পণ লক্ষ করলে মনে হয়, বিশ্বায়ন অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল— দেশের সীমান্তের বেড়া আমরা অনেক আগেই ভাঙতে শুরু করেছিলাম৷ আসলে ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবাই সমান রাঙা৷’

 

মার্কিন দেশে স্বীকৃত প্রথম বাঙালি বুদ্ধিজীবী

ধনগোপাল— প্যাটি‍

বাবা কিশোরীলাল ডাকসাইটে উকিল এবং প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ৷ সহোদররা সকলে দেশপ্রেমিক৷ যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়ের নাম জানেন না— এমন দেশপ্রেমিক বাঙালি কেউ আছে নাকি! তাঁদের প্রভাবে ধনগোপালও দেশব্রতে দীক্ষিত৷ ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৩৬) বিদেশে গুপ্ত সমিতি স্থাপন করবেন এমনতর ইচ্ছা নিয়ে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়েই যন্ত্রবিদ্যা শেখার অছিলায় জাপানে কিছুকাল কাটিয়ে আমেরিকায় যান৷ তাঁর আগেই তাঁর আর এক সহোদর ক্ষীরোদগোপাল মুখোপাধ্যায় একই উদ্দেশ্য নিয়ে আমেরিকায় এসেছেন৷ খুবই কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে লাগলেন৷ ভর্তি হলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ ধনগোপাল সেখান থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে বি.এ. পাশ করলেন৷ 

কিন্তু পড়তে পড়তেই প্রেমে পড়ে গেলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী প্যাটির সঙ্গে৷ আলাপ-পরিচয় দ্রুত ঘনিষ্ঠতর হতে লাগল৷ মেয়েটির পোশাকি নাম এলেন রে ডুগান— ধনগোপালের চেয়ে বয়সে বছর দু’য়েকের বড়৷ তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা৷ ১৬৮৬ সালে জনৈক পূর্বপুরুষ দেশত্যাগ করে আমেরিকা চলে আসেন উইলিয়াম পেন-এর দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রার সহকারী হিসেবে এবং পেন-প্রতিষ্ঠিত পেনসিলভেনিয়া রাষ্ট্রেই বসবাস করতে শুরু করেন৷

এই বংশেরই ওয়াল্টার ডুগার পেনসিলভেনিয়ার কয়লাখনিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতে থাকেন৷ তিনিই আমাদের ধনগোপালের প্রেয়সী প্যাটির জন্মদাতা৷ পাছে প্যাটির বাবা ধনগোপালের সঙ্গে সম্পর্কটি না-পছন্দ করে বসেন, তাই ধনগোপাল রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে নিতে দেরি করেননি৷ খবরটা গুরুজনদের কানে যেতেই তাঁরা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বসলেন৷ এশিয়া দেশবাসী জনৈক নাগরিককে বিয়ে করার অপরাধে এলেন রে‍-এর নাগরিকত্ব কেড়ে নিল মার্কিন সরকার৷ তখন সেইরকম ধারার আইনই সে দেশে চালু ছিল৷ স্বামী বিবেকানন্দের অনুরাগিণী হিসেবে পরে বিখ্যাত মিস ম্যাকলিওড (স্বামীজির ‘জো’)-এর কানে এই বিয়ের খবর যেতে তিনি নাকি ঝরঝরিয়ে কেঁদে‍ ফেলেছিলেন— প্যাটি এ কী করল! কিন্তু প্যাটিকে সামনাসামনি দেখে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই অসামান্যা প্রেমিকার প্রেমের আকাঙ্ক্ষার ব্যাপ্তি কত গভীর ও বিশাল৷

স্ত্রীকে ভালবেসে ধনগোপাল দেশ ছাড়লেন—আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন৷ তারই মধ্যে দু’বার ভারতে এসে ঘুরে গিয়েছিলেন৷ দু’বারই এসেছিলেন বেলুড় মঠে, স্বামী শিবানন্দের কাছে৷ রামকৃষ্ণভক্ত ধনগোপাল— বাড়ি আর ভক্ত জীবনের টানাপোড়েনে কেমন যেন ভিতরে ভিতরে ধসে যাচ্ছিলেন৷ নিজেকে আর টানতে পারছিলেন না৷ ছেচল্লিশ বছরের জীবনটাতে জোর করে একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিলেন৷ প্রিয়ার করুণ চাহনি, সন্তানের আহ্বান সব কিছুর আকর্ষণকে ছেদ করে ধনগোপাল নিউইয়র্কে আত্মহত্যা করলেন৷

বিয়ের পরে ধনগোপালের সন্তান প্যাটির কোলে আসতে খুব দেরি হয়নি৷ ১৯১৯ সালের ২৭ আগস্ট যখন প্যাটির কোলে জুনিয়র ধনগোপালের জন্ম হলো— তখন সেই সন্তান পরিবারের প্রায় সকলের চোখের মণিটি হয়ে উঠল৷ বাবার নামকে একটু ছোট করে নিয়ে সবাই তাকে ‘গোপাল’ নামে সাদরে ডাকতে লাগল৷ ধন-প্যাটির প্রেমের ফসল তাঁদের জীবনে স্বীকৃতি এনে দিল৷ জ্যা-মুক্ত তিরের মতো, উর্ধ্বলোকবিহারী শ্যেন দম্পতির মতো যশের খ-বিন্দু অভিমুখে প্যাটির পাশে ধনগোপালের দুর্নিবার অভিযান একটা ইতিহাস গড়ে তুলল৷ এই সময়ে প্যাটির পরিবারের ঘনিষ্ঠবন্ধু রজার বলডুইনের সঙ্গে ধনগোপালের সখ্য তাদের পারিবারিক জীবনে সোনালি ফসল ফলিয়ে চলেছিল৷

ধনগোপালের শ্বশুর ওয়াল্টার ডুগার চিলেন খনি‍-বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার৷ সঙ্গীতেও তাঁর প্রবল আগ্রহ ও অধিকার ছিল৷ নিজে ফটো তোলার বিশেষ ক্যামেরাও আবিষ্কার করেছিলেন৷ মুকডেসে তাঁর একটা কারখানা ছিল৷ এই কারখানারই এক তরুণ কর্মচারী ১৯২৯ সালে বিশ্ববিখ্যাত হন, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুডার৷ ১৯১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ভারতে ও এশিয়াতে যে সূর্যগ্রহণ হয়— তা দেখবার জন্য ডুগার বের হন৷ শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে ধনগোপালের সম্পর্ক পরে এতই সহজ হয়েছিল তাঁদের‍ পারিবারিক জীবনে যে, ধনগোপাল এ-সময়ে পণ্ডিত জওহরলালকে একটি চিঠিতে লেখেন— ‘আমার শ্বশুরমশায়কে অনুরোধ করেছি যে এলাহাবাদে গিয়ে তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করবেন৷ ওঁকে‍ একটু ঘুরিয়ে দেখাবেন, যদি তখন আপনি ওখানে থাকেন৷ সোয়ার্থমোর কলেজের হয়ে উনি সুমাত্রায় যাচ্ছেন সূর্যগ্রহণ পর্যবে‍ক্ষণ করতে৷ আশা করি এলাহাবাদে আপনি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন৷’

কিন্তু এমন একটি সুখের সংসারেও আগুন লেগে গেল৷ স্ত্রীকে ভালবেসে ধনগোপাল দেশ ছাড়লেন—আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন৷ তারই মধ্যে দু’বার ভারতে এসে ঘুরে গিয়েছিলেন৷ দু’বারই এসেছিলেন বেলুড় মঠে, স্বামী শিবানন্দের কাছে৷ রামকৃষ্ণভক্ত ধনগোপাল— বাড়ি আর ভক্ত জীবনের টানাপোড়েনে কেমন যেন ভিতরে ভিতরে ধসে যাচ্ছিলেন৷ নিজেকে আর টানতে পারছিলেন না৷ ছেচল্লিশ বছরের জীবনটাতে জোর করে একটা পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিলেন৷ প্রিয়ার করুণ চাহনি, সন্তানের আহ্বান সব কিছুর আকর্ষণকে ছেদ করে ধনগোপাল নিউইয়র্কে আত্মহত্যা করলেন৷ 

রম্যাঁ রলাঁ তাঁর ‘INDE-ভারতবর্ষ: দিনপঞ্জী’ (১৯১৫-১৯৪৩)-এ লিখেছেন যে, ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে রামকৃষ্ণ মিশনের কাজে ফ্রান্সে আসেন স্বামী সিদ্ধেশ্বরানন্দ৷ তিনি রলাঁর কাছে আসেন৷ ‘ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের করুণ পরিণতি সম্পর্কে স্বামী সিদ্ধেশ্বরানন্দ কিছু খুটিনাটি তথ্য আমাকে দিলেন– তিনি ছিলেন মহৎ শিল্পী, তিনিই প্রথম আমার কাছে রামকৃষ্ণকে উদ্ঘাটিত করেছিলেন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন৷ কিছুকাল যাবৎ তিনি মানসিক চিকিৎসালয়ে আটকে রাখা হয়েছিল৷ সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য, নির্জনতায় নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁর আবেগদীপ্ত বাসনা ও বিয়ের মধ্যে যে‍-মার্কিন জীবনযাত্রায় ঢুকেছিলেন তার মধ্যে এক মর্মান্তিক বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন৷ তিনি কখনও মন ঠিক করে উঠতে পারেননি৷…’

ওটাই শেষ কথা এবং পরম সত্য কথা ‘মন ঠিক করে উঠতে পারেননি৷’ ‘ঘরেও নাহি পারেও নাহি সন্ধেবেলায়’ মৃত্যু এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল৷

 

যতীন্দ্রমোহন – নেলি গ্রে‍

স্কুলের শি‍ক্ষা শেষ করে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন আরও পড়াশোনার জন্য৷ সহপাঠী হিসেবে পেলেন পরবর্তীকালে ভারতের কয়েকজন সুসন্তানকে‍— রাজেন্দ্রপ্রসাদ, দেবীপ্রসাদ খৈতান, মণিমোহন সেন, সুরেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখকে৷ কিন্তু এখানে বেশিদিন পড়া হল না৷ বাবা চট্টগ্রামের বিখ্যাত আইনজীবী যাত্রামোহন সেন চাইছিলেন তাঁর একটি সন্তান অন্তত ব্যারিস্টার হন৷ তাই যতীন্দ্রমোহনকে তিনি বিলেত পাঠিয়ে দিলেন৷ লন্ডনের কেমব্রিজের ডাউনিং কলেজে যতীন্দ্রনাথ ভর্তি হলেন৷ আর এখানেই প্রেমের ফাঁদটি পাতা ছিল— নেলি গ্রে এবং যতীন্দ্রমোহন- জোড়াপাখি সেই ফাঁদে ধরা পড়লেন৷ 

কেমব্রিজেই বাস করতেন গ্রে‍-ম্পতি৷ শ্রীমতী গ্রে যেসব ছেলেরা কেমব্রিজে পড়তে আসতেন—বিশেষ করে ভারত থেকে‍— তাঁদের সন্তানবাৎসল্যে ভালবাসতেন— স্নেহমমতায় পূর্ণ ছিল তাঁর বুক৷ ঘর ছেড়ে দূর বিদেশে পড়তে এসেছেন তাঁরা— যতটা পারতেন তাঁদের মাতৃস্নেহে পালন করতেন৷ প্রায়ই ছেলেদের ডেকে চায়ের নেমন্তন্ন করে এটা-ওটা খাওয়াতেন, অসুখ-বিসুখ হলে দেখভাল করতেন৷ এই সুবাদেই যতীন্দ্রমোহন তাঁর ভালবাসা-মমতার সংসারে প্রবেশ করলেন এবং অবশ্যই তাঁদের একমাত্র সন্তান কুমারী নেলি গ্রে‍-র হৃদয়ের অভ্যন্তরেও৷ আগে আগে সপ্তাহে একদিন, পরে বারত্রয়িক, পরে নিতুই৷ কখনও বা দিনে একাধিকবার৷

এবারে মা-বাবা একটু প্রমাদ গুনলেন৷ বুঝলেন পঞ্চশরের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে৷ সন্ত্রস্ত হলেন এই ভেবে তাঁদের একমাত্র সন্তান যদি বিয়ে করে সাত-সমুদ্দুর তেরো-নদীর পারে দূরে চলে যায়—তাঁরা বাঁচবেন কোন অবলম্বনকে ঘিরে৷ কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না, পাছে মেয়ের কোমল হৃদয়ে ব্যথা লাগে৷ অনেকখানি ব্যাপারটা এগিয়ে গেলে যতীন্দ্রমোহন বাবাকে চিঠি লিখে সব জানালেন, তিনি নেলিকে বিয়ে করতে চান, বাবার অনুমতি প্রার্থনীয়৷ চিঠি পেয়ে যাত্রামোহন রাগে অগ্নিশর্মা৷ ছেলে প্রেম করেছে বলে নয়— বিয়ে করে বউকে খাওয়াবে কী? এখনও তো রোজগারের নাম-গন্ধটি নেই৷ বাবার উপর নির্ভর করে বিয়ে‍— নৈব নৈব চ৷ তাছাড়া হিন্দুসমাজের বাসিন্দা তিনি৷ বিদেশিনী বিয়ে করে মেম বউকে নিয়ে ঘরে উঠলে ধর্ম এবং সমাজ নিয়ে তো কম ঝঞ্ঝাট হবে না৷ অতএব পত্রপাঠ ছেলেকে পত্রীয় জবাব দিলেন৷ চিঠি দিলেন শ্রীমতী গ্রে‍-কেও৷ সেই চিঠিতে তাঁর তিনটি আপত্তি‍— পাত্র-পাত্রীর মধ্যে ধর্মীয় পার্থক্য দুস্তর; যৌথ একান্নবর্তী পরিবারে ইংরেজ মেয়ে এসে সংসারে মানিয়ে নিতে পারবেন না বলেই তাঁর ধারণা— এমনকী সংসারে এবং বিবাহিত জীবনে সুখী না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি৷ সবচেয়ে বড় কথা অর্থবান সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে এনে তার সাধ-আহ্লাদ মেটানো তো দূরের কথা—‘দু’বেলা দু’মুঠো খেতে দেওয়ার তো তাঁর ছেলের সঙ্গতি এখন দূর অস্ত৷ অতএব ওদের বলে দেবেন বিয়ের খোয়াব না দেখাই ভাল৷ আপনি নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে সহমত হবেন৷

শ্রীমতী গ্রে অবশ্য এসব নিয়ে ভাবছিলেন না৷ এক্ষেত্রে জামাই-মেয়ে আলাদা হয়ে থাকবে৷ তাঁদের যা ধনসম্পদ আছে তাতে তাঁর মেয়ে‍-জামাইয়ের জীবন শুরু করার কোনও অসুবিধে হবে না৷ তাঁর একমাত্র ভাবনা মেয়ে দূরে চলে যাবে, তাঁরা একলা হয়ে যাবেন দু’জনে৷ অতএব দুই প‍ক্ষের মধ্যে একটা সাধারণ ব্যাপার দাড়িয়ে গেল— বিয়েটা না হওয়াই উচিত৷

এমন অবস্থায় যতীন্দ্রমোহন পড়লেন ফাঁপরে৷ বাবা শুধু চিঠি দেননি, জাহাজে করে দেশে ফেরার জন্য টিকিট আর টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন যতীন্দ্রমোহনের বিলেতের অভিভাবকের কাছে৷ খুব হয়েছে, আর লেখা-পড়া করতে হবে না, দেশে ফিরে এসে বংশের মান-সম্মান রক্ষা কর৷ যতীন্দ্রমোহন-নেলি দু’জনেই বুঝতে পারলেন— এ বিয়ে হওয়ার নয়৷ যাত্রামোহনের নির্দেশকে অস্বীকার করার সামর্থ্য নেই যতীনের৷ তাঁর হৃদয় আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ভেবে রক্তাক্ত হতে থাকল৷ নেলির চোখেও অশ্রুর ধারা৷ ভাঙা হৃদয় নিয়ে স্বদেশগামী জাহাজে চড়ে বসলেন যতীন্দ্রমোহন, বন্দরে এসে নেলি চোখের জলে একশা৷ গভীর চুম্বনের আশ্লেষে আবিল বিদায়মুহূর্ত৷ 

যাওয়ার আগে স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফিরছেন, খবরটা পাঠিয়ে দিয়েছেন যতীন্দ্রমোহন৷ লিখেছিলেন— যৌথ পরিবারে আমার স্ত্রীকে নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না, বাবা৷ যাত্রামোহনের সমগ্র পরিবার প্রস্তুত হয়ে উঠেছেন মনে মনে নবদম্পতিকে স্বাগত জানানোর জন্য৷ সংশয়ের মেঘ যে কেটে গেছে যতীন্দ্রমোহন বুঝতে পারলেন, যখন দেখলেন গোটা পরিবার হাসিমুখে নেলিকে বরণ করে নিলেন৷ একটুখানি শুচিবাই কেউ কেউ যে দেখাননি‍— তা বলা চলবে না৷ কিন্তু মেমসাহেবের মধুর ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ৷ অল্পদিনেই নেলি যেমন নতুন জীবনকে মানিয়ে নিলেন, তেমনই গোটা পরিবার তাঁকে‍ মেনে নিতে লাগল— একগাছের ছাল অন্য গাছে বেশ জোড় লেগে গেল৷ মেমসাহেব বেশ জাদু জানেন— তাঁর প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ৷

জলে ঢেউ ওঠে যত, তত উদ্বেলিত হয় যতীন্দ্রমোহনের হৃদয়৷ একটা করে দিন যায় আর অশ্রুলবণাক্ত সমুদ্রের ব্যবধান ক্রমশ দূরবর্তী হয়৷ নেলির মুখ, অতীত সুখের কথা ভেবে যতীন্দ্রমোহন উন্মাদপ্রায়৷ ভাবতে‍ ভাবতে যতীন্দ্রমোহন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন৷ পোর্ট সৈয়দ বন্দরে জাহাজ এসে ভিড়েছে৷ দেখছেন সেখান থেকে বিলেতগামী একটি জাহাজ দাঁড়িয়ে৷দ্রুত ভারতগামী জাহাজ থেকে নেমে বিলেতগামী জাহাজে উঠলেন— টিকিটপত্র নিয়ে ঝামেলা কম হলো না৷ কিন্তু নেলির কাছে যেতে পারবেন— এই আনন্দে পথের কষ্ট তাঁর কাছে গণ্যই হল না৷ তাঁর যে নেলিকে চাই-ই চাই৷ তাঁর প্রেমের দায়িত্ব তিনি সবটাই নিজের কাঁধে নেবেন৷

হঠাৎ করে যতীন্দ্রমোহনকে একদিনে ফিরে আসতে দেখে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন শ্রীমতী গ্রে৷ বেশ তো জটিলতা কাটছিল— আবার বিপত্তি কেন! এবার তিনি বেশ কড়া৷ যতীন্দ্রমোহনকে ডেকে সাফ বলে দিলেন— তাঁর মেয়েকে জোর করে বিয়ে করলে একটা পেনিও তাঁদের দেবেন না৷ যতীন্দ্রমোহন তাঁকে‍ সব বোঝালেন৷ কীভাবে তিনি জাহাজে মনের দিক থেকে ক্ষতবি‍ক্ষত হচ্ছিলেন, কেনই বা ফিরে এলেন— সব৷ দুটি চোখে মিনতি ঝরিয়ে নেলিকে তিনি তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেন৷ কিন্তু শ্রীমতী গ্রে বজ্রকঠিন স্বরে শুধু বললেন— না৷

অতএব নেলিকে সব কথা খুলে বললেন৷ তারপর দু’জনে সিদ্ধান্ত নিলেন, সামাজিক বিয়ে নয়, দু’জনে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করবেন৷ কেম্ব্রিজ থেকে পনেরো মাইল দূরে রয়স্টন শহরের এক রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে সেখানে দু’জনে কাগজে‍-কলমে বিয়ে করলেন গোপনে৷ তারপরে দুজনে এসে শ্রীমতী গ্রে‍-কে জানালেন৷ একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন তিনি৷ এমনটা যে হতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল, কিন্তু এত দ্রুত সব ঘটে যাবে‍— ভাবতেই পারেননি৷ কিন্তু তিনি তো মা— মমতাময়ী গর্ভধারিণী৷ বকুনি দিতে গিয়েও পারলেন না৷ স্বভাব মমতায় মেনে নিলেন অনিবার্যকে৷ তারপর মেয়ে‍-জামাইকে কাছে টেনে আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা জানালেন, প্রচুর উপহার দিলেন৷ কাছের কিছু স্বজনকে নিয়ে একটা ভোজসভার আয়োজনও করলেন৷ একপ‍ক্ষের সমর্থন তাহলে পাওয়া গেল৷

অপরপক্ষ তখন জাহাজ আসার দিন গুনছিলেন৷ জাহাজঘাটায় জাহাজ ভিড়লে একে‍-একে যাত্রীরা সবাই নেমে এলেন৷ কিন্তু যতীন কই! উদ্বিগ্ন যাত্রামোহন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিগ্রাম করলেন৷ ছেলের আগের চিঠিতে তো তার মতিগতি সব জেনেছিলেন৷ তবে কি সে শেষ পর্যন্ত এল না! এল না-র একটি অর্থ তিনি অনুমান করলেন— যতীন তাহলে ওই মেয়েটাকেই বিয়ে করেছে বলে এল না! এদিকে যতীন্দ্রমোহন দেশে বাবার গম্ভীর মুখ এবং অন্যদের প্রতিক্রিয়া অনুমান করছিলেন৷ তাই আর দেরি না করে নতুন বউকে নিয়ে পরের জাহাজে দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন৷ মা-মেয়ের সে এক করুণ দৃশ্য৷ সমুদ্রের জলে চোখের জলে সে এক আশ্চর্য বেদনাবিধুর উত্তালতা৷ জাহাজ ছেড়ে দিল৷ এক অজানা ভারতবর্ষ নামক একটা অজানা দেশের দিকে নেলি৷ বুকে ঝড় কি কম উঠছিল৷ মা-বাবার মুখ বার বার করে মনে পড়ে তাঁর সবই বেসামাল৷

যাওয়ার আগে স্ত্রীকে নিয়ে দেশে ফিরছেন, খবরটা পাঠিয়ে দিয়েছেন যতীন্দ্রমোহন৷ লিখেছিলেন— যৌথ পরিবারে আমার স্ত্রীকে নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না, বাবা৷ যাত্রামোহনের সমগ্র পরিবার প্রস্তুত হয়ে উঠেছেন মনে মনে নবদম্পতিকে স্বাগত জানানোর জন্য৷ সংশয়ের মেঘ যে কেটে গেছে যতীন্দ্রমোহন বুঝতে পারলেন, যখন দেখলেন গোটা পরিবার হাসিমুখে নেলিকে বরণ করে নিলেন৷ একটুখানি শুচিবাই কেউ কেউ যে দেখাননি‍— তা বলা চলবে না৷ কিন্তু মেমসাহেবের মধুর ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ৷ অল্পদিনেই নেলি যেমন নতুন জীবনকে মানিয়ে নিলেন, তেমনই গোটা পরিবার তাঁকে‍ মেনে নিতে লাগল— একগাছের ছাল অন্য গাছে বেশ জোড় লেগে গেল৷ মেমসাহেব বেশ জাদু জানেন— তাঁর প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ৷ যাত্রামোহন শ্রীমতী গ্রে‍-কে চিঠি লিখে ফেললেন প্রবল উৎসাহে‍—‘ম্যাডাম, আপনার মেয়ে ক্ষণজন্মা, সুশীলা, সুভদ্রা এবং মোহিনী, সরলা৷ ও আমাদের অপরিসীম আনন্দের উৎস৷ আমি বিশ্বাস করি নেলি‍— আমার বউমা আমার সন্তানের জীবনে সত্য হয়ে উঠবার অঙ্গীকার নিয়ে এসেছে৷ আমরা কৃতজ্ঞ৷’

একটা বড় সংসারে যখন শুভকামনা করে তখন সংসার জীবনের পথ সুগম হয়৷ কে যেন বলেছিলেন— সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা পরিবারে সমৃদ্ধি আর আনন্দের হাওয়া বইতে শুরু করেছিল৷ শুধু শরীরের চাহিদা নিয়ে এই মেয়েটি সেনগুপ্ত পরিবারে আসেননি‍— একটা আত্মিক সৌন্দর্যের সুরভি সারা পরিবারে তিনি বইয়ে দিয়েছেন৷ একটা আভ্যন্তরীণ শক্তিতে তিনি ভরপুর৷ সাধে কি আমার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী স্মৃতিচারণায় লিখে গেছেন—‘চট্টগ্রামে, পতি‍-গৃহে মহিলা যেদিন পা দিলেন সেদিন সেখানে‍ যেন স্বর্ণপ্রদীপ জ্বলে উঠল৷ বহু দশক এবং বাধা-বিঘ্ন উত্তীর্ণ হয়ে সেই প্রদীপ জাতীয় জীবন প্রজ্বলিত করে আজও প্রদীপ্ত৷ মহিলার উদ্দীপিত উৎসাহ এবং মাতৃ মননের সমন্বয়ে এই পরম সত্য, সৃষ্টিরই তাৎপর্য৷’ 

যতীন্দ্রমোহন কারা থেকে কারান্তরে দণ্ডভোগ কালে রাঁচিতে স্থানান্তরিত হয়ে রাঁচি‍ জেলেই মৃত্যুবরণে বাধ্য হলে সেই দুঃসহ বিচ্ছেদকে নেলি মেনে নিতে পেরেছিলেন তাঁদের অনুগত সন্তানদের মুখ চেয়ে ততখানি নয়, যতখানি তাঁর স্বামীর অকৃতকার্য সম্পাদনে আত্মসম্পাদনের মধ্যে৷ দু’বার তাঁকে‍ অল্ডারম্যান নির্বাচিত করে এবং চট্টগ্রাম অইনসভার সদস্য নির্বাচিত করে দেশও তাঁকে‍ সম্মান জানিয়েছে৷ চট্টগ্রাম তাঁর আপন স্বদেশভূমি হয়ে উঠেছিল—দেশবিভাগের পর সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে অগৌণে স্বামীর সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে৷ এমনকী পাকিস্তানের মানুষ তাঁকে‍ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ব পাকিস্তানে পরিষদের সদস্য নির্বাচন করেন৷

নেলি সেনগুপ্তা, ভারতীয় রাজনীতিতে একটি পরম-শ্রদ্ধেয় নাম— অবশ্যই ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে৷ তিনটি মহিলার নাম একই কালে উচ্চারিত হয়— অ্যানি বেসান্ত, সরোজিনী নাইডু এবং নেলি সেনগুপ্তা৷ এঁদের মধ্যে দু’জন নিজেদের দেশকে ছেড়ে এসে ভারতবর্ষকেই আপন দেশে পর্যবসিত করেছিলেন৷ দম্পতির জীবনে ব্যক্তিগত সুখের একটা দিক থাকেই৷ কিন্তু তিনি যে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তর স্ত্রী৷ দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের সহধর্মিণী৷ স্বামীর প্র্যাকটিস জমে উঠেছে, ল কলেজে অধ্যাপনা করছেন, মধুর সাংসারিত জীবনে স্বামীর সঙ্গে অবসর জীবন কাটান অপটু হাতে ব্রিজ খেলে, পুজোর ছুটি হলে কর্ণফুলিতে বজরা চড়ে বেড়াতে যাওয়া, চুটিয়ে সংসার করার চেয়ে আরও যে একটা বৃহত্তর জীবন আছে ‘বিদেশিনী’ নেলি তা মর্মে‍ মর্মে‍ উপলব্ধি করেন৷ এখন ভারতবর্ষই তাঁর জীবন, ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা তাঁর দিবারাত্রির ভাবনা৷ ১৯২১ সাল, স্বামী কারাবরণ করেছেন— কারাগার পর্যন্ত সঙ্গী হিসেবে গেছেন৷ স্বামী মেয়র হয়েছেন— নেলির এর চেয়ে খুশির প্রাপ্তি কিছু নেই৷

১৯৩১৷ আবার দু’জনে বিলেতে ফিরে গেছেন যতীন্দ্রমোহনের স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য প্রধানত৷ শ্রীমতী গ্রে‍-র আনন্দ বাঁধভাঙা৷ মেয়ে‍-জামাইকে নিয়ে আনন্দে দিন কাটে৷ বেশি খুশি হয়েছেন মেয়ে স্বামীর সঙ্গে দেশব্রতে ঝাঁপিয়ে‍ পড়েছেন জেনে৷ ফেরার পথে জাহাজ থেকে নামতেই যতীন্দ্রমোহনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ সঙ্গে গেলেন নেলি৷ আদালত ঘরেই স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করে দিল পুলিশ৷ হাজতে যতীন্দ্রমোহনের রক্তচাপ বেড়ে গেলে স্ত্রীকে তারবার্তা পাঠালেন৷ নেলি এসে স্বামীর সেবায় অতন্দ্র প্রহর কাটাতে লাগলেন৷ 

স্বামী হাসপাতালে৷ ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়া নেলি সেনগুপ্তাকে ভারতীয় রাজনীতি, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদে বেছে নিল৷ নেলি সেনগুপ্তা তখন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে এক উৎসর্গীকৃত সৈনিক৷

নেলিকে আমরা ভারতীয় রাজনীতিতে প্রথম দেখেছিলাম ১৯২১ সালেই চট্টগ্রামে খদ্দর বিক্রি করে গ্রেপ্তার হওয়ার সূত্রে৷ ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় স্বামীর সঙ্গে তিনি দিল্লি, অমৃতসর ভ্রমণ করেন৷ দিল্লিতে একটি নিষিদ্ধ জনসভায় বক্তৃতাদানের অপরাধে গ্রেপ্তার হয়ে চারমাসের জন্য কারাবরণ করেন ভারতকে ভালবেসে৷ আবার ১৯৩৩ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে সভানেত্রী নির্বাচিত নেলিকে বেআইনি‍-ঘোষিত কংগ্রেসের অধিবেশনস্থল থেকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে৷ কী অপূর্ব দাম্পত্য জীবন৷ 

তারপর যতীন্দ্রমোহন কারা থেকে কারান্তরে দণ্ডভোগ কালে রাঁচিতে স্থানান্তরিত হয়ে রাঁচি‍ জেলেই মৃত্যুবরণে বাধ্য হলে সেই দুঃসহ বিচ্ছেদকে নেলি মেনে নিতে পেরেছিলেন তাঁদের অনুগত সন্তানদের মুখ চেয়ে ততখানি নয়, যতখানি তাঁর স্বামীর অকৃতকার্য সম্পাদনে আত্মসম্পাদনের মধ্যে৷ দু’বার তাঁকে‍ অল্ডারম্যান নির্বাচিত করে এবং চট্টগ্রাম অইনসভার সদস্য নির্বাচিত করে দেশও তাঁকে‍ সম্মান জানিয়েছে৷ চট্টগ্রাম তাঁর আপন স্বদেশভূমি হয়ে উঠেছিল—দেশবিভাগের পর সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করে অগৌণে স্বামীর সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে৷ এমনকী পাকিস্তানের মানুষ তাঁকে‍ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ব পাকিস্তানে পরিষদের সদস্য নির্বাচন করেন৷ প্রায় চল্লিশ বছরের বৈধব্য জীবনে স্বামীর স্মৃতিকে আঁকড়ে‍ থেকেই তাঁর জীবন কাটে৷

‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধি দিয়ে ভারত সরকার তাঁকে‍ যে সম্মান দেন তা যতীন্দ্রমোহনের উদ্দেশে নিবেদিত৷

বাঙালি বাবুর মেম বিবি ধারাবাহিক রচনাটি এখানেই সমাপ্ত হল