বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা জেলার রাজনগর গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে যে বালকটি জন্ম হয়, তাঁর নাম সুরথনাথ ঘোষ। বাবা মোহিনীমোহন। মা শৈবলিনী দেবী। সেই বালকটি যখন লেখক হিসেবে লেখালেখি শুরু করেছেন, তখন নিজেই নিজের নাম পরিবর্তন করে নাম রাখলেন সমরেশ। জন্মের তারিখ ১৯২৪ সালের ১১ ডিসেম্বর।
দেশ বিভাগের বেশ কিছু আগেই তাঁরা নৈহাটিতে চলে আসেন এবং সমরেশ নৈহাটি স্কুলে ভর্তি হন। দাদা ছিলেন রেলওয়ে কর্মচারী। ফলে রেলের গ্রন্থাগার থেকে বই এনে পড়বার অভ্যাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল সমরেশের। অল্প বয়স থেকেই বহু ধরনের মানুষের সঙ্গে তিনি মিশতে পারতেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় মন এতটুকু ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগ স্থাপিত হয় ১৯৪২ সালে। জীবিকার জন্য বহু ধরনের কাজকর্ম তিনি করেছেন। কিন্তু সাহিত্য রচনার অভ্যাসটি ছিল আকৈশোর। ১৯৪৪ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্প্রদায়িকতা বিরোধী গল্প ‘আদাব’ তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। ওই সালেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। রাজনীতি করবার কারণে কারাবাসও করতে হয়েছিল তাঁকে। সাম্যবাদে আস্থাশীল হলেও সাহিত্য সৃষ্টির উপর দলীয় অনুশাসন কোনদিন মেনে নেননি। ফলে একসময় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। কিন্তু লেখালেখির সঙ্গে তাঁর যোগ ক্রমশই বাড়তে থাকে। পরবর্তীকালে সাহিত্যকেই একমাত্র জীবিকা করেছিলেন। পশ্চিমবাংলার প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যে ছদ্মনাম তিনি নিয়েছিলেন সেটি হল ‘কালকূট’। এছাড়া ‘ভ্রমর’ ছদ্মনামেও কিছু লেখালেখি করেছেন। ‘মহানগর’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
বৈচিত্র তাঁর সৃষ্টি প্রতিভার একটা লক্ষণ। সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে প্রখরভাবেই তিনি সচেতন ছিলেন। তাঁর শিল্প-কর্মে ব্যক্তি মনের বৈচিত্রকে সমান গুরুত্ব দিয়ে গেছেন তিনি। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ ১৯৫১ সালে বেরিয়েছে। তাঁর উপন্যাসে বৈচিত্র এতটাই, যা যে কোনো পাঠককে মুগ্ধ করবে। নানানরকম কাজ করেছেন জীবনে। যেমন তিনি ইছাপুরের বন্দুক কারখানাতে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। বাস করেছেন শ্রমিক বস্তিতে। নিতান্ত নিম্নবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের জীবন নিয়ে বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। যেগুলির মধ্যে রয়েছে জগদ্দল, বি টি রোডের ধারে, শ্রীমতি কাফে প্রভৃতি উপন্যাস।
যে উপন্যাস তাঁকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি দিয়েছিল সেটি হল ‘গঙ্গা’।মাছ ধরার মরশুমে একদল জেলে গঙ্গা স্রোতে ইলিশ মাছ ধরার জন্য সমবেত হয় গঙ্গা বক্ষের একটি বিশেষ জায়গায়। মাছ কেনাবেচা হয়। লাভের কড়ি গুনে নিয়ে ফিরে আসে জেলেরা। মাছ মারাদের জীবন এই উপন্যাসের মূল বিষয়। এই উপন্যাসের নায়ক বিলাস। কেমন করে বহুবিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে সফলতাকে স্পর্শ করে এই জেলেরা, সেটাই দেখিয়েছেন সমরেশ। এর মধ্যে তাদের জীবনের শত্রুতার আর বন্ধুতার স্রোত প্রতিস্রোত দেখা দেয়। আসে প্রেম এবং বিরহ। নায়ক বিলাসের মনের মধ্যে আছে সমুদ্র যাওয়ার স্বপ্ন।এই স্বপ্নদর্শী যুবককে প্রতিষ্ঠিত করে উপন্যাসটি শেষ হয়েছে।
যে দুটি উপন্যাস তাঁকে বিতর্কের শিরোনামে তুলে ধরেছিল তার একটি হল ‘বিবর’ এবং অপরটি হল ‘প্রজাপতি’। ‘বিবর’ প্রকাশিত হওয়ার পর বহু পাঠকের বহুনিন্দা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু এই উপন্যাসের শক্তিকে অস্বীকার করা যায়নি কখনোই। অসম্পূর্ণ উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’র প্রেক্ষাপট রামকিঙ্কর বেইজের জীবন।
‘কালকূট’ ছদ্মনামে সমরেশ বসু বেশ কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন।অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই নামে রচিত উপন্যাসগুলির মধ্যে একটা পরিকল্পনা লক্ষ্ করা যায়, যেখানে লেখক নিজেকে এক পথ চলার আনন্দে মুগ্ধ পথিক রূপে কল্পনা করেছেন এবং পথিকের চোখ দিয়ে অনুভব করেছেন এই বিশ্বসংসারের বিচিত্র সুন্দরকে।কালকূট রচিত প্রথম উপন্যাস ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’।কুম্ভমেলার বিপুল জনসমাবেশে অভিযাত্রী লেখক যেন ভারতআত্মার সন্ধান পেয়েছেন, ধর্মে নয়, অবশ্যই মানবতায়। কালকূট নামে অপর যে উপন্যাসগুলি প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে আছে— আরব সাগরের জল নোনা, তুষার সিংহের পদতলে, মুক্ত বেনীর উজানে, চলো মন রূপনগরে, পূণ্যভূমে পুণ্যস্নান, নির্জন সৈকতে, স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গনে প্রভৃতি। ‘শাম্ব’ উপন্যাস লিখে তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পর্যন্ত পেলেন(১৯৮০)।
সমরেশ বসুর গল্প উপন্যাস নিয়ে কম সিনেমা তৈরি হয়নি। যার মধ্যে রয়েছে কুহক, গঙ্গা, নির্জন সৈকতে, দুই নারী, বিভাস, সুরের আগুন, বাঘিনী, দুরন্ত চড়াই, তিন ভুবনের পারে, অপরিচিত, ৭৮ দিন পরে, এপার ওপার, স্বাতী, বিকেলে ভোরের ফুল, মৌচাক, ছুটির ফাঁদে, শেষ বিচার, অমৃতকুম্ভের সন্ধানে, রাজেশ্বরী, নিশান্তে, প্রেম ও পাপ, প্রজাপতি প্রভৃতি।
সমরেশ বসু অসংখ্য ছোট গল্প লিখেছেন। সেই গল্পগুলির সংকলনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। যার মধ্যে রয়েছে মরশুমের একদিন, অকাল বৃষ্টি, ঋতু, পসারিণী, ষষ্ঠ ঋতু, পাহাড়ি ঢল, বনলতা, পাপ পুণ্য, চেতনার অন্ধকার, আমি তোমাদের লোক প্রভৃতি। বড় লেখক কখনও একটি সীমার মধ্যে বদ্ধ থাকতে পারেন না। জীবনকে নানাভাবে নানারূপে দেখে সঞ্চিত হয় তাঁর অভিজ্ঞতা। সাহিত্য গড়ে ওঠে সেই অভিজ্ঞতার ভূমিতেই। সমরেশ বসুর ক্ষেত্রে একথা বিশেষভাবে সত্য হয়ে উঠেছে। তিনি জীবনকে; বিশেষত মানুষকে দেখেছেন নানাভাবে। তাঁর দৃষ্টির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে তাঁর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ সাহিত্য রূপায়ণের কাঠামো। এই মানুষটিকে আমরা হারিয়েছি ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ। তাঁর জন্মের শতবর্ষে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।।