বুদ্ধবাবু ও আশির দশকের বাংলায় ‘প্রগতি চলচ্চিত্র’

সম্প্রতি চলে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ এদেশের বামপন্থী নেতাদের মধ্যে বিশিষ্ট একজন নেতা হিসেবে তাঁর নাম আগামী প্রজন্ম চিরকাল তাঁকে‍ মনে রাখবে৷ বামপন্থী আন্দোলনে বুদ্ধদেববাবুর অবদান সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথা লিখেছেন৷ আমি এই লেখায় সে সব দিকে না গিয়ে লিখব প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে কীভাবে এক নতুন দিশার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন, তার কথা৷ আমরা জানি পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসে ১৯৭৭ সালে৷ সেই মন্ত্রিসভায় তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হয়েছিলেন বুদ্ধবাবু৷

তিমি মন্ত্রী হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে বামপন্থীদের প্রগতি সংস্কৃতির সূচনা করার চেষ্টা করার পাশাপাশি বাংলা সিনেমাতেও সেই প্রগতি সংস্কৃতির সুস্থ হাওয়া বইবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷ এই উদ্যোগের সঙ্গে চল্লিশের দশকের ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও গণনাট্য আন্দোলনের ছায়া অবশ্যই আছে৷ আমার মনে আছে একটি তথ্যচিত্রে সেই সময় আমি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলাম, যার নাম ছিল ‘অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে’৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেই তথ্যচিত্রের প্রযোজক ছিল৷ ছবিটির পরিচালক ছিলেন গৌতম ঘোষ, সনৎ দাশগুপ্ত ও জগন্নাথ গুহ৷

কাহিনিচিত্র প্রযোজনার কাজেও বুদ্ধবাবু সরকারি ভাণ্ডার খুলে দিয়েছিলেন৷ আমরা জানি এমন উদ্যোগের শুরু বিধানচন্দ্র রায়ের হাত ধরে৷ তিনি সরকারের তহবিল থেকে টাকা দিয়েছিলেন বলেই সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ বানাতে পেরেছিলেন৷ সেটা ছিল ১৯৫৫ সাল৷ এরপর ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে দেবকী বসু তৈরি করেন ‘অর্ঘ্য’৷ ১৯৭৪ সালে সত্যজিৎ রায় বানান ‘সোনার কেল্লা’৷ এবার বুদ্ধবাবুর হাত ধরে সরকারের সেই প্রকল্পই নতুন করে শুরু হল তবে নতুন এক রাজনৈতিক দর্শনকে সামনে রেখে৷ এই সূত্রেই ক্ষমতায় আসার পরের বছর ১৯৭৮ সালে প্রথমে তৈরি হয় মৃণাল সেনের ‘পরশুরাম’৷ ১৯৭৯ সালে উৎপল দত্ত তৈরি করেন ‘ঝড়’ ও তরুণ মজুমদার তৈরি করেন ‘গণদেবতা’৷ ১৯৮০ সালে হয়তো বুদ্ধবাবুর ইচ্ছাতেই সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন ‘হীরক রাজার দেশে’৷ ঋত্বিক ঘটক ১৯৭৬ সালে মারা যাওয়ায় তাঁকে‍ দিয়ে কোনও ছবি বানানো সম্ভব হয়নি৷ মৃত্যুর আগে ১৯৭৪ সালে তিনি তৈরি করেন তাঁর শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’৷ ছবিটি‍র জন্য অর্থ দিয়েছিল তৎকালীন ভারত সরকারের ফিল্ম ফিনান্স কর্পোরেশন৷ যারা তাদের প্রথম ছবি ‘ভুবন সোম’ বানাতে অর্থ দিয়েছিল মৃণাল সেনকে, ১৯৬৯ সালে৷ কিন্তু ছবিটি ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায়৷ এই মুক্তির ব্যবস্থার পেছনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনও ভূমিকা ছিল কিনা জানা নেই৷ তবে থাকাটা অসম্ভব নয়৷ তখন ঋত্বিক ঘটক আর আমাদের মধ্যে নেই৷ এই পর্বের ছবিগুলির মধ্যে ‘গণদেবতা’ ও ‘হীরক রাজার দেশে’ বক্স অফিসে সাফল্য পেয়েছিল৷

ছবিগুলি অবশ্যই আমি একটু আগে যে বামপন্থী প্রগতি সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করেছি তার সঙ্গে মানানসই৷ প্রাথমিক সাফল্যের কারণে ১৯৮১ থেকে একে একে একঝাঁক নতুন পরিচালকদের হাত দিযে বাংলা প্রগতি চলচ্চিত্রের একটি ধারার জন্ম হয়েছিল৷ গৌতম ঘোষের ‘দখল’, বিপ্লব রায়চৌধুরীর ‘মহাপৃথিবী’, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘চোখ’, সৈকত ভট্টাচার্যের ‘যাকে ঘুষ দিতে হয়’, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘আজ কাল পরশুর গল্প’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘গৃহযুদ্ধ’, শ্যাম বেনেগালের ‘আরোহণ’ (হিন্দি‍) সরোজ দে’র ‘কোনি’ ইত্যাদি বেশ কিছু ছবি তৈরি হতে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের টাকায়৷ এই সব পরিচালকদের মধ্যে গৌতম, বুদ্ধদেব, উৎপলেন্দু, বিপ্লব পরে বাংলায় নব্যধারার পরিচালক হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন৷

১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ পরবর্তী ভারতীয় ছবির যে নব তরঙ্গের কথা বলা হয়, সেই তরঙ্গে বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কোনও জায়গাই হতো না যদি বুদ্ধবাবু দরাজ হস্তে সরকারি কোষাগার তৎকালীন নব্য পরিচালকদের সামনে খুলে না দিতেন৷ যা ১৯৭৭-এর পরবর্তী কয়েক বছরে বাংলার চলচ্চিত্র জগতে এই ‘প্রগতি চলচ্চিত্র’ নামে কিছুদিনের জন্য উদয় হয়ে আবার হারিয়ে য়ায়৷ এর কারণ ছবিগুলি বাণিজ্যকিভাবে মোটেও সফল হয়নি৷ বেশিরভাগ ছবি রিলিজ করাই যায়নি সরকারি নিয়মের বাধ্যবাধকতার কারণে৷

আজ যদি এই ছবিগুলি দেখার সুযোগ হয় তবে দেখা যাবে যে ছবিগুলির একটি বিশেষ চরিত্র রয়েছে৷ সেটা হল ছবিগুলির বিষয় প্রধানত সমাজের প্রান্তিক মানুষদের জীবন৷ তাদের জীবনের সংগ্রাম৷ তাদের বাঁচা মরা৷ আজকের বাংলা ছবিগুলির থেকে যা অনেকটাই আলাদা৷ এককথায় এই ছবিগুলি বাংলার প্রগতি চলচ্চিত্র ধারার অন্তর্ভুক্ত৷ সে সময়ের আনন্দবাজার পত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাবে স্বনামধন্য চলচ্চিত্র সাংবাদিক সেবাব্রত গুপ্ত ছবিগুলিতে বাংলার ‘থার্ড সিনেমা’ হিসেবে চিহ্নিত করতেও পিছ-পা হননি৷ ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ পরবর্তী ভারতীয় ছবির যে নব তরঙ্গের কথা বলা হয়, সেই তরঙ্গে বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কোনও জায়গাই হতো না যদি বুদ্ধবাবু দরাজ হস্তে সরকারি কোষাগার তৎকালীন নব্য পরিচালকদের সামনে খুলে না দিতেন৷ যা ১৯৭৭-এর পরবর্তী কয়েক বছরে বাংলার চলচ্চিত্র জগতে এই ‘প্রগতি চলচ্চিত্র’ নামে কিছুদিনের জন্য উদয় হয়ে আবার হারিয়ে য়ায়৷

এর কারণ ছবিগুলি বাণিজ্যকিভাবে মোটেও সফল হয়নি৷ বেশিরভাগ ছবি রিলিজ করাই যায়নি সরকারি নিয়মের বাধ্যবাধকতার কারণে৷ এই নিয়ে বেশ সমালোচনাও শোনা গিয়েছিল৷ অনেকেই মনে করেছিলেন এইভাবে সরকারি অর্থের অপচয় নিন্দনীয়৷ কিন্তু অন্যদিক দিয়ে দেখলে এটা মানতে হয় যে আজ বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস যদি কেউ লিখতে বসেন তবে তাকে আশির দশকের এইসব চলচ্চিত্রগুলিকেই দেখতেই হবে৷ বাংলা প্রগতি চলচ্চিত্র হিসেবেই ছবিগুলি চিহ্নিত হয়ে আছে ইতিহাসে পাতায়৷

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের খাতায় ‘কমিউনিস্ট ফিল্মস ফ্রম কেরালা’ শিরোনামে মোট ৫৯টিরও বেশি ছবি নথিভুক্ত হয়ে আছে৷ মালায়লাম ভাষার ছবিগুলি তৈরি হযেছে কেরালায়৷ ১৯৫৪ সলে ‘রাইচান এন্না পারুরান’ (নাগরিক রাইচান) দিয়ে শুরু হয় ২০১৭ সাল অবধি তৈরি হওয়া ‘ওরু মেক্সিকান অপরাথা’ (একটি মেক্সিকান বিশালতা), ‘অমল নিরাদ’ (আমেরিকার কমরেড) ও ‘সাকাবু’ (সিদ্ধার্থ শিব) এই তিনটি ছবি ধরা হয়েছে৷ তবে এইসব ছবির কোনোটাই কেরালা সরকারের অর্থে তৈরি হয়নি৷ তবে কেরালায় বামপন্থী রাজনৈতিক বিশ্বাসের ছবি তৈরির চল আজও আছে৷ ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘গুলমোহর’ উল্লেখযোগ্য৷

বাংলার প্রগতি চলচ্চিত্রের সূচনা হয়েছিল বুদ্ধবাবুর চেষ্টায়৷ তবে তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বাংলা সিনেমার দর্শকদের ওপর৷ যেমন হচ্ছে কেরালায়৷ বাংলায় সেই দায়িত্ব কতটা পালন করা হচ্ছে তার উত্তর আমরা আজকের বাংলা চলচ্চিত্রের জগতের দিকে তাকালেই পেয়ে যাব৷