বাঙালির ইতিহাস বিস্মরণের মুদ্রাদোষে অযত্নের শিকার তরু দত্তের সমাধিস্থল

শীতের হিমেল সন্ধ্যায়, নিউ ইয়ার্সকে স্বাগত জানাতে গোটা শহর যখন আলোয ভাসছে তখন নিবিড় ঘন আঁধারে মানিকতলায় কবরখানা জুড়ে রীতিমত গা ছমছমে পরিবেশ। এ এক বিষম বৈপরীত্য। 

চারপাশে ঝোপঝাড় আগাছার জঙ্গলের মধ্যে মানিকতলার খ্রিস্টীয়ান সিমেট্রিতে একের পর এক সমাধি। অন্ধকারে মেপে পা না ফেললে হোঁচট খাওয়ার ভয় রয়েছে। নিকষ অন্ধকারে দু চার হাত দূরের জিনিসও ভালো করে ঠাওর করা যায় না। এই অগোছালো, অবিন্যস্ত পরিবেশেই চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন দুই বোন, অরু আর তরু দত্ত। ভারতীয় উপমহাদেশের যে দুই বিস্মৃতপ্রায় কবি ঔপনিবেশিক শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের জাতিদম্ভ ও পরাধীন ভারতের রক্ষণশীলতার লৌহকপাটের আগল ভেঙে ফরাসি ও ইংরাজি দুই ভাষাতে কাব্যচর্চা করে পশ্চিমের মন জয় করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে যক্ষ্মার ছোবলে বয়সের নিরিখে সাকুল্যে কুড়ির কোঠাতেই বিদায় নিয়েছিলেন কলকাতার রামবাগানের অভিজাত দত্ত বাড়ির দুই কন্যা। তাদের ভাই চৌদ্দ বছরের কিশোর অবজুও শিকার হয়েছিল একই কালরোগের। সেও ঘুমিয়ে আছে দিদিদের পাশেই। 

অরু দত্ত এবং তরু দত্ত – দুই পিঠোপিঠি বয়সের বোন ছিলেন ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ ও ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’র লেখক। ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র দত্তও এই পরিবারের এক সদস্য। নিতান্তই স্বল্পায়ু তরু দত্ত তাঁর ২১ বছরের ক্ষণিক জীবনে শুধু কবি নন, অনুবাদক, সমালোচক, সাহিত্য সংকলক বা ভারতীয়দের মধ্যে ফরাসি ভাষায় প্রথম ঔপন্যাসিক হিসাবে উপমহাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসের ক্রমবিন্যাসে এক অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করে গিয়েছেন। অরু ছিলেন তরুর চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। তাঁর জন্ম ১৮৫৪ সালে, তরুর ১৮৫৬ তে। ১৮৭৪ সালে মারা যান অরু, তরু ১৮৭৭ সালে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত ‘এ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান পোয়েট্রি ইন ইংলিশ’ সংকলনে অরু দত্তকেও তাঁর সাহিত্য প্রতিভার নিরিখে রীতিমতো স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। নিতান্তই অসময়ে এই চরাচর বিদায় নেওয়ার আগে সাকুল্যে আটটি কবিতা লিখেছিলেন তরুর দিদি। সেই সীমিত সৃষ্টির পরিসর থেকেই অসাধারণ সাহিত্যকীর্তির পরিচয় মেলে। 

সাধারণভাবে বলা হয়, বাঙালি সেই গোষ্ঠীর মানুষ, যারা স্বভাবতই নিজেদের ইতিহাসকে ভুলে যেতে তিলমাত্র দ্বিধা করে না। বাঙালি যে আত্মবিস্মৃত জাতি, হাতেনাতে তার প্রমাণ মেলে মানিকতলা খ্রিষ্টীয়ান সিমেট্রিতে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত বেশ কিছু বঙ্গসন্তানের সমাধি রয়েছে এখানে। এগুলির মধ্যে অন্যতম পুরনো সমাধি দত্ত পরিবারের। তিন ভাই বোনের সাথে শায়িত রয়েছেন বাবা গোবিন চন্দ্র দত্ত আর মা ক্ষেত্রমনি দত্ত। সমাধিগুলি ঘিরে স্বল্প উচ্চতার একটি দেওয়াল। তারই গায়ে একটি ফলকে বলা হয়েছে এখানেই চির নিদ্রায় শায়িত আছেন তরু সহ দত্ত তাঁর পরিবারের সদস্যরা। যে ফলকটির গায়ের লেখা এখন প্রায় অস্পষ্ট। ২০০৫ সালে কাঠামোটির সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু কালস্রোতে সেই সংস্কার এখন অতীতের স্মৃতি মাত্র। 

সামগ্রিকভাবে পুরো চত্বর জুড়েই অযত্নের ছাপ। ধারাবাহিকভাবে সংস্কারের অভাব। অথচ ভারতের নবজাগরণ তথা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলনে এই দত্ত পরিবারের ভূমিকা ও অবদান কোনটাই যে ভোলার নয়, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন উনবিংশ শতকের বাংলার সমাজ জীবন ও সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়। তাঁর ব্যাখ্যায়, নবজাগরণের আলোকবর্তিকা বহন করেছেন দত্তরা। অরু-তরুর ঠাকুরদা রসময় দত্ত হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ দুইয়েরই ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। গোবিন চন্দ্র জার্মান ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই মেধাবী। কিন্তু স্কুল জীবনে গোবিনের ফলাফল মধুসূদনের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভাল ছিল। 

এতো বিখ্যাত মানুষ, তবুও তাঁর ভাগ্যে এত অবেহেলা কেন? 

শক্তিসাধনবাবু মনে করেন, অরু ও তরু দত্ত দুই বোন ইংরাজি ও ফরাসি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করায় এক বৃহত্তর অংশের মানুষের কাছে অনেকটাই অপরিচিতা থেকে গিয়েছেন। ফলে তাদের কেন্দ্র করে আবেগ, উচ্ছ্বাস বা আগ্রহ সব কিছুরই অভাব রয়েছে। আর সাধারণভাবে জনস্রোত যা কিছুকে ঘিরে থাকে, সরকার তা নিয়েই বেশি আগ্রহী। অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকার বা হেরিটেজ কমিশনের উদ্যোগ আয়োজন অনেকটা চাঁদ সওদাগরের বাম হাতে পুজো করার মতোই! 

যদিও ২০২১ এর অক্টোবর মাসে কলকাতা পুরসভার মেয়র, রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের শীর্ষ কর্তা, একাধিক জনসংগঠন যৌথভাবে মানিকতলা খ্রিস্টান সিমেট্রিতে ঢোকার মুখটিতে তরুর স্মৃতিতে একটি ফলক বসিয়েছিলেন। যাতে পথচলতি মানুষ এখানকার স্থান মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন। সেদিন সরকারি তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল ‘কিছু’ দিনের মধ্যেই ভোল বদলে যাবে এই সমাধিস্থলের। এর পর তিন বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু আগাছার জঙ্গল তেমন কিছু পরিষ্কার হয়নি, ঝোপঝাড়ের আধিক্যে সমাধি স্থলের ভিতরের রাস্তায় হাঁটা দায়। আর কোনও বাতি না থাকায় রাতের বেলা সমাধিস্থলে নেমে আসে নিঃঝুম অন্ধকার। একে অন্তত ভোলবদল বলা চলে না। 

অন্য একটি তথ্য জানা গেল পুরোনো কলকাতার ইতিহাস গবেষক সুবীর ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। তা হল, রামমোহন লাইব্রেরির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট প্রয়াত অধ্যাপক ডাঃ পার্থ সেনগুপ্ত একটা সময় পর্যন্ত নিজের উদ্যোগেই তরু দত্তের মৃত্যুদিবসে তাঁর সমাধিতে ফুল দিতেন। এরকম বিচ্ছিন্ন কিছু প্রয়াস বাদ দিলে সব মিলিয়ে দত্ত ভগিনীদের ভবিতব্যে জুটেছে অনাদরের অবহেলা। 

এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট স্থপতি ও হেরিটেজ কমিশনের বরিষ্ঠ সদস্য শ্রীকুমার ভট্টাচার্য আশ্বাস দিয়েছেন সমাধিস্থলের ‘ভোলবদল’ খুব যে দুরূহ বিষয়, তা কিন্তু নয়। তবে এক্ষেত্রে সরকারিস্তরে হেরিটেজ কমিশনের তরফে অর্থসংস্থান অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁর কাছেই জানা গেল এখনও বিদেশ থেকেও বেশ কিছু মানুষ আসেন, যাঁরা  উপনৈবেশিক আমলে পত্তন হওয়া এই শহরের নানা প্রান্তে খ্রিষ্টীয়ান সমাধিস্থলগুলি পরিদর্শন করেন। ফলে এগুলির রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ ভাবে করা প্রয়োজন। না হলে হারিয়ে যেতে বাধ্য ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা বেশ কিছু অধ্যায়।  

হয়ত বা এইভাবেই মানুষের স্মৃতির ঝাঁপি থেকে একদিন ঝরে যাবে ‘তরু’ যিনি তাঁর প্রতিভায় ফুল ফুটিয়েছিলেন কাননে। জ্ঞানের আলো জ্বেলেছিলেন গগনের তারার মতো। বিদেশিরাও সেই ‘তরু’র সামনে মাথা নুইয়েছিলেন, মুগ্ধতায় তাকিয়েছিলেন তারার দিকে।আর আমরা বাঙালিরা আজ সেই ‘তরু’র সামনে আলোটুকু জ্বালাতেও ভুলে গিয়েছি।