নানা রঙের দিনগুলি‍

আমরা যে‍-কালে‍র ভিতর দিয়ে চলি, তা অত্যন্ত কাছে থাকে ব’লে তাকে আমরা দেখি না৷ বোধ হয় অব্যবহিত বর্তমানকে সম্পূর্ণ ক’রে চিনতে পারা মনের ধর্মই নয়৷ তার দুখানি মাত্র পা, অথচ কাল তিনটি, তাই তিনটি কালে সে সমানভাবে পা ফেলতে পারে না৷ যদি কেউ পারে তবে জানা যাবে সে ব্যাকরণের পাতা খুলে ব্যাকরণের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালে আবদ্ধ হয়ে আছে৷ ব্যাকরণের বাইরে যে তিনটি কাল তার উপরে মনের গতি, পেণ্ডুলমের গতি৷ পেণ্ডুলাম তার গতিসীমার দুই প্রান্তে একবার ক’রে থামে, মধ্যপথে কখনো থামে না৷

লিখতে ব’সে প্রথমেই এই কথাগুলো মনে আসছে, কারণ অতীতে যে কয়েকটি বছরের কথা মনে আনতে চেষ্টা করছি, এখন মনে হয় তাদের সম্পূর্ণ ক’রে দেখতে পাচ্ছি৷ তখন পারিনি৷ – তখন, অর্থাৎ যে সময়ে সে কালের মধ্যে বর্তমান ছিলাম৷

সে দিনের স্মৃতি মনে রোমাঞ্চ জাগায়৷ আজকের এই মন ও দৃষ্টি নিয়ে সেই দিনগুলোর মধ্যে ফিরে গিয়ে সেই কালকে একটু আদর ক’রে আসতে ইচ্ছে হয়৷ 

অতীত ও ভবিষ্যৎ কালেই যে মানুষ বেশি বাস করে তার আর একটি প্রমাণ দিয়ে থাকেন গণৎকার৷ কেউ হাত দেখে, কেউ কোষ্ঠী দেখে, মানুষের অতীত ও ভবিষ্যৎ বলে চলেছেন৷ বর্তমান তাঁর কাছে তুচ্ছ, কারণ বর্তমানের জ্ঞানের উপর কারও দাবি নেই৷ গণৎকারও তাই সাধারণ মানুষের মতো দ্বিকালদর্শী৷ আমিও তাই৷ ত্রিকালদর্শী হলে ঋষি হতে পারতাম৷ 

১৯৩৩-৩৪-৩৫-৩৬ সনের সেই দিনগুলি‍— যা সোনার খাঁচায় রইল না, অথচ যা হারিয়ে যায়নি৷

গণৎকার ব’সে আছেন ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রীটের একটি প্রশস্ত ঘরে৷

সুরেশ বিশ্বাস৷ এ কালের কেউ তাঁকে‍ চেনে না, চেনবার উপায়ও নেই, তিনি স্বেচ্ছায় নিজেকে লুপ্ত করেছেন ইহকালের দৃষ্টির আড়ালে৷ 

সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস

সুরেশ বিশ্বাস হাতের রেখা দেখছেন৷ সজনীকান্তের হাত৷ অতিকায় অতিপুষ্ট আঙুলসম্বলিত হাত৷ 

“আপনার আরও কয়েক বছর গণ্ডগোল আছে‍— তারপর দিন আসছে উন্নতির— ভীষণ উন্নতি সামনে‍— কেউ ঠেকাতে পারবে না৷’’

সজনীকান্ত হয়তো অবিশ্বাসের হাসি হাসছেন মৃদু মৃদু, তবু কথাটা বিশ্বাস করতে ভাল লাগে৷

একটু দূরে কিরণ রায় টেবিলে মনোযোগ দিয়ে প্রুফ দেখছেন হট্টগোলের মধ্যে৷ জনারণ্যে কিরণকুমার একা৷ 

ডক্টর সুশীলকুমার দে হাত এগিয়েছেন সুরেশ বিশ্বাসের দিকে৷ 

“ঢাকার চাকরি ছাড়তে হবে‍— You will have o fly away from Dacca!”

এখনও সে ধ্বনি কানে বাজছে৷ 

ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হাত৷

বিলেত যাওয়া আবার ঘটবে অল্পদিনের মধ্যে৷ নিশ্চয় ঘটবে৷ 

সাড়ে তিন বছরের ঘটনা, যে কথাটি পরপর লিখে চলেছি৷ চলন্ত ছবি৷ এক-একটি ছবি ঘিরে কত রঙ, তা শুধু আমার মনের মধ্যেই উজ্জ্বল৷ 

অসুখবিলাসী প্রেমেন্দ্র মিত্র নিজের যে‍-কোনো তুচ্ছ অসুখের কথা নিয়ে কিরণের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক ধরে আলাপ চালাচ্ছেন৷

প্রেমেন্দ্র মিত্র 
প্রেমেন্দ্র মিত্র

এক পাশে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীরদচন্দ্র চৌধুরী ইংল্যান্ডে একটি বিশেষ ভারতীয় ফার্ন গাছ আছে কি না তা নিয়ে তুমুল তর্ক বাঁধিয়েছেন৷ সামনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন এক খণ্ড খোলা পড়ে আছে৷ 

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর ক্রমশঃ-প্রকাশিত ‘অভিশাপ’ উপন্যাসের কিস্তি অতি বিলম্বে এনেছেন৷ তা নিয়ে কিছু তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে৷ তিনি অভিশপ্তের মতো বসে আছেন নীরবে৷ পাশে তাঁর অনুচর কবি সুবল মুখোপাধ্যায়, মুখে স্মিত হাসি৷

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিতান্তই তরুণ যুবক, চেহারায় উদাসীন বাউলের ভাব৷ বেপরোয়া লেখক৷ লিখছেন প্রচুর৷ নতুন প্রতিভা আবিষ্কারের সজনীকান্তের ইনটুইশন দেখে অবাক হই৷

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মধুর কণ্ঠে সরস গল্প জমিয়ে তুলেছেন৷ পরম উপভোগ্য মুহূর্তগুলি উড়ে চলেছে পাখা মেলে৷

হ্রস্বদেহ বজ্রকণ্ঠ প্রমথনাথ বিশীর সঙ্গে শিল্পী অরবিন্দ দত্তের তুমুল তর্ক চলছে৷ এ তর্কের কোনও হেতু নেই৷ তর্কের জন্যই তর্ক৷ আর্ট ফর আর্টস সেক৷ 

মোহিতলাল মজুমদার রবীন্দ্রনাথের প্রতি বড়ই ক্ষুব্ধ৷ তাঁর সমালোচনা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে খেয়াল নেই৷ বলছেন— খুব দম্ভের সঙ্গে‍— “রবীন্দ্রনাথ একটি লাইন ইংরেজী লিখতে জানেন না৷’’ এবং আরও কত কি, লেখবার মত নয়৷ 

তাঁকে‍ সামনে পেলে রক্তপান করেন, এই রকম ভাব৷

পাশের ঘরে ঢুকছেন ক’জন৷ নলিনীকান্ত সরকারের গান হবে৷ মাসিকপত্র অফিসে গান! অতএব একটা ঘরে খিল বন্ধ হল৷ দেহতত্ত্বের গান সব ঢঙ্গ মার্কা৷ রচনানৈপুণ্যে পুরস্কার পাবার উপযুক্ত৷

বড় ঘরটাতে অন্তত পঁচিশজন বসে তর্কবিতর্ক চলছে৷ 

নবাগতের প্রশ্ন—“সজনীবাবু কোথায়?’’

“তিনি বেরিয়ে গেছেন৷’’

“বড়ই দরকার ছিল৷’’

“ঘণ্টাখানেক পরে এলেই দেখা পাবেন৷’’

আধ ঘণ্টা পরে পাশের তালাবন্ধ ঘর (গণপতি চক্রবর্তীর ইলিউশন বক্স!) থেকে আর এক দরজার খিল খুলে সজনীকান্তের আবির্ভাব৷

বাইরে যাননি তিনি৷ ওটি আত্মরক্ষার ব্যবস্থা৷ নইলে ভিড়ের মধ্যে সম্পাদনা বা লেখার কাজে কিছু অসুবিধা হ’ত৷

নীরদচন্দ্র চৌধুরী

সুরেশ বিশ্বাস গল্প জমিয়ে বসেছেন৷ “নীরদ চৌধুরী কেমন জানেন? মস্ত বড় পণ্ডিত৷ সাহিত্য ইতিহাস বিজ্ঞান দর্শন সব জানেন৷ ভূগোলের জ্ঞান অদ্ভুত৷ সমস্ত দেশের খবর ইঞ্চি ইঞ্চি হিসেবে বলে দিতে পারেন৷ ইউরোপের কোন্‌ গ্যালারিতে কোন্‌ বিখ্যাত ছবি আছে তা বলে দিতে পারেন৷ তবে তাঁর সামান্য একটু ত্রুটি আছে৷ –- তিনি লিলুয়ার বেশি দেশ নিজে চোখে দেখেননি৷’’

সুরেশ কম্পোজিটার প্রুফ হাতে ঘোঁত-গোঁত করতে করতে সিঁড়ি‍ বেয়ে দোতলায় উঠছেন, “বাবুরা সব লেখক হয়েছেন, একটা বানান ঠিক ক’রে লিখতে শেখেননি৷’’ ইত্যাদি৷

অশোক চট্টোপাধ্যায় এসেছেন৷ খুদুদা তিনি সবার৷ আড্ডা জমানোয় নোবেল প্রাইজ পাবার উপযুক্ত৷ রবীন্দ্রকাব্যরে নতুন অনুবাদ শোনাচ্ছেন, : “ওগো তুমি কোথা যাও— O cow, where do you go” অথবা যৌবন নিকুঞ্জে‍ In the bowerless jow forest” অথবা “তিমির আড়ালে‍— Behind the whale”৷

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় অশরীরী, একেবারে শেলীর স্কাইলার্ক— স্থূলত্ব কিছু নেই, সবখানি আবেগ আর উচ্ছ্বাস৷ সব কাজ তাঁর ইনস্‌পায়ার্ড৷ সুন্দর কিছু পেলেই গদগদ ভাব৷ মধুর কণ্ঠ, গীতধর্মী সুর, সেই সুরের কাছে সত্য মিথ্যা সব একাকার৷ অবিন্যস্ত চুল— দেখলেই মনে হয় দুনিয়া চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে এই খবরটি তাঁর মুখে এখুনি শুনতে পাব৷ 

ঘোর গরম, পাখার হাওয়া তুচ্ছ মনে হচ্ছে৷ এমনি সময় পাখা বন্ধ ক’রে দিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ একটি সিগারেট জোগাড় করেছেন, সেটিকে পুরো খেতে হবে আরাম ক’রে৷ পাখার হাওয়ায় অকারণ বেশি পুড়ে যায়৷ তীক্ষ্ণ তীব্র কণ্ঠ৷ অবিচলিত, আত্মস্থ, আপন বিষয়ে সচেতনহীন৷ গ্রাম্য বালক যেন৷ উত্তেজনাহীন রাগদ্বেষহীন৷

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিভূতিবাবু বলছেন ব্যবসা করবেন৷ তার ফলে এক তুমুল কাণ্ড ঘটে গেল৷ এই ঘটনাকে একটু প্রলম্বিত করে “প্ল্যান’’ গল্পটি লিখেছিলাম৷ সেটি ‘বঙ্গশ্রী’ জ্যষ্ঠৈ (১৩৪০) সংখ্যায় ছেপেছিলেন সজনীবাবু৷ 

এর বছর দুই আগে যখন এই বৃহৎ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হইনি, তখন হ্যারিসন রোডের ট্রামে যেতে যেতে এক নকল রবি ঠাকুরকে দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলাম৷ এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিলাম তাঁর দিকে৷ গায়ের রঙ ফরসা হ’লে আসল বলে ভুল হত৷

চেহারাটা মনে রেখেছিলাম, মনে রাখার মতো বলে৷

সেই নকল রবীন্দ্রনাথকে দেখলাম এই ‘বঙ্গশ্রী’র আসরে৷ সত্যেন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত৷ লেখেন, ছবি আঁকেন, অভিনয় করেন৷ 

ইতিপূর্বে বাইরে যাঁকে‍ সামান্য চিনেছি, একে একে সবাইকে দেখি ‘বঙ্গশ্রী’র আসরে৷

রাজেন্দ্রলাল স্ট্রীটে শনিরঞ্জন প্রেসের টাইপ-ঘরের বিপরীত ঘরে আমি নিজে যখন ১৮ পয়েন্ট কম্‌প্রেসড্‌ টাইপের মত বাস করছি, তখন এক ব্যক্তির সঙ্গে ঘটনাসূত্রে আলাপ হয়৷ হ্রস্বদেহ, গম্ভীর মানুষ৷ বাড়িতে দেহচর্চা করেন৷ লোহার রিঙ ঝোলানো আছে কড়িকাঠে৷ কারলাইলের গোঁড়া ভক্ত, তাঁর ছবি টাঙানো আছে ঘরে৷

কিছুদিন আগে ভাগলপুর থেকে বনফুলের কয়েকটি ছন্দে লেখা গল্প সংগ্রহ করে এনেছি৷ “জনার্দন জোয়ার্দার’’ ছাপা হচ্ছে ‘শনিবারের চিঠি’তে৷ তাঁকে‍ পড়ে শোনাচ্ছি৷ গম্ভীর লোকের উপর কৌতুক-কাহিনীর কি প্রতিক্ৰিযা হবে জানতাম না৷

সুট পরা নিখিলচন্দ্র দাস গল্পের শেষ অংশ শুনে মেঝেতে গড়াতে লাগলেন৷ সে কি দৃশ্য৷ আমি তো স্তম্ভিত৷

তার পরদিন আবার এসেছেন৷ 

“ঐ কবিতাটার শেষ কটা লাইন আবার পড়ুন তো৷’’

আমি আবার পড়লাম৷ 

পুত্র জনপ্রিয় জনার্দনকে ধরে পিতা গর্জন করছেন আর মারছেন৷ প্রচুর মার খেয়ে‍—

‘স্কিপ করে‍

জনার্দন প্রণম্য পিতায়

সার্কাসি কায়দায়

স্যালিউট করি‍

গেল সরি৷’

আবার নিখিলচন্দ্রে দাসের কোট-প্যান্টের ভাঁজ ভাঙল, ধুলোমাখা হলেন আপাদমস্তক৷

তাঁকেও দেখলাম ‘বঙ্গশ্রী’ অফিসে, প্রথমে গম্ভীর মূর্তিতে, পরে মার মূর্তিতে, হাসিয়ে দিলে আর রক্ষা ছিল না৷ নলিনীকান্ত সরকার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র থাকলে সেদিন রক্তপাত হত৷

কিছুদিন পরে এবং কিছুদিনের জন্য তিনি ও সজনীকান্ত পরস্পর সুখ-দুঃখের ভাগী হলেন৷

শিল্পী যামিনী রায় এসে বসেছেন৷ ব্যাখ্যা করছেন তাঁর আপন শিল্পভঙ্গী৷ শিল্পী অতুল বসু, চৈতন্যদেব চট্টোপাধ্যায়, মনীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, হরিপদ রায় আসছেন নিয়মিত৷

বনফুল সিনেমা দেখে জ্যানেট গেনরকে উদ্দেশ ক’রে কবিতা লিখে টেলিফোনে শোনাচ্ছেন কিরণকুমারকে৷

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন মুঙ্গের থেকে৷ আলাপ হ’ল তাঁর সঙ্গে৷ আবিষ্কার করলাম পনেরো বছর আগে আমরা একই কলেজে একই ক্লাসে এবং সেকশনে পড়েছি৷ কেউ কাউকে চিনতাম না, ‘বঙ্গশ্রী’ অফিসে বসে পরিচয় হ’ল৷ কেউ কাউকে কখনো দেখেছি বলেও মনে হ’ল না৷

ডাক্তার রামচন্দ্র অধিকারী আবৃত্তি শোনাচ্ছেন সবাইকে অবাক ক’রে৷ স্মৃতি এবং কণ্ঠ দুই-ই চমকপ্রদ৷ অপরের ফুসফুস নিয়ে কারবার, কিন্তু তাঁর নিজের অন্তরটা আর সবারই কাছে উন্মুক্ত থাকত৷ 

ডাক্তার পশুপতি ভট্টাচার্য আসতেন কদাচিৎ৷ সব রকম বিষয়ে লেখার ওস্তাদ৷ আর আসতেন উকিল জ্ঞান রায়, দেবীদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ কবি জগদীশ ভট্টাচার্য, বাসবেন্দ্র ঠাকুর, ঝুনো কবি কৃষ্ণধন দে৷

কবি হেমচন্দ্র বাগচী শান্ত মধুর ভাবে এসে বসতেন৷ প্রকাণ্ড ব্যাগে গান্ধীজি, উড়িষ্যার মন্দির এবং অসহযোগ আন্দোলনকে পুরে নির্মলকুমার বসু আসতেন প্রসন্ন হাসিমুখে৷ 

সকল বিষয়ে সকল বিধিনিষেধভঙ্গকারী সজনীকান্ত খামখেয়ালিতে সকলকে হার মানাতেন৷ দল ক’রে হঠাৎ অফিসের সময় ডায়মন্ড হারবার যেতে হবে৷ সজনীকান্ত সহকারী কিরণকে বলছেন, “সঙ্গে না গেলে চাকরি খেয়ে নেব৷’’

শিক্ষক মনোজ বসু, ‘নবশক্তি’ সম্পাদক সরোজকুমার রায় চৌধুরী, কর্মযোগী যোগানন্দ দাস, দুর্ধর্ষ গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যিক কলহপ্রিয় গিরিজাশঙ্কর রায় চৌধুরী— সবাই আসছেন, যাঁরা যখন খুশি৷ চলচ্চিত্রের মতো নিজ নিজ ভূমিকা অভিনয় ক’রে চলে যাচ্ছেন৷

আশ্চর্য আড্ডা৷ লেখক, শিল্পী, শিল্প-রসিক, সাহিত্য-রসিক— যাঁরই দু’খানা পা সচল তাঁকেই দেখা যাচ্ছে সেখানে৷ বেলা একটা থেকে ভিড় জমছে৷ সংখ্যা বাড়ছে ক্রমে৷ ডক্টর বটকৃষ্ণ ঘোষ, সুকুমার সেনকে দেখা যাচ্ছে বিকেলের দিকে, কখনো দুপুরে৷ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আত্মপ্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠিত নন, কিন্তু সজনীর উৎসাহে সৃজনী উৎস খুলছে আশ্চর্য দ্রুত৷

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

কিছুমাত্র ক্ষমতার পরিচয়ও দৃষ্টি এড়ায় না সজনীকান্তের৷

তাঁর গুণগ্রহণের ভাষা ছিল, “ওয়ান্ডারফুল!’’ যা শুনতেন, সব ওয়ান্ডারফুল৷ এ জন্য কোনো কোনো লেখকের অধঃপতন ঘটেছে সন্দেহ নেই, সময়কালে অপ্রিয় সত্য বললে হয়তো লেখকের উপকার হত৷ কিন্তু তবু বলব এই ‘ওয়ান্ডারফুল’ কথাটি পুনঃপুনঃ উচ্চারিত হয়েছিল ব’লে আজও অনেকে সাহিত্যের পথে চলেছেন আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে৷ 

সজনী-কেন্দ্রিক ‘বঙ্গশ্রী’কে ঘিরে কি বিচিত্র ভিড় কি বিচিত্র সম্ভাবনা!

সজনীকান্তের চরিত্র ছিল রহস্যময়৷ তিনি কখনও তাঁর শেষ দেখতে দিতেন না৷ প্রতি পদে বিস্মিত হয়েছি৷ অনেক সময় ইচ্ছে ক’রে রহস্য বাড়াতেন৷ অনেক জটিল সমস্যার কি ক’রে যে সহজ সমাধান খুঁজে পেতেন তা আজও জানি না৷

সেদিনের আড্ডায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা স্বীকার করবেন, একটি চরিত্রের এই রহস্যময় বৈচিত্র্যই সেদিনের ছিল সর্বপ্রধান আকর্ষণ৷ ভাল লেগেছিল সে বৈচিত্র্য৷

ভীরুতা দেখিনি কখনো৷

অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে‍ পড়তে দ্বিধা দেখি নি কখনো, তা সে নিজের জন্যই হোক বা আশ্রিতের জন্যই হোক৷

‘বঙ্গশ্রী’ থেকে সরে যাবার বেলাতেও সেই অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে‍ পড়া৷ অথচ সম্পাদক সজনীকান্ত ‘বঙ্গশ্রী’ সম্পাদনায় চরম যোগ্যতাই দেখিয়েছিলেন৷ ‘বঙ্গশ্রী’ প্রথম শ্রেণীর কাগজ হয়েছিল৷ সম্পাদনার আঙ্গিক বা কৌশল বিষয়ে আমি তো তাঁর কাছে প্রায় সবটাই ঋণী৷

এই ‘বঙ্গশ্রী’কে কেন্দ্র করে যে শক্তি গড়ে উঠে‍ছিল তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আজ কি হতো বলা যায় না৷ ‘বঙ্গশ্রী’ খুব বড় কাগজ হত অবশ্যই, কিন্তু সুরেশ বিশ্বাসের ভবিষ্যদ্বাণী যে ফলতে পারত না তাতে সন্দেহ নেই৷ 

আঠারো বছর হ’ল ‘বঙ্গশ্রী’র কাল গত হয়েছে৷ তখন যে সব পুত্র জামাতা পিতা সেখানে একত্র হয়েছিলেন, এখন তাঁদের প্রায় সবাই পিতা শ্বশুর বা পিতামহের স্থান নিয়েছেন৷ শুধু স্মৃতির মধ্যে সেই কাল আজ বেশি উজ্জ্বল, বেশি রোমাঞ্চকর৷