১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ, ফেব্রুয়ারি মাস৷ স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকা তথা বিশ্বজয় করে কলকাতায় ফিরে এসেছেন৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার রাজবাড়ির বিস্তৃত প্রাঙ্গণে স্বামীজিকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হল৷ সারা কলকাতা জুড়ে উন্মাদনা৷ এমনই একটি উন্মাদনাকর পরিবেশের এক মনোহর বর্ণনা প্রকাশিত হল ‘ভারতী’ পত্রিকার চৈত্র ১৩০৩ বঙ্গাব্দের সংখ্যায় ৭৭৯-৭৮২ পৃষ্ঠা জুড়ে৷ তাতে রমণীরাও স্বামীজির দর্শনের জন্য কতখানি উন্মুখ হয়ে পড়েছিলেন সে সময়ে— তার একটি মনো্জ্ঞ বর্ণনা আছে৷ এ সময় ‘ভারতী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন হিরণ্ময়ী দেবী ও সরলা দেবী৷ সম্ভবত সরলা দেবী ‘স্বামী বিবেকানন্দ:আশা’ নামে এই প্রতিবেদনটি রচনা করেছিলেন৷ এই নিবন্ধের শেষে লেখা হয়েছিল—
“ইচ্ছা করিলে বিবেকানন্দ স্বামী স্বদেশের অনেক কাজ করিতে পারিতেন৷ সমাজ সংস্কারের দুইটী প্রধান উপাদান তাঁহাতে বর্ত্তমান—পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতা; এবং তিনি নিজেকে কোন বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত না করাতে সম্প্রদায় নির্ব্বিশেষে সমস্ত হিন্দুরই শ্রদ্ধাভাজন৷ সভ্যতার সংস্পর্শে তাঁহার মার্জ্জিত প্রাচ্য জ্ঞানালোকে মাতৃভূমি সমুজ্জ্বল করিবার ক্ষমতা তাঁহার ছিল৷ কিন্তু সে ক্ষমতানুযায়ী কর্ত্তব্য তিনি স্বীয় কর্ত্তব্য বলিয়া গ্রহণ করিলেন না৷ সে আমাদেরই দৃরদৃষ্ট৷ হায়! আমাদের নৈতিক দুর্দ্দশায় যাঁহাকে সূর্য্যোদয় মনে করিতেছিলাম, তাহা সূর্য্যোদয় নহে— একটী বৃহৎ তারার ক্ষণিক জ্যোতিমাত্র৷”
এই মন্তব্য কোনও বিদ্বেষপ্রসূত নয়, আশাহত লেখিকার আক্ষেপমাত্র৷
(২)
‘ভারতী’র এই সংখ্যাটি সরলা দেবী ডাকযোগে স্বামী বিবেকানন্দের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন৷ স্বামীজি এ-সময়ে দার্জিলিং-এ ছিলেন৷ বর্ধমান মহারাজাদের একটি বাড়ি সেখানে ছিল ‘রোজ ব্যাঙ্ক’ নামে৷ স্বামীজি সেখানেই থাকতেন৷ পত্রিকাটি পেয়ে স্বামীজি সরলা দেবীকে একটি চিঠি লেখেন৷ অনেক পরে এই চিঠিটি দুটি প্রাপ্ত চিঠির সঙ্গে সরলা দেবী ‘ভারতী’তে ছাপিয়ে দেন স্বামীজির মহাপ্রয়াণের (৪ জুলাই ১৯০২) অব্যবহিত পরেই৷ পত্র-সহ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হল ভাদ্র ১৩০৯ সংখ্যায় (পৃ.৪৮৭-৪৯৮)‘ওঁ স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন’ নামে৷ অনেক পরে বৈশাখ ১৩২৯ সংখ্যার ‘উদ্বোধন’-এ এবং সেখান থেকে জৈ্ষ্ঠ ১৩২৯ সংখ্যার ‘ভারতী’তে (পৃ. ১৭৬-১৮৬) তা পুনর্মুদ্রিত হয় ‘স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী বিবেকানন্দের পত্র’ নামে৷
‘উদ্বোধন’ প্রকাশানালয় স্বামীজির পত্রাবলী একখণ্ডে প্রকাশ করেছে৷ এর চতুর্থ সংস্করণের (পৌষ ১৩৮৪) ১৫তম পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হয় আষাঢ় ১৪১৬ বঙ্গাব্দে৷ এর ৩৪০, ৩৪২ এবং ৪৩৭ সংখ্যক পত্রগুলিই সরলা দেবীকে লেখেন স্বামীজি৷ এই ‘পত্রাবলী’র সম্পাদক-অনুবাদক কে ছিলেন তা আমাদের অজানা৷ কিন্তু চিঠিগুলি এখানে একেবারে অবিকৃতভাবে মুদ্রিত হয়নি৷ ইংরেজি শব্দ ব্যবহার নয় শুধু, সমগ্র একটি শব্দও বদল করা হয়েছে৷ আমরা তুলনামূলক আলোচনা করতে চাইছি না, এই নিবন্ধের তা উদ্দেশ্যও নয়৷ কিন্তু অধিকতর নির্ভরতার জন্য আমরা ‘ভারতী’ পত্রিকার পাঠই সরাসরি এখানে উদ্ধার করছি৷ প্রথম চিঠিটি ছিল এই প্রকার:
ওঁ তৎসৎ
Rose Bank
বর্দ্ধমান রাজবাটি, দার্জিলিঙ্গ;
৬ই এপ্রেল, ১৮৯৭
মান্যবরাষু—
মহাশয়ার প্রেরিত ভারতী পাইয়া বিশেষ অনুগৃহীত বোধ করিতেছি, এবং যে উদ্দেশ্যে আমার ক্ষুদ্র জীবন ন্যস্ত হইয়াছে, তাহা যে ভবাদীয়ার ন্যায় মহানুভাবাদের সাধুবাদ সংগ্রহ করিতে সক্ষম হইয়াছে তাহাতে আপনাকে ধন্য মনে করিতেছি৷
এ জীবন সংগ্রামে নবীন ভাবের সমুদ্ঘাতার উত্তেজক অতি বিরল, উৎসাহায়ত্রীর কথাত দূরে থাকুক, বিশেষতঃ আমাদের হতভাগা দেশে৷ এজন্য বঙ্গ-বিদূষী-নারীর সাধুবাদ সমগ্র ভারতীয় পুরুষের উচ্চকণ্ঠ ধন্যবাদাপেক্ষাও অধিক শ্রদ্ধা৷
প্রভু করুণ যেন আপনার মত অনেক রমণী এদেশে জন্মগ্রহণ করেন ও স্বদেশের উন্নতি-কল্পে জীবন উৎসর্গ করেন৷ আপনার লিখিত ভারতী পত্রিকার মৎসম্বন্ধী প্রবন্ধ বিষয়ে আমার কিঞ্চিৎ মন্তব্য আছে; তাহা এই—
পাশ্চাত্যদেশে ধর্ম্মপ্রচার ভারতের মঙ্গলের জন্যই করা হইয়াছে এবং হইবে৷ পাশ্চাত্যেরা সহায়তা না করিলে যে আমরা উঠিতে পারিব না ইহা চিরধারণা৷ এদেশে এখনও গুণের আদর নাই, অর্থবল নাই, এবং সর্ব্বাপেক্ষা শোচনীয় এই যে কৃতকর্ম্মতা (Practicality) আদৌ নাই৷
উদ্দেশ্য অনেক আছে, উপায় এ দেশে নাই৷ আমাদের মস্তক আছে, হস্ত নাই৷ আমাদের বেদান্ত মত আছে, কার্য্যে পরিণত করিবার ক্ষমতা নাই৷ আমাদের পুস্তকে মহাসাম্য বাদ আছে, আমাদের কার্য্যে মহা ভেদ বুদ্ধি৷ মহা নিঃস্বার্থ নিষ্কাম কর্ম্ম ভারতেই প্রচারিত হইয়াছে, কিন্তু কার্য্যে আমরা অতি নির্দ্দয়, অতি হৃদয় হীন, নিজের মাংসপিণ্ড শরীর ছাড়া অন্য কিচুই ভাবিতে পারি না৷
তথাপি উপস্থিত অবস্থার মধ্য দিয়াই কেবল কার্য্যে অগ্রসর হইতে পারা যায়, অন্য উপায় নাই৷ ভাল মন্দ বিচারের শক্তি সকলের আছে কিন্তু তিনিই বীর যিনি এই সমস্ত ভ্রম প্রমাদ ও দুঃখপূর্ণ সংসারের তরঙ্গে পস্চাৎপদ না হইয়া, এক হস্তে অশ্রুবারি মোচন করেন ও অপর অকম্পিত হস্তে উদ্ধারের পথ প্রদর্শন করেন৷ একদিকে গতানুগতিক জড়পিণ্ডবৎ সমাজ, অন্যদিকে অস্থির ধৈর্য্যহীন অগ্নিবর্ষণকারী সংস্কারক, কল্যাণের পথ এই দুইয়ের মধ্যবর্ত্তী৷ জাপানে শুনিয়াছিলাম যে সে দেশের বালিকাদিগের বিশ্বাস এই যে যদি ক্রীড়া পুত্তলিকাকে হৃদয়ের সহিত ভালবাসা যায় সে জীবিত হইবে৷ জাপানি বালিকা কখনও পুতুল ভাঙ্গে না৷ হে মহাভাগে, আমারও বিশ্বাস যে যদি কেউ এই হতশ্রী, বিগতভাগ্য, লুপ্তবুদ্ধি, পরপদবিদলিত, চিরবুভুক্ষিত, কলহশীল ও পরশ্রীকাতর ভারতবাসীকে প্রাণের সহিত ভালবাসে তবে ভারত আবার জাগিবে৷ যবে শত শত মহাপ্রাণ নরনারী সকল বিলাস ভোগসুখেচ্ছা বিসর্জ্জন করিয়া কায়মনোবাক্যে দারিদ্র্য ও মূর্খতার ঘনাবর্ত্তে ক্রমশঃ উত্তরোত্তর নিমজ্জনকারী কোটী কোটী স্বদেশীয় নরনারীর কল্যাণ কামনা করিবে, তখন ভারত জাগিবে৷ আমার ন্যায় ক্ষুদ্রজীবনেও ইহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি যে সদুদ্দেশ্য, অকপটতা ও অনন্তপ্রেম বিশ্ববিজয় করিতে সক্ষম৷ উক্ত গুণশালী একজন কোটী কোটী কপট ও নিষ্ঠুরের দুর্বদ্ধিনাশ করিতে সক্ষম৷
আমার পুনর্ব্বার পাশ্চাত্য দেশে গমন অনিশ্চিত!, যদি যাই তাহাও জানিবেন ভারতের জন্য— এদেশে লোকবল কোথায? অর্থবল কোথায়? অনেক পাশ্চাত্য নরনারী ভারতের কল্যাণের জন্য ভারতীয় ভাবে ভারতীয় ধর্ম্মের মধ্যদিয়া অতি নীচ চণ্ডালাদিরও সেবা করিতে প্রস্তুত আছেন৷ দেশে কয়জন? আর অর্থবল!! আমাকে অভ্যর্র্থনা করিবার ব্যয়নির্ব্বাহের জন্য কলিকাতাবাসিরা টিকিট বিক্রয় করিয়া লেকচার দেওয়াইলেন এবং তাহাতেও সংকুলান না হওয়ায় ৩০০ টাকার এক বিল আমার নিকট প্রেরণ করেন!!! ইহাতে কাহারও দোষ দিতেছি না বা কুসমালোচনাও করিতেছি না, কিন্তু পাশ্চাত্য অর্থবল ও লোকবল না হইলে যে আমাদের কল্যাণ অসম্ভব ইহারই পোষণ করিতেছি৷
ইতি সং
চিরকৃতজ্ঞ ও সদা প্রভুসন্নিধানে
ভবৎকল্যাণ-কামনাকারী
বিবেকানন্দ৷
চিঠিখানিতে স্বামীজির সৌজন্য, বদান্যতা এবং ভারতীয়তা ছত্রে ছত্রে উচ্চারিত৷ চিঠির শেষ স্তবকে স্বামীজিকে অভ্যর্থনা করা এবং তার ব্যয় নির্বাহের জন্য স্বামীজির কাছেই উদ্যোক্তাদের তিনশো টাকার বিল পাঠানোর (!!!) প্রসঙ্গ পাঠ করে একালের পাঠক চমকিত হবেন৷ এ বিষয়ে একটি তথ্য নিবেদন করি৷ আমেরিকা থেকে ফেরার পর স্বামীজির একটি প্রকাশ্য সংবর্ধনা শোভাবাজার রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়— তা আগেই উল্লিখিত হয়েছে৷ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন বিজয়কৃষ্ণ দেব৷ এর কিছুদিন পরেই স্টার থিয়েটারে পরবর্তী সংবর্ধনাটি অনুষ্ঠিত হয়৷ স্বামীজির প্রচলিত জীবনীগুলিতে এর উল্লেখ থাকলেও কোন তারিখে এটি অনুষ্ঠিত হয়— সে বিষয়ে সম্যক জানানো হযনি৷ এ-বিষয়ে ‘ভারতী’-সম্পাদিকা আমাদের জানিয়েছেন যে তেসরা মার্চ ১৮৯৭ তারিখে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় একটি পোস্টার সাঁটানো হয়— তাতে বিজ্ঞাপিত হয় যে ৪ মার্চ (পরদিন) স্টার থিয়েটারে এই সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হবে৷ সরলা দেবীরা এই সংবাদে উৎফুল্ল হন যে সেখানে তাঁদের পক্ষে স্বামীজিদর্শন সম্ভবপর হবে৷ নানা কারণে সেই ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়নি৷
যাঁরা এই সংবর্ধনার আয়োজন করেন তাঁরা টিকিট বিক্রি করেন অনুষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের জন্য এবং স্বামীজি এখানে ‘সর্বাবয়ব বেদান্ত’ শীর্ষক একটি বক্তৃতা করেন৷ তবুও অনুষ্ঠানের ব্যয় সংকুলান না হওয়ায় উদ্যোক্তারা স্বামীজিকেই এই টাকাটি দেওয়ার জন্য ‘বিল’ করে পাঠান৷ এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা এদেশে ঘটেছিল জেনে আমরাও যুগপৎ দুঃখিত এবং লজ্জিত অনুভব করছি এতদিন পরেও৷ একজন সম্বলহীন সন্ন্যাসীকে ‘সংবর্ধনা’র নামে এতবড় অপমান করা হয়েছিল৷ স্বামীজির ধৈর্য্য, তিতিক্ষা এবং উদারতা এর পরের চিঠিতে আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ সেখানে আমরা লক্ষ করব তিনি এই প্রসঙ্গের প্রকাশ্য আলোচনা যুক্তিযুক্ত মনে করেন না বলেই তা বিস্তরিত করে সরলা দেবীকে জানাতে চাননি৷ অনুমান করি স্বামজির ৬ এপ্রিল তারিখের চিঠি পেয়ে সরলা দেবী তাঁকে একটি উত্তর দেন৷ সেই চিঠির কোনও হদিশ আমরা পাইনি— বস্তুত সরলা দেবীর স্বামীজিকে লেখা কোনও চিঠিই আমাদের হস্তগত হয়নি৷ স্বভাবতই ‘ভারতী’তে প্রকাশিত বিবেকানন্দ প্রসঙ্গগুলিই আমাদের আলোচনায় ব্যবহার করতে হয়েছে৷ সদ্য আমেরিকা-প্রত্যাগত একজন বীর সন্ন্যাসী সম্পর্কে চৈত্র ১৩০৩ (১৮৯৭) সংখ্যায় শোভাবাজার সংবর্ধনা প্রত্যাগত জনৈক ব্যক্তির মুখে সেই সভায় স্বামীজি-প্রদত্ত বক্তৃতার কথা তাঁরা ‘মুগ্ধ হইয়া শুনিতে’ পেয়েছিলেন৷ সেই ‘A fine strong built fellow’ সম্পর্কে এই নিবন্ধের শেষে, সরলা দেবী লিখেছিলেন—
“অর্দ্ধশতাব্দী পূর্ব্বে একবার বলিষ্ঠ রামমোহন রায় আসিয়া অনেকটা অজ্ঞান ও বামাচার এদেশ হইতে দূরীভূত করিয়াছিলেন৷ তাহার পর কেশবচন্দ্র সেন আর একবার এদেশে স্বাস্থ্যকর পবনের হিল্লোল করিয়াছিলেন৷ এখন বিবেকানন্দ স্বামী সমাগত৷ এখনও দেশে বহু আবর্জ্জনা স্তূপীকৃত রহিয়াছে, বিবেকানন্দের ন্যায় বীর কি শুধু তাহার দূষ্যতা সম্বন্দ্যে (য) মন্তব্য প্রকাশ করিয়া স্থির থাকিবেন? তাহার সংস্কারে নিজেকে নিযুক্ত করিবেন না?
এর পরেই তিনি এই নিবন্ধের সূচনায় প্রদত্ত উদ্ধৃতাংশটি মন্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেন৷ স্বামীজির সামার্থ্যের প্রতি নির্ভরতা এবং আধ্যাত্মিকতা নয় স্বদেশহিতৈষণায় তাঁর অনিবার্য পালনীয় ভূমিকার কথাই প্রত্যাশাস্বরূপ বিবৃত হয়েছে৷ অতপর আমরা সরলা দেবীকে লেখা পরের চিঠি ২৪ এপ্রিল তারিখে লিখিত— উদ্ধার করছি:
Darjeeling
C/o. M.N. Banejey, Esq.
24th April 1897
মহাশয়াষু—
আপনার সহানুভূতির জন্য হৃদয়ের সহিত আপনাকে ধন্যবাদ দিতেছি, কিন্তু নানা কারণবশতঃ এ সম্বন্ধে আপাততঃ প্রকাশ্য আলোচনা যুক্তিযুক্ত মনে করি না৷ তন্মধ্যে প্রধান কারণ এই যে, যে টাকা আমার নিকট চাওয়া হয় তাহা ইংলণ্ড হইতে আমার সমভিব্যাহারী ইংরেজ বন্ধুদিগের আহ্বানের নিত্তিই অধিকাংশ খরচ হইয়াছিল৷ অতএব এ কথা প্রকাশ করিলে, যে অপযশের ভয় আপনি করেন তাহাই হইবে৷ দ্বিতীয়তঃ তাঁহারা, আমি উক্ত টাকা দিতে অপারক হওয়ায় আপনা আপনি মধ্যে উহা সারিয়া লইয়াছেন শুনেতেছি৷
আপনি কার্য্যপ্রণালীসম্বন্ধে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন— তদ্বিষয়ে প্রথম বক্তব্য এই যে, “ফলানুমেয়াঃ প্রারম্ভাই” হওয়া উচিত, তবে আমার অতি প্রিয়বন্ধু মিঃ মূলরের প্রমুখাৎ আপনার উদারবুদ্ধি স্বদেশবাৎসল্য ও দৃঢ় অধ্যবসায়ের অনেক কথা শুনিযাছি এবং আপনার বিদূষীত্বের প্রমাণ প্রত্যক্ষ৷ অতএব আপনি যে আমার ক্ষুদ্র জীবনের অতি ক্ষুদ্র চেষ্টার কথা জানিতে ইচ্ছা করেন তাহা পরম সৌভাগ্য মনে করিয়া, অত্র ক্ষুদ্র পত্রে যথাসম্ভব নিবেদন করিলাম৷ কিন্তু প্রথমতঃ আপনার বিচারের জন্য আমার অনুভবসিদ্ধ সিদ্ধান্ত ভবৎসন্নিধানে উপস্থিত করিতেছি; আমরা চিরকাল পরাধীন, অর্থাৎ এ ভারতভূমে সাধারণ মানবের আত্মস্বত্ব বুদ্ধি কখনও উদ্দীপিত হইতে দেওয়া হয় নাই৷ পাশ্চাত্যভূমি আজ কয়েক শতাব্দী ধরিয়া দ্রুতপদে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হইতেছে৷ এ ভারতে কৌলীন্য প্রথা হইতে ভোজ্যাভোজ্য পর্য্যন্ত সমস্ত বিষয় রাজাই নির্দ্ধারণ করিতেন৷ পাশ্চাত্যদেশে সমস্তই প্রজারা আপনারা করেন৷
এক্ষণে রাজা সামাজিক কোনও বিষয়ে হাত দেন না, অথচ ভারতীয় জনমানবের আত্মনির্ভর ত দূরে থাকুক আত্মপ্রত্যয় পর্য্যন্ত এখনও অনুমাত্রও হয় নাই৷ যে আত্মপ্রত্যয় বেদান্তের ভিত্তি তাহা এখনও ব্যবহারিক অবস্থায় কিছুমাত্রও পরিণত হয় নাই৷ এই জন্যই পাশ্চাত্য প্রণালী অর্থাৎ প্রথমতঃ উদ্দিষ্ট বিষয়ের আন্দোলন, পরে সকলে মিলিয়া কর্তব্য সাধন এ দেশে এখনও ফলদায়ক হয় না, এই জন্যই আমরা বিজাতীয় রাজার অধীনে এত অধিক স্থিতিশীল বলিয়া প্রতীত হই৷ এ কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে সাধারণে আন্দোলনের দ্বারা কোনও মহৎ কার্য্য করার চেষ্টা বৃথা, “মাথা নেই তার মাথা ব্যথা”— সাধারণ কোথা? তাহার উপর আমরা এতই বীর্য্যহীন যে কোনও বিষয়ের আন্দোলন করিতে গেলে তাহাতেই আমাদের বল নিঃশেষিত হয়, কার্য্যের জন্য কিছুমাত্রও বাকি থাকে না৷ এজন্যই বোধ হয় আমরা প্রায়ই বঙ্গভূমে “বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া” প্রত্যক্ষ করি৷ দ্বিতীয়তঃ যে প্রকার পূর্ব্বেই লিখিয়াছি— ভারতবর্ষের ধনীদিগের নিকট কোনও আশা করি না৷ যাহাদের উপর আশা, অর্থাৎ যুবক সম্প্রদায়— ধীর স্থির অথচ নিঃশব্দে তাহাদিগের মধ্যে কার্য্য করাই ভাল৷ এক্ষণে কার্য্য;–“আধুনিক সভ্যতা”— পাশ্চাত্য দেশের—ও “প্রাচীন সভ্যতা”— ভারত মিসর রোমকাদি দেশের— মধ্যে সেই দিন হইতে শিক্ষা সভ্যতা প্রভৃতি উচ্চজাতি হইতে ক্রমশঃ নিম্নজাতিদিগের মধ্যে প্রসারিত হইতে লাগিল৷ প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, যে জাতির মধ্যে জনসাধারণের ভিতর বিদ্যাবুদ্ধি যত পরিমাণে প্রচারিত সে জাতি তত পরিমণে উন্নত৷ ভারতবর্ষের যে সর্ব্বনাশ হইয়াছে তাহার মূল কারণ ঐটি, দেসীয় সমগ্র বিদ্যাবুদ্ধি এক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে রাজ্যশাসন ও দম্ভবলে আবদ্ধ করা৷ যদি পুনরায় আমাদিগকে উঠিতে হয় তাহা হইলে ঐ পথ ধরিযা অর্থাৎ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্যার প্রচার করিযা৷ আজ অর্দ্ধশতাব্দী ধরিয়া সমাজ সংস্কারের ধূম উঠিয়াছে৷ ১০ বৎসর যাবৎ ভারতের নানা স্থল বিচরণ করিযা দেখিলাম সমাজ সংস্কারক সভায় দেশ পরিপূর্ণ৷ কিন্তু যাহাদের রুধিরশোষণের দ্বারা “ভদ্রলোক’’ নামে প্রথিত ব্যক্তিরা “ভদ্রলোক” হইয়াছেন এবং রহিতেছেন, তাহাদের জন্য একটি সভাও দেখিলাম না! মুসলমান কয়জন সিপাহি আনিয়াছিল? ইংরাজ কয়জন আছে? ৬ টাকার জন্য নিজের পিতা, ভ্রাতার গলা কাটিতে পারে এমন লক্ষ লক্ষ লোক ভারত ছাড়া কোথাও পাওয়া যায? ৭০০ বৎসর মুসলমান রাজত্বে ৬ কোটি মুসলমান, ১০০ বৎসর খ্রীশ্চান রাজত্বে ২০ লক্ষ ক্রিশ্চিয়ান্— কেন এমন হয়? Originality একেবারে দেশকে কেন ত্যাগ করিয়াছে?আমাদের দক্ষ হস্ত শিল্পী কেন ইউরোপীয়দের সহিত সমকক্ষতা করিতে না পারিযা দিন দিন উৎসন্ন যাইতেছে? কি বলেই বা জর্ম্মান্ শ্রমজীবী ইংরাজ শ্রমজীবীর বহুশতাব্দপ্রোথিত দৃঢ় আসন টলমলায়মান করিয়া তুলিয়াছে?
কেবল শিক্ষা শিক্ষা শিক্ষা৷ ইউরোপে বহুনগর পর্য্যটন করিয়া তাহাদের চরিত্রেরও সুখস্বচ্ছন্দ ও বিদ্যা দেখিয়া আমদের গরিবদের কথা মনে পড়িয়া অশ্রজল বিসর্জ্জন করিতাম৷ কেন এ পার্থক্য হইল?–শিক্ষা, জবাব পাইলাম৷— শিক্ষাবলে আত্মপ্রত্যয়, আত্মপ্রত্যয়বলে অন্তর্নিহিত ব্রহ্ম জাগিয়া উঠিতেচেন, আর আমাদের ক্রমেই তিনি সংকুচিত হচ্চেন৷ নিউইয়র্কে দেখিতাম Irish Colonists আসিতেছে—ইংরাজ-পদ-নিপীড়িত, বিগতশ্রী, হৃতসর্ব্বস্ব, মহাদরিদ্র, মহামূর্খ— সম্বল একটি লাঠি ও তার অগ্রবিলম্বিত একটি ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটুলি৷ তার চলন সভয়, তার চাউনি সভয়৷ ছ’মাস পরে আর এক দৃশ্য— সে সোজা হয়ে চলছে, তার বেশভূষা বদলে গেছে, তার চাউনিতে তার চলনে আর সে ভয় ভাব নাই! কেন এমন হল? আমার বেদান্ত বলছেন যে ঐ Irishman-কে তাহার স্বদেশে চারিদিকে ঘৃণার মধ্যে রাখা হয়েছিল— সমস্ত প্রকৃতি এক বাক্যে বলছিল “Pat তোর আশা নাই, তুই জন্মেছিস গোলাম্, থাক্বি গোলাম্’”— আজন্ম শুনিতে শুনিতে Pat-এর তাই বিশ্বাস হল, নিজেকে Pat hypnotize কর্লে যে সে অতি নীচ, তার ব্রহ্ম সংকুচিত হয়ে গেল৷ আর আমেরিকায় নামিবামাত্র চারিদিক থেকে ধ্বনি উঠিল—“Pat তুইও মানুষ আমরাও মানুষ, মানুষেই ত সব করেছে, তোর আমার মত মানুষ সব কর্ত্তে পারে, বুকে সাহস বাঁধ”,– Pat ঘাড় তুল্লে, দেখ্লে ঠিক কথাইত, ভিতরের ব্রহ্ম জেগে উঠলেন, স্বয়ং প্রকৃতি যেন বল্লেন, “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত?’”
ঐ প্রকার আমাদের বালকদের যে বিদ্যা শিক্ষা হচ্চে তাও একান্ত অনস্তিভাবপূর্ণ (negative)৷ স্কুলবালক কিছুই শিখে না কেবল সব ভেঙ্গে চুরে যায়,– ফল “শ্রদ্ধাহীনত্ব’”৷ যে শ্রদ্ধা বেদান্তের মূলমন্ত্র, যে শ্রদ্ধা নচিকেতাকে যমের মুখে যাইয়া প্রশ্ন করিতে সাহসী করিয়াছিল, যে শ্রদ্ধাবলে এই জগৎ চলিতেছে সে ”শ্রদ্ধার” লোপ৷ … বিবেকানন্দ স্বামীর এই যে প্রচণ্ড বিশ্বাস যে দেশীয় নারী য়ুরোপে গিয়া বাগ্মিতা সহকারে এদেশের ধর্ম্ম প্রচার করিলে দেশের মহদুপকার হইবে— তাঁর এই বিশ্বাসে ও উদ্বোধন বাক্যে প্রবুব্ধ হইয়া তদনুরূপ কার্য্য করা আমার পক্ষে সম্ভাবিত ছিল না৷ অযোগ্যতাই তাহার মুখ্য কারণ৷ কিন্তু আমার অপেক্ষা যোগ্যতরা কোন হিন্দু মহিলা কোন দিন এই ইঙ্গিত গ্রহণ করিয়া কৃতকৃত্য হইবেন, স্বদেশে বিদেশে মাতৃভূমির নাম গৌরবান্বিত করিয়া তুলিবেন—এ কল্পনা দূরপরাহত নয় এই আশা করি৷ ভাঃ সং
নিরামিষ ভোজন সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই— প্রথমতঃ আমার গুরু নিরামিষাশী ছিলেন, তবে দেবীর প্রসাদ মাংস কেহ দিলে অঙ্গুলি দ্বারা মস্তকে স্পর্শ করিতেন৷ জীবহত্যা পাপ তাহাতে আর সন্দেহও নাই, তবে যত দিন রাসায়নিক উন্নতির দ্বারা উদ্ভিজ্জাদি মনুষ্যশরীরের উপযোগী খাদ্য না হয়, তত দিন মাংস ভোজন ভিন্ন উপায় নাই৷ মহারাজা অশোক তরবারির দ্বারা দশ বিশ লক্ষ জানোয়ারের প্রাণ বাঁচাইলেন বটে, কিন্তু ১০০০ বৎসরের দাসত্ব কি তদাপেক্ষা আরও ভয়ানক নহে? দু-দশটা ছাগলের প্রাণনাশ বা আমার স্ত্রী-কন্যার মর্য্যাদা রাখিতে অক্ষমতা ও আমার বালক বালিকার মুখের গ্রাস পরের হাত হতে রক্ষা করিতে অক্ষমতা ও কয়টির মধ্যে কোন্টি অধিকতর পাপ? যাঁহারা উচ্চশ্রেণীর এবং শারীরিক পরিশ্রম করিয়া অন্ন সংগ্রহ করেন না তাঁহারা বরং না খান, যাহাদের দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করিতে হইবে বলপূর্ব্বক তাহাদিগকে নিরামিষাশী করা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা বিলুপ্তির অন্যতম কারণ৷ উত্তম পুষ্টিকর খাদ্য কি করিতে পারে জাপান তাহার নিদর্শন৷ সর্ব্বশক্তিমতি বিশ্বেশ্বরী আপনার হৃদয়ে অবতীর্ণা হউন৷
ইতি—
বিবেকানন্দ৷
স্বামীজি লিখিত এই চিঠির দৈর্ঘ্য (যদিও সংক্ষেপিত) স্বভাবতই প্রমাণ করে স্বামীজি সরলা দেবীর চিঠির যথোচিত গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং তাঁর উত্তরের মধ্যে তাঁর দৃঢ়তা ও ভবিষ্যৎদর্শন প্রসারিত আছে৷ নিরামিষ-আমিষ ভোজনের উপকারিতা-অপকারিতার মতো প্রসঙ্গও এখানে আলোচিত হয়েছে৷ চিঠিটি প্রকাশ করার সময় সম্পাদিকা পদটীকায় একটি মন্তব্য সংযোজন করেছেন৷ এর পশ্চাৎপটটিও প্রকাশযোগ্য৷ স্বামীজি সরলা দেবীর মধ্যে এমনই একটি সামর্থ্য নিহিত দেখতে পেয়েছিলেন যার জন্যে তিনি সরলা দেবীকে ভারতের গণ্ডির বাইরে নিয়ে গিয়ে বিদেশে ভারতীয় ধর্মের প্রচারে তাঁকে অভিযাত্রিণী করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন৷ পারিবারিক রক্ষণশীলতা ও অন্যান্য কারণে সরলা দেবীর পক্ষে স্বামীজির এই নির্ভরতাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি— কিন্তু স্বামীজির আদর্শ ক্রমশ তাঁকে গ্রাস করে চলেছিল সন্দেহ নেই৷ এবারে আমরা স্বামীজির তৃতীয় পত্রটির কিছু অংশ এখানে উদ্ধার করছি:
বেলুড়মঠ৷
১৬ই এপ্রিল ১৮৯৯৷
মহাশয়াষু—
আপনার পত্রে সাতিশয় আনন্দ লাভ করিলাম৷ যদি আমার বা আমার গুরুভ্রাতাদিগের কোনও একটি বিশেষ আদরের বস্তু ত্যাগ করিলে, অনেক শুদ্ধসত্ব এবং যথার্থ স্বদেশাহিতৈষী মহাত্মা আমাদের কার্য্যে সহায় হন তাহা হইলে সে ত্যাগে আমাদের মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হইবে না বা এক ফোঁটাও চক্ষের জল পড়িবে না জানিবেন এবং কার্য্যকালে দেখিবেন৷ তবে এতদিন কাহাকেও ত দেখি নাই সে প্রকার সহায়তায় অগ্রসর৷ দু-একজন আমাদের Hobby-র জায়গায় তাঁহাদের Hobby বসাইতে চাহিয়াছেন৷ এই পর্য্যন্ত৷ যদি যথার্থ স্বদেশের বা মনুষ্যকুলের কল্যাণ হয়, শ্রীগুরুর পূজা ছাড়া কি কথা, কোনও উৎকট পাপ করিয়া খৃষ্টীয়ানদের অনন্ত নরক ভোগ করিতেও প্রস্তুত আছি জানিবেন৷ তবে মানুষ দেখ্তে দেখ্তে বৃদ্ধ হতে চলিলাম৷ এ সংসার বড়ই কঠিন স্থান৷ গ্রীক্ দার্শনিকের লান্টান হাতে করিয়া অনেক দিন হইতেই বেড়াইতেছি৷ আমার গুরুঠাকুর সর্ব্বদা একটি বাউলে গান গাইতেন৷ সেইটি মনে পড়ল৷
“মনের মানুষ হয় যে জনা
নয়নে তার যায় গো জানা
সে দু এক জনা
সে রসের মানুষ উজান পথে করে আনাগোনা’’
এইত গেল আমার তরফ থেকে৷ এর একটিও অতিরঞ্জিত নয় জানিবেন এবং কার্য্যকালে দেখিবেন৷
তারপর যে সকল দেশহিতৈষী মহাত্মা গুরুপূজাটি ছাড়লেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন, তাঁদের সম্বন্ধেও আমার এইটুকু খুঁৎ আছে৷ বলি এত দেশের জন্য বুক ধড়ফড়, কলিজা ছেঁড় ছেঁড়, প্রাণ যায় যায়, কণ্ঠে ঘড় ঘড় ইত্যাদি— আর একটি ঠাকুরেই সব বন্ধ করে দিলে?
এই যে প্রবল তরঙ্গশালিনী নদী যার বেগে পাহাড় পর্ব্বত ভেসে যেন যায় একটি ঠাকুরে একেবারে হিমালয়ে ফিরিয়ে দিলে! বলি ওরকম দেশহিতৈষিতাতে কি বড় কাজ হবে মনে করেন, বা ওরকম সহায়তায় বড় বিশেষ উপকার হতে পারে? আপনারা জানেন, আমিত কিছুই বুঝতে পারি না৷ তৃষ্ণার্ত্তের এত জলের বিচার, ক্ষুধায় মৃতপ্রায়ের এত অন্নবিচার এত নাক সিঁটকান? কে জানে কার কি মতি গতি৷ আমার যেন মনে হয় ও সব লোক গ্লাসকেশের ভিতর ভাল, কাজের সময় যত ওরা পিছনে থাকে ততই কল্যাণ৷
প্রীত্ না মানে জাত্ কুজাত্
ভুখ্ না মানে বাসি ভাত্৷
আমিত এই জানি৷ তবে আমার সব ভুল হতে পারে, ঠাকুরের আঁটিটি গলায় আট্কে যদি সব মারা যায় তা না হয় আঁটিটি ছাড়িয়ে দেওয়া যায়৷
যাহা হউক এ সম্বন্ধে আপনাদের সঙ্গে অনেক কথা কহিবার অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষা রহিল৷
এ সকল কথা কহিবার জন্য রোগ শোক মৃত্যু সকলেই আমায় এ পর্য্যন্ত সময় দিয়াছেন, বিশ্বাস এখনও দিবেন৷
এই নববর্ষে আপনার সমস্ত কামনা পূর্ণ হউক৷
কিমধিকমিতি৷
বিবেকানন্দ৷
পাঠক অনুমানই করতে পারছেন— প্রথম দুটি চিঠি খুবই পরপর লেখা হয়েছিল— তৃতীয় চিঠিটি তাদের প্রায় দু’বছর পরে লেখা৷ তৃতীয় চিঠিটি আকারে ছোট কিন্তু অবশ্যই আন্তরিক৷ বিতর্কের পরিবর্তে আত্মবিশ্বাস এখানে বহুল পরিমাণে উচ্চারিত৷
এই তিনটি চিঠিই ‘ভারতী’-র ভাদ্র ১৩০৯ সংখ্যায় স্বামীজির প্রয়াণের অব্যবহিত পরেই প্রকাশিত হয়৷ প্রকাশের আগে সম্পাদিকা যে মন্তব্য করেছিলেন, তা আমরা এখানে উদ্ধার করেছি৷ এখানে জানতে পারা যায় সরলা দেবীর সঙ্গে স্বামীজির পত্রালাপের সংখ্যা আরও বেশি ছিল৷ সেগুলি কোথায় গেল?
…ছয় বৎসর পূর্ব্বে য়ুরোপ ও আমেরিকায় কীর্ত্তিমান্ স্বামী বিবেকানন্দ যখন বঙ্গদেশে পদার্পণ করেন, তখন তাঁহার সম্বন্ধে “ভারতী’’তে আলোচনা হয়৷ সেই আলোচনা উপলক্ষে বর্ত্তমান ভারতী-সম্পাদিকার সহিত তাঁহার কিছু পত্র ব্যবহার হইয়াছিল৷ নিম্নে আমরা তাহার মধ্যে তিনখানি পত্র প্রকাশ করিতেছি৷ ভূমিকায় পাঠক-সাধারণকে একটি কথা বলা আবশ্যক৷ নিম্ন-প্রকাশ্য পত্রাবলীতে ভারতী-সম্পাদিকা সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অত্যুক্তিগুলি পরিহার পূর্ব্বক গ্রহণ করিবেন৷ যাহা সৌজন্যমূলক ও স্পষ্ট অতিরঞ্জন, এবং প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিবিশেষ, নহে, কিন্তু শ্রেণীবিশেষই যাহার লক্ষ্য সে সম্বন্ধে অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন৷ এই পত্রগুলির মধ্যে যে উচ্চ সংকল্প, যে স্বদেশপ্রেম, যে তেজঃপুঞ্জ সমাহিত রহিয়াছে তাঁহার গুরুভ্রাতাগণ তাহা অনুধাবন করিয়া তাঁহাদের নেতৃপুরুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষঙা কার্য্যে পরিণত করিতে যত্নবান্ হইবেন এই আশা করা যায়৷…
এখানে ‘ছয় বৎসর পূর্ব্বে’ যে আলোচনাটির কথা বলা হয়েছে— তা চৈত্র ১৩০৩ সংখ্যার ‘ভারতী’তে প্রকাশিত হয় সেকথা আমরা বলে এসেছি৷ উল্লিখিত চিঠিগুলি প্রকাশের পর ‘ভারতী’ বৈশাখ ১৩১২ সংখ্যায় সরলা দেবী ‘আমার বাল্যজীবনী’ নামে একটি ক্ষুদ্র রচনা প্রকাশ করেন৷ সেখানে তিনি স্বামীজির প্রতি তাঁর নির্ভরতা দ্ব্যর্থ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন—
স্বামীজির চিঠিগুলি ‘ভারতী’র যে সংখ্যায় সরলা দেবী প্রকাশ করেছিলেন তার শিরোনাম ছিল ‘স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন’৷ স্বামীজির প্রয়াণে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মিশনের কী পরিণতি হবে সরলা দেবীকে তা ভাবিয়ে তুলেছিল৷ তিনি শঙ্কিত হয়ে ‘মঠ’বাসী পুরুষগণের উপর— অনেক ভরসা’ রেখেও নিবেদিতার নামোচ্চরণ না করেও তাঁর সঙ্গে মঠ-এর সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতাজনিত মঠের কর্মোদ্যোগে শিথিলতা লক্ষ করেছিলেন৷ তাঁর মতে একজন ইংরেজললনার উৎসাহে ও উত্তেজনায় রামকৃষ্ণ মিশনের দুই-একজন সন্ন্যাসী প্লেগের সময় অনেক প্রকৃত কাজ করেছিলেন৷ নিবেদিতা পুনর্বার ফিরে এলেও ‘রামকৃষ্ণ সন্ন্যাসী’দের তাঁর পাশে দেখতে না পেয়ে সরলা দেবী কিছুটা আশাহত হয়তো৷ তবুও ‘বিদেশীয়া রমণীর অঞ্চল’ না ধরে মিশনকে ‘নিজের পুরুষাকারে’ নির্ভর করে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় গ্রামে গ্রামে মৌমাছিদের চাকের মতো আচ্ছন্ন হয়ে কর্মব্রতে উদ্দীপ্ত হওয়ার জন্য তিনি আ্হ্বান জানিয়েছিলেন৷ হয়তো কিছুটা অসহিষ্ণু মন্তব্যও করেছিলেন—‘মঠধারী ও তাঁহার অনুচরগণ যদি এখনও কূর্ম্মের ন্যায় নিজেদের আত্মশরীরে লুপ্ত ও গুপ্ত রাখেন— কর্ম্মীর অপ্রতিহত তেজে বাহির হইয়া না আসেন, তবে এই হতভাগ্য দেশকে ধিক্’৷
‘নিবেদিতা লোকমাতা’ গ্রন্থের গ্রন্থকার অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় শঙ্করীপ্রসাদ বসু প্রথম খণ্ডে (পঞ্চম মুদ্রণ মাঘ ১৪০৬) ২২২ পৃষ্ঠায় এই প্রসঙ্গতি উল্লেখ করে লিখেছেন—‘সেই নিবেদিতা যখন সংঘের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করলেন, তখন বেলুড়মঠের সর্বনাশের কল্পনার আনন্দে শিহরিত হলেন বহু জনই৷ কী বীভৎস উল্লাস ঘটেচিল সরলা দেবীর ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় রচনায়, তার পূর্ণরূপ আমরা সরলা দেবী প্রসঙ্গে উত্থাপিত করব৷ যে কোনও কারণেই হোক, অধ্যাপক বসু এই খণ্ডে বা পরের খণ্ডে এমনতর ‘পূর্ণ’রূপ’ আমাদের দেননি৷ সম্ভবত, তাঁরও মনে দ্বিধা দেখা দিযেছিল— সরলা দেবীর মন্তব্যে ‘বীভৎস উল্লাস’ আশ্রিত ছিল কিনা! আমাদের মনে হয়েছে এখন এর পুনর্বিচার করার সময় হয়েছে৷ আমাদের হাতের কাছে সরলা দেবীর আত্মস্মৃতি ‘জীবনের ঝরাপাতা’ রয়েছে৷ এর ‘বাইশ’ অধ্যায়টি আমরা সমগ্রত উদ্ধার করছি এই পুনর্বচিারের উপকরণ হিসাবে৷ দীর্ঘ উদ্ধৃতি না বলে সরলা দেবীর জীবনে স্বামীজির অবস্থানের দলিল হিসেবেই এটি গ্রহণযোগ্য৷
৷৷বাইশ৷৷
ভারতী সম্পাদনসূত্রে অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানে প্রবেশ
অনেক দিক থেকে অনেক জলধারা এসে একটি স্রোতস্বতীকে ভরে তুলে৷ স্বামী বিবেকানন্দের সংস্পর্শে আমার জীবননদী আর একটা ভাবের ধারায় ভরাট হল৷ ভারতীয় সম্পাদনসূত্রে কত অজানা লোকের সংস্পর্শে এসেছিলুম, তার মধ্যে স্বদেশে বিদেশে এক নবযুগের প্রবর্তক স্বামী বিবেকানন্দ আমারও অন্তরের উপাদানে এক নতুন তত্ত্বের সমাবেশ করলেন— সেটি হচ্ছে আধ্যাত্মিক জীবনের আকাঙ্ক্ষা৷ অনেকে অনেক কিছু মনে করত স্বামী বিবেকানন্দকে৷…
… স্বামীজী নিবেদিতাকে বলেছিলেন, “সরলার education perfect৷’’ আমার রচনায় যে আত্ম-অভিব্যক্তি পেয়েছিলেন, সে ভারতীয় আত্মা— ইংলণ্ডীয় নয়, ফরাসীয় নয়৷ ভারতীয় সভ্যতার বীজ তাতে নিহিত দেখেছিলেন৷ তাই ‘ভারতী’তে তাঁর সম্বন্ধে আমার প্রথম লেখাটি পড়েই তাঁর কল্পনার চোখে সে বীজের ভিতর অঙ্কুরিত ও পল্লবিত বৃক্ষকে দেখতে পেয়েছিলেন৷ তাই তখনই তাঁর একান্ত উৎসাহ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল এই রকম ভারতীয় নারী, ভারতীয় বেশে বিদেশে গিয়ে ভারতীয় শিক্ষা প্রচার করুক৷ পরে আমাকে সাক্ষাতে দেখে শুনে, আমার কথা-বার্তায়, আমার লেখা গদ্যে পদ্যে সেই ভাব স্থায়ী হয়ে তাঁকে পেয়ে বসেছিল, আমাকে তাঁর সঙ্গে প্রচারকার্যে বিদেশে নিয়ে যাবার জন্য আগ্রহযুক্ত হয়েছিলেন৷ তাঁর আগ্রহের প্রাবল্যে আমার অপ্রস্তুততার মাত্রার প্রতি দৃষ্টি দেননি বোধহয়৷ নিবেদিতা একেবারে আনাকোরা পাশ্চাত্য মেয়ে ছিলেন, ভারতীয় ধর্ম সম্বন্ধে শিক্ষা-দীক্ষা তাঁকে একেবারেই ছিল না, তাঁকে যদি গড়ে তুলতে পেরে থাকেন তবে আমাকে প্রয়োজন মত গড়ে পিটে নেওয়া খুবই সহজসাধ্য এইটে অনুমান করেছিলেন বোধ হয়৷ নিবেদিতাকে যদি “কালীতত্ত্ব’’ বুঝিয়ে তাঁকে দিয়ে এলবার্ট হলে কালী সম্বন্ধে বক্তৃতা দেওয়ান সম্ভবপর হয়ে থাকে, তবে আমাকে বোঝান আরও সহজ হবার কথা৷ নিবেদিতার বক্তৃতা শুনে সায়ান্স এসোসিয়েশনের ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার ভীত হয়ে বলেছিলেন—“এতদিন কালো কালী ছিল— তাই রক্ষে, এ সাদা কালী এসে দাঁড়ালে দেশকে পৌত্তলিকতা থেকে আর বাঁচান যাবে না৷’’ স্বামী বিবেকানন্দ জানতেন আমি মহর্ষির দৌহিত্রী বটে, ব্রাহ্মভাবে মানুষ বটে, কালীদুর্গার বিদ্ভেষপুষ্ট ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব আমার উপর খুব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা বটে, এ সবই সত্য৷ কিন্তু তা হলেই বা? নরেন দত্তরূপে তিনি য়খন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের অনুগামী ছিলেন, তিন্যি কি তখন ব্রাহ্মভাবাপন্ন ছিলেন না? পরমহংসদেবের সংস্পর্শে এসে সাকার-নিরাকার-ভেদের পর্দা তাঁর জ্ঞানচক্ষু থেকে আস্তে আস্তে সরে যায় নি কি? আমারও যেতে বাধ্য৷ এই নিশ্চয়তায় প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি আমায় তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক হয়েছিলেন৷ এদিকে আমার এ বিষয়ে যে ততটা উৎসাহ হল না তার কারণ কতকগুলি চিরাগত তামসিক সংস্কারের বশে ও তার দরুন ভীরুতায়৷…
…খ্রীস্টীয় চিন্তাধারার টীকা নেওয়া ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে অকারবর্জিত নিরাকার ঈশ্বরের প্রণিধানের পক্ষপাতী হল৷কিন্তু পারলে কৈ? ঈশ্বরের চরণকল্পনা ব্যতিরেকে তাঁকে কল্পনা করা যায় না, তাঁর আঁখি কল্পনা ব্যতিরেকে দিবীব চক্ষুরাততং— আমাদের প্রতি তাঁর স্নেহমাখা নির্নিমেশ আঁখি দেখা যায় না— সে আঁখিতে আঁখি রাখা যায় না৷ কল্পনাতে তাঁকে ইন্দ্রিয়ময় রূপময় দেবমূর্তিতে দেখতে হয়, সাকার করতেই হয়৷ তা দোষের নয়, কেননা, খ্রীস্টানরাও তাই করেন৷ কিন্তু ছবিতে, মৃত্তিকায় বা প্রস্তরে আমার কাল্পনিক ভাবমূর্তিকে আকারযুক্ত করলেই Heathenism হল৷ নবযুগের খ্রীস্টান মিশনারির অঙ্কুশাঘাতে বিদ্ধ ভারতবর্ষ এই Heathenism-এর অপবাদ সহ্য করতে পারলে না৷ অথচ দেশের যুবকদের খ্রীস্টান হয়ে যাওয়াও সহ্য করতে পারলে না— তাতেও জাতীয় আত্মাভিমানে ঘা লাগে৷ তাই নিরাকার ব্রহ্মোপাসনার ঘোষণা হতে থাকল, তারই প্রচার ও প্রতিষ্ঠা চলল— দেশ থেকে প্রতিমা পূজা তুলে দেবার প্রচেষ্টা হল— না হলে যেন ‘অসভ্য’ ‘বর্বর’ আখ্যার যোগ্য হব আমরা৷ এই হল রামমোহনের বা ব্রাহ্মধর্মের যুগ৷ কিন্ত শীঘ্রই নবতর যুগ দেখা দিল— এবার নিরাকারের সঙ্গে সঙ্গে সাকারের যুক্তিপূর্ণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হল, কেননা এ যুক্তির যুগ৷ শুধু উপনিষদ নয়, হিন্দুর সকল ধর্মপুস্তক— সকল ‘scriptures’-গুলিই আবার সকলে ভাঁজতে লাগল, সেগুলি ঘেঁটে ঘেঁটে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল৷ দেখলে অমূল্য রত্নরাজিতে ভরা, বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার মত একেবারে নয়৷ অনেক ব্রাহ্মসমাজীরাও আবার ‘হিন্দু’ বলে নিজেদের পুনরাখ্যাত করলেন, সাধনার সহায়স্বরূপ গৃহে প্রতিমার পুনঃস্থাপনা করলেন৷ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যিনি ব্রাহ্মসমাজের একজন নেতা ছিলেন— দলভঙ্গ করে বেরিয়ে এলেন, দলে দলে ব্রাহ্মরাই তাঁর শিষ্য হলেন৷ তারপরে এলেন এক ‘dynamic personality’— স্বামী বিবেকানন্দ৷ ‘Dynamic’ সেই— যার ভিতরে বারুদের ধর্ম আছে, প্রচণ্ড তেজ, প্রচণ্ড ভাঙ্গাগড়ার শক্তি৷ সেই বারুদের আগুন থেকে একটা স্ফুলিঙ্গ আমার ভিতরে এসে পড়েছিল— আমায় ভেঙ্গে গড়ে তুলছিল৷ আমার আধ্যাত্মিক পিপাসা আমার শৈশবের গতানুগতিক ‘ব্রাহ্মধর্ম’ থেকে অনেক দূরের পথে নিয়ে চলছিল৷
অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন৷
(৩)
প্রসঙ্গত সরলা দেবীর স্বামীজি দর্শনেচ্ছা সম্পূর্ণ হয়েছিল অন্য একটি উপলক্ষে৷ সেসময়ে সবেমাত্র বেলুড় মঠে রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপিত হয়েছে৷ সরলা দেবী সেখানে এসে স্বামীজির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে উন্মুখ৷ কিন্তু বাড়ির রক্ষণশীলতা তাঁকে এই ‘অসমসাহসিক’ কাজে উৎসাহ দেয়নি৷ বাধ্য হয়ে তিনি সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়ে বাগবাজারে নৌকো ধরে জলপথে বেলুড়ে আসেন৷ এই যোগাযোগটি করে দিয়েছিলেন স্বয়ং নিবেদিতা৷ গঙ্গার পাড়ে একটা জায়গাকে কোনওক্রমে পরিষ্কার করে মাটি পিটিয়ে বসার উপযুক্ত করা হয়েছিল৷ সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বামী সারদানন্দও৷ স্বামী বিবেকানন্দ খুবই কম কথা বলছিলেন— উদাস দৃষ্টিতে গঙ্গার পার হয়ে তিনি যেন অন্য কোথাও লীন৷ বেশি কথা বলেছিলেন স্বামী সারদানন্দ৷ সেদিনের অনুভূতি সরলা দেবী যেন বর্ণনা করে উঠতে পারেননি৷ একাধিকবার দর্শনের জন্য তিনি পুনশ্চ সেখানে এসে স্বামীজির সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ করেছিলেন৷ স্বামীজি তখনই নিবেদিতাকে বলেন, সরলা দেবীকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে প্রচারের কাজে নিয়োগ করতে৷ পাগড়িবিহীন মুণ্ডিতমস্তক স্বামীজিকে দেখে বাহ্যত সরলা দেবী অভিভূত হয়েছিলেন৷ তাঁর মধ্যে তিনি ভবিষ্যৎ ভারতকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন৷
দর্শান্তে ফিরে এসে সরলা দেবী স্বামীজিকে পত্র-সহ ‘ভারতী’র বিশেষ একটি সংখ্যাও পাঠান, যেটিতে তাঁর ‘আহিতাগ্নিকা’ কবিতাটি মুদ্রিত হয়েছিল (ভারতী, আষাঢ় ১৩০৬)৷ এর প্রথম স্তবকটি ছিল নিম্নরূপ:
সর্ব্বদেব সাক্ষী করি এক ব্রত করিলে গ্রহণ!
পথ যে দুর্গম একায়ন৷
সুতীব্র দিবস আর সুদীর্ঘ শবরী,
অপ্রকম্প্যচিত্তে
সর্ব্ব ভয় পরিহরি
পারিবে কি যেতে?
সে সুখলালিতা!
দুরাশা-চালিতা!
স্বামীজির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবশত তাঁর সেবাধর্মে মনে মনে তিনি আকৃষ্ট হন৷ মায়াবতী আশ্রমে তিনি যান স্বামী স্বরূপানন্দের কাছে এবং গীতা-উপনিষদাদি অধ্যয়নে রত হন৷ তাঁর এই বৈরাগী অবস্থা লক্ষ করে তাঁর অভিভাবকেরা সরলা দেবীর বিবাহের জন্য উদ্যোগী হয়ে পড়েন৷ সরলা দেবী আকুমারী স্বামীজি-নিবেদিতা৷
শনিবারের চিঠি, জানুয়ারি ২0১৩
স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন উপলক্ষে রচনাটি পুনঃপ্রকাশিত হল