এখন ভোরবেলা। পৌনে ছটা। মাঠের শেষে হলুদ ফুলে ঢাকা সোঁদাল গাছের ডানদিকে নুয়ে পড়া ডালের ওপারে টুকটুকে লাল সূর্য। শিশু হনুমান কেন, আমারও সুখাদ্য মনে হয়। হালকা ঠাণ্ডা হাওয়ার একটা আমেজ। চৈত্র শেষের কদিন। আরেকটা বছর চুপিসারে কেটে পড়ল। পাওয়া, না পাওয়া। খানিক দেওয়া, কিছু নেওয়া। জীবন—কালিদা, এর নাম জীবন। সকালে হাঁটতে বেরিয়ে নিজের সঙ্গে অনেক অনেক কথা। নিজেকেও একটু পাত্তা দিতে হয়। নাহলে খুব চেনা একজন ভালো মানুষ অচেনাই রয়ে যাবে জীবনভোর।
গত বছর এমনই এক ভোরে ফোনে ডাক এসেছিল। দৌড় দৌড়। চেনাজানা লোক দিয়ে চটজলদি অনুমতি। বেনাপোল সীমান্তে বিশাল ডাবে চুমুক দিয়ে বিকেল চারটায় বৈঠক বনানী রেস্তোরাঁ। জানলার পাশে সম্রাজ্ঞীর মতো এলোচুলে বসেছিলো ইতি। বিকেলের নরম রোদ চিবুক ছুঁয়ে পিছলে যাচ্ছিল। একটা কফি। তারপর বনানী গেস্ট হাউস। পরের দুটো দিন ভোর থেকে সন্ধে ঢাকা শহরের তালাশনামা। ভালো থাকতে, সুখে থাকতে আর কতটুকু লাগে?
আমাদের বাংলা তো কর্কটক্রান্তি রেখার উপর নিচে। তাই উষ্ণপ্রধান। ফাগুনের মধুর বাতাস চৈত্রের শেষ থেকে আগুন বয়ে আনে। পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশের রমনা ময়দানে প্রাচীন বটগাছ ঘিরে বসে খাদ্যের আয়োজন। ইলিশ থাকে। তবে যে খাবার ছাড়া এই উৎসব পূর্ণতা পায় না তা হল পান্তাভাত।
নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ। যে নামেই ডাকুন, এই নামে উৎসব জড়িয়ে থাকে। বঙ্গাব্দ ঠিক কতটা পুরানো সেসব বিতর্কে আমরা যাবো না। তবে আকবর বাদশাহের বহু বছর আগে থেকেই এর চল। রাজা শশাঙ্কের সময়কার দুটি শিবমন্দিরে এই বাংলা ক্যালেন্ডার খোদিত রয়েছে। আসল কথায় চাষবাসের আর ফসল তোলার সঙ্গে তৎকালীন বাংলার মানুষের জনজীবন। সুতরাং রাজকরের জন্যেও ওই হিজরী সনের নিয়ম চলছিলো না। তাই মুর্শিদকুলি খানের আমলে নববর্ষের নবরূপে আগমন। তাই দোকানে বা ব্যবসায় আজও হালখাতা। পুরোনো যত আবর্জনা সরিয়ে নতুন চোখে জীবনের উদযাপন।
আমাদের বাংলা তো কর্কটক্রান্তি রেখার উপর নিচে। তাই উষ্ণপ্রধান। ফাগুনের মধুর বাতাস চৈত্রের শেষ থেকে আগুন বয়ে আনে। পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশের রমনা ময়দানে প্রাচীন বটগাছ ঘিরে বসে খাদ্যের আয়োজন। ইলিশ থাকে। তবে যে খাবার ছাড়া এই উৎসব পূর্ণতা পায় না তা হল পান্তাভাত।
স্নান সেরে তাঁতের পাঞ্জাবী পরনে আমি ধোপদুরস্ত। ইতি এল। সাদা লাল ঢাকাই জামদানী। সাক্ষাৎ ঈশ্বরী। কানের পিছনে একটু আতরের ছোঁয়া দিলাম। মিশরের মহার্ঘ্য সুগন্ধী। ফারাওভোগ্য। ইতির হাতখোঁপায় সুগন্ধী জুঁই। রিক্সাওয়ালার পরনেও আকাশ রঙা ফতুয়া। বলতে হল না। হালকা মেঘলা সকালে শন শন হাওয়া কেটে রিকশা চললো রমনা ময়দানের দিকে।
পান্তাভাতের জন্যে চাই মাটির হাঁড়ি। ঢেঁকিছাঁটা চালের একটু বেশি সেদ্ধ করা ভাত। নরম আঙুলের আলতো টিপুনি যেন সহ্য না হয়। আগের রাতের ভাত জল ঝরিয়ে ঠাণ্ডা হলে জল। ভাতের আগা থেকে এক কড়। একটা গন্ধরাজ লেবু ভাসিয়ে ঢাকনা চাপা। প্রেয়সীর সুখস্বপ্নে এক ঘুমে রাত কাবার। দুটো শুকনো লঙ্কা শুকনো কড়ায় সেঁকে গুঁড়ো করে হাঁড়িতে। এক চামচ কাসুন্দি, একটু নুন, সামান্য আদা আর কাঁচা লঙ্কা ছেঁচা আর বড় টুকরো পেঁয়াজ কয়েকটা। এক চামচ কাঠের ঘানির সরষে তেল। ব্যস। গন্ধরাজ লেবুর টুকরোগুলো নিঙড়ে নিন। চলে নীল শাড়ি নিঙ্গাড়ি নিঙ্গাড়ি পরাণ সহিত মোর —ওই রকম নিংড়ানো। ক্লাসিক পান্তাভাত তৈরি। সাদাকালো জমানা হোক বা থ্রি কোয়ার্টার জেন জি-এর অল টাইম হিট।
সঙ্গী হওয়ার জন্য আলুসেদ্ধ (জ্যোতি হলে বেশি ভালো, চন্দ্রমুখী আলু সেদ্ধ হলে যেন ক্যারেকটার থাকে না)। সরষে তেলে ভাজা পেঁয়াজ রসুন কুচি, শুকনো লঙ্কার কড়কড়ে ভাজা একটু নুন দিয়ে মেখে নিলেই ওয়াহ। রমনা ময়দানে ইলিশ থাকে উৎসবে। আমার পছন্দ কাচকি মাছের চচ্চড়ি। খুউব সহজ রান্না। পেঁয়াজকলি, বেগুন ছোট ছোট করে টুকরো। জুলিয়েন কাট আদা, রসুন কুচি, পেঁয়াজকুচি (মাঝারি মাপের)। ঝিরি ঝিরি কাটা কাঁচা লঙ্কা, ধনেপাতা, টম্যাটো আর দু ইঞ্চি মাপের কাঁচা আমের টুকরো। ভাজতে থাকুন। জিরে গুঁড়া, এক চিমটে ধনেগুঁড়ো, আমচুর, গুঁড়ো লঙ্কা এক চামচ। এক ইঞ্চি দারচিনি, চার পাঁচটা গোলমরিচ, দুটো লবঙ্গ থেঁতো করে। ভালো করে ধুয়ে, জল ঝরিয়ে বেছে রাখা কাচকি মাছ দিয়ে মিনিট পাঁচেক বেশি আঁচে নেড়েচেড়ে নিলেই জামাই আদর চচ্চড়ি। দেরি না করে সবাই গোল হয়ে মেঝেতে বসে শুরু করে দিন। ওড়িশার মানুষ পান্তাভাত টক দই দিয়ে খেতে ভালোবাসেন। তবে আমরা তো বাংলা নববর্ষ উদযাপন করছি। তাই না?
একটা ভুল হয়ে গেছে। একটা শরবত তো চাই শুরুতে। যা গরম! রাজনৈতিক নেতাদের মত একটা তরমুজ বেছে নিন। তিন চার টুকরো খোসাসমেত সরিয়ে রাখুন। বাকিটা টুকরো করে কেটে নিন। বীজগুলো বেছে ফেলুন। মিক্সিতে ঘুরিয়ে ছেঁকে নিন। গ্লাসে চিনির পাউডার, কারেন্ট নুন, খোসা সমেত লেবুর টুকরো আর তিন চার পাঁচটা পুদিনা পাতা। আমার স্পেশাল রেসিপি দু টুকরো কাঁচা লঙ্কা অথবা খুব সামান্য গোলমরিচের গুঁড়ো। কাঠের হামানদিস্তার বাঁট দিয়ে একটু পিষে নিন হালকা হাতে। বরফ কুচি আর তরমুজের রস। ওই সরিয়ে রাখা তরমুজের টুকরো দিয়ে সুসজ্জিত করে পরিবেশন। প্রতি চুমুকে স্বর্গীয় উল্লাস। কোথায় লাগে মশলা কোক!!
ইতির সঙ্গে এরপর গিয়েছিলাম ময়মনসিংহ। খুলনা। সাতক্ষীরার রাজাদিঘী। ওখানে আমার পূর্বপুরুষের ঠিকানা ছিল। হারিয়ে গেছে। যেমন হারিয়ে গেছে ইতি। অশান্ত বাংলাদেশ থেকে তার আর চিঠি আসেনা। ফোন আসেনা। এমন করে আমাদের নববর্ষ কি হারিয়ে যাবে একদিন? না না। কক্ষনো না। আমরা আছি তো। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল/পূণ্য হউক পূণ্য হউক….।।