নববর্ষের আবাহনে কবি বললেন, ‘এসো হে বৈশাখ এসো, এসো৷ তাপস নিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষেরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক৷’ বঙ্গাব্দের প্রারম্ভিক এই বৈশাখী উৎসবের বাঙালি নববর্ষ সাড়ম্বরে ১৪৩২ বছরে পদার্পণ করল৷ কোন সুদূর গৌড় সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ে যে বঙ্গাব্দের সূচনা তা আজও গাঙ্গেয় বঙ্গে বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত৷ ইতিহাসের উত্তাল অধ্যায়ে হিন্দু, বৌদ্ধ, তুর্কি অধিকারের পট পরিবর্তনের শেষে উদিত ইংরেজ রাজত্বেরও অবসান ঘটেছে, কিন্তু এই দীর্ঘকাল ধরে বঙ্গীয় জনজীবন কিন্তু পরিচালিত হয়েছে বঙ্গাব্দের তিথি নক্ষত্রের নির্দেশে৷
বাঙালি জীবনে বিশেষ করে হিন্দু বাঙালির জীবন কিন্তু এখনও বঙ্গাব্দের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত৷ দীর্ঘ বহিরাগত শাসনে, মুসলমান ও ইংরেজদের অধীনে প্রশাসনিক কাজকর্ম হয়েছে শাসকের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়কালেও বাঙালির জীবন আন্দোলিত হয়েছে, পূজাপার্বণ তথা উৎসব সবকিছু কিন্তু বঙ্গাব্দের বিধি অনুযায়ী৷ পয়লা বৈশাখে যার শুভ সূচনা, ঋতুচক্রের আবর্তনে সেটি এসে শেষ হয় বছর শেষের চড়ক-সংক্রান্তিতে৷
বিগত ১৪০০ বছরের অধিককাল ধরে বঙ্গজীবন এই বঙ্গাব্দ দ্বারা একান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত৷ দু’শো বছরের ইংরেজ শাসনে অফিস আদালত স্কুল ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চললেও অন্তঃসলিলা ব্যক্তিজীবন ও সমাজপার্বণ সবই নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে বঙ্গাব্দের তিথি অনুযায়ী৷ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ যেমন বাঙালি আপন করে নিয়েছে বর্ষের শুভারম্ভরূপে, তেমনি ভারতের অন্যান্য স্থানেও আছে তার সরব প্রতিধ্বনি৷ যেমন পাঞ্জাবে বৈশাখী, অসমে বিহু, মণিপুর শিলহেনবা, কেরলে বিষু৷ ইংরেজ রাজত্বের প্রভাবে যদিও পয়লা জানুয়ারি সাড়ম্বরে পালিত হয় সগর্জন Happy New Year দিয়ে কিন্তু সে হল শহরভিত্তিক কাজের নববর্ষ৷ কিন্তু পয়লা বৈশাখে পালিত হয় বাঙালির প্রাণের নববর্ষ, যার প্রভাব প্রান্তিক পল্লির লোকালয় অবধি সুবিস্তৃত৷
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের পর যখন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ধর্মীয় বিভাগ প্রবল হয়ে উঠল তখন দেবেন্দ্রনাথের ভায়েদের বাড়িতে পারিবারিক প্রাচীন ধারা অনুযায়ী দুর্গোৎসব হত, তখন মহর্ষি কলকাতা ত্যাগ করে পাহাড় ভ্রমণে যেতেন৷ কিন্তু মুশকিল হল, হিন্দু পুজোর উৎসবে যোগদান করতে না পেরে মহর্ষির পরিবারের ছেলেমেয়েরা ওইরকম একটি সর্বমিলনের উৎসবের জন্যে অধীর হয়ে থাকত৷ সেই সূত্র ধরেই ব্রাহ্ম পরিবারে পালিত হত মাঘোৎসব৷
কেননা কোন সুদূরকালে গৌড়রাজ শশাঙ্কের প্রথম গৌড় সাম্রাজ্য স্থাপনের মহালগ্নে যে বঙ্গাব্দের শুরু সেটাই বাঙালি জীবনের সঙ্গে ঋতুচক্রের আবর্তনে পুজো-পার্বণে উৎসবরূপে বারবার বাঙালিকে অভিষিক্ত করে এসেছে৷ কালানুক্রমে প্রকৃতির নব নব রূপে যে ষড়ঋতুর আবর্তন বাংলায় সুপ্রকাশিত তারই আনন্দিত রূপ দেখা যায় এই বাংলায় ঋতু উৎসবে৷ এই ঋতু উৎসবের উদ্ঘাটনেই বাঙালি প্রাণে উচ্চারিত হয় তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে৷
‘হায়রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল, পণ্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ সাল৷’ সেই কালিদাসের লেখা ‘ঋতু সংহার’ কাব্যে আমরা পাই বিভিন্ন ঋতুতে প্রেমিকজনের মিলন বিচ্ছেদের আর্তির কথা৷ তা পরে রাধাকৃষ্ণের অবলম্বন করে বৈষ্ণব মহাজনরা রচনা করেছেন, ঋতুভেদে রাধাকৃষ্ণের রসবিলাসের কথা৷ কিন্তু বাংলায় লোকজীবনে এই ঋতুচক্রে প্রাণের উৎসবের বিচিত্র রসোল্লাসের প্রকাশ৷
আবহকাল ধরে বাঙালিজীবনে আছে লোকজীবন ও লোকোত্তর জীবনের স্বীকৃতি৷ সেখানে দেখি ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা৷’ তাই বাঙালির লোকোৎসব আন্দোলিত হয় সেই অপ্রত্যক্ষ লোকাতীতের স্মরণকে কেন্দ্র করে৷ তাই বর্ষশেষের চড়কসংক্রান্তি তথা শিবসন্ন্যাসীদের গাজনের মেলার পরদিন শুরু হয় প্রভাতে পূজাপার্বণে ও অপরাহ্নে লোকসম্মিলনের উৎসবে৷
উৎসব প্রবন্ধে রবি-কবি বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন, একাকী— কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন যে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ৷’ তাই দেখি আবহমানকাল ধরে বঙ্গজীবনে নববর্ষে একদিকে একান্তে আছে মহতো মহীয়ানের নিকট প্রার্থনা ও অন্যদিকে আছে সর্বজনের মনের মাঝে মিলনের আনন্দ উৎসব৷ সেই জন্যেই দেখি আমাদের দোল, দুর্গোৎসবে, সেই আরাধ্যের পুজোর আয়োজনের সঙ্গে আছে উৎসবের আনন্দ, যেখানে পুজো ও উৎসব একাকার হয়ে গেছে৷
একথা অনস্বীকার্য যে বঙ্গাব্দ আমাদের আপামর বাঙালির জীবনের অত্যাজ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে৷ বাঙালির জীবনের পুজোপার্বণ বা উৎসব সবকিছুই বঙ্গাব্দের তারিখ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়৷ পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণ থেকে পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজন্মোৎসব, বুদ্ধজয়ন্তী, বর্ষার রথযাত্রা,শরতে দুর্গোৎসব, দীপাবলি উৎসব, হেমন্তে নবান্ন, শীতে পৌষোৎসব, মাঘোৎসব, বসন্তে বসন্তপঞ্চমী উৎসব থেকে রঙবাহারি হোলি উৎসব পর্যন্ত সবকিছুই বঙ্গাব্দের তিথি নক্ষত্রানুযায়ী নিয়ন্ত্রিত৷ এগুলি যদি একান্তভাবে হিন্দুসমাজের পরিচিতি বহন করে তাহলে অবশ্য লক্ষণীয় অন্য সম্প্রদায়ের উৎসবের তারিখগুলি কিন্তু বঙ্গাব্দের তারিখ অনুযায়ী হয় না৷
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের পর যখন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ধর্মীয় বিভাগ প্রবল হয়ে উঠল তখন দেবেন্দ্রনাথের ভায়েদের বাড়িতে পারিবারিক প্রাচীন ধারা অনুযায়ী দুর্গোৎসব হত, তখন মহর্ষি কলকাতা ত্যাগ করে পাহাড় ভ্রমণে যেতেন৷ কিন্তু মুশকিল হল, হিন্দু পুজোর উৎসবে যোগদান করতে না পেরে মহর্ষির পরিবারের ছেলেমেয়েরা ওইরকম একটি সর্বমিলনের উৎসবের জন্যে অধীর হয়ে থাকত৷ সেই সূত্র ধরেই ব্রাহ্ম পরিবারে পালিত হত মাঘোৎসব৷ কিন্তু মহর্ষির মৃত্যুর পর মাঘোৎসবের উজ্জ্বলতা ম্রিয়মান হতে আরম্ভ করে৷ অতঃপর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে মহর্ষির দীক্ষার দিন নিয়ে শান্তিনিকেতনে ৭ই পৌষ এক উৎসবের সূচনা করেন৷ দৈনিক নিয়মিত তিনি শান্তিনিকেতনের প্রভাতী প্রার্থনাসভায় আচার্যের ভাষণের অঙ্গরূপে নববর্ষে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের সূচনা করে ভাষণ দেন৷ পরবর্তী সময়ে পঁচিশে বৈশাখে এগিয়ে নিয়ে আসা হয়৷ এবং ক্রমে নববর্ষের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে৷ এবং প্রাতঃকালীন অনুষ্ঠানে বর্ষবরণ জীবনে বিশেষ প্রসার লাভ করে৷
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে অতীতে সকালে পূজাপার্বণ ও ব্যবসার হালখাতার শুভারম্ভ ও বিকালবেলা অতিথি আপ্যায়ন বা সম্মেলনের আয়োজনে অথবা অধুনা, সকালে সাংস্কৃতিক আবাহন বা বিকেলে জনসম্মেলন কিন্তু অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গাব্দের প্রথম দিন বা পয়লা বৈশাখে৷ সেই সূত্রে এখন আবার একটি ঢেউ উঠেছে এই বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে বাঙালিরূপে আত্মসম্বিতে ফিরে দেখার দিনে বাঙালিয়ানাকে প্রতিষ্ঠা করার৷
একথা অনস্বীকার্য যে বঙ্গাব্দ আমাদের আপামর বাঙালির জীবনের অত্যাজ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে৷ বাঙালির জীবনের পুজোপার্বণ বা উৎসব সবকিছুই বঙ্গাব্দের তারিখ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়৷ পয়লা
বৈশাখে বর্ষবরণ থেকে পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজন্মোৎসব, বুদ্ধজয়ন্তী, বর্ষার রথযাত্রা,শরতে দুর্গোৎসব, দীপাবলি উৎসব, হেমন্তে নবান্ন, শীতে পৌষোৎসব, মাঘোৎসব, বসন্তে বসন্তপঞ্চমী উৎসব থেকে রঙবাহারি হোলি উৎসব পর্যন্ত সবকিছুই বঙ্গাব্দের তিথি নক্ষত্রানুযায়ী নিয়ন্ত্রিত৷ এগুলি যদি একান্তভাবে হিন্দুসমাজের পরিচিতি বহন করে তাহলে অবশ্য লক্ষণীয় অন্য সম্প্রদায়ের উৎসবের তারিখগুলি কিন্তু বঙ্গাব্দের তারিখ অনুযায়ী হয় না৷ মুসলমানদের পরবগুলি ঈদ বা শবেবরাত সব হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়৷ এমনকি ভাষাদিবসও পালিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারি৷ ক্রিশ্চানদের ইস্টারপর্ব বা ক্রিসমাস হয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী৷ কিন্তু ওই দুটি সম্প্রদায় ছাড়া বাঙালি জনসাধারণের জীবনে আজও বঙ্গাব্দ অত্যন্ত সজীবভাবে বিদ্যমান, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি৷
বাঙালির এই শুভ নববর্ষ দিবসে সম্প্রতি বাঙালি হওয়ার একটা হিড়িক পড়ে যায়৷ দেখে শুনে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘চাণক্য’ নাটকের একটি সংলাপের কথা মনে পড়ে যায়—‘এতদিন সন্তানকে ভুলে কোথায় ছিলি মা (বাপ)৷’ পরিবর্তনের স্রোতে বহিরঙ্গে বাঙালির অনেক পরিবর্তন হলেও, বাঙালি পরিচয়ে একদা যে শৌর্য, বীর্য, কর্তব্যপরায়ণতা, বিদ্যাবত্তা, মনীষা ও প্রতিবাদী নেতৃত্বদানের শক্তির আধিপত্য ছিল, আন্তর্জাতিকতায় অর্ধশিক্ষিত বোধের অনিবার্য পরিণামে তা আজ প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ সেটা কিন্তু পয়লা বৈশাখে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে মাছভাত ভক্ষণের মহড়ায় ফিরিবে না, ফিরিবে না, সে অস্তশশী৷ তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে স্বনিষ্ঠ সাধনায়৷
তাই শুভ নববর্ষের পুণ্যপ্রভাতে বাঙালির এই প্রার্থনাই সোচ্চার হোক— ‘গিয়াছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ’৷