দহনবেলায় ভোজেরথালায়

নিদাঘের দহনবেলা। বাইপাস ধাবা থেকে একটু এগিয়ে একটা কদম গাছের নিচে লাল টুকটুক বুলেট। রয়াল এনফিল্ড ক্লাসিক ৫০০। দু দিকের হাতলে জলপাই সবুজ হেলমেট। পাশেই গাছে আধ হেলান দিয়ে কানু হারামজাদা । মানে আমাদের সৌনক। এখন একটা পনেরো। মিনিট দশ বাকি এষার আসতে। মর্নিং স্লট। ওকে মাইকেলনগর বাড়িতে ছেড়ে সৌনক ফিরবে বসিরহাটের বাড়িতে। শনিবারের সপ্তাহান্তে একটু বাড়ির আরাম।

স্নিগ্ধ আকাশি কামিজ, সাদা সালোয়ার আর রে ব্যান অ্যাভিয়েটর। স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা। ‘অনেকক্ষণ?’ ‘মিনিট দশ ‘। গুম গুম আওয়াজ তুলে পক্ষীরাজ চলল ভি আই পি রোডের দিকে। এয়ারপোর্টের সামনে বাম দিকের হাওয়াই আড্ডার ফ্লাইওভারটা দেখলেই মাথার পোকা নড়ে ওঠে। কতদিন — কত্তদিন কোথাও যাওয়া হয় না। হোটেল ইন্ডাস্ট্রির এই এক সমস্যা। বিশেষ করে শেফদের ।

এষাকে নামিয়ে দিয়ে বাইক ঘোরানোর সময় দেখলো পূর্ণাকাকীমা বেরিয়ে এসেছেন। ‘এই ছেলে, দু দণ্ড বসে যাও। এই ভরদুপুরে একটু বিশ্রাম নিতে হয়। এসো ভেতরে।’ অগত্যা। বসার ঘরে টিভিতে মাসুম চলছে। নাসিরুদ্দিনের এক মায়াবী গল্প। চিরকালীন। ‘এসো। গৃহস্থের বাড়িতে দুপুরে দু মুঠো খেতে হয়।’

কালো নুনিয়া চালের ভাত। শুক্তো। পেঁয়াজ – পোস্ত আর কাঁচা আমের চাটনি। আমাদের বাজারের গোপাল এই চালটা দিয়ে যায়। যেমন স্বাদ তেমনি গন্ধ। অবরে সবরে রান্না হয়।

শুক্তোর তিতা কাহিনি

পঞ্চদশী মেয়ে আর আমি পুরোনো গানের পোঁটলা খুলে বসেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙ্গ গানটায় আবেগ দিয়ে ( গানের গলা না থাকলে আবেগই সম্বল) উচ্ছে তিতা, পলতা তিতা, তিতা নিমের শুক্ত/ তাহার অধিক তিতা যাহা বিনি ভাষায় উক্ত। ….,

বাবা …. পলতা কি? পটল গাছের পাতা। এই উত্তরটা জানি। এবার বোমা…. সব পাতাই তো তিতা। তাহলে শুধু পটলের পাতা কেন ? ঠিক কথা। কাল আমরা আমপাতা দিয়ে শুক্তো বানাবো। কলিংবেল বাজছে। অঙ্কের মাষ্টারমশাই এযাত্রায় আমার রক্ষাকর্তা।

শুক্তো আমার বেশ প্রিয় খাদ্য। অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের বাইরে কিন্তু এর প্রচলন নেই। আয়ুর্বেদ বলে এতে শরীর ঠান্ডা থাকে। কিন্তু বৈষ্ণব সাহিত্যে যে শুক্তোর আখ্যান পাওয়া যায়, রাঙালু, কুমড়ো, বেগুনের সেই পদে কিন্তু তিক্ত আস্বাদের নামগন্ধ নেই। নিন্দুকেরা বলে, তিতা শুক্তো আদৌ এদেশী খাবারই নয়। পোস্ত সর্ষের ছোঁয়ায় এই পদ আদতে পর্তুগিজ। যে যা বলে বলুক। শক হুন দল, পাঠান মোগল একদেহে হল লীন। সুতরাং, বিরিয়ানী থেকে ম্যাংগো পেস্ট্রি….. সবই বাঙালির উদার উদরে উদাত্ত আহবান পেয়ে থাকে।

ঘটির শুক্তো, বাঙালের শুক্তো, উড়িয়ার শুক্তো, দুধের, নিমপাতার, করলার, পলতার, মেথির, শিউলিপাতার, চালকুমড়োর আরও কতো হাজার রকম শুক্তো। ত্রিপুরা আর বাংলাদেশে মাছের শুক্তোর ও চল আছে। অতো ভাবনা চিন্তার কী আছে? মাছের পিত্তি দিয়ে রাঁধলেই দিব্যি তিতা হবে! আমার বাঙাল ঘরণীর ততোধিক বাঙাল মাতৃদেবী একমাত্র জামাইকে শুধু ভস্ম করতে বাকি রাখলেন।

শুক্তো কিন্ত উচ্চবংশীয় ব্যঞ্জন। উচ্চ আপ্যায়নে এর আদর। বিলাতী খাদ্য তালিকায় এর স্থান স্টার্টারে। কিন্তু……. যাক গে। আর বললুম না। শুক্তো রান্নায় চাই রাঁধুনি। মানে ভালো রন্ধনশিল্পী তো সব রান্নাতেই অবশ্যই চাই। কিন্তু রাঁধুনি নামের মসলাটি শুক্তো রান্নায় চাই। খানিকটা জোয়ানের মত দেখতে। মানে মসলার জোয়ানের কথা বলছি আর কি। চালকুমড়োর শুক্তো কিন্তু উচ্ছে, তেজপাতা আর গোটা সর্ষের খেলা। একটু মেথি, নুন, শুকনো লঙ্কা, চিনির ছোঁয়া, ঘিয়ের একটু ছিটে। কিন্তু লালপেড়ে শাড়ি পরে সিঁথি জোড়া সিঁদুর দিয়ে, কপালে মস্ত সিঁদুর টিপ, হাঁসুলিকে লজ্জা দেওয়া নথ আর দুহাতে শাঁখা পলা নোয়ার সঙ্গতে চারগাছা আটপৌরে চুড়ি।

এই সরতো…বলে কাঁঠালকাঠের উঁচু পিঁড়িতে বসে জামাইষষ্ঠীর সকালে যে শুক্তো রাঁধতেন, তার কথা বলি।

আলু, রাঙালু, বরবটি, শিম, উচ্ছে / করলা, বেগুন, পেঁপে, কাঁচকলা…. সব লম্বা দিকে কাটা। সজনে/ নাজনে ডাঁটা দু গাঁটের মাপে বাইরের আস্তর ছাড়িয়ে। এবং বিউলি ডালের বড়ি। সব একে একে ছাঁকা সর্ষে তেলে ভেজে তুলে রাখা কানা উঁচু সোনার বরণ কাঁসার থালায়। অল্প সা জিরে, কটা শুকনো লঙ্কা, সামান্য ধনে আর দু টিপনি মেথি শুকনো খোলায় নেড়ে চেড়ে মিহি করে পিষে নেওয়া হলো। পোস্ত বাটা হলো, লাল সর্ষে বাটা হলো। শিল ধোওয়া জল একটা কাঁসার বাটিতে। এবার কড়া বসলো উনুনে। সুগন্ধী গাওয়া ঘি হালকা আঁচে। লালচে আভা ধরলে কটা তেজপাতা, দুটো শুকনো লঙ্কা, মৌরি, একটু পাঁচফোড়ন , রাই সর্ষে এক টিপ। গন্ধে রান্না ঘর ম ম। এবার সামান্য চিনি আর রাঁধুনি। কম আঁচে দু মিনিট নাড়াচাড়া। এবার সব সবজি। মাছের শুক্তোয় হলুদ লাগে। নিরামিষ শুক্তোয় নৈব নৈব চ। মসলাটা ভালো করে নেড়ে চেড়ে মিশিয়ে নিতে চার পাঁচ মিনিট। এবার ঈষদুষ্ণ জল। বেশি আঁচে টগবগ করে ফুটতে দিতে হবে কিছুক্ষণ। নাহলে সেদ্ধ হবে কি করে? বেগুনটা পরে দিলেও হয়। খানিক পরে সর্ষে বাটা, পোস্ত বাটা। আরও কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া। বড়ি ।মাপমত নুন। এবার দুধের পালা। এই সাদা রঙটাই চাই। নামিয়ে নিয়ে ঢালা হলো কাঁসার গামলিতে। দু টিপ ভাজা মসলা আর এক ছটাক ঘি। ব্যাস। শুক্তো রান্না শেষ।

এবার গিন্নিমা মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল বসানোর আগে রুপোর ডাবর থেকে এক খিলি পান নিয়ে মুখে দিলেন। রুপোর তবক দেওয়া বেনারসি জর্দার গন্ধে আলবোলা সরিয়ে কর্তামশাই আর চোখে তাকিয়ে আছেন হেঁশেলের দিকে। একটু হাসি। একটু প্রশ্রয়। আগে তেতো, তবে তো মিষ্টির পালা।।

প্রথম পাতে শুক্ত তো হলো।
এবার বীরভূমের পোস্ত না হলে এই স্বাদ আসবেই না পিয়াঁজ পোস্তয়। আমি বলি ফাঁকিবাজি রান্না। সর্ষে তেলে তেজপাতা আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন। এক চিমটে পাঁচফোড়ন। এরপর পিয়াঁজকুচি। নেড়ে চেড়ে নরম হয়ে এলে নুন আর পোস্তবাটা। কিপটেমি নৈব নৈব চ। নাড়তে নাড়তে তেল ছেড়ে এলে কাঁচা লঙ্কা কুচি। ব্যাস। হয়ে গেল।’ আর পোস্ত বাটার ঝামেলা! মনে মনে ভাবে সৌনক। শিল নোড়া ছাড়া কি আর এমন স্বাদ আসে?

পোস্তর মৌতাত ছাড়া খাওয়া দাওয়ায় এমন স্বাত্তিক নেশা জমবে কী করে?

আমের চাটনির জন্যে ঠিকঠাক আম চাই। টাটকা সবুজ টক কাঁচা আমের প্রয়োজন। খোসা ছাড়ানোর দরকার নেই।

প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে বাঙালি কাঁচা আমের চাটনি খেয়ে আসছে। গৌড়রাজ শশাঙ্ক খেতেন কিনা কোথাও লেখা নেই। খেতেন নিশ্চয়ই। তবে সিরাজউদদৌলা তো অবশ্যই খেতেন। অমন বিশাল আমবাগান!

আমগুলোকে টুকরো করে নুন হলুদ জলে ঘণ্টা দুই। গায়ে হলুদ বলে কথা। কড়ায় একটু সরষে তেল। ছোট্ট একটা তেজপাতা, তিন চার পাঁচটা শুকনো লঙ্কা, আর কালো সরষে খানিকটা। আগুনের আঁচ থাকবে গোপন প্রেমের মত। নরম। আলতো। এবার আমের টুকরো। সামান্য নেড়ে চেড়ে জল। ফুটুক। সেদ্ধ হয়ে এলে থেঁতো করা আমআদা। এর সুগন্ধ আমের উল্লাসকে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। তারপর চিনি। মিঠা চাহিয়ে তো বহুত। অহমিয়াদের একটা কথা মনে পড়ে গেল। চিনি ছাড়া চায়ের কাপে প্রেমিকা আঙুল ডুবিয়ে দেয়। দয়িত সেই চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে। মিঠা মিঠা আহে। দারুণ না? যাকগে। চাটনি তৈরি। চাইলে এতে কাজু কিসমিস দিতে পারেন। আমার না পছন্দ।

সৌনক এরপর কখন বাড়ি ফিরলো আর ফেরার আগে ও আর এষা দুষ্টুমি করলো কিনা সে খবর আমার কাছে নেই। আমার পাওনা হলো রেসিপি।

এই দাবদাহে চারিদিকে যখন তাপে সবাই ঝালাপালা তখন পাতে একটু পেট ঠান্ডার সুলুক সন্ধান দিলে মন্দ কী!!