বিলাইতি ভোজের সফরনামা

গোড়ার কথা

সেই কত শত যুগ আগে থেকে ভারতবর্ষের সোনা, সম্পদ ও সমৃদ্ধি যেন পৃথিবীর অর্ধভাগকে লোভাতুর করে তুলেছিল। ইতিহাস ও প্রাচীন সাহিত্য বলে রোম, মিশর, আরব ও চিনদেশের সঙ্গে ভারতের গড়ে উঠেছিল বাণিজ্যিক সম্পর্ক। মধ্যযুগের গোড়াতে ইউরোপীয় বণিকেরা আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল ভারতীয় সুগন্ধি মশলার ঘ্রাণে। তাদের মধ্যে সবার প্রথমে, পাঁচশো বছরেরও আগে যিনি ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলেন তাঁর নাম ভাস্কো দা গামা। সেটা ছিল ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দ। পর্তুগালের অধিপতি ইমানুয়েল ভারতের কিংবদন্তীস্বরূপ সম্পদরাশি ও ধনরত্ন – সোনার প্রাচুর্যে তাঁর কৌতূহল নিবারণের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত পাত্রকে। মালাবার উপকূলে কালিকটে পৌঁছে কিন্তু সেখানকার দেশীয় মুসলমান বণিকদের কাছে তিনি পেলেন শুধুই বিমুখতা। ভারতীয় সমৃদ্ধির প্রমাণ পেলেও বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপনের সমস্ত আশা পরিত্যাগ করে তাঁকে ফিরে যেতে হ’ল স্বদেশে। কিন্তু রাজা ইমানুয়েল আশা ছাড়লেন না। তাঁর আদেশে এবার এলেন Pedro Alvares Cabral. তিনি এলেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই সুকৌশলে জয় করলেন স্থানীয় বণিক তথা শাসক শ্রেণীর আতিথ্য ও আশ্বাস। স্থাপিত হ’ল ভারতের বুকে প্রথম পর্তুগীজ বাণিজ্যকুঠি। সাধারণ ভারতীয় মানুষের কাছে ‘অতিথি দেবঃ ভব’। তাদের আতিথেয়তায় আপ্লুত এই বিদেশিদের আঞ্চলিক সহজ-সরল মানুষদের বিশ্বাস জয় করে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হ’ল না। প্রাকৃতিক ও অনায়াসলব্ধ সম্পদে ভরা উর্বর এই দেশটিতে ছড়িয়ে আছে অশেষ সম্ভাবনা, সোনা, মণি-রত্ন আর স্বাদু সুগন্ধি মশলার অপর্যাপ্ত ভাণ্ডার। উপনিবেশ স্থাপনের স্বপ্ন আর বাণিজ্যিক অধিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইল না। তা আগ্রাসী হয়ে রাজনৈতিক অধিকার স্থাপনের জন্য ক্রমেই সচেষ্ট হতে শুরু করল।

১৫১০ খ্রিস্টাব্দে মালাবার উপকূলে গোয়া নামে পরিচিত বন্দর শহর তথা সমগ্র জেলাটি পর্তুগীজদের অধিকারে চলে এল। ১৫৫৮ সালে পরপর দমন ও দিউ নামে দু’টি অন্যতম প্রধান বন্দরও তারা দখল করে নিল। এর আগে ১৫৩১ সালে তৎকালীন আঞ্চলিক রাজপরিবারের বদান্যতায় পর্তুগীজরা একটি নিজস্ব দুর্গ তৈরি করেছিল। পর্তুগীজ সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ডাচ বা দিনেমাররাও ভারতে অনুপ্রবেশ করে মালাবার ও করমণ্ডল উপকূলে এবং পূর্বভারতের বঙ্গ তথা অবিভক্ত বাংলায় বাণিজ্যিক কুঠি স্থাপন করল। তবে এদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতে উপলব্ধ সম্পদ, রপ্তানির মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবেই বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক আগ্রাসন নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার Spice Island নামে পরিচিত  Java ও Moluccas সংলগ্ন অঞ্চলে ষোড়শ শতকে ইতিমধ্যেই ডাচ এবং স্প্যানিশরা মশলা ব্যবসায়ে যথেষ্ট আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যদিকে ফ্রান্সও পিছিয়ে রইল না। ১৬৬৪ সালে ফরাসি বণিকরা যথেষ্ট শক্তির পরিচয় দিয়ে ভারতের পূর্ব উপকূলে জনপথের গায়ে গড়ে তুলল তাদের উপনিবেশ। দক্ষিণে পণ্ডিচেরী ও পূর্বে বাংলার চন্দননগরে প্রতিষ্ঠিত হ’ল এদের অধিকৃত নিজস্ব কর্মকেন্দ্র।

ইতিমধ্যে নিজের শক্তি সঞ্চয়ে উদ্যোগী হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশরাও। ১৫৮৮ সালে দুর্ধষ Spanish Armadaকে সমুদ্র-যুদ্ধে পরাজিত করে পুঁজিবাদী ব্রিটেন যথেষ্ট সাহস অর্জন করেছিল। এর বারো বছর পর রানী প্রথম এলিজাবেথ দণ্ড রাজকীয় সনদ লাভ করে  John Watts এবং George White -এর নেতৃত্বে একদল বণিক সক্রিয় হয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন East India Company  নামে একটি বাণিজ্য সংস্থা। প্রাথমিকভাবে এর দু’টি নাম ছিল। যথাক্রমে  Honourable East-India Company এবং British East-India Company এবং সাধারণের কাছে John Company. সে সময় ইস্ট ইল্ডিয়া কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মশলা-বাণিজ্যের অধিকার অর্জন। আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে উপলব্ধ দারচিনি, লবঙ্গ এবং বিশেষ করে গোলমরিচ, যা ইউরোপীয় রসনার স্বাদ বর্ধনে অপরিহার্য উপকরণ, ছিল অত্যন্ত মহার্ঘ। ‘Clove’, ‘Peppercorn’ এবং ‘Trader’s Increase’ নামে তিনটি জলযানের নৌবহর নিয়ে কোম্পানির যাত্রা হল শুরু, কিন্তু সফল হল না। কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশদের প্রবল প্রতিরোধের শিকার হতে হল Dutchদের কাছে। গভীর ষড়যন্ত্রের ফলে Moluccasএ ১০ জন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীর মুণ্ডচ্ছেদ করা হ’ল। হেরে গিয়ে কোম্পানি নিজেদের কর্মধারার লক্ষ্য পরিবর্তন করে নির্বাচন করল ভারতের তটরেখা।

ব্রিটেনের প্রথম জাহাজ Hector ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে অবশেষে গুজরাটের অন্তর্গত সুরাট বন্দরে এসে ভিড়ল। কোম্পানির প্রতিনিধিদের আপ্যায়িত করা সত্ত্বেও বাদশাহ জাহাঙ্গীর তাদের বাণিজ্যিক অধিকার করলেন না। কারণ তাঁর আনুকূল্যে ভারতের পশ্চিম উপকূলে ইতিমধ্যেই পর্তুগীজরা ব্যবসায়িক আধিপত্য কায়েম করেছিল। সম্ভবত এদের প্রবল বিরোধিতাই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপক্ষতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এরপর বছর চারেকের মধ্যেই ছলে-বলে পর্তুগীজ অধীনে থাকা তিনটি জাহাজকে আটকে রেখে ব্রিটিশরা প্রচুর মুক্তিপণ আদায় করে নিল। ফলে সমুদ্রপথে পর্তুগীজ প্রাধান্য অনেকাংশেই খর্ব হয়ে গেল এবং ব্রিটিশদের পথ হয়ে গেল বহুলাংশেই সুগম। জাহাঙ্গীর বাদশাহের বদান্যতার লাভেরও সুযোগ গেল এসে। তাঁর ইচ্ছা এবং অনুজ্ঞায় ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমতটে গুজরাটের সুরাট বন্দরে স্থাপিত হল প্রথম ব্রিটিশ বাণিজ্যিক কুঠি। Surat Factory East India Company সংগ্রহ করতে শুরু করল গুজরাট থেকে সুতির কাপড় এবং আগ্রা থেকে Indigo বা নীল। সালটা ছিল ১৬১২।

অন্যদিকে পর্তুগীজরা যথারীতি গোলমরিচ তথা মশলার বাণিজ্যে আগের মতোই নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে রইল। কিন্তু খুব বেশিদিনের জন্য নয়। সমুদ্রপথ নির্ভর পর্তুগীজ বাণিজ্য তাদের জাহাজগুলির ওপর ক্রমাগত ব্রিটিশ হামলায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে Treaty of Madrid অনুযায়ী গৃহীত হল সন্ধি প্রস্তাব। ফলস্বরূপ East India Company গোয়া থেকে মশলা ইত্যাদি সংগ্রহের অনুমতি পেয়ে গেল। তারপর ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাদ্রাজ অঞ্চলের বেশকিছু জমির ইজারা কোম্পানির অধীনে চলে এল। সবশেষে পশ্চিম উপকূলে বোম্বের ওপর ব্রিটিশ অধিকার বর্তালো এর ২৮ বছর পর, ১৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে। ইংল্যান্ডের রাজা Charles-II এর সঙ্গে পর্তুগাল রাজবংশের Catherine of Bragansa-র বিবাহ সূত্রে রানি যৌতুক হিসেবে বোম্বে পোর্ট এবং সমুদ্রে ঘেরা সংলগ্ন অঞ্চল (যা প্রকৃতপক্ষে সাতটি দ্বীপের সমষ্টি) লাভ করলেন।

নানা বাধাবিপত্তি পেড়িয়ে সবশেষে মোঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেবের প্রাথমিক ওজর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ১৬৯০ খ্রীস্টাব্দে হুগলি নদীর তীরে কালীক্ষেত্র ওরফে কালিকাটা তথা কলিকাতা গ্রামে কোম্পানি কুঠি স্থাপন করতে সফলতা পেল। ইংরেজি উচ্চারণে পরে এর নাম হল Calcutta. এরই সঙ্গে দখলে এল আরও দুটি গ্রাম গোবিন্দপুর ও সূতানুটি। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুঘল প্রতিপত্তিতে ধ্বস নামা শুরু হ’ল। কো্পানি এর সুযোগ নিতে দেরি করল না। বিস্তারিত ছড়িয়ে যাওয়ার পথ অনেকটাই সুগম হয়ে এল। যদিও এরপর বাধা এসেছিল ফরাসি শক্তির কাছ থেকে ১৭৪৬ সালে মাদ্রাজ ওরফে Madras অঞ্চলটি তারা আক্রমণ করে কো্পানির কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। অবশ্য ২ বছর পর উত্তর আমেরিকায় ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চদের মধ্যে অধিকারের যুদ্ধের ফলস্বরূপ সেখানে আধিপত্য স্থাপনের বিনিমযে মাদ্রাজ আবার ফিরে এলো কোম্পানির দখলে।

সত্যি বলতে গেলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আগ্রাসনের সাফল্যের মূলে সর্বপ্রধান ভূমিকা Robert Clive-এর। এই ধুরন্ধর কূটকৌশলী সেনাপতিটি ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাস্ত করে মুঘল শাসনের ধারাটিকে সমূলে উৎপাটিত করলেন। কোম্পানির শাসনের মধ্যে দিয়ে প্রোথিত হ’ল ব্রিটিশ রাজত্বের ভিত্তিপ্রস্তর।

কোম্পানির হাতের পুতুল হয়ে বাংলার মসনদে বসলেন নবাব মীরজাফর। অন্যদিকে দিল্লির মুঘল বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে দরবার করে কোম্পানি পেয়ে গেল সমগ্র বাংলার রাজস্ব আদায়ের ছাড়পত্র। সমগ্র রাজস্বের এক চতুর্থাংশ দস্তুরী ধার্য হল তাদের জন্য। মোঘল বাদশাহের কাছে এই অংশের পরিমাণ খুব বেশি না হলেও কোম্পানির ধনভাণ্ডার ফুলে ফেঁপে উঠতে দেরি হল না। এর বহুলাংশই যেত প্রতিনিধিদের নিজস্ব অধিকারে। এঁরা ক্রমশই খিদমদগার পরিবৃত হয়ে আরামদায়ক আধা-নবাবি চালচলন ও জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলেন। দেশীয় উপপত্নী গ্রহণ করে বা রক্ষিতা পালন করে ও দো আঁশলা সন্তানের জন্মদান করে সাজপোশাক ও সর্বোপরি খাদ্যাভাস, হুক্কা-সেবন ও পানচর্বনে আশক্ত হয়ে পড়লেন। স্বদেশে এরা খ্যাতি লাভ করলেন ‘’White Nobab’ নামে। Robert Clive এর অধস্তন কর্মচারীরা অনেকেই সঙ্গে একটি বাক্সে পান খাওয়ার সরঞ্জামের সাথে পিকদান রাখতেন। গরমের দেশে সকালের জলখাবার হিসেবে এঁরা খেতেন ডাল, চাল, মাংস মেশানো খিচুড়ী জাতীয় Kedgree আর তার সঙ্গে আমের আঁচার।

পশ্চিমের মালাবার অঞ্চলের তটরেখা ধরে দক্ষিণ পেরিয়ে কোম্পানির পক্ষ বিস্তারের আয়ত্বে এল পূর্ব ভারতের করমণ্ডল উপকূল ধরে বঙ্গোপসাগর। মাথায় পূর্বের সমুদ্র মোহনার কূলে। কোম্পানির শাসন অব্যাহত রইল আরও ১০০ বছরেরও বেশি। তারপর ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ নাড়িয়ে দিল কোম্পানির আসন। ব্রিটেনের শাসক মণ্ডলে উঠল প্রবল সমালোচনার ঝড়। বিপ্লবকে যেভাবে কোম্পানির উর্ধতন আমলার অসহিষ্ণুতা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করেছিল এবং ভারতীয় জনসাধারণ ও বিশেষভাবে নীল ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ওপর অমানুষিক অত্যাচারের কৈফিয়ৎ চাইলেন তাঁরা। পার্লামেন্টের সমর্থনে১৮৭৪-এর ১লা জুন রানী ভিক্টোরিয়া নিজের হাতে তুলে নিলেন শাসনভার। East India Company হল নিশ্চিহ্ন। রানী ঘোষণা করলেন, ‘…that from the highest to the humblest, all may feel that under Our rule the great principles of Liberty equity and justice are served to them (the subjects);

And to promote their happiness, to add to their prosperity and advance their welfare, are the ever-present aims and objects of Our Empire.’

তৎকালীন প্রায় সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত এবং কলিকাতা তথা Calcutta, সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী। তবে সকল শুরুরই শেষ আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণের পর দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ-শাসনের কবলমুক্ত হয়ে স্বাধীন হল ভারত, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই আগস্ট, দ্বিধাবিভক্ত হয়ে। ১৪ই আগস্ট স্বরাজ পেয়েছিল পাকিস্তান। স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কূট-কৌশলী ব্রিটিশ প্রতিনিধি খণ্ডিত ভমিতে ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক হিংসা-দ্বেষ ও অবিশ্বাসের বীজ বুনে দিয়ে গেলেন।

তবুও একথা অনস্বীকার্য ঔপনিবেশিকতার প্রথম পর্যায়ে যে ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা দেশে শাসনের ভার নিতে এসেছিলেন তাঁরা ছিলেন আন্তরিকভাবে সাধারণের শুভার্থী। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ, শিল্পকলা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সঙ্গীত ও লোকশিল্পকে নিজেদের অনুসন্ধিৎসার প্রেরণায় গবেষণার সাহায্যে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে জনমানস তথা বিশ্বে পরিচিতি দেওয়ার প্রয়াস করেছিলেন। বিস্তারিত করেছিলেন সমাজ-সংস্কার এবং শিক্ষার ধারা। প্রাথমিকভাবে দেশীয় শাসকবর্গ তথা সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ রাজকর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও সংঘাত থাকলেও সামাজিক সংস্কারে এঁরা যথেষ্ট উদ্যোগী ছিলেন। অন্যদিকে রাজ আমলের শাসক শ্রেণির অনেকেই ভারত ও ভারতীয় ধ্যান-ধারণা ও রীতি-নীতিকে দেখতেন নীচু চোখে। নিজেদের শ্রেষ্ঠতা প্রমাণ করতে প্রাচ্য ইতিহাসের ধারা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সমস্তই পাশ্চাত্যের আলোয় আলোকিত করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁদের ক্ষোদিত পথ ধরেই ভারতবর্ষ নতুন করে আবিষ্কার করেছে নিজেকে। অবশ্য সে সমস্ত বিতর্কিত বিষয় আমার আলোচ্য বিষয় নয়। এ আলোচনা শুধুই দীপ জ্বালানোর আগে সরঞ্জাম গোছানোর প্রস্তুতি।

তিন শতকেরও আগে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের খাদ্যাভাসের সঙ্গে মিলিয়ে ভারতীয় খানসামা ও বাবুর্চিরা এক সমন্বয়ী রন্ধন ধারার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। ব্রিটিশ আগ্রাসনের তত্ত্বাবধানে East India Company তথা British Raj এর আমলে ভারতের সৈন্য-শিবির থেকে রাজকর্মচারী ও উচ্চবিত্ত মহলের রসনা পরিতৃপ্তির তাগিদে সে ধারা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পুষ্টি পেয়েছিল বিস্তৃত রাজভোজের পরিবেশনায়। এই দীর্ঘ বসবাসের ফলস্বরূপ ইতিমধ্যে ইংরেজ পিতার দ্বারা ভারতীয় মাতৃগর্ভে উদ্ভূত হয়েছিল একটি বর্ণসংকর খ্রিস্টধর্মী নতুন মানব সম্প্রদায়।

যাদের নাম দেওয়া হয়েছিল Anglo-Indians অথবা চলতি কথনে ফিরিঙ্গি। সময়ের সঙ্গে ভারতে অনুপ্রবেশকারী অন্যান্য ইউরোপীয় জাতির মিশ্রণের ফলে Dutch, Portugese এবং French পদবীধারীরাও একইভাবে Anglo-Indian নামের তকমা পেয়ে গেলেন। এই বিভিন্ন জাতির নানা বিশিষ্টতায় ভিত্তি করে নিজেদের স্বাদ ও সৃজনশীলতার মেলবন্ধনে অভিনব খাদ্যাভাসে Anglo-Indian সম্প্রদায় এনে দিলেন পরিপূর্ণতা। আপামর ভারতীয় রসনায় আজও সমান সুস্বাদু হয়ে রয়েছে সে ফিরিঙ্গি খানার এলাহী সম্ভার।

আমার জীবনের নানা ধাপে জন্মস্থান বিহার, একদা রাজধানী ব্রিটিশ বাতাবরণের রেশমালা কলকাতার আনাচে-কানাচে আর প্রবাসে বম্বে শহরের কর্মস্থলে বাঙালি খ্রিস্টান পরিবার তথা নানা সম্প্রদায়ের Anglo-Indianদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আমাকে আবাল্য চমৎকৃত ও কৌতূহলী করে তুলেছে। অপার আগ্রহে জানতে চেয়েছি বিলায়তি থেকে ‘ফিরিঙ্গিখানা’য় বিবর্তন। সে বিবর্তনের একটি রূপরেখা নিয়েই আমার এই নিবেদন বিলায়েতি ভোজের সফরনামা নিজের একান্ত ইচ্ছের তাগিদে স্মৃতি ও সত্যসংগ্রহের পথে সংগৃহীত হয়েছে রসনা-পরিতৃপ্তির চাবিকাঠি। আশা রাখি, আমার মতো কৌতূহলী পাঠকদের কাছে অনেক জানা অজানা কথা নিয়ে এই ইতিবৃত্ত অনেকটাই তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিপন্ন হবে।

ক্রমশ

অঙ্কন: দেবাশীষ দেব