শ্মশানচারীর চালচরিত্তির 

দীর্ঘ ২৮ বছরের শ্মশানচারী জীবন।অপরিমেয় বৈভব ও সুখ তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি সংসার জীবনে। অল্প বয়সেই মানুষ দেখার নেশায় অজানা-অচেনা রহস্য লোকের টানে গৃহত্যাগী এই তন্ত্রসাধক, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের জীবনের অভিজ্ঞতাকে লিপিবদ্ধ করবেন ধারাবাহিকভাবে।

বিমূর্ত অন্ধকারের এক গভীর ঝাপটায় সে আসতো, অসহায় কায়াহীনা রাত নিয়ে নয়। তার মঞ্চ আলোকিত হয়ে থাকত হাজার রহস্যে মোড়া এক খুনির আলপনা নিয়ে। সে এসে বসতো দিবেন্দ্রন রাতটির পাশে, কায়াহীন নয়, ছায়াহীনও নয়। রাতের কোনও মুহূর্তই তাকে কাবু করতে পারত না। নীল নির্জন চাঁদের আলোয় দুষ্টুমি দেখে সে মিট মিট করে হাসতো।

যে রাতে সে এসেছিল সেই রাতেই যদু মল্লিকের কুমারী মেয়ের বিষ খাওয়া ঢাউস গতর পোড়াতে বিস্তর কাঠ লেগেছিল। সে মরেও নিস্তার পায়নি। নির্লজ্জ অনামুখো তান্ত্রিকের হলুদ লালসায় তাকে মড়া খেলাতে বাধ্য হতে হয়েছিল। জটাই পাগলী ছিল সাঁইথিয়ার এক মেঠো শ্মশানের আরবানি।মদ- ভাঙ আর গাঁজার দমে সদা সর্বদা সে অস্থির। মদের ঝোঁকে কখন কাকে কী বলতো, ও নিজেও জানে না। কিন্তু ফলন ছিল অব্যর্থ। যাকে বলবে মরবে– সে দিন, ক্ষণ, রাশি মেনেই মরতো। বুকে শেল বাজতো। সন্তানহারা হয়ে শ্মশানে বুক চাপড়াতেও দেখেছে সবাই।

সে আসতো আঁধারের চিরুনি মাথায় দিয়ে। কালো নিকষ আঁধারের বুকে ঝলমল করতো সেই সাদা ধবধবে নরকংকালের হাড়ের  ঝকঝকানি।তারপর এলো চুলে বাঁধতো খোঁপা। যুগের পর যুগ হাহাকার থেকে আকাশ ছোঁয়া বাঁদীর দর কষাকষি এসে মিশে যেত ওই চুলের পরতে পরতে। জেগে উঠত প্রেতের হাসি–মড়ার বুকফাটা কান্না। আর আঁটকু়ড়ো রাত তার সমস্ত তুফান বীণে তুলতো দেবতার উদ্দেশ্য আলোক মঞ্জুরী। যেন কোন আশ্বিনের শারদ প্রভাতে বেজে উঠবে জন্মান্তরের বীজমন্ত্র, মন্দ্রিত হবে ঘন্টার ধ্বনি।

মায়া কুহকিনী হয় যখন রাতের ঘরে চাঁদ দোলে আলোয় ভরে আসা নয় – এক মায়াবী আলোয় মেরে ধরেছিল লতা সাধনা আঁধারটি।

একে সোমত্থ শরীর, তায় চাঁড়াল বাগদীর গতর। কালো মেঘের মতো গায়ের রং। জার্সি গাইয়ের মতো টানা টানা চোখ জোড়া। ওস্তাদও বটে। আজ লতা সাধনায় বসবে আগমবাগীশ নিজেই। সবকিছু ঠিকঠাক — গ্রহ সন্নিবেশও ঠিকঠাক। স্থান মাহাত্ম আর বলে কাকে? শুরু হলো লতা সাধনা। এই গুহ্যবিদ্যা জানে  ওঝার ওঝা, মহা ওঝা।  ডাকিনের ডাকিন, মহা ডাকিন। গুরুর গুরু

মহাগুরু।

প্রথমে চিৎ হয়ে পড়ে থাকবে লাশ। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম মেনে ছড়ানো থাকবে হাত-পা। আকাশের দিকে মেলে দেবে ভরাট উন্মুক্ত স্তন। ঠোটের বাউরীতে মধু আর ছোলা ভাজা দিতে দিতে শুরু হয়ে গেল মন্ত্র উচ্চারণ। চললো তান্ত্রিক পাখার সঞ্চালন।  এলোপাথাড়ি করতে লাগলো, লাগলো অজস্র তান্ত্রিক উপকরণ—ভস্ম। অবশেষে ঠোঁট ফাঁক করে মাগীটার গালে কাঁচা মদ ঢালতেই যেন নড়ে উঠল মনে হল গতরটা। হাত পা মেলতে লাগলো। শরীরটা আধবসা হয়ে ওঠার জন্য পাগল হয়ে গেল। আগমবাগীশের মোটা পুরুষ্টু থাবা দুটোতে ভরে উঠলো অভাগীর পুরুষ্টু স্তন দুটি। হিংস্র উল্লাসে আগমবাগীশের ঠোঁট কামড়ে ধরতে গেল তার ঠোঁট দুটি।

কিন্তু রাতের অন্ধকার গেল। গেল আশা পূর্ণ হওয়ার আগেই। জটাই পাগলীর চিৎকার খান খান করে দিল শ্মশানের নিস্তব্ধতাকে।-মর –মর-মর।আঁটকুড়োর ব্যাটার মরণ হয় না রে? শালা সব খিঁচা কবলার ব্যাটা।আধপচা বাসি মড়াটাকে শান্তি দিচ্ছে না রে। ধম্মো গেল, কম্মো গেল—ধনে পড়ল টান—সব শালাই বলে এখন তান্ত্রিকের মাঠান।

বিমূর্ত রাত গলে গলে পড়তে লাগলো। একমুখ লজ্জায় চাঁদ ঢেকে গেল অন্ধকারে। আগমবাগীশ তান্ত্রিকের লতা সাধনা আর সম্ভব হয়ে উঠলো না ।

ক্রমশ

অঙ্কন: দেবাশীষ দেব