কীর্তন ও বসন্ত 

শেলি
বসন্ত নিয়ে কবি শেলির ওই পংক্তি কারোই আমাদের অজানা নয়—  If  winter comes can spring be far behind? এই বসন্তের আকাঙ্ক্ষা সারা জগতের কবিতা, গান, প্রেম, আনন্দ ও বিরহকে এক মহলে, এক মাহলে কী করে টেনে এনেছে, জানার শেষ আছে কি? আজ বসন্ত, কাল দোল। কী করে যে উত্তর-পশ্চিম ভারতের গ্রামীণ মানুষ এক উজ্জ্বল সোনালি ঋতুকে গানে, নাচে, গুলালে এত রঙিন করলেন সে এক হরিই জানেন, যাঁকে ঘিরেই হোরি উৎসব। হোলি খেলা। রাধা-কৃষ্ণ লীলা-সংকীর্তন। উত্তর ভারত জুড়ে পূরব অঙ্গ নামধারী যে-অপরূপ ব্যথা ও ভালবাসা ডেকে আনা সুরের সাম্রাজ্য গড়ে উঠল– কাজরি, পূর্বি, চৈতি– সেখানে খর গ্রীষ্মে গ্রামের মানুষের জলের প্রার্থনা, ঘন বর্ষায় প্রেমিকের জন্য নিঃসঙ্গ নারীর আকাঙ্ক্ষা এবং বিরহগীতি কী করে একসময় উত্তীর্ণ হল রাধাকৃষ্ণের মিলনবিরহ কীর্তনে, লীলাসঙ্গীতে এই কৌতূহল কোনওদিনই নিবারিত হওয়ার নয়। সাধারণ মানুষ তার নিজের জীরনরস ও মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়ে নিলেন হোরি ভজন, হোরি ঠুংরি, দাদরা, রকম রকমের গোষ্ঠীগান। এই সুর, কাব্য ও ধর্মের ত্রিবেণী এই বঙ্গভূমে প্রতিষ্ঠা ও প্রসার পেল যাঁর জীবন ও কীর্তি অবলম্বন করে, তিনি চৈতন্যদেব। আজ রবীন্দ্রনাথের বসন্তগান, কীর্তনাঙ্গ গানের আসরে চৈতন্যদেব ও কীর্তন প্রসঙ্গে ফিরে আসব। তার আগে কবির রচিত একটা আবাহনী গান শুনি বসন্তের… ‘বসন্তে, বসন্তে তোমার কবিরে দাও ডাক’

চৈতন্যজীবনী থেকে জানা যায় কিশোর বয়স থেকেই চৈতন্যদেব কীর্তন করতে ভালবাসতেন, শ্রীবাসের অঙ্গনে নিত্যরাত কীর্তন হত এবং সেই কীর্তনের সঙ্গে তিনি নাচতেন। নাচ যে কীর্তন গানের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল, তা মহাপ্রভুর জীবনকথা  থেকেই উঠে আসছে।

শ্রীচৈতন্য যে ধর্মপ্রচার করলেন তার এক প্রধান বাহন ছিল কীর্তন। তাঁর প্রেমধর্মে কীর্তনকে যেভাবে সাধনভজনের অঙ্গ করে তুললেন, তা এক আশ্চর্য অনুপ্রেরণার ছবি মেলে ধরে।

বৃন্দাবনদাস বিরচিত চৈতন্যভাগবতে দেখা যাচ্ছে, গয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর শ্রীচৈতন্যদেব যখন হরিনামে উন্মত্তবৎ হয়ে উঠছেন, তখন টোলের ছাত্ররা বললে, প্রভু, ‘আমরাও তোমার সঙ্গে কীর্তন করিব, কিন্তু কীর্তন কেমন করিয়া করিতে হয় তাহা তো জানি না। আমাদিগকে শিখাইয়া দেও।’

পুরীতে চৈতন্যদেবের এই সংকীর্তন শুনে মহারাজ গজপতি প্রতাপরুদ্র তাঁর সভাপতিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এ কী সঙ্গীত’ পণ্ডিত সার্বভৌম ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘ইহা চৈতন্যদেবের সৃষ্টি।’

সুর, কাব্য ও ধর্মকে মেলানোর যে-রসায়ন কীর্তনে, সে-প্রসঙ্গে ‘কীর্তন’ নামের সংক্ষিপ্ত কিন্তু মূল্যবান গ্রন্থের লেখক খগেন্দ্রনাথ মিত্রকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, পৃথিবীর আর কোথায়ও এমন সমন্বয়ের চেষ্টা তিনি দেখেননি।

সেই রবীন্দ্রনাথ কেমনভাবে রেখেছেন কীর্তনের অঙ্গকে তাঁর নিজের রচনায়?

আমরা সে-প্রসঙ্গে যাব, তার আগে মাত্র ২৮ বছর বয়সে লেখা কবির একটা প্রিয় পরিচিত গান শুনব ‘রাজা ও রানী’ নাটক থেকে। বিভাস রাগে, একতালে নিবদ্ধ গানটিতে রাধা ও কৃষ্ণের ছবিও দেখি আমরা…

‘বঁধূ তোমায় করব রাজা তরুতলে’

রবীন্দ্রনাথের গানে কীর্তনের রূপরসে প্রবেশের আগে তাঁর প্রিয় বসন্তের মুখ চেয়ে একটু দাঁড়াব। আজ ৩০ ফাল্গুন, কাল ফাল্গুনী পূর্ণিমা, চৈতন্যদেবের জন্মতিথি। তাঁর ৬৫ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ এরকমই এক ফাল্গুনী দিনে— তারিখটা যদিও ৯ ফাল্গুন— নূতন-পুরাতন, শেষ ও অশেষের সংশ্লেষে একটি প্রেমের গান লিখেছিলেন। বড় অভিমানী সুর তাতে, আবার নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার বাসনা সেই শুভ নিমেষেই। শুভ নিমেষ! কী তার ব্যাখ্যা? তাহলে শুনুন…

‘পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে অধেক আঁখির কোণে’

এই একটু আগে কবির ২৮ বয়সের একটা গান আমরা শুনেছিলাম ‘রাজা ও রানী’ নাটক থেকে। ওই গানের পরে পরেই তিনি সিন্ধু-খেমটায় একটি গান বাঁধেন বড় আনন্দের সুর ও উৎসবের মেজাজে। দৃশ্যে দৃশ্যে ভরপুর গানটি কমলমুকুলদলের মতো স্বতঃপ্রকাশ পায়…

‘আজ আসবে শ্যাম গোকুলে ফিরে’

রবীন্দ্রগানে কীর্তনের কথায় কবির লেখা একটি চিঠি মনে না এসে পারে না। ১৮৯৫-এর ৫ জুলাই সাজাদপুর থেকে লেখা সে-চিঠিতে বলছেন: ‘কাল অনেক রাত পর্যন্ত নহবতে কীর্তনের সুর বাজিয়েছিল; সে বড়ো চমৎকার লাগছিল, আর ঠিক এই পাড়াগাঁয়ের উপযুক্ত হয়েছিল— যেমন সাদাসিধে তেমনি সকরুণ।… সেকালের রাজাদের বৈতালিক ছিল— তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে গান গেয়ে প্রহর জানিয়ে দিত, এই নবাবিটা আমার লোভনীয় মনে হয়।’

শুধুই কি কীর্তন, এক সন্ধেবেলায় শিলাইদহে জলিবটে করে ফিরতে ফিরতে সোনালি অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ শুনলেন দূরের এক অদৃশ্য নৌকো থেকে ভেসে আসছে বেহালার সুর। প্রথমে পূরবী, পরে ইমনকল্যাণের আলাপ শোনা গেল। কবি লিখেছেন, ‘সমস্ত স্থির নদী এবং স্তব্ধ আকাশ মানুষের হৃদয়ে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।’ চিঠির তারিখ ১৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৫।

ঊনবিংশ শতকের শেষ দশকটা যে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গে জমিদারি তদারকি করে কাটালেন তাতে এই সব প্রকৃতি ও মানুষের সংসর্গের ফলে উঠল তাঁর গুচ্ছ গুচ্ছ সেরা গল্প, আর তাঁর অপূর্ব, অলৌকিক সব ঋতুসঙ্গীত।

৪০ বছর বয়স অবধি তাঁর খাঁটি ঋতুসঙ্গীত কটি? ভাবা যায়, বর্ষার গান মোটে ৭, বসন্ত মোটেই ৩, শরৎ কেবল ১টা। বর্ষার ৭টি গানের রাগিণী মল্লার ঘরের। বসন্তের ৩টি গানের রাগিণী বাহার ও বসন্ত। অথচ কবি জীবন শেষ করলেন ১১১টি বর্ষার এবং ৯৫টি বসন্তের গান রচনা করে। আর কত যে রাগ-রাগিণী মিশল সে-সব রচনায়!

আমরা এমন একটি বসন্তের গান এখানে শুনব, যা চিরকাল নারীকণ্ঠেই শুনে গেলাম। পুরুষেরও কি রোদনভরা বসন্ত আসে না? থাকে না? আপনারা শুনুন কবির ৭৪ বছর বয়সের সেই গান…

‘রোদন-ভরা এ বসন্ত’

চল্লিশ বছর বয়স অবধি রবীন্দ্রনাথ দেশী সুরের যে ২৬টি গান রচনা করলেন তার মধ্যে ১৩টিই কীর্তন আধারিত। কীর্তন সুর ছাড়া আর যে-একটি সুরে তিনি নির্ভর করেছেন, সে-সুর বাংলায় বিভাস নামে প্রচলিত। যে-বিভাসে একটু আগেই আপনারা শুনেছেন ‘বঁধূ তোমায় করব রাজা।’

তবে যে ১৩টি কীর্তন সুরের কথা বলা হল কবির গানে, তাদের গায়নে প্রচলিত কীর্তন গানের তেমন গাঢ় মিল খোঁজা ঠিক হবে না। বরং একটা সুর ও অনুরণনের গূঢ় মিল খোঁজাই কাজে দেবে।

একটা কথা এখানে বলা দরকার। কীর্তনে আখর নামে একটা বিশেষ অঙ্গ আছে। তান ও আলাপে কথাহীন সুরের বিস্তার না। এ গান কথা ও সুরের বিস্তার করে সুরে বা রাগিণীতে, খোলের সঙ্গে ছন্দ রেখে। একেই বলা  হয় আখর দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ আখরকে বলেছেন ‘কথার তান’। প্রথম দিকে কিছু গানে আখর রাখলেও পরে আর রাখেননি।

মাত্র ২৩ বছর বয়সে একতালে বেহাগ রাগিণীতে এক অপূর্ব প্রেমের গান, থুড়ি, প্রেমের কীর্তন রচনা করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই বছরটা পূজার অঙ্গে কী যে প্রেমের বন্যা কবির গানে— ‘তুমি ছেড়ে ছিলে, ভুলে ছিলে বলে’, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’, ‘এ মোহ আবরণ খুলে দাও’! বছরটা যে নতুন বউঠান কাদম্বরী দেবীর প্রয়াণবর্ষও!

আপনারা সেই সময়ের কীর্তনাঙ্গটা শুনুন…

‘আমি জেনে শুনে তবু ভুলে আছি’

আবার বসন্তে ফিরব আমরা। একটু অন্য মজা নিয়ে বসন্তের হর্ষ ও বিষাদে বিভোল‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যের মায়াকুমারীগণের মিলিত গানকে আমরা এক একক পুরুষকণ্ঠে শুনব। অতুলনীয় দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে অমর হয়ে ওঠা গানটি তাঁরই প্রিয় শিষ্য পরিবেশন করবেন। আর সেই গানের উত্তরে আমরা শুনব ওই নাটিকারই এক অন্য অংশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠের গান নারীকণ্ঠে। সে-গান অমরের গান।

কিন্তু প্রথমে মায়াকুমারীগণের সেই গান…

‘কাছে ছিলে দূরে গেলে, দূর হতে এসো কাছে’

আর এবার অমরের গান…

‘দিবসরজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি’

রবীন্দ্রনাথের  কোন গান যে পূজার আর কোন গান প্রেমের– এ আর কার খেয়াল থাকে? কিংবা কোন গান পুরুষের আর কোন গান নারীর? এ সেই কীর্তনের মতোই: বৃদ্ধ কীর্তনসাধক শ্রীরাধার বিলাপ শোনাচ্ছেন আর শ্রোতৃমণ্ডলীর বুক ভেসে যাচ্ছে জলে— এ তো বাংলার পল্লিসমাজের অতি পরিচিত দৃশ্য।

বসন্তের গানে কত যে বিলাপ রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ, তা গান শুনতে শুনতে সমানে অবশ করে আনে আমাদের। স্বল্পস্থায়ী এই ঋতুতে এত কান্নার প্রবাহ কি কেবল ভারতীয়দেরই একচেটিয়া? কী উত্তর ভারতজোড়া পূরব অঙ্গ গানে, কী বাংলার গানে, কী রবীন্দ্রনাথে। পাশ্চাত্যের অনুপম কম্পোজার আন্তোনিও ভিভালদি তাঁর অবিস্মরণীয় ভায়োলিন কনচের্তো ‘ফোর সিজনজ’-এ স্প্রিং বা বসন্তের আনন্দের এক অপূর্ব ছবি এঁকেছেন। ব্যথা রেখেছেন শীত বা বসন্তের জন্য।

টি এস এলিয়ট

অথচ ওই পাশ্চাত্যেরই প্রণম্য আধুনিক কবি টি এস এলিয়টের তাঁর বিখ্যাত ‘The Wasteland’ কবিতায় ধ্বংস ও বিপন্নতার ছবি আঁকতে গিয়ে বসন্তের গভীর, গহন নির্মমতার কথা বললেন…

April is the cruellest month, breeding

Lilacs out of the dead land, mixing

Memory with desire, stirring

Dull roots with spring rain.

আমরা এবার যে-গানে যাব তা বসন্তের সেই ব্যথার মোচড়ে, হারানোর বিষাদ ও দ্বন্দ্বের দুর্যোগে আচ্ছন্ন। কীর্তনে যে আখর থাকে সেই কথা-সুরের হারিয়ে যাওয়ারও আশ্লেষ আছে।

‘লিখন তোমার ধুলায় হয়েছে ধুলি’

আজকের গীতিনাট্যের শেষ নিবেদন রাখা হচ্ছে এমন একটি গান যাকে মানুষ সম্পর্কিত করে বর্ষার সঙ্গে। নানা রাগিণী মিশিয়ে এবং অবশ্যই, কীর্তনের রূপরস বুনে ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ বর্ষামঙ্গলের জন্য রচনা করলেন ‘কৃষ্ণকলি’ গানটি। শান্তিদেব ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে গানের বাঁধা ছন্দ ভেঙে অবৃত্তির ধারায় ‘ক্ষণিকা’র কবিতাটিকে নতুন করে গড়লেন। প্রাচীন কথকতা পদ্ধতিতে যেন বলা হল গানটাকে। ভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এক-এক কলিতে এক-একটি রাগিণীর ব্যবহার করা হল। তালহীন এই রূপটিই জনপ্রিয় হল, মানুষ ভুলে গেলেন প্রথম আদি সেই অর্ধঝম্পকের সেই রূপরেখা, ছন্দলাবণ্য।

সেই প্রাচীন রূপ যা গানের কীর্তনভাবকে প্রবলভাবে ডেকে আনে। এখন আমরা শুনব…

‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’

শনিবারের চিঠি, বাষট্টি বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা