ভারতীয় সংস্কৃতি থুড়ি বাঙালির রক্ষণশীলতাকে অতি সহজভাবে উপেক্ষা করে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেছেন অ-ভারতীয় সঙ্গিনীকে – এমন সব মানুষ যাঁরা পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত অথচ সামাজিকভাবে তৎকালীন বঙ্গ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁদের কথাই আলোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধে।
আলোচনার শুরু মধুকবি, রেবেকা ও হেনরিয়েটাকে দিয়ে।পরবর্তীতে এমন আরও অনেককে নিয়ে।
।।১।।
মধুকবি, রেবেকা ও হেনরিয়েটা
কোন বঙ্গসন্তান প্রথম একটি মেমসাহেবাকে ঘরনি করে নিয়ে এসেছিলেন—এ বিষয়ে তামা-তুলসী-গঙ্গাজল হাতে নিয়ে আমি সত্যি কথাটা বলতে পারব না। কারণ তেমন তথ্য প্রমাণ নেই। তবে জানাশোনা যে মানুষটি এই কাজে প্রথম এগিয়ে গিয়েছিলেন বলে আমাদের কাছে ‘পাথুরে’ প্রমাণ আছে—তাঁকে মোটামুটি চোখমুখওয়ালা বাঙালি মাত্রেই চেনেন, জানেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের মহাকবি, বাঙালি হলেও ধর্মে খ্রিস্টান এবং জীবনে অনেক আলোড়নকারী ঘটনার সংঘটক—মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
তিনি যখন ‘ভদ্রলোক’ হয়ে ওঠেননি—বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন—তখনই স্বপ্ন দেখতেন একটি ‘নীলনয়না’ সঙ্গিনীর। খিদিরপুরের বাড়িতে বসে সতেরো বছরের মধু ‘My fond sweet blue-eyed maid’-এর উদ্দেশে কবিতা লেখেন–
I loved a maid, a blue-eyed maid,
As fair a maid can e’er be, O
কখনও বা কোনও পেনিলোপি বা অজানা কুমারীর উদ্দেশে প্রেম নিবেদন করে বসেন কবিতায়—তাকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে চুমুতে চুমুতে প্রাণ ভরাতে চেয়েছেন–
When I gladly met her beneath you almond tree…
Thee I kissed and embraced her, and Oh! Who can tell
What passions tumultuous did my bosom swell!
কিন্তু সে ইচ্ছা তখনই পূরণ হয়নি। সেজন্য বঙ্গভূমি ছেড়ে তাঁকে দূর মাদ্রাজে যেতে হয়েছিল—অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁর চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত। যিনি এলেন তিনি ‘নীলনয়না’ ছিলেন কিনা বলতে পারব না—তবে সপ্তদশ বৎসরের সেই পুরনো আকাঙ্ক্ষা তাঁর কাছে এসেছিল সপ্তদশী হয়েই। রেবেকা টমসন ম্যাকট্যাভিশ যখন মাইকেল মধুসূদন ডাটকে বিয়ে করলেন, ৩১ জুলাই, ১৮৪৮ তারিখে,–তখন তিনি ঠিক সতেরো।
কিন্তু বিয়ের আগে পরিচয়ের একটা পর্ব ছিল—ইংরেজ মতে যাকে বলে কোর্টশিপ—আমাদের ভাষায় মন দেওয়া-নেওয়ার। কৃষ্ণাঙ্গ, মাদ্রাজে একেবারে অপরিচিত এবং বিত্তহীন মধুসদনের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গিনীর পরিচয়পর্ব বিষয়ে আলোকপাত করার মতো উপকরণ আমাদের নেই। কাছেই থাকেন দু’জনে—চিঠিপত্র লেখালেখি যা হয়েছিল তার নমুনা নেই। হয়তো মধুসূদনের আয়ত দুটি নয়নে প্রেমের কাঙালপনা, হয়তো বা সব মিলিয়ে মধুর ব্যক্তিত্বে এই শ্বেতাঙ্গিনী মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরিচয়টা ঘটে যাওয়ার পর বিয়ের জন্য তাঁরা কালক্ষেপ করেননি। মাদ্রাজে আসা, প্রেমে-পড়া এবং বিয়ে-করার মধ্যে মাস ছয়েকের ব্যবধান। নিঃসঙ্গ-নিঃসম্বল জীবনে একটা অবলম্বন তো মধুর দরকারই ছিল। বিয়ে হল রেজিস্ট্রি করে। সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত জেসি রে, রিচার্ড নামেই যিনি পরিচিত ছিলেন; অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নেইলার ও তাঁর স্ত্রী সুসানাহ্ এবং এডওয়ার্ড প্রাইস। নেইলার ছিলেন অরফ্যান মাদ্রাজের অ্যাসাইলামের হেডমাস্টার। এই অনাথ আশ্রমেই তো শিক্ষকের কাজ পেয়েছিলেন মধুসূদন। দুটো অ্যাসাইলাম—একটি ছেলেদের, অন্যটি মেয়েদের। রেবেকা এই মেয়েদের অনাথ আশ্রমের সদস্যা ছিলেন। কিন্তু পড়াশোনা করতেন ছেলেদের স্কুলে—সেই সূত্রে মধুসূদনের ছাত্রী এবং ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমে নাকি একটা সামাজিক সম্মতি থাকে।
মধুসূদনের বেলাতেও প্রেমের পথটি খুব মসৃণ ছিল না, কিছুটা কন্টকাকীর্ণ ছিল। কোত্থেকে একটা কালো-কেলো লোক এসে একটা সাহেবের মেয়েকে দখল করে বসবে—এ তো হতে দেওয়া যায় না। বাধা দেওয়ার লোকের অভাব ঘটেনি। নইলে বন্ধু গৌরদাসকে চিঠিতে মধুসূদন লিখবেন কেন-‘তাঁকে পেতে আমার দারুণ ঝামেলা হয়েছিল। তাঁর বন্ধুরা, বুঝতেই পারছ, এই বিয়ের খুব বিরোধী ছিল। কিন্তু সব ভাল যার শেষ ভাল।’ বিয়েতে পাত্র-কন্যা দু’জনেই কিছু কিছু মিথ্যা ব্যাপার ঘটিয়ে বসলেন। ভবিষ্যতে যিনি ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক লিখবেন— তাঁর পক্ষে এটা স্বাভাবিক ছিল। শর্মিষ্ঠা, দেবযানীর স্বামী যযাতিকে বিয়ে করতে গিয়ে বলেছিলেন, পাঁচপ্রকার অবস্থায় মিথ্যা কথা বললে পাপ হয় না। এই পাঁচপ্রকার কনসেশনের মধ্যে অন্যতম ছিল—স্ত্রীলোকের মনোরঞ্জন। অতএব নিজের এলেম দেখানোর জন্য ছেচল্লিশ টাকা মাইনের মাস্টারমশায় পিতৃপরিচয় দিতে গিয়ে রেজিস্টারে মিথ্যে লিখলেন—রাজনারায়ণ দত্ত, অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট। আর নাগপুর-জাতা কন্যা রেবেকা, গরিব গোলন্দাজের পিতৃহীন অনাথ-আশ্রম-পালিতা—বাবার নাম লিখলেন—ডুগাল্ড ম্যাকট্যাভিশ। অথচ তাঁর বাবা তো ছিলেন রবার্ট টমসন আর মা ক্যাথরিন টমসন। মাইকেল কেন যে তাঁর শ্বশুরের পরিচয় দিতে গিয়ে গৌরদাস বসাককে নীলকর বলেছিলেন বুঝতে পারি না। তবে কি শ্বশুর একজন নীলব্যবসায়ী অর্বুট নট কোম্পানির কর্মচারী একথা বললেন বন্ধুর কাছে—ইজ্জত কমে যাবে বলেই এমন কথা লিখেছিলেন?
যাই হোক গে, ইংল্যান্ডে যাওয়ার যে স্বপ্ন তিনি কৈশোর থেকেই দেখে আসছিলেন—এখনই তার পূরণ না হলেও এক শ্বেতাঙ্গিনীকে অঙ্কশায়িনী করে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটেছিল। বিয়ের পর ব্ল্যাকটাউন ছেড়ে এর লাগোয়া উত্তরের সাগরের ধারে রায়পুরমে একটি ভাড়াবাড়িতে, বেশি টাকা গুনেই, তিনি সংসার পাতলেন। সংসারের খরচ বাড়ল। একটু লেখালেখি করে তিনি আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। এরই মধ্যে তাঁর কবিপ্রতিভা থেমে না থেকে রচনা করে বসল ‘ক্যাপটিভ লেডি’ কাব্যটি। এ কাব্যের সূচনায় থেকে গেল রেবেকাবন্দনা।
‘’আমি রবিকরোজ্জ্বল স্বপ্ন বুনতে থাকবো আর তোমার নয়ন আমাকে জোগাবে
একমাত্র তোমাকেই নিবেদন করবো আমার মালা, প্রেমের মালা সৌন্দর্যের প্রেরণা;
সম্রাজ্ঞী সিংহাসনে।’
তারপরে বিবাহিত জীবনের অনিবার্য পরিণাম—রেবেকা গর্ভবতী হলেন। জন্ম নিল তাঁদের প্রথম সন্তান—সাদরে নামকরণ করলেন তাঁরা—বার্থা ব্লানশ কেনেট। তিন মাস পর তার ব্যাপটিজম্ হল। গৌরদাসকে চিঠি লিখে অনুরোধ করলেন তাঁদের কন্যাসন্তানের জন্মের কথা তিনি যেন তাঁর বাবা-মাকে জানিয়ে দেন। গৌরদাসকে চিঠিতে স্ত্রীর কথা লিখতেন মাঝে মাঝেই—কিন্তু রেবেকার পরিচয় দিতে গিয়ে তাঁকে বারবার Mrs. D লিখতেন কেন বুঝি না। Mrs. Dutt-এর সংক্ষিপ্ত রূপ না রেবেকাকে আদর করে যে নামে ডাকতেন তার আদ্যাক্ষর।
সন্তান জন্মের পর সংসারের খরচ বেড়েছে, পদোন্নতি হওয়ায় আয়ও; কিন্তু সন্তানের জন্ম দিয়েই রেবেকার স্বাস্থ্যহানি ঘটেছিল। সম্ভবত তিনি জন্মভমি নাগপুরে(উত্তরে)চলে এসেছিলেন স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য। কিন্তু তিনি বিরহদশাক্রান্তাও হলেন। দেড় বছরের কিছু বেশি কালের মধ্যে উভয়ের মধ্যে এই সাময়িক দরত্ব দু’জনকেই বিরহানলে জর্জরিত করেছিল—এই অনুমান অস্বাভাবিক হবে না। নইলে মধুসূদন কেন ‘On the Departure of My Wife and Child to the Upper Provinces’ নামে কবিতাটি লিখে বসবেন–
My house is lonely– for I seek in vain
For them Who made it star-light there’s a cry
Of anguish fiercely wrong by untold pain
E’en from heart’s of heart’s! Hear it on high.
ঈশ্বরের কাছে তাঁদের জন্য সকাতরে প্রার্থনা জানিয়েছেন।
।।২।।
আমি জানি না কেন এই আপাত-বিরহটুকু অনিবার্যভাবে এসে গিয়েছিল। কারণ এই আপাত-বিরহ সূচনা করেছিল এক চিরস্থায়ী বিরহের জন্মলগ্নকে। রেবেকা স্বাস্থ্যোদ্ধারে যাওয়ামাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এগারো এপ্রিল তারিখে এক ভদ্রমহিলা মাত্র একচল্লিশ বছরে মারা গেলেন—যাঁর অবিবাহিত একটি কন্যার নাম হেনরিয়েটা। এই ঘটনাই মধুসূদনের সঙ্গে হেনরিয়েটাকে জুটি বা একটু কাছে এনে দিয়েছিল—যদিও এই ঘটনার সময় উভয়ের ঘনিষ্ঠতা বাড়ার ব্যাপারটি ঘটে যায়নি।
যাই হোক, রেবেকা ফিরে এলেন উত্তরপ্রদেশ থেকে এবং আসার পরেই পুনশ্চ গর্ভবতী হয়ে পড়েন। ১৮৫১ সালে জন্ম নিলেন দ্বিতীয় কন্যা ফিবি। সংসারে খরচ বাড়তেই থাকল। কিন্তু দু’’জনেই বেহিসেবি। ৯ মার্চে এই কন্যার জন্ম হল আর অক্টোবরে পুনশ্চ তৃতীয়বারের জন্য রেবেকার গর্ভসঞ্চার ঘটে গেল–
‘বেদের আদরে বেদেনি রে তোর চুলে বাঁধিয়াছে জট,
তারি সোহাগের বাঁধনে ভেঙেছে তনুর তট।’
তৃতীয় সন্তানের জন্ম অর্থকষ্টকে ত্রিগুণিত করে দিল। এই সময়ে মাদ্রাজ স্কুলে চাকরি পেয়ে খানিকটা অর্থ-স্বাচ্ছন্দ্য এল। এবার জন্ম হল একটি পুত্র সন্তানের ২৬ জুলাই তারিখে। নিশ্চয়ই দত্ত-দম্পতি খুব খুশি হয়েছিলেন। তার নামকরণ হল জর্জ জন ম্যাকটাভিশ ডাট। এবার বাড়ি বদল করলেন তাঁরা—রায়পুরমের বাড়ি ছেড়ে উঠে এলেন ভেপারি ক্যাসেলেটে।
এই সময়েই খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল সহকর্মী জর্জ হোয়াইটের সঙ্গে। রায়পুরমে তিনিও অনেকদিন ছিলেন—তখনই পরিচয় ছিল। এখন ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল মিসেস হোয়াইট মারা যাওয়ায়—মিসেস অ্যালাইজা হোয়াইট তিনটি সন্তান রেখে চলে গিয়েছিলেন। বড় মেয়ে এমিলিয়া হেনরিয়েটা সফাইয়া–ও তখন সতেরো বছরের। তাঁর বাবা অবশ্য আবার একটি বিয়ে করে বসেছিলেন। ছোট দুটি ভাইকে নিয়ে হেনরিয়েটা অবশ্য এই বিয়েতে অসুখীই হয়েছিলেন। প্রায় পরিত্যক্তা হেনরিয়েটার পাশে দাঁড়ালেন কবি মধুসূদন। সপ্তদশী তাঁকে গ্রহণ করলেন সমস্ত মন দিয়ে। ততদিনে মধুসূদন চার সন্তানের জনক। গৌরদাস বসাককে চিঠিতে লিখলেন—‘I have a fine English wife and four children.’ চিঠি লেখার তারিখ ২০ ডিসেম্বর, ১৮৫৫।
আর এই চিঠি লেখার ক’টা দিন পরেই মধুসূদন গোপনে মাদ্রাজ ত্যাগ করে fine wife আর চারটি সন্তানকে ছেড়ে (ছোট ছেলে জেমস তখন মাত্র দশ মাসের, ক’দিন পরে তার মৃত্যুও হল) কলকাতার উদ্দেশে রওনা হলেন। Holt ছদ্মনামধারী মধুসূদন কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়েও আর মাদ্রাজে ফিরে এলেন না। Fine wife and four childen চিরতরে পরিত্যক্ত হয়ে গেলেন। কী তাঁদের অপরাধ জানি না। যে রেবেকা তাঁর মন জুড়ে ছিলেন—কেন তাঁর প্রতি এই নিষ্ঠুরতা বুঝি না। সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল। হেনরিয়েটাকে দায়ী করব? কিন্তু কেন? সাড়ে ছ’বছরের বার্থা, চার বছর দশমাসের ফিবি, সাড়ে তিন বছরের জর্জকে ছেড়ে এম এম ডাট যখন কলকাতা বন্দরে পা দিলেন, তখন তিনি মি: হোল্ট। ১৮ জানুয়ারি ১৮৫৬ –সেই যে কলকাতায় পা রাখলেন আর ফিরে গেলেন না।
আর ফিরে পেতে চাইলেন না অভিমানিনী ব্যক্তিত্বময়ী রেবেকাও, তাঁর স্বামীকে। কিন্তু কোনও বিবাহ-বিচ্ছেদের ব্যাপারেও তিনি এগিয়ে আসেননি। হেনরিয়েটাকে মধুসূদন তাই আইনসম্মতভাবে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করার অধিকার পাননি। মধুসূদন মাদ্রাজ ছাড়ার পর আরও ছত্রিশ বছর বেঁচেছিলেন রেবেকা। ততদিনে ক্ষয় রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছিল। তাতেই তাঁর জীবনের অন্তিম লগ্ন এগিয়ে এসেছিল। ততদিনে স্বামী মধুসূদন ও সপত্নী হেনরিয়েটার মৃত্যু ঘটেছিল। বৈধব্যকে ভূষণ করে মধুসূদনকেই একমাত্র স্বামী হিসেবে ভাবতে ভাবতে রেবেকার মৃত্যু ঘটেছিল। জানি না হিন্দুসমাজ এই পতিপরায়ণা একলগ্নী শ্বেতাঙ্গিনী বধূকে সাধ্বী স্ত্রীর সম্মান দেবে কিনা। শুধু ঘৃণায় তাঁর সন্তানেরা ‘ডাট’ পদবি বিসর্জন করেছিলেন।
।।৩।।
হেনরিয়েটার জন্ম ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ, মধুসূদনের চেয়ে বারো বছরের ছোট। মধুসূদনের ঘরে যখন এলেন ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে—তখন তিনি বাইশ বছরের। মধুসূদন জাহাজে করে কলকাতায় এসেছিলেন ১৮৫৬ সালের গোড়ায়। ততদিনে হেনরিয়েটার কারণে রেবেকার সংসার ভেঙে তছনছ। আসার সময় নিশ্চয়ই হেনরিয়েটাকে বলে এসেছিলেন। যেহেতু রেবেকার সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়নি, স্বভাবতই কুমারী হেনরিয়েটাকে মাদ্রাজে রেখেই তাঁকে চলে আসতে হয়েছিল। কিন্তু কতদিন তিনি মধুকে ছেড়ে মাদ্রাজে থাকতে পারবেন সৎমা মিসেস হোয়াইটের কৃত্রিম সংসারে? অতএব তাকে একাই কলকাতা চলে আসতে হল জাহাজে চড়ে। সম্ভবত ১৮৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এসে পড়লেন মধুর খিদিরপুরের বাড়িতে, একাই এলেন।
তিনি এলেন নয়, তাঁর আগমন ঘটল। আর আবির্ভাব ঘটল বাগদেবীর। মধুসদন মগ্ন হলেন সাহিত্যের সমুদ্রে। হেনরিয়েটা অনেকটাই শিক্ষিতা, তার উপরে স্বামীকে ভালবেসে বাংলাও শিখেছেন বেশ খানিকটা—স্বামীর লেখা নিজে পড়বেন বলে। পিতার অনুমতি ছাড়াই চলে এসেছিলেন কলকাতায় প্রেমিকের কাছে, হয়তো স্বামীর মতোই তিনিও ছদ্মনামে জাহাজে চড়েছিলেন। যে সময়ে তিনি কলকাতায় আসেন—সে সময়ের কাছাকাছি যে-সব যাত্রীবাহী জাহাজ মাদ্রাজ থেকে কলকাতা এসেছিল—তাদের যাত্রী-তালিকায় হেনরিয়েটা নামের কোনও যাত্রীর সন্ধান পাননি অনেক অনুসন্ধান করেও গবেষক গোলাম মুরশিদ। সেজন্যেই মনে হয় তিনিও মি: হোল্ট জাতীয় মিসেস কিছু হয়ে গিয়েছিলেন।
হেনরিয়েটা এসে গেছেন ১৮৫৮ সালে—কিন্তু মধুসূদনের কোনও চিঠিতেই এই আগমনের প্রসঙ্গ নেই। ৯ জানুয়ারি ১৮৫৯ তারিখে মধুসদন গৌরদাস বসাককে যে চিঠিটি দেন, তাতেই তিনি প্রথম শ্রীমতী দত্তের উল্লেখ করে লেখেন–‘Mrs. Dutt desires me to convey to you her best thanks for your letter received yesterday and for the interest you evince in our affairs.’ এ থেকে বোঝা যায় মধুসূদন-হেনরিয়েটার পরিবারে গৌরদাস বসাক ভালভাবেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন ইতিমধ্যেই।
কলকাতায় আসার পরে পরেই হেনরিয়েটার গর্ভসঞ্চার হয়েছিল—তাঁর গর্ভে তাঁদের সন্তান শর্মিষ্ঠার জন্ম হয় ১৮৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে৷ প্রসঙ্গত, কলকাতায় আসার পর নিয়মিত ব্যবধানে হেনরিয়েটা স্বামীকে চারটি সন্তান উপহার দিয়েছিলেন৷ তার মধ্যেই রচিত হয়ে গিয়েছিল ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১)৷ এবং হেনরিয়েটার স্বামী তখন মহাকবি৷ জানি না, হাফ-ইংলিশ এই কন্যার মনে তাতে কী প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল৷
কিন্তু অনুমান করতে বাধা নেই যে হেনরিয়েটা যখন প্রথম সন্তানের জন্ম দেন তাঁর এক নিঃসঙ্গ অজানা পরিবেশে, তখন প্রেমিক মধুসূদন কী গভীর আশ্লেষে হেনরিয়েটার পাশে থেকে তাঁকে সন্তান পালনে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন৷ সাড়ে ন-বছর আগে মাকে হারিয়েছিলেন, তাঁর ছোট ভাইটিও দেখতে দেখতে বিশ বছরে পা দিয়েছিল—সুতরাং সন্তানপালন কী জিনিস হেনরিয়েটার অভিজ্ঞতায় ছিল না৷ রেবেকার চার সন্তানের জনক হিসেবে নিশ্চয়ই মধুসূদন সে তুলনায় অভিজ্ঞ পিতা৷ হেনরিয়েটা অ্যালাইজা শর্মিষ্ঠা অতএব পিতা-মাতা উভয়ের লালনে বেড়ে উঠছিলেন৷ বিবাহ-বিচ্ছেদ যে ঘটেনি- এই সত্যটা লুকিয়ে রাখার কারণে শর্মিষ্ঠাকে ব্যাপটাইজ করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল৷ পূর্বপক্ষের সন্তানদের ছেড়ে আসার শূন্যতা (বেদনা বলা কি ঠিক হবে!) শর্মিষ্ঠাকে পেয়ে পূর্ণ হয়েছিল অনুমান করি৷ কিন্তু তাকে আদর করতে গিয়ে বার্থা, ফিবি, জর্জ, মাইকেলের স্মৃতি কি তাঁকে পীড়িত করেনি! রেবেকার কথাও কি মধুসূদনকে মর্মপীড়া প্রদান করেনি! রেবেকাকে ছেড়ে মধুর পালিয়ে আসাটা তাঁর বন্ধুদেরও ভাল লাগেনি৷ রাজনারায়ণ বসু তো গভীর সন্দেহ করতেন—মধুসূদন হেনরিয়েটাকে কোনওদিনই বিয়ে করেননি—পালিয়ে এসে (আজকের ভাষায় লিভ টুগেদার) দাম্পত্যজীবন যাপন করেছিলেন৷ প্রশ্ন উঠতে পারে সামাজিক বিয়ে হলেই কি তবে বিয়ে, নইলে নয়! সে সব তর্ক তোলা থাক—সাধ্বী হেনরিয়েটাকে এখন আমরা দেখি মধুর প্রতি তিনি কতখানি আসক্ত!
সংসারজীবনে নিরবচ্ছিন্ন সুখ কেউ উপভোগ করেন না৷ হেনরিয়েটার পিতার মৃত্যু হল এক সময়৷ হয়তো সেই মৃত্যুর কথা মনে রেখেই রাজনারায়ণ বসুকে তিনি লিখেছিলেন–‘I am in mourning for a relative of my wife’s– that died in England five months ago’ ইনিই সম্ভবত শ্বশুর—হেনরিয়েটার গর্ভধারিণীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার বিয়ে করায় হেনরিয়েটা যাঁর কাছ থেকে দূরে চলে গিয়েছিলেন৷ সেজন্যই কি ‘শ্বশুরমশাই’ তাঁর শুধুমাত্র রিলেটিভ হয়ে গিয়েছিলেন! অবশ্য একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে— ইনি শ্বশুরমশায় নাও হতে পারেন৷ কারণ জর্জ জাইলস হোয়াইট মাদ্রাজে মারা যান ৭ জানুয়ারি ১৮৬১ সালে৷
আগেই বলেছি হেনরিয়েটা স্বামীকে ভালবেসে বাংলা শিখেছিলেন৷ শিখেছিলেন স্বামীর বাংলা রচনার স্বাদ গ্রহণ করবেন বলে৷ ‘তিলোত্তমা’ কাব্যের তিনিই প্রথম পাঠিকা—বন্ধু রাজনারায়ণকে লিখে সেই কথাই মধুসূদন সপ্রেমে উল্লেখ করেন–‘Your good wife, by the bye, is not the first lady-reader of Tilottama. The author’s wife claims to have read it before her.’
৷৷৪৷৷
এই ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ মধুসূদনকে খ্যাতি এনে দিল বটে, কিন্তু পুরনো স্বপ্নটা ‘Sigh for the distant sea’—আবার জেগে উঠল এই খ্যাতির সূত্রে৷ বিদেশে যাওয়ার জন্য তিনি ব্যগ্র হয়ে উঠলেন৷ জমি-জায়গা বিক্রি করে কিছু টাকাও হাতে এসেছে, কিন্তু তা দিয়ে গোটা পরিবারকে নিয়ে বিদেশে যাওয়া যাবে না৷ হেনরিয়েটা আর ছোটদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, বন্ধুদের কাউকে তাঁর পাওনা আদায় করে হেনরিয়েটাকে দিতে ও তাঁকে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করে, কারওর ওপর পরিবারকে দেখার ভার দিয়ে তিনি ১৮৬২ সালে ৯ জুন সোমবার সকালবেলা বিলেতের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন৷ জাহাজ তিনদিন পরে মাদ্রাজ বন্দরে ভিড়ল৷
“বাধ্য হয়ে লাউডন স্ট্রিট ছেড়ে বামুনপাড়া, সেখান থেকে বেনেপুকুরের ওঁচা পাড়ায়৷ হেনরিয়েটা সর্বংসহা সাধ্বী—সব কিছুকেই মানিয়ে নিচ্ছেন৷ উপায় কী! টাকার জন্য কবি ছুটছেন পুরুলিয়া-পঞ্চকোটে প্রাণের দায়ে৷ কলকাতায় দিন গুজরান করেন হেনরিয়েটা কায়ক্লেশে৷ ঋণের পরিমাণ পাহাড়প্রমাণ৷”
অনুমান করতে বাধা নেই, পূর্বস্মৃতি মধুসূদনকে উতলা করে তুলেছিল৷আশঙ্কাও কি হয়নি? যদি রেবেকার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! তাঁর বার্থা (এমন নাম কি কেউ দেয়!), ফিবি, জর্জ আর মাইকেল এই চার বছরে নিশ্চয়ই বড় হয়ে উঠেছে, ওরা নিশ্চয়ই আরও সুন্দর হয়েছে৷ আর ওদের মা-ও কি আগের মতো সুন্দর নেই৷ বিদেশে পাড়ির চেয়ে দূরবর্তী একটা জগতে মধুসূদনের মন পাড়ি দিয়েছে—তার খেই নেই, পার নেই, বন্দর নেই৷ ছেলেমেয়েরা কোন স্কুলে পড়ছে, কেমন হয়েছে পড়াশোনায়, তাদের মা কী করে সংসার পালন করছে—নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে ওর৷ বন্ধুরা সব কেমন আছে? একবারটি কি ওদের সঙ্গে দেখা করে আসব? যদি রেবেকার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে?
ভাবতে ভাবতে জাহাজ ছেড়ে দেয়, কলকাতা আর মাদ্রাজ দূর থেকে দূরতর হয়ে চলে৷ মনকেমনের হাওয়ার পাকে স্মৃতিগুলো মেদুর হয়ে ওঠে৷ হয়তো হেনরিয়েটা আর সন্তানদের চিন্তাই প্রধান হয়ে দেখা দেয়৷ তারপরে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য খুঁটিনাটি পার করে পড়া শুরু৷ বিলাসী জীবনও৷ কিন্তু সুখ বস্তুটার সঙ্গে মধুর সম্পর্ক কখনও গড়ে ওঠেনি মধুসূদনের৷ কলকাতায় মহাদেব চট্টোপাধ্যায় তাঁর তালুকের পত্তনিদার ছিলেন—কথা ছিল নিয়মিত পাওনা টাকা তিনি পাঠাবেন৷ কথা থাকলেও রাখবার পাত্র ছিলেন না চাটুজ্যেমশায়, অতএব টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন৷ হেনরিয়েটাকেও তাঁর টাকা দেওয়ার কথা—দু-এক কিস্তি দিয়ে তা-ও বন্ধ করলেন মহাদেব৷ আত্মীয়- স্বজনদের ব্যবহারও এর চেয়ে ভাল ছিল না৷ বিলেতে মধুসূদন কলকাতায় হেনরিয়েটা—দু’জনেই ভেবে কুলকিনারা পান না—কীভাবে এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷ তার ওপর মধু তো চিরদিন বেহিসেবি—ঋণ করে ঘি খাওয়ার দলে, যাকে বলে চার্বাকপন্থী আর হেনরিয়েটার নিজস্ব কোনও সম্বল নেই৷ তবে কি তিনি ভালবাসার দায় মেনে ছেলেমেযেদের নিয়ে পথের ভিখারি হবেন? শেষ অবধি মরিয়া হয়ে—স্বামী চলে যাওয়ার ন-মাস পরে তিনি ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসের শেষে কলকাতা ছেড়ে লন্ডনের পথে রওনা দিলেন—মরতে যদি হয় তবে সবাই মিলে মরব৷ মধু কি একটা উপায় করবে না! দুটি সন্তানকে নিয়ে তিনি লন্ডনে পৌঁছলেন ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২ মে৷ আর মাইকেল পড়লেন বিপাকে৷ নিজেরই সংস্থান নেই—এদের নিয়ে কী করবেন, কোথায় থাকবেন ভেবে তিনি পাগল৷ হেনরিয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন—তুমি কি কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে আনতে পেরেছ৷ পেরেছেন শুনে কম ভাড়ায় একটা বাড়ি নিয়ে কায়ক্লেশে দিন কাটাতে লাগলেন৷ এতদিন পরে হেনরিয়েটাকে কাছে পেয়ে মধুসূদন উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন কিনা জানি না৷ যেমন জানি না রাগারাগি করেছিলেন কিনা৷ কিন্তু সন্তানদের পেয়ে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন৷
কিন্তু লন্ডনে খরচ অনেক বেশি৷ তাই স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে অপেক্ষাকৃত কম খরচের ফ্রান্সের ভার্সাইতে চলে এলেন মধুকবি৷ রু দ্য শিঁতয়ে নামে একটি রাস্তার উপরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করলেন, বাড়ির নম্বর ১২৷ আঠারোটি অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের বাস এই ফ্ল্যাটে৷ মধুকবির বাসের কোনও উপযুক্ততা ছিল না এই বাড়ির৷ কিন্তু অন্নচিন্তা চমৎকারা৷ হেনরিয়েটা এখানেই স্বস্তিতে মাথা গুঁজে নিলেন৷ স্বামী লেখালেখি যাতে শান্তিতে করতে পারেন—এই সর্বংসহা নারী তার আয়োজন করতে লাগলেন৷
কিন্তু জমা টাকা দ্রুত ফুরিয়ে আসছে—তার উপরে হেনরিয়েটা তৃতীয়বার গর্ভবতী হয়েছেন৷ কলকাতা থেকে টাকা আসে না, ধার পাওয়াও আর অসম্ভব৷ বাড়ির কাছের চার্চের সাহায্য যদি না পেতেন, তবে হয়তো অনাহারেই তাঁকে সপরিবারে মরতে হত৷ এবারে বুঝি তাঁকে ঋণের টাকা শোধ না করার দায়ে জেলে যেতে হবে৷ চিঠি লিখলেন একমাত্র ভরসা Vid-কে—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে৷ শুধু চিঠি যেতেই সময় লেগে যায় প্রায় পাঁচ সপ্তাহ৷ একটা নয়, পরপর এমন অনেক চিঠি৷ একটাতে লিখলেন বই থেকে পাওয়া তাঁর আয় তিনি ভার্সাইনিবাসী মাদমোজেল এলাইজা শর্মিষ্ঠা দত্ত ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের দিয়ে যেতে চান৷ এর মধ্যে স্ত্রী অ্যামেলিয়া হেনরিয়েটা সফাইয়া দত্ত-ও আছেন৷ এ সব চিঠি যখন লিখছেন তখন ভার্সাইয়ের ফ্ল্যাটের অন্য প্রতিবেশীরা তাঁর ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে পালা করে লম্বা রুটি আর দুধের বোতল রেখে আসতেন৷ দরজা খুলে হেনরিয়েটা সেই দুধের বোতল ছেলের মুখে তুলে ধরতেন—হবু ব্যারিস্টার মাইকেল এম এস ডাট-এর স্ত্রী তিনি৷
একদিন পাড়াতেই একটা মেলা বসেছে৷ শর্মিষ্ঠা আর মিলন বায়না ধরেছে, তারা মেলাতে যাবেই৷ হেনরিয়েটার সম্বল মাত্র তিনটি ফ্রাঁ৷ মধুকে বললেন, তিনটি মাত্র ফ্রাঁ নিয়ে তো মেলাতে যাওয়া যায় না, তুমি একটা কিছু ব্যবস্থা কর৷ কিন্তু কী করবেন তিনি৷ নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পায়ের ওপর পা দিয়ে পড়ে চলেছেন শার্ল বোদলেয়ার৷ স্ত্রীকে বললেন—একটা চিঠি তো দিয়েছি এমন একজনকে— Who has the courage of an English man, the wisdom of an ancient sage and the heart of a Bengali mother, ভরসা করছি আজকের ডাকেই, আজই তো ডাক আসার দিন—তিনি কিছু টাকা পাঠাবেন৷ সেদিনই ডাকে তাঁর পাঠানো টাকা এল—চোদ্দোশো টাকা! পাঠিয়েছেন তিনিই—‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’৷
৷৷৫৷৷
নাঃ, এভাবে আর বিদেশে পড়ে থাকা চলে না৷ স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে একাই দেশে ফিরে আসা স্থির করলেন৷ ব্যারিস্টার তো হয়ে গেছেন৷ দেশে ফিরে গিয়ে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে প্রচুর প্রচুর টাকা উপার্জন! মাইকেল এম এস ডাট তো যে সে পাত্তর নয়৷ সুতরাং তিনি কলকাতায় ফিরে এলেন৷ তখনও হাইকোর্টে প্র্যাক্টিস করার জন্য আবেদন করেননি, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল—‘ফিরে এসেই উঠেছেন বিলাসবহুল স্পেন্সেস হোটেলে৷ অথচ ফেরার আগে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে লিখেছিলেন—প্র্যাক্টিস জমার আগে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে দেশে ফেরা উচিত হবে না৷ কিন্তু সেই অনুচিত কাজটাই করে বসলেন৷
হোটেল কর্তৃপক্ষ টাটকা ব্যারিস্টার এম এস ডাটকে প্রথম প্রথম খুব খাতির করেছিল৷ তারপর ধার জমতে জমতে তার পরিমাণ দেখে তাদের চক্ষু চড়কগাছ৷ পশার নেই, টাকা নেই—যা টাকা পান সবই হোটেলে দিতে হয়৷ গর্ভবতী স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের আর কী-ই বা পাঠাবেন! এখানে ধার ওখানে ধার করে ঋণে মাথার সব চুল বিকিয়ে দিলেন৷ কিন্তু দূরবর্তী হেনরিয়েটার কাছে স্বামীর ছবিটা উজ্জ্বলই হয়ে উঠেছিল৷ তাই একটা মোটা খরচের ঝুঁকি নিয়েও ওই দূরদেশে প্রমোদ-ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন—প্যারিসের উত্তর-পশ্চিমে সমুদ্র-বন্দর ডিয়োপ-এ৷ কিন্তু ফিরে এসে বুঝলেন তিনি ঝুলছেন একটা শূন্যের ওপরে৷ সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য তিনি শুরু করলেন মদ্যপান৷ না, কলকাতায় থাকতেই স্বামীকে সঙ্গ দিতে আগেই মদ খাওয়ার অভ্যাস করেছিলেন আর এখন মদ যাতে তাঁকে খায়— সেই অভ্যাসটা ভালমতোই করতে শুরু করলেন৷
আর এই বেসামাল অবস্থাতেই আর একটা বেসামাল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন৷ এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মাদ্রাজ ছেড়ে কলকাতা আসার সময়৷ তখন ছিলেন ঝাড়া-হাত-পা৷ এখন তিনটি সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে অপারগ হেনরিয়েটা কলকাতায় ফিরে আসাটাই স্থির করলেন৷ কিন্তু পাথেয় কোথায়? একে-ওকে ধরে জাহাজ কোম্পানির কাছে ইনিয়ে-বিনিয়ে মিথ্যে কথা বলে, আর্থিক দুর্গতির কথা বলে দয়া ভিক্ষা করে, স্বামীর কাছে চলে আসার ব্যবস্থাটি করে নিলেন হেনরিয়েটা৷ ভালবাসার জন্য কত মূল্যই দিতে হয়৷
কলকাতায় এসে দেখলেন স্বামীর সারা শরীরে প্রৌঢ়ত্বের ছাপ, মোটাও হয়ে গেছেন কবি—‘অ্যালকোহলিক ফ্যাট’! কবির বিলাসবাহুল্য একটুও কমেনি৷ স্পেন্সেস হোটেল ত্যাগে বাধ্য হয়েই ৬ লাউডন স্ট্রিটের বাড়িটি ভাড়া করেছেন চারশো টাকা দিয়ে৷ ১৮৬৯ সালে চারশো টাকা—কল্পনা করা যায় কি! হেনরিয়েটা হাজার চেষ্টা করেও কবির বিলাসিতার লাগাম টেনে ধরতে পারেন না– তাঁর সমস্ত গৃহিণীপনা ভেঙে চুরমার৷ এর ওপর কবি মাঝে মাঝেই পরিচিতদের ডেকে ভোজ খাওয়াচ্ছেন—নিজে করছেন আকণ্ঠ মদ্যপান৷ তার ওপরে জুটেছে বেড়াতে যাওয়ার শখ৷ তিনমাস এসে কাটিয়ে গেলেন সপরিবারে উত্তরপাড়ায়৷ মাস তিনেক সেখানে থেকে চন্দননগরে—স্বামী-স্ত্রী ফরাসি ভাষাটা রপ্ত করে নিলেন এখানে ভাল করে৷ আয় নেই, ব্যয় বেহিসেবি৷ দুর্গতি বেড়েই চলেছে—ব্যারিস্টার হিসেবে ব্যর্থ কবি হিসেবে সার্থক মধুসূদন৷ এর মধ্যে মামলার কাজ নিয়ে তিনি ঢাকা গেলেন—কিন্তু টাকা তেমন পেলেন না, বরং শরীরটা ক্ষতিগ্রস্ত হল খুব৷ ১৮৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ফিরে এলেন ঢাকা থেকে৷
বাধ্য হয়ে লাউডন স্ট্রিট ছেড়ে বামুনপাড়া, সেখান থেকে বেনেপুকুরের ওঁচা পাড়ায়৷ হেনরিয়েটা সর্বংসহা সাধ্বী—সব কিছুকেই মানিয়ে নিচ্ছেন৷ উপায় কী! টাকার জন্য কবি ছুটছেন পুরুলিয়া-পঞ্চকোটে প্রাণের দায়ে৷ কলকাতায় দিন গুজরান করেন হেনরিয়েটা কায়ক্লেশে৷ ঋণের পরিমাণ পাহাড়প্রমাণ৷ বিদ্যাসাগর আর কতদিন টানবেন! পঞ্চকোট থেকে কবি যখন ফিরলেন—জীবনীশক্তি নিঃশেষিত৷ তিনি কি জানতেন তাঁর আয়ু আর মাত্র ন-মাস! হেনরিয়েটারও তো তাই!
বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে
একে একে কাঠুরিয়া কাটি; অবশেষে
নাশে বৃষে, হে বিধাতঃ এ দুরন্ত রিপু
তেমতি দুর্বল দেখ করিছে আমারে
নিরন্তর৷ হব আমি নির্মূল সমূলে
এরপরে৷
১৮৬১ সালেই কবি তাঁর আপন পরিণাম এভাবেই কি দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর গ্র্যান্ড ফেলো রাবণের মধ্যে৷
ঢাকা থেকে ফেরার পরেই কবির স্বাস্থ্য খুব ভেঙে যায়৷ এবং হেনরিয়েটার স্বাস্থ্যও৷ আসন্ন মৃত্যুর ছায়া তিনি যেন চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন এবং তাকে আরও ত্বরান্বিত করার জন্য মদ্যপানের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ চার্বাক ঋণ করে ঘি পান করার পরামর্শ দিয়েছিলেন—মদ্যপানের কথা বলেননি৷ তাঁরা নিজে অনেক কষ্ট করেন, কিন্তু সন্তানদের যথাসম্ভব সুখে রাখার চেষ্টা করেন৷ এখন তাঁদের ভবিষ্যৎ কী হবে না ভেবেই তাঁরা মদ্যপান করে চলেছেন— ততদিনে যে মদেই তাঁদের খেয়ে ফেলেছে৷ এ কেমন দাম্পত্য জীবন, সংসার যাপন? মেয়েটি তত বড় হয়নি, তবুও বালিকা কন্যাটির বিয়ে দেওয়ার জন্য তার মা পাগল৷ ১৮৭৩ সালের ৭ মে শর্মিষ্ঠা নামের এক কিশোরীর সঙ্গে তার দ্বিগুণ বয়সের এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান যুবকের বিয়ে দিয়ে দিলেন৷ পাত্রের লজ্জাকর বয়সের কথা ভেবে বিয়ের দলিলে তাঁর বয়স লেখা হল পরিণত বয়স্ক– of age. আর শর্মিষ্ঠা ঠিক ১৩ বছর ৭ মাস ২২ দিন—শরীর-মনে অপ্রস্তুত৷ ছেলেটি ছবি আঁকেন৷ তাতে পেট চলে না বলে হাইকোর্টে অনুবাদের কাজ করতেন৷ সেই সুবাদেই হয়তো মাইকেলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল৷ এক সময় লাউডন স্ট্রিটেই থাকতেন৷ চেনা-জানাটা হয়তো তাতে একটু গভীরতর হয়ে উঠেছিল৷ চেনা-জানা সবাইকে দূরবর্তী করে রেখে মেয়ের বিয়ে দিয়ে মাইকেল নিজের কাছে সবচেয়ে বড় পরাজয়টি মেনে নিলেন৷ হেনরিয়েটার বুকের যন্ত্রণা কি সুরার তীব্রতায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল!
মেয়ে চলে গেছে৷ মন আরও শূন্য৷ ভাঙা মন নিয়ে চলে এলেন পুনশ্চ উত্তরপাড়ায়, লাইব্রেরির দোতলায়৷ আগের বারের স্বপ্নালু দৃষ্টি এখন মৃত্যুর ছায়া-কাতর৷ হাসপাতালে না গিয়ে লাইব্রেরির নির্জনতায় বাস হয়তো মহাকবি মধুসূদনের পক্ষে অন্য অর্থে সার্থক৷ কিন্তু এই নির্জনতা তাঁকে মদ্যপানের সুড়ঙ্গপথে মরণের আরও কাছাকাছি করে দিল৷ বন্ধুরা আসেন দেখা করতে– গৌরদাস, মনোমোহন ঘোষেরা৷ কিন্তু চিকিৎসা বলে কিছু নেই প্রায়৷সিরোসিস অব লিভার, উদরী আর হৃদরোগ তাঁকে জীর্ণ করে চিকিৎসার অযোগ্য করে তুলেছে৷
এ অবস্থায় শাশুড়ি হেনরিয়েটাকে উত্তরপাড়ায় না রেখে জামাতা উইলিয়াম ওয়াল্টার এবান্স ফ্লয়েড তাঁর ১১ নং লিন্ডসে স্ট্রিটের বাড়িতে তাঁকে আশ্রয় দিলেন৷ আর মাইকেলকে উত্তরপাড়ায় রাখা উচিত হবে না ভেবে ডক্টর সূর্যকুমার গুডিব চক্রবর্তী ও ডক্টর পামার তাঁকে অলিপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন৷ বন্ধুরা আসেন—এমনকী পাদ্রি কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ও৷ এই প্রথম একেবারে শেষ জীবনে তাঁদের দাম্পত্য জীবনে পাশাপাশি থাকাতে ছেদ পড়ে গেল৷ হাসপাতালে মধু রইলেন জীবনের শেষ সাত-আটটা দিন৷ বিছানাতে শুয়ে শুয়েই হেনরিয়েটার কথা একে-ওকে জিজ্ঞেস করেন৷ শরীরের যন্ত্রণা ছাপিয়ে মনের যন্ত্রণায় আরও কাতর হন৷ শেষে ২৬ জুন ১৮৭৩ তারিখে এক পুরনো কর্মচারী তাঁকে জানালেন হেনরিয়েটা আর নেই৷ মাত্র ৩৭ বছর ৩ মাস ১৭ দিনের একটি নারী, ভালবেসে যিনি মাদ্রাজের জীবন, আত্মীয়স্বজনের বন্ধন কাটিয়ে একা একা পাড়ি দিয়েছিলেন এক অজানা জীবনের উদ্দেশে, স্বামীকে ভালবেসে সমস্ত যন্ত্রণা সয়ে গেছেন—সেই ভালবাসার নদীটি মরুপথে হারিয়ে গেল৷ সকল দুঃখের কাঁটাকে যিনি ফুলে পরিণত করেছিলেন– ‘অবিবাহিত’ সেই সাধ্বী আমাদের প্রাতঃস্মরণীয়াদের তালিকায় ঠাঁই করে নিতে পারলেন না৷
ওদিকে মধুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল কিনা ছাব্বিশে জুনের সংবাদে—তার সাক্ষ্য কেউ দিয়ে যাননি৷ কিন্তু তাঁর অন্তর-বিষণ্ণতা প্রকাশ পেয়েছিল কীভাবে হেনরিয়েটার শেষকৃত্য পালন হবে তার উদ্বেগ-আবেগের ভাবনায়৷ তাঁর না আছে কোনও সঞ্চয়, না আছে লোকবল৷ কে তার দায়িত্ব নেবে৷ শুধু আকুল আর্তনাদে ভেঙে পড়ে বলেছিলেন—বিধাতা, তুমি আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে নিলে না কেন?
তারপরে বন্ধু মনোমোহন ঘোষকে কাতরভাবে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—হেনরিয়েটার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া ঠিকমতো হয়েছে কিনা, কাকে কাকে খবর দিয়েছিলে, কে কে এসেছিলেন৷ তুমি তো দশ বছর ধরে তাকে চিনতে৷ আর খুব করে জিজ্ঞেস করেছিলেন বারো আর ছ’বছরের ছেলে দুটোর জন্য৷ শর্মিষ্ঠার তো যা হোক একটা হিল্লে হয়ে গেছে—তাঁর ছেলেরা যদি দুটো খেতে পরতে পায় তো মধুর ছেলেরাও পাবে৷ মনোমোহন তাঁর কথা রেখেও ছিলেন৷
কিন্তু অনেক কথা ভাবার, আরও অনেক বিরহবেদনায় ক্লিষ্ট হওয়ার সময়ও তো তাঁর কমে আসছিল৷ উনত্রিশে জুন, রবিবার তাঁর অন্তিম লগ্ন এগিয়ে এল৷ বেলা দুটোর সময় মৃত্যু এসে তাঁর সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়ে দিল৷ বাঙালিরা বলে—‘সিঁথির সিঁদুর নিয়ে যে স্ত্রী চলে যায় সে ভাগ্যবতী৷ হেনরিয়েটা সিঁদুর পরেননি কখনও, কিন্তু ভালবাসার রাঙা রাগে সীমন্ত তাঁর রঙিনই ছিল৷ ভাগ্যবতী তিনি ছিলেন কিনা জানি না—কিন্তু মধুসূদন ভাগ্যবান ছিলেন এমন চিরবাঞ্ছিতা এক প্রেরণাময়ীকে বুকের কাছে পেয়ে৷
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪১৯