বাংলারঙ্গমঞ্চেরইতিহাসঃ মিনার্ভা থিয়েটার       

স্টার থিয়েটারের মতো মিনার্ভা থিয়েটারও ঐতিহ্যমণ্ডিত৷ ‘মিনার্ভা’ নামেই এই থিয়েটার এখনও পর্যন্ত চলছে৷ প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নাগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায় এই নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠা করেন৷ ৬ নং বিডন স্ট্রিটের যে জমিতে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই জমিতেই পাকা নাট্যশালা হিসেবে মিনার্ভা থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়৷থিয়েটারের ম্যানেজার হলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ৷ এমারেল্ড থিয়েটারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি মিনার্ভায় অভিনয় শি‍ক্ষক হিসেবে যোগ দেন৷ স্টেজ ম্যানেজার করা হয় ধর্মদাস সুরকে আর সঙ্গীত শি‍ক্ষক হিসেবে যুক্ত হন দেবকণ্ঠ বাগচী৷ সেই সময়ের বিখ্যাত চিত্রকর মঞ্চ বিশেষজ্ঞ মিস্টার উইলিয়ার্ড মঞ্চসজ্জার দায়িত্ব পান৷ রূপসজ্জা ও দৃশ্যসজ্জার দায়িত্ব পান পিম সাহেব৷ ধুমধাম সহকারে মিনার্ভা থিয়েটারের দ্বার উদঘাটিত হল ১৮৯৩ সালের ২৮ জানুয়ারি, শেক্সপিয়রের বিখ্যাত ট্র্যাজেডি ‘ম্যাকবেথ’ নাটক দিয়ে৷ অনুবাদ করেছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ৷ নাম ভূমিকায় অভিনয় করলেন গিরিশচন্দ্র৷ তিনকড়ি সাজলেন লেডি ম্যাকবথে৷ গিরিশচন্দ্রের ছেলে দানীবাবু সাজলেন ম্যালকম৷ ম্যাকডাফের চরিত্রে অঘোরনাথ পাঠক৷ লেডি‍ ম্যাকডাফের চরিত্রে প্রমদাসুন্দরী৷ অর্ধেন্দুশেখর অনেকগুলি চরিত্রে অভিনয় করলেন (ডাকিনী, ডাক্তার, হত্যাকারী, দ্বারপাল প্রভৃতি‍)৷ পণ্ডিত ও বিদগ্ধ মহলে এ নাটকের সুখ্যাতি হলেও সাধারণ দর্শকেরা এ নাটক নিতে পারলেন না৷ মাত্র দশটি রজনী অভিনীত হয়েছিল এ নাটক৷

নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ

অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ হলেন গিরিশচন্দ্র৷ তিনি তখন দু’টি হালকা চালের নাচ-গানের নাটক উপস্থাপন করলেন৷ একটি ‘মুকুল মুঞ্জরা’ অপরটি ‘আবু হোসেন’৷ দু’টি নাটকই রাতারাতি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেল৷ ‘আবু হোসেন’ নাটকের নাম ভূমিকায় অভিনয় করলেন অর্ধেন্দুশেখর৷ ‘মুকুলমুঞ্জরা’তে করলেন বরুণচাঁদের চরিত্রে৷ দুটি নাটকেই হাসির বন্যা বইয়ে দিলেন তিনি৷ এই ধরনের অভিনয়ে‍ তখন অর্ধেন্দুশেখরের জুড়ি ছিল না৷ সাফল্যের শীর্ষে উঠে মিনার্ভাতে এবারে পরপর গিরিশচন্দ্রের বিভিন্ন নাটক অভিনীত হতে থাকল৷ সেই তালিকায় আছে‍– সপ্তমীতে বিসর্জন, নল-দময়ন্তী, বড়দিনের বকশিস, কমলে কামিনী, করমেতিবাঈ, প্রফুল্ল প্রভৃতি৷ ‘প্রফুল্ল’ সেই সময়ে স্টারেও অভিনীত হচ্ছে‍, সেখানে যোগেশের চরিত্রে‍ অমৃতলাল মিত্র৷ মিনার্ভাতে যোগেশ করছেন গিরিশচন্দ্র৷ এই দুইয়ের অভিনয়ের তুলনা করতে গিয়ে‍ অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর একটি গ্রন্থে অকপটে বলেছেন, ‘গিরিশের যোগেশের পার্শ্বে অমৃতলালের যোগেশ হীনপ্রভ হইয়া পড়িল৷ মনে হইল একজন যথার্থ যোগেশ, আর একজন যোগেশ সাজিয়াছেন৷’ ‘প্রফুল্ল’ তো বটেই, এছাড়া মিনার্ভাতে ‘’জনা’ নাটকে বিদূষকের চরিত্রে অভিনয় করতেন গিরিশচন্দ্র৷ গিরিশ বিদূষক চরিত্রকে হালকা থেকে সিরিয়াস করে তুলতেন৷ গিরিশের পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে নিঃসন্দেহে ‘জনা’ শ্রেষ্ঠ৷ জনার চরিত্রে অভিনয় তিনকড়ির জীবনেও শ্রেষ্ঠ অভিনয়৷ পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাসে দ্রৌপদীর চরিত্রে তিনকড়ি৷ কীচকের চরিত্রে শেষের দিকে অভিনয় করতেন গিরিশচন্দ্র৷

মালিক নাগেন্দ্রভূষণের সঙ্গে আর্থিক ব্যাপারে গিরিশচন্দ্রের বনিবনা হচ্ছিল না৷ নাগেন্দ্রভূষণের অমিতব্যয়িতা ও কাপ্তেনী মনোভাবের জন্য প্রচুর আয় সত্ত্বেও এই রঙ্গমঞ্চের আর্থিক সঙ্গতি গড়ে ওঠেনি৷ অগত্যা ১৮৯৬ সালে গিরিশচন্দ্র মিনার্ভা ছেড়ে আবার স্টারে যোগ দিলেন৷ এই সময়ে মিনার্ভার পরিচালনার দায়িত্ব নেন চুনীলাল দেব৷ কিন্তু মিনার্ভার দুর্দশা আর কাটে না, বরং বাড়তেই থাকে৷ ১৮৯৮ সালের ৩১ মার্চ প্রকাশ্যে নীলামে মিনার্ভাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়৷ ১৯০০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২২ জুন মঞ্চগৃহ সংস্কারের জন্য মিনার্ভার অভিনয় বন্ধ হয়৷ হাতবদলের পালা চলতেই থাকে৷ নীলামের প্রথম ক্রেতার কাছ থেকে মঞ্চ কিনেছিলেন শ্রীপুরের জমিদার নরেন্দ্রনাথ সরকার৷ পরে এই নরেন্দ্রনাথ মিনার্ভা ছেড়ে দেন৷ মালিক হলেন জমিদার প্রিয়নাথ দাস৷ এদিকে প্রিয়নাথের কাছ থেকে মাসিক পাঁচশো টাকা ভাড়ায় তিন বছরের জন্য মিনার্ভা লিজ নেন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত৷ অমরেন্দ্রনাথ থিয়েটার বাড়ির নতুন করে সংস্কার করলেন৷ গ্যাসের পরিবর্তে স্থায়ীভাবে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করলেন৷ ১৯০৩ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষীরোদাপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘রঘুবীর’ নাটক দিয়ে অমরেন্দ্রনাথ মিনার্ভার নতুন আলোকিত রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন করলেন৷ নিজে অভিনয় করলেন রঘুবীরের চরিত্রে৷ কিন্তু নাটক জমল না৷ এইভাবে কিছুদিন আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করেও মিনার্ভা থিয়েটার চালিয়ে অমরেন্দ্রনাথ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন৷ অবশেষে অমরেন্দ্রনাথ মিনার্ভা লিজ দিলেন এক ধনী ব্যবসায়ী মনোমোহন পাঁড়ে‍কে৷ মনোমোহন আবার থিয়েটারটিকে সাবলিজ দিলেন চুনীলাল দেবকে, মাসিক সাতশো পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায়৷ বসুমতীর মালিক উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে চুনীলাল দর্শকদের টিকিটের বিনিময়ে উপহার প্রথা চালু করলেন৷ উপহারের হিড়িক ফেলে, লোভ দেখিয়ে খদ্দের টানতে আরম্ভ করল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ৷ বর্ষার দিনে আবার ছাতাও উপহার দেওয়া হল৷ যারা দর্শক টানার জন্য এমন সব কাণ্ডকারখানা করতে পরেন, তারা নাট্যাভিনয়ের উন্নতির চেষ্টা করবেন, এমনটা আশাই করা যায় না৷

১৯০৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করেন লর্ড কার্জন৷ ফলে জাতীয়তাবোধের আন্দোলন তুমুল আকার ধারণ করে৷ মিনার্ভার জন্য গিরিশচন্দ্র লিখলেন ‘সিরাজদ্দৌলা’, প্রথম অভিনীত হল ১৯০৫-এর ৯ সেপ্টেম্বর৷ দানীবাবু সিরাজের ভূমিকায়৷ গিরিশচন্দ্র করিমচাচা৷ ড্রেক এবং দানশা চরিত্র দুটিতে অর্ধন্দেুশেখর৷ লুৎফা সুশীলবালা৷ ঘসেটি বেগম সুধীরাবালা৷ জহরা তারাসুন্দরী৷ প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা পেল এ নাটক৷ বাংলা মঞ্চে যেন নতুন প্রাণের সাড়া দেখা দিল৷ এই ভাবনা থেকেই গিরিশ লিখলেন ‘মীরকাশিম’ নাটক৷ ১৯০৬ সালের ১৬ জুন অভিনীত হল৷ এখানে মীরজাফরের চরিত্রে গিরিশচন্দ্র, মীরকাশিমের চরিত্রে দানীবাবু এবং তিনটি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে অর্ধেন্দুশেখর অবিস্মরণীয় অভিনয় করলেন৷ প্রখ্যাত নাট্য গবেষক দর্শন চৌধুরী স্বীকার করেছেন, ‘মিনার্ভায় মাস্টার অর্ধেন্দুশেখরের উদ্যম এবং ম্যানেজার গিরিশের প্রচেষ্টা মিলেমিশে‍ থিয়েটারে ন্যাশনালিটির উদ্বোধন ঘটিয়েছিল৷’ মিনার্ভা থিয়েটার থেকেই ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং গিরিশচন্দ্রের ঐতিহাসিক নাটকের পূর্ণ যাত্রা শুরু হয়৷ প্রথম দুই নাট্যকারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এই থিয়েটার থেকেই৷ মিনার্ভাতে বৈদ্যুতিক পাখার বন্দোবস্ত করা হয়, এবং তখন ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকের অভিনয়ের ভিড় বেড়েই চলে৷ এখানেই আবার অভিনীত হল ‘চৈতন্যলীলা’’৷ গিরিশ ও অর্ধেন্দুশেখর মাধাই ও জগাই-এর চরিত্রে অভিনয় করেন৷ স্টারে ‘চৈতন্যলীলা’’র স্বর্ণযুগে এঁরা অভিনয় করেননি৷ কীভাবে মাতাল পাষণ্ড বর্বর মাধাই ও জগাই মহাপ্রভুর স্পর্শে ভক্তে রূপান্তরিত হচ্ছে তাঁরা তা অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে বাস্তবায়িত করে তুললেন৷

১৯০৭ সালের জুলাই থেকে মিনার্ভা আবার দুরবস্থায় পড়ে৷ দানীবাবু, গিরিশচন্দ্র, তিনকড়ি প্রমুখ শিল্পী মিনার্ভা ছেড়ে কোহিনুর থিয়েটারে চলে যান৷ বাধ্য হয়ে মিনার্ভা কর্তৃপক্ষ অমরেন্দ্রনাথ দত্তকে স্টার থিয়েটার থেকে মিনার্ভায় নিয়ে আসে৷ বছরখানেক অমরেন্দ্রনাথ যুক্ত ছিলেন মিনার্ভাতে৷ তাঁর সময়ে অভিনীত হল প্রফুল্ল, দুর্গাদাস, সিরাজদৌল্লা, ছত্রপতি শিবাজি, বলিদান, নূরজাহান, মেবার পতন প্রভৃতি নাটকগুলি৷ অমরেন্দ্রনাথ ছেড়ে যাওয়ার পর গিরিশচন্দ্র আবার ফিরে এলেন মিনার্ভাতে৷ গিরিশচন্দ্রের ‘অশোক’ এবং ‘শঙ্করাচার্য’ মিনার্ভাতেই প্রথম অভিনীত হয়৷ ১৯১১ সালে মিনার্ভা লিজ নিয়েছিলেন যিনি, সেই ব্যবসায়ী মনোমোহন পাঁড়ে মিনার্ভার এক-তৃতীয়াংশ বেচে দিলেন মহেন্দ্রনাথ মিত্রকে, বাইশ হাজার টাকায়৷ ১৭ জুন মহেন্দ্রনাথ নতুন করে মিনার্ভা চালু করেন অতুলকৃষ্ণ মিত্রের ‘রকমফের’ নাটক দিয়ে৷ গিরিশচন্দ্র তখন মিনার্ভাতে৷ গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গিরিশচন্দ্রের ‘বলিদান’ নাটক নামানো হল৷ করুণাময় চরিত্রে গিরিশচন্দ্র৷ মঞ্চে গিরিশচন্দ্রের এই শেষ অভিনয়৷ দিনটি ছিল ১৯১১ সালের ১৫ জুলাই৷ এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ ১৯১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের জীবনাবসান হয়৷

এদিকে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ আইন রদ হয়৷ ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়৷ স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার অর্থনীতি এবং জীবনযাপনের পদ্ধতির ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ে৷ যদিও মিনার্ভা থিয়েটার-সহ বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চের নাট্যাভিনয়ে এই পরিস্থিতি বদলের কোনও হদিশ খুঁজে‍ পাওয়া যায় না৷ ১৯১২ সালের মহেন্দ্রনাথ মিত্রের মৃত্যুর পর মনোমোহন পাঁড়ে আবার মিনার্ভার মালিক হয়ে বসেন৷ এ সময় খাসদখল, ভীষ্ম প্রভৃতি‍ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল মিনার্ভা থিয়েটারে৷ ১৯১৫ সালে মিনার্ভার দায়িত্ব নেন উপেন্দ্রনাথ মিত্র৷ ১৯১৫ সালের ২ অক্টোবর দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সিংহলবিজয়’ নাটক দিয়ে মিনার্ভার দ্বার উদঘাটিত হয়৷ ম্যানেজারের পদে তখন অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯) চলাকালীন মিনার্ভাতে যে নাটকগুলি অভিনীত হয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাটক ‘মিশরকুমারী’৷ দেশ-কাল-পাত্র বিশেষে যথোপযোগী দৃশ্যপট ও সাজগোজ এবং সরঞ্জাম যথাসম্ভব ঠিক রেখে দর্শকের চোখে নিপুণভাবে ধরা দিয়েছে এই নাটক, ফলে এই রঙ্গশালার অধ্যক্ষ ও শিল্পীদের অকুণ্ঠ চিত্তে প্রসংসা করেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷

অহীন্দ্র চৌধুরী

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে মিনার্ভার যাত্রাপথে সবচাইতে বড় আঘাত এল, হঠাৎ আগুনে মিনার্ভা থিয়েটার সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয় ১৯২২ সালের ১৮ অক্টোবর৷ উপেন্দ্রনাথ মিত্র হার মানেননি৷ তিনি নতুন উদ্যমে পুড়ে যাওয়া নাট্যমঞ্চটি পুনর্নির্মাণে ও সংস্কারে উঠে পড়ে লাগলেন৷ ১৯২৫ সালের ৮ আগস্ট শুরু হল নবনির্মিত মিনার্ভায় নতুন করে নাট্যাভিনয়৷ নাটকের নাম ‘আত্মদর্শন’৷ এই সময় থেকে মিনার্ভায় দর্শকদের জন্য নানা সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করা হয়৷ মহিলা দর্শকদের জন্য আলাদা বিশ্রামগৃহের ব্যবস্থা করা হয়৷ অহীন্দ্র চৌধুরীর মতো দুর্ধর্ষ নট তখন এই মঞ্চে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের তাক লাগিযে দিযেচিলেন৷ যেমন ‘মিশরকুমারী’ নাটকে আবন, ‘বেহুলা’ নাটকে চাঁদ সদাগর, ‘দেবযানী’ নাটকে‍ শুক্রাচার্য চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শক মনে দাগ কেটে গিয়েছিল৷ ১৯৩২ সালে যখন সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হল, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে মিনার্ভা কর্তৃপক্ষ টিকিটের দাম আবার কমালেন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে (১৯৩৯-৪৫) মিনার্ভা নতুন পরিচালক বোর্ডের তত্ত্বাবধানে আসে, তখন মিনার্ভায় যোগ দেন নামী শিল্পীরা৷ সে তালিকায় রয়েছেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তি গুপ্তা, নীরদাসুন্দরী প্রমুখ শিল্পী৷ মিনার্ভাতেই ‘কাঁটাকমল’ নাটকে অভিনয় চলাকালীন অসুস্থ  হয়ে পড়েন দুর্গাদাস৷ বেশ কিছুদিন রোগভোগের পর মারাও

যান৷ ইতিমধ্যে মিনার্ভায় যোগ দেন নির্মলেন্দু লাহিড়ি, মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সরযূবালা দেবী, ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, মহেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ শিল্পী৷ ১৯৪৪ সালের ১১ মার্চ শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’-এর প্রথম অভিনয় এই মঞ্চে৷ নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস৷ মঞ্চে এই তাঁর প্রথম অভিনয়৷ এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অভিনীত হল মিশরকুমারী, রামের সুমতি, চন্দ্রশেখর, দুই পুরুষ প্রভৃতি নাটক৷ ‘দুই পুরুষ’ নাটকে ছবি বিশ্বাসের নুটুবিহারী চরিত্রে অভিনয় দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল৷

স্বাধীনতার পরে কয়েক বছর নানা কারণে মিনার্ভার দরজা বন্ধ ছিল৷ ১৯৪৯ সালে আবার নিয়মিত অভিনয়ের আসর শুরু হয়৷ অহীন্দ্র চৌধুরী আবার যোগ দিলেন মিনার্ভাতে৷ বিভিন্ন নাটক অভিনয়ের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে আছে শরৎচন্দ্রের ‘চন্দ্রনাথ’’৷ নাট্যরূপ দিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত৷ নাম ভূমিকায় ছবি বিশ্বাস, সরযূর চরিত্রে সরযূবালা দেবী, কৈলাস খুড়োর চরিত্রে অহীন্দ্র চৌধুরী৷ দর্শকদের মোহিত করে দিলেন শিল্পীরা৷ এই সময় মিনার্ভা আবার আর্থিক সাফল্যের মুখ দেখে৷ তখনকার কয়েকটি স্মরণীয় প্রযোজনা হল ঝিন্দের বন্দী, জীবনটাই নাটক, জাহাঙ্গীর, দেবত্র, মহানায়ক শশাঙ্ক, ঠাকুর রামকৃষ্ণ, এরাও মানুষ প্রভৃতি নাটক৷

উৎপল দত্ত

পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকের গোড়ায় বহুরূপী গোষ্ঠী শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় ‘ছেঁড়াতার’ এবং ‘রক্তকরবী’ নাটকের নিয়মিত অভিনয় করে প্রতি বৃহস্পতি, শনি এবং রবিবারে৷ কিন্তু দর্শক আনুকুল্য থেকে বঞ্চিত হয় বহুরূপী গোষ্ঠী৷ মিনার্ভার তখন খুবই দুরবস্থা৷ প্রায়ই অভিনয় বন্ধ থাকে৷ ১৯৫৯ সালে মিনার্ভা থিয়েটার লিজ নিলেন উৎপল দত্ত তাঁর ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’-এর নামে৷ ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত টানা দশ বছর উৎপল্ল দত্ত তাঁর লেখা নাটক মঞ্চস্থ করলেন৷ অবধারিতভাবেই তিনিই পরিচালক৷ এখানে তাঁর পরিচালনায় যেসব নাটক হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ছায়ানট, অঙ্গার, ফেরারী ফৌজ, কল্লোল, তীর, লেনিনের ডাক প্রভৃতি নাটক৷ এছাড়া অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর নাট্যরূপ দিলেন৷ মধুসূদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ মঞ্চস্থ করলেন৷ তখন এই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সব রথী-মহারথীরা৷ যার মধ্যে আছেন শোভা সেন, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, ছন্দা চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল সেন, রবি ঘোষ প্রমুখ শিল্পী৷ পরিচালনায়, অভিনয়, সেট নির্মাণে, দৃশ্যসজ্জায়, আলোকসম্পাতে, সঙ্গীতের ব্যবহারে এবং সর্বোপরি সম্মিলিত অভিনয়ে সেদিন মিনার্ভা থিয়েটার দর্শকমনে দাগ কেটেছিল৷ ‘অঙ্গার’ নাটকে খনিগর্ভ যখন জলে ভেসে যাচ্ছে, সেখানে তাপস সেনের আালোকসম্পাত দর্শকরা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না৷ শ্রমিক আন্দোলনের মার্কসীয় তত্ত্ব ভাবনার সঙ্গে মঞ্চে কয়লাখনিতে‍ আগুন লাগা বা জনপ্লাবনের চমকপ্রদ দৃশ্যকে মিশিয়ে উৎপল দত্ত পেশাদারি মঞ্চে আনতে‍ চেয়েছিলেন এক পরিবর্তন এবং বলা বাহুল্য এ ব্যাপারে তিনি সর্বাংশে সার্থক হয়েছিলেন৷ এই নাটকের প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯৫৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর৷ সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর৷ প্রথম দফায় ১৯৬১ সালের ৩০ এপ্রিল ৩০০ রজনীতে ‘অঙ্গার’ নাটকের শেষ প্রদর্শন হয়৷ ‘কল্লোল’ নাটক উৎপল দত্তের আরেক যুগান্তকারী সৃষ্টি৷ তৎকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় এ নাটক বন্ধ রাখতে হয়৷ বাংলার বিখ্যাত দৈনিকে ‘কল্লোল’-এর বিজ্ঞাপন পর্যন্ত প্রকাশিত হতে পারেনি৷ ১৯৭১ সালের ২৮ জুলাই লিটল থিয়েটার গ্রুপ মিনার্ভা ছেড়ে চলে যায়৷ লিটল থিয়েটার গ্রুপ তাদের অভিনয়ের জন্য মিনার্ভার নাম পরিবর্তন করে‍ ‘শিশির নাট্য মন্দির’ রাখার পরিকল্পনা করেছিল৷ যদিও আইনঘটিত এবং নানান কারণে শেষ পর্যন্ত সে নাম পরিবর্তন সম্ভব হয়নি৷ মিনার্ভা নামটিই থেকে যায়৷

১৯৭০-এর দশকে এসে দেখলাম মিনার্ভা থিয়েটারে ‘এ’ মার্কা ব্লো-হট নাটকের অভিনয়ের আয়োজন চালু হয়েছে৷ মিস জে, মিস ভেরোনিকা, মিস ববি প্রমুখ নৃত্যশল্পী বিভিন্ন নাটকে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় নৃত্য প্রদর্শন করছেন, যেগুলি মূল নাটকে প্র‍ক্ষিপ্ত বলেই মনে হবে৷ পথটা খুলে দিয়েছিলেন মিস শেফালি, বিশ্বরূপা থিয়েটারে ‘চৌরঙ্গী’ নাটকের মধ্য দিয়ে৷ মিনার্ভার মালিক তখন কস্তুরচাঁদ জৈন৷ তিনি ওইভাবে থিয়েটারকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন৷ সমর মুখার্জি এমন কয়েকটি নাটকের নির্দেশক৷ তাঁরই নির্দেশনায় অভিনীত হল ‘প্রজাপতি’ (কাহিনিকার সমরেশ বসু), ‘ব্যাভিচার’ প্রভৃতি নাটক৷ এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে অভিনীত হল ‘স্বর্ণবলয়’ (কাহিনিকার ডা. নীহাররঞ্জন গুপ্ত), ‘জয়া’ (কাহিনিকার সুবোধ ঘোষ) প্রভৃতি অকিঞ্চিৎকর নাট্যপ্রযোজনা৷ বহু নামী শিল্পী তখন বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে গেছেন৷ যেমন সুপ্রিয়া দেবী, আরতি ভট্টাচার্য, অসীমকুমার, সন্তু মুখোপাধ্যায়, শমিত ভঞ্জ, কালী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী৷ আশির দশকে এক এক করে বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চের দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হতে থাকে৷ বহু ক্ষেত্রে আগুনের লেলিহান শিখা রঙ্গমঞ্চগুলিকে পুড়িয়ে দিয়েছে৷ এই তালিকাভুক্ত নাট্যমঞ্চগুলি হল স্টার, বিশ্বরূপা, রঙমহল৷ পাশাপাশি বন্ধ হল রঙ্গনা, সারকারিনা, বিজন থিয়েটার, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ প্রভৃতি৷ মিনার্ভাও কি আর খোলা থাকে?

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে‍ মিনার্ভা থিয়েটার অধিগ্রহণ ও সংস্কার করা হয় একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে৷ বর্তমানে সিটের সংখ্যা কমানো হযেছে৷ পুরো প্রেক্ষাগৃহটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত৷ তবে নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের চল আর নেই৷ কেউ কেউ ভাড়া নিয়ে নাটক করছেন অথবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করছেন৷ অথচ এ কথা বিস্মৃত হলে চলবে না যে এই মঞ্চেই বিভিন্ন সময়ে গিরিশচন্দ্র, অর্ধেন্দুশেখর, অমরন্দ্রেনাথ, অপরেশচন্দ্র, অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস, ছবি বিশ্বাসের মতো প্রতিভাধর শিল্পী এখানে অভিনয় করে গেছেন৷ গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ক্ষীরোদাপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের বিখ্যাত নাটকগুলি এই মঞ্চেই অভিনীত হয়েছে৷ গিরিশচন্দ্রের জীবনের শেষ দশ-বারো বছর প্রায় তিনি মিনার্ভাতেই কাটিয়েছেন৷ পরিণত বয়সের নাটক রচনাগুলি এই মঞ্চের জন্যই করেছিলেন৷ গিরিশপুত্র দানীবাবু এ মঞ্চে এক সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন৷ এখানে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ পাওয়া গেছে (সীতারাম, চন্দ্রশেখর, দুর্গেশনন্দিনী), শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ পাওয়া গেছে (দেবদাস, চন্দ্রনাথ, রামের সুমতি‍)৷ এছাড়া বিধায়ক ভট্টাচার্য, দেবনারায়ণ গুপ্তের মতো গুণী মানুষদের পাওয়া গেছে নাট্যরূপ দেওয়ার কাজের জন্য৷ শতবর্ষ উত্তীর্ণ মিনার্ভা থিয়েটার নানা চড়াই-উৎরাই পার করে বিচিত্রমুখী নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করেছে, সে কথা স্বীকার করতেই হয়৷

শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪২৬