আদিকথন
‘Where there is no vision, the people perish’
বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি চিত্রপরিচালক জাঁ লুক্ গোদারকে আমরা La Nouvelle Vague বা নিউওয়েব চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে জানি৷ মহান সাহিত্যিক গী দ্য মপাসাঁর La Femme de Paul এবং Le Signe নামের দুটি গল্প অবলম্বনে ১৯৬৬ সালে Masculin Feminin নামে একটি অনন্যসাধারণ ছায়াছবি নির্মাণ করেন গোদার৷ গোদার আদ্যোপান্ত বাস্তববাদী এবং মার্কসীয় সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক৷ ছায়াছবিটিতে, সমকালীন ফরাসি যুবসত্তার চেতনাজাত সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আন্দোলন, একমাত্র পার্থিব জগতের সঙ্গে যুক্ত জীবনবোধের প্রতি তাদের আগ্রহ ও উন্মাদনার নির্যাস প্রকাশিত হয়েছে৷ গোদার তাঁর চিত্রনির্মাণের আয়োজনে, বিপ্লবী নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক বের্টলট ব্রেখট যে দর্শকের দৃষ্টি ও মর্ম থেকে নাট্যমায়া তথা কাহিনিমোহ ভেঙে দিয়ে, তাকে পরিবেশিত তথ্য ও তত্ত্ব থেকে alienate করে দেওয়ার পদ্ধতি আরম্ভ করেছিলেন, সেই প্রকরণই যুক্ত করেন৷
মপাসাঁর কাহিনিতে পুরুষ ও নারীর অন্তর্জগতের ভাবরাশির সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ, তাদের জৈবিক কামনা-বাসনা, বাস্তবজীবনে নারীরা প্রকৃত অবস্থান ইত্যাদি স্থান পেয়েছে৷ কিছু তত্ত্ব স্বয়ং গোদারের মতের বিরোধী হলেও তিনি সবই মিশ্রিত করেছেন৷ প্রখ্যাত সমালোচক ও লেখক Phillip John Usher তাঁর দাপুটে ব্যাখ্যায় দেখিয়েছেন, নরনারীর প্রতিভাসিত মূর্তির সঙ্গে তুলনার অযোগ্য ঘটনাবলীর মিশ্রণজাত ভাঙাগড়ার মধ্যে, শেষ পর্যন্ত পুরুষের দম্ভই কালিমাময় হয়ে পড়ে৷ গোদার বিখ্যাত এই ছায়াছবিটিতে উনবিংশ শতকের ফ্রাংকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের আবহে, ‘মার্কস ও কোকাকোলা’র বিষম মিশ্রণে জাত নরনারীর মধ্যে নারী স্বাধীনতার অলীক ঘোষণা নিয়ে বালখিল্য আবেগ দেখাতে দ্বিধা করেননি৷ তাঁর উক্তি… ‘it’s more a film on the idea of youth.A philosophical idea, but not a practical one.’
‘At the very moment we open
the cork of a ‘coca-cola’ bottle
The vapourous spirit comes out
like beautiful coloured bubble
The spirit vanishes within half an hour–
leaving behind dyspeptic taste of sour’…
ক্ষণিকের উন্মাদনার পরেই প্রশ্নটা স্পষ্ট হয়– মানুষের আসল আবাসভূমির সঠিক অবস্থানটি কোথায়? এই চমক-জাগানো প্রশ্ন বিভ্রান্তির জন্ম দিলেও, এটি একজন সচেতন মানুষের মূল সত্তার সঙ্গে সর্বতোভাবে যুক্ত৷ এ জিজ্ঞাসার উত্তরে একজন নারী, বিনা চিন্তাভাবনায় সহজেই তার অবস্থানের ঠিকানা জানিয়ে দেয়৷ নরনারীর নিজের নিজের স্থিতির নিকেতন সম্পর্কে মতামত অথবা বাস্তবতা, প্রায়ই একে অন্যকে অতিক্রম করে কিংবা বাগবিতণ্ডার আবহ গড়ে তোলে৷
গোদারের চেতনার বুর্জোয়া ভোগবাদ, নিত্যদিনের চাহিদার সুষম নিবৃত্তি-সুখলাভ, মানবের মধ্যেকার বিচ্ছিন্নতা, যেগুলি আবার কার্ল মার্কসের ধনতন্ত্র সমালোচনার কেন্দ্রীয় অস্ত্রশস্ত্র, এসব কিছুর ওপরেই স্থাপিত আছে সেই মূল প্রশ্ন– মানুষের বাসভূমি কোথায়? ছায়াছবি এবং মপাসাঁর সাহিত্যেও এসব জটিল বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছে৷
এক
‘I have multiplied visions and used similtitudes’— (বাইবেল)
আমাদের চেতনার প্রান্তরে জ্ঞান-অনুভূতির আগমন হয় বিদ্যুতে ভর করে৷ পুঁথিপুস্তক জন্ম নেয় পরবর্তীকালের বিস্তারিত ঝড়ের আকারে৷(ওয়ালটার বেনজামিন)
বিখ্যাত পোলিশ লেখক জোসেফ কনরাড বলেছেন– “আমার যে কাজটা আমি আয়ত্তে আনতে চেয়েছি– সেটা হল লিখিত শব্দের শক্তি দিয়ে পাঠককে ‘শোনানো’, তাকে ‘অনুভব করানো’ এবং সর্বোপরি তাকে ‘দেখানো’৷ ছায়াছবি বা সিনেমা সাহিত্যকে সাধারণ দর্শকের আরও কাছে এনে দেয়৷ আজকের Post-literate জগতে দর্শনযোগ্য চলচ্চিত্র, এমনকী একটা আঁকা চিত্রও, আপাত নীরস অক্ষরের থেকে বেশি প্রভাবশালী৷ সিনেমা, বর্তমানে পপুলার কালচারের পৃষ্ঠপোষক এবং সাহিত্যকে সিনেমায় রূপান্তরিত করলে সাহিত্যের প্রভাব বিস্তারিত হয়৷ অভিযোজন বা adaptation অনেক সময় অনুবাদ বা মধ্যবর্তী হওয়ার কাজ করে৷ এটা বলা বাহুল্য যে, সিনেমা অনেক ক্ষেত্রেই সাহিত্যের সূক্ষ্ণতা ও সুচারু জটিলতাগুলির সার্থক রূপায়ন করতে ব্যর্থ হয়৷ আবার, Louise Flavin, ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-অধ্যাপিকা বলছেন, ‘আমাদের শেখানো হয় সাহিত্যের সূক্ষ্ণতা ও বিভিন্ন সাহিত্যিক উপাদানগুলির পাঠ, তাদের অর্থসম্পদও আহরণ করি, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দৃশ্যমান ছায়াছবির অন্তরের সূক্ষ্ণ ইশারাগুলিকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি না৷’…
Geofferey Wagnar–প্রখ্যাত চিত্রসমালোচকের মতে– গোদারের Masculin Feminin একটি Analogy Adaptation, যা সাহিত্যের বিষয়বস্তুকে, মূল সম্পদকে অধিকতর ঐশ্বর্যময় করে তোলে৷ এ ধরনের Adaptation নূতনতর পটভূমি আবিষ্কার করে; চরিত্রগুলি নূতনতর জন্মলাভে সফল হয়; কাহিনির অক্ষরে অক্ষরে লুকিয়ে থাকা গুপ্তভাব, রহস্যময় অনুভূতি সকল উন্মোচিত করে৷ আমেরিকার সুখ্যাত রহস্যময় ড্যানিয়েল টারাডাশ বলছেন, ‘What I try to discover is the basic premise, the basic idea, the basic theme behind a particular piece of writing and to try to dramatise that without making it obvious.’
উন্নতমানের Adaptation সাহিত্যের আত্মাকে উন্মোচিত করে, শব্দের বিন্যাসমাত্রাকে নয়৷ সাহিত্য রচয়িতার মানসভূমি এবং সেই সাহিত্যের চিত্রকাহিনির পরিচালকের চৈতন্যলোক কতখানি কাছাকাছি, অধিগ্রহণের সকল ক্ষেত্রেই এই তথ্যটি সবথেকে আগে স্মরণীয়৷ Adaptation তত্ত্বের অন্যতম প্রধান ও প্রথম জনক George Bluestone বলেন,… ‘the adaptor is not so much a translator but a new author’৷ এভাবে বিচার করলেই আমরা বুঝতে পারি একজন সার্থক পরিচালক তাঁর গৃহীত কাহিনির শুধুমাত্র অনুবাদক নন, এমনকী সাধারণভাবে ব্যাখ্যাকারও নন, তাঁকে সাহিত্যিকের আত্মার বান্ধব হতে হয় এবং সর্বত্রগামী হতে হয়৷
‘চিত্রভাষার ব্যাপারে বিপ্লবের পুরোধা হলেন জাঁ লুক গোদার৷’ এ উক্তি সত্যজিৎ রায়ের৷ তিনি বলেছেন, সকল যুগের সব ধরনের ছায়াছবির পরিচয় গোদার জানতেন৷ গোদার আপাত-বিরোধী চিত্রভাষা ও চিত্রতত্ত্বকে একই ছবিতে সমন্বিত করতেন, উত্তম কুশলতার সঙ্গে একই চিত্রের আধারে, একই বিষয় নিয়ে নানা ভাষায়, নানান পটভূমিতে, অনেক ধরনের বিপক্ষীয় বিষয়ের তথ্য ও তত্ত্ব আমদানি করতেন৷ এ ব্যাপারে তাঁর মনীষা ছিল আশ্চর্য রকমের ফলবান৷ তাঁর ছবিতে আধুনিক কাব্য প্রেম, সহমর্মিতার উৎকৃষ্ট প্রকাশ দেখা যেত, ফলে গোদারের চিত্রভাষাও সবসময় একরকম থাকত না, যেমন– ‘Pierrot le Fou’ বা Masculin-Feminin ছায়াছবিতে দেখা গেছে৷
চিত্র-নির্মাণ উপন্যাস রচনার মতো একটি ব্যক্তিগত কাজ নয়৷ অনেকসময়ই চিত্রনাট্যকার কোনও নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে আবদ্ধ থাকেন, সাহিত্যের গল্প-কাঠামোর বাইরে যেতে পারেন না, কিংবা যেতে চান না৷ এ বিষয়ে ইনগ্রিড বার্গম্যানের উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে– ‘Film has nothing to do with literature’৷ ইটালির সুখ্যাত পরিচালক আন্তোনিয়ানি লিখেছেন—‘প্রথমে আমাকে কোনও একটি অত্যাশ্চর্য অনুভূতির মায়াজালে আবদ্ধ হতে হয়৷অথবা কোনও একটি বিশিষ্ট চরিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া দরকার, কিংবা যে কোনও অভাবিত সমস্যায় ডুবে যেতে হয়৷ একবার যদি এরকম কিছু একটা ঘটে যায়, তখন আর আমার প্রয়োজন হয় না এক সুলিখিত গল্পের অথবা বিস্তারিত চিত্রনাট্যের৷’ স্বযং রবীন্দ্রনাথ সিনেমাকে সাহিত্য থেকে পৃথক, স্বাধীন ও স্বনির্ভর এক শিল্পমাধ্যম হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন৷ তবুও প্রশ্ন উঠতে পারে– সব ছায়াছবিই কি কোনও না কোনও সাহিত্যরসের Adaptation নয়? কবিগুরু নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন– সিনেমা যেন শুধুমাত্র কাহিনির বিন্যাস তুলে এনে তার দৃষ্টিগ্রাহ্য চিত্র নির্মাণ না করে; ছায়াছবি যেন গল্পকাহিনি, সঙ্গীত, অভিনয় ইত্যাদির ওপরেও নিজস্ব কোনও মর্মবার্তা প্রকাশ করতে শেখে৷
এই প্রত্যাশাই সঠিক একজন মহত্তম শিল্পীর কাছ থেকে৷ এই মুহূর্তে ভারতবর্ষ-সহ বিশ্বের সর্বত্র অনেক পরিচালক মৌলিক গল্প বা ‘থিম’ নিয়ে সিনেমা তৈরি করছেন, বেশ কিছু রসোত্তীর্ণও হয়ে চলেছে৷ একারণেই আমরা আজ, Adaptation শব্দটির ভেতরের পরিচয়টা অনুভব করতে পারছি৷
এবং, এখানেই আমার প্রশ্ন জেগে উঠেছে– আমরা মৌলিক গল্প লিখতে পারি, বলতেও পারি, কিন্তু ‘গল্প বলা’ আমরা শিখলাম কোথা থেকে? গল্প যে কীরকম হয় বা কী হলে তাকে গল্প বলা যেতে পারে, এই চিন্তনের ফলশ্রুতিতে যে কাঠামোর উদ্ভব, তা আমাদের অর্জিত, স্বভাবজ নয়৷ বহুযুগ ধরে আমরা সেই অ্যারিস্টটলীয় নীতিবাক্য অনুসরণ করেই গল্পকাহিনি গঠন করে চলেছি, তা হল– An ideal plot must have a beginning, a middle and an end–৷ এরপর, আধুনিক যুগের প্রগতির সঙ্গে বদলে গিয়েছে আমাদের অনেক প্রাগৈতিহাসিক এবং প্রাচীনতম বিশ্বাস ও জ্ঞান৷ আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের মনে Time, Space ও Origin of life সম্পর্কে যাবতীয় ধারণার বহুল পরিবর্তন ঘটিয়েছে৷ তাই, সময় আর সোজা একটি সুতোর মতো নয়, অনেক সময় একটি ক্ষুদ্র মুহূর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকে পুরো মানব-ইতিহাস৷ স্যামুয়েল বেকেট এবং জেমস জয়েস এই গভীরতা আপন মাধুরী মিশিয়ে নিজেদের রচনায় যুক্ত করেছেন৷ এ যুগের, পশ্চিমের অত্যাধুনিক লেখকগণ এই অভিনব চিন্তা-চেতনার আশ্রয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কাহিনি-কাঠামো, চরিত্রায়ন সৃষ্টি করে চলেছেন৷
‘Adaptation’নিয়ে প্রশ্নমালার শেষ নেই৷ সিনেমার মধ্যে উপরে বর্ণিত মৌলিকত্ব আনতে পারলেই কি তা স্বনির্ভর, আত্মবলে বলীয়ান এক শিল্প হয়ে উঠবে?এখনকার অনেক ছায়াছবিতে Post-Modern উপন্যাস থেকে নেওয়া কিছু কিছু অভিনব পন্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে৷ সেক্ষেত্রে, তাহলে সিনেমাকে সাহিত্য-প্রভাব থেকে মুক্ত বলি কোন বিচারে? বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক Harold Bloom একটি তত্ত্বের সমর্থন করেছেন, তা হল– Anxiety of Influence৷ এই ধারণাটি হল–বর্তমান যুগের বা যে কোনও যুগের লেখক বা শিল্পীগণ তাঁদের পূর্বসূরি সৃজনশীল শিল্পী সাহিত্যকিদের সঙ্গে এক ‘Oedipal conflict’ সূত্রে যুক্ত থাকেন৷ অর্থ হল– বর্তমানের লেখক তাঁর পূর্বেকার লেখকের প্ৰভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন না৷ কেননা, তিনি যা-ই লেখেন না কেন, তার মধ্যে পুরো সাহিত্য-শিল্প-ইতিহাস এবং তাঁর নিজের সমাজ-শিল্প-সংস্কৃতির স্মৃতিবাহিত চেতনা ও পরোক্ষ শর্তগুলো মিশে থাকে৷ যুগযুগান্তের স্মৃতি আমাদের মধ্যে কীভাবে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে তার পৌরাণিক, ধর্মীয় এবং নতুন ধরনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আমরা জানি৷ এই চমকপ্রদ বিষয়টি প্রায় দেড়শো বছর আগে ম্যাথু আর্নল্ড সামান্য ভিন্ন ভাষায় লিখে গেছেন– ‘Culture, the acquainting ourselves with the best that has been known and said in the world, and thus with the history of human spirit’৷
সুতরাং যে কোনও উপন্যাসের অনুকরণ বা অনুসরণে কোনও নতুন ছায়াছবি নির্মিত হলেই তাকে Adaptation কিংবা রূপান্তর বলা হতে পারে না৷ এক অর্থে, সবরকম কাহিনিযুক্ত ছায়াছবিই কোনও না কোনও ভাব, আদর্শবোধ বা আত্মচেতনার চিত্রায়ণ৷ শিল্পী নতুন গল্পের রূপায়ণ করলেও সে প্রচেষ্টার পিছনে থাকে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, অভিজ্ঞতা এবং মনীষার প্রেরণা৷
তবে, এটা বলে রাখা ভাল যে, সাহিত্য বা ছায়াছবির কাঠামো বা তত্ত্ব নিয়ে কোনও চরম বা পরম সিদ্ধান্ত থাকতে পারে না৷ Adaptation নিয়েও তেমন নির্দিষ্ট গতিপথ নেই; অর্থাৎ শিল্প-সাহিত্য সর্বযুগে সর্বকালে স্বাধীন, সার্বভৌম৷
দুই
মপাসাঁর গল্প নিয়ে গোদার যে ছবিটি তৈরি করেন, তার সমালোচনা বেশ তীব্র৷ অনেকেই মপাসাঁকে এই বলে তিরস্কার করেন যে, নর-নারীর চরিত্রায়ণে তিনি অদি জান্তব আবহ সৃষ্টি করেছেন৷ আদতে এই সমালোচনা রক্ষণশীল মনোভাবের পরিচায়ক৷ বাস্তবে, মপাসাঁ সাহিত্যে এক ধরনের আধুনিকতার জনক৷ ভিক্টোরিয়ান যুগের যে রীতি-প্রকৃতিকে আজ আমরা Realism বা Narrative বলি, মপাসাঁ এই উত্তরণের একজন সার্থক বাহক৷ এরই সঙ্গে মিশেছে মানবমন ও পারস্পরিক মানব-সম্পর্ককে আত্মস্থ করে, তাকে সহৃদয় কুশলতার সঙ্গে কাগজের বুকে লিপিবদ্ধ করার অসাধারণ ক্ষমতা৷ মপাসাঁর চরিত্রায়ণে, আবহনির্মাণে তাঁর আত্মজীবনীর ছোঁওয়া পাওয়া যায়, এরই সঙ্গে মিশে আছে চিরন্তন মানব-প্রকৃতি এবং তাঁর শিল্পীমনের মনস্তাত্ত্বিক প্রকাশভঙ্গি৷
মপাসাঁর সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে চিত্র-পরিচালক হিসেবে গোদারেরও সমালোচনা হয়— তিনি অতি আধুনিক এবং অনেক ক্ষেত্রেই উগ্র আধুনিক৷ গল্প দুটির প্রথমটির মূল বিষয় হল নারীর সমকামিতা৷ মানুষের অন্তরের সুপ্ত প্রেমভাবনা নারীর সমকামিতার সঙ্গে মিশে যাওয়ার পরেও অনেক বেশি কিছু থেকে যায় এই ছায়াছবিতে৷ সেসবের মধ্যে প্রধান হল গোদারের ব্যাখ্যাত কার্ল মার্কসের আদর্শ৷
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে, ফ্রা্ন্সে মার্কসের চিন্তাভাবনা তরুণ-তরুণীদের মানসজগতে এক আলোড়ন এনেছিল৷ তারা বিষয়টাকে ভালভাবে এবং পুরোপুরি না বুঝেই উত্তেজিত হয়ে উঠত এবং উগ্র ব্যবহার করত৷ এ ব্যাপারটা অন্যান্য দেশেও দেখা গেছে৷ নতুন কোনও তত্ত্বের জন্ম কিংবা পুনরাবিষ্কার হলেই তাকে সম্যকভাবে না বুঝে উন্মাদনা জেগে ওঠে এক শ্রেণির মানুষের, বিশেষত তরুণ হৃদয়ে৷ ‘বিপ্লব’-এর অপব্যাখ্যা এবং তার ব্যর্থ প্রয়োগ মানবের রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকী সাংস্কৃতিক জগতেও চিরকালীনতার আখ্যা পেয়েছে৷ গোদার তাঁর ছায়াছবিতে কিছু কিছু Anti-American gesture দেখিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সর্বোপরি বলতে চেয়েছেন এবং নির্দিষ্ট করেছেন যে, হঠাৎ মেতে ওঠা যুবদল আসলে নিজেদের চেনে না; নতুন তত্ত্বটির অন্তরের বার্তাটির পরিচয় জানে না, তাই তারা হঠাৎ উগ্র হয়ে গিয়ে কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে– তাও বোঝে না৷
ছায়াছবিটিতে গোদার পুরুষ ও নারীর পৃথক ভুবনের পৃথক চিন্তাভাবনা ফুটিয়ে তুলেছেন৷ নারী সেখানে স্বাধীন, বাড়ির গণ্ডিতে আবদ্ধ নন৷ সমাজে তাঁদের চলাফেরাও বাধাহীন, অনেকেই চাকরিবাকরি করেন, স্বেচ্ছায় প্রেমে-অপ্রেমে বাঁধা পড়েন৷ এখানে প্রশ্ন উঠে আসে—‘সত্যিই কি তাঁরা মুক্তপ্রাণ? ছায়াছবিতে যে পটভূমি নির্মিত হয়েছে, তাতে তাঁদের এক আলাদা সুরম্য, সুন্দর লৌহবাসরের ছায়া, তার নাম ‘Feminine’৷ এই পরিচয় তৈরি করেছে পুরুষসমাজ৷ পুরুষ চিরদিন নারীত্বের একান্ত ব্যক্তিগত উত্তম গুণাবলিকেও কখনও মেয়েলি দুর্বলতা, কখনও অভ্যাস, কখনও বা অন্য কিছু বলে বিদ্রূপ করেছে কিংবা পাশে সরিযে রেখেছে৷ নারীকে নীরব করে রাখতে ষোড়শ শতাব্দীতেই প্রবাদবাক্য গড়ে উঠেছিল পুরুষশাসিত সমাজে– Silence is the best ornament of a woman যে ‘সত্তাপরিচয়’ অন্যের দ্বারা রচিত এবং আরোপিত, তা এক্ষেত্রে সুসজ্জিত, সুশোভিত এক পাঁচিলঘেরা পুষ্পোদ্যানে সহধর্মী৷ এইরূপ মানুষের মূলগত, ব্যক্তিসত্তাগত অস্তিত্বে হস্তক্ষেপ শুধুমাত্র নারী স্বাধীনতাবাদীদের বক্তব্য নয়– বিবেকবান সকল মানুষই এ মতে মত দেবেন৷
মানব Identity নিয়ে নির্দিষ্ট উত্তপ্ত, রাজনৈতিক আলোচনাকে তথাকথিত মার্কসবাদীগণ সুকৌশলে নিজেদের কাজে লাগিয়েছেন৷ অথচ, তাঁদের আলোচনার ক্ষেত্রেও নারীকে একান্তভাবে ‘নারী’ হিসেবে দেখানোর তত্ত্বটি বিচ্যুত নয়৷ তখনই প্রশ্ন ওঠে– মানুষের সত্যিকার স্বত্বরূপটি ঠিক কীরকম? বলা হয়েছে মানুষের Identity হল a bundle of roles and rights৷ এ যুক্তিতে, তাহলে মানুষকে কেমন করে শ্রেণিতে ফেলা যায়? এ ধরনের প্রচেষ্টাই কি ব্যর্থ নয়? কোনও জ্ঞানই পূর্ণ হতে পারে না৷ যে জ্ঞানভাণ্ডারের প্রবক্তাগণ দাবি করেন যে, তাঁদের তত্ত্বই জ্ঞান বা জীবনের শেষ কথা বলে তাঁরা ভুলের স্বর্গে বাস করেন৷মার্কসবাদের মধ্যে জীবনের সকল তত্ত্ব ও তথ্যকে নিজেদের মতে আনবার এক বিপজ্জনক ঝোঁক দেখা যায়৷ জ্ঞান যখন অজ্ঞানকে চিনতে পারে, তখনই তা মহান৷ প্রাচীন গ্রিক দর্শনশাস্ত্রে একটি চমৎকার বাক্যবন্ধ আছে– ‘The Eye begins to see only when it encounters its own blindness’ একজন প্রকৃত শিল্পী এই অজ্ঞাত জ্ঞানের সন্ধান করেন৷ শিল্প তাই বাঁধনহীন, সীমাহীন৷ যাঁরা শিল্পসাহিত্যকে সমাজ-স্বার্থের সহমর্মিতার প্রয়োজনে নিযুক্ত করতে চান, তাঁরা কি জানেন মানবজীবনের বিশালত্ব থেকে প্রয়োজনীয় Adaptation কীভাবে করতে হয়? বৃহত্তর মানবজীবনের অথবা অন্তহীন শিল্প-সংস্কৃতির আকাশপ্রমাণ আয়নায় আমরা ক’জন আপন আপন মুখ দেখার চেষ্টা করি?
তিন
The primary function of art is to transcend boudaries– মপাসাঁ একজন খাঁটি শিল্পী হিসেবে এটাই করতে চেয়েছেন৷ তিনি দেখিয়েছেন– মানুষের অন্তরে প্রেমসম্পদ লিঙ্গে আবদ্ধ থাকে না, প্রয়োজনের বদ্ধজলায় সীমিত হয় না৷ পুরুষ ও নারী দু’জনেই যখন জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রের সীমাহীন বিপদের মধ্যে পড়েন, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখা যায় তাঁরা একইরকম আচরণ করছেন, তখন নারীপুরুষের ভেদরেখা মুছে যায়৷ কেননা, মানুষের মধ্যেই কিছু সর্বজনীন মানবীয় উপাদান-স্বত্ব থাকে, যেগুলোকে খুব নিবিষ্টচিত্তে অনুধাবন করতে পারলে প্রতিমুহূর্তে ধরা পড়ে অনেক না-জানা তথ্য এবং তত্ত্ব৷ শিল্পের প্রধান কাজ অজানার পানে এগিয়ে চলা৷ আর, শিল্পকে যদি সামাজিক কারণে ব্যবহার করতে হয়, তবে মনে হয় বিশ্বমানবের একত্ব, মানুষে-মানুষে ঐক্যবোধ এবং বিশ্বভুবনের সকল, সর্বস্তরের মানুষকে সেই বৃহত্তর শৈল্পিক সামিয়ানার নীচে এনে, আমাদের সীমিত জীবনে, অসীম Adaptation কাজটি যথাসম্ভব পূর্ণ করাই মানবজীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত৷ Ameican Transcendentalist-গণ এটাই করতে চেয়েছেন৷ তাঁদের যুক্তি হল– মানুষের অন্তর্নিহিত ধর্মই সবসময়ই একতাবোধ এবং সার্বিক মানবজীবনের পরম ও চরম সার্থকতার জন্য এই একত্ববোধ একান্ত প্রত্যাশিত৷ এই প্রসঙ্গে আমরা ভারতীয় দর্শনের অদ্বৈতবাদ এবং কবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বমানবতাপ্রেমের উদাহরণ দিতে পারি৷
জাঁ লুক গোদার চিত্র দেখানোর মাধ্যম হিসেবে যেমন ব্রেখটিয়ান পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন, তেমনই কোথাও তাঁর ছায়াছবি উগ্র আধুনিক হয়ে উঠেছে৷ এসব কর্মকাণ্ডই বুঝি তাঁকে বিপ্লবী অভিধায় ভূষিত করেছে৷ প্রচলিত পদ্ধতি ছেড়ে দিয়ে নতুন পথে চলা মানেই বিদ্রোহ নয়৷ সত্যজিৎ রায়ই বলেছেন, ‘বিদ্রোহই আধুনিকত্বের একমাত্র সংজ্ঞা নয়৷’ উগ্র আধুনিকতা যে মানবজীবনে অভিশাপ ডেকে আনে তা আমরা দেখছি৷ এ কারণে মানুষ ঐক্যবোধবিচ্যুত হয়৷ প্রকৃত Adaptation -এর মধ্যে আত্মদর্শনের পেলব ব্যাপারটা থাকে৷ ব্রেখটিয়ান পদ্ধতি সেই পেলব, প্রেমময় অনুভূতিকে ভেঙে দিয়ে মানুষকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করতে সফল হয়৷ Formalist-দের defamiliarization ধারণার তত্ত্ব থেকেই ব্রেখটিয়ান পদ্ধতির জন্ম৷ এ পদ্ধতি দর্শককে কোনও ভাব বা সত্যমাধুর্যের চরম স্তরের অনুভবে পৌঁছতে দেয় না৷ ব্রেখট ভেবেছিলেন মানুষের মন থেকে কোনও দৃশ্যের মায়ামোহ বা ইলিউশন কাটিয়ে দিতে পারলেই তার চেতনা বাস্তবের দুঃখবোধ বা ধনীর শোষণ ইত্যাদির প্রতি বেশি পরিমাণে আকৃষ্ট হবে এবং বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে৷ প্রমাণিত হয়েছে যে, এটা খুব বুদ্ধিদীপ্ত ভাবনা নয়৷ প্রকৃত অর্থে পরিবর্তন আসে মানবমনের ভেতর থেকে, তার অভিজ্ঞতা ও গভীরতর শিক্ষাদীক্ষা থেকে৷
সেই অখণ্ড, অসীম বিশ্বমানবতার সীমাহীন ভাণ্ডার থেকেই প্রকৃত Adaptation করতে হয়, কী ছায়াছবিতে, কী জীবনে৷ ব্যক্তিগত অনুভব তখনই হয় যখন সে বিশুদ্ধ ‘Philosophical Wonder’-এর স্বাদ পায়, তখনই তার মনে সমাজের মানুষের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় ‘Adaptation’-এর অদম্য স্পৃহা জেগে ওঠে৷ বাইরের কোনও প্রভাবে যদি এ ব্যাপারটা ঘটেও যায়, তাতে আবেগ আর শক্তি থাকলেও,স্থায়িত্ব থাকে না৷ অখণ্ড নন্দনতত্ত্বই পরিমিতির শক্তি দিয়ে মানবমনে পরিবর্তন আনতে পারে৷ জগতের সকল শিল্পী, সকল সাহিত্যিক বা চিত্রপরিচালকগণই এই অখণ্ড নন্দনস্তূপ থেকে প্রয়োজনীয় রসটুকুর অভিযোজন করে চলেছেন৷ এ কাজে সার্থক তিনি, যিনি জীবনে, সাহিত্যে, শিল্পে রূপান্তরের অদৃশ্য সেই মহাশিল্পীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন৷
শনিবারের চিঠি, বাহান্ন বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা