ঘোষগ্রামের মহালক্ষ্মীমাতা          

বীরভূম জেলার অন্তর্গত রামপুরহাট মহকুমার অধীন মুর্শিদাবাদ সীমান্তে ঘোষগ্রাম অবস্থিত৷ গ্রামটি দেবী লক্ষ্মী-মাতার গ্রাম হিসেবে পরিচিত৷ লক্ষ্মীমাতা হচ্ছেন ভগবান বিষ্ণুর পত্নী৷ ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী৷ পুরাকালে ঋষি দুর্বাসা দেবরাজ ইন্দ্রের আচরণে রুষ্ট হয়ে তাঁকে লক্ষ্মীছাড়া হও বলে অভিশাপ দেন৷ দেবরাজ ইন্দ্রকে ঋষি দুর্বাসার অভিশাপের কারণে দেবী লক্ষ্মী ইন্দ্রের ভবন স্বর্গ হতে সাগরে নির্বাসিত হন৷ পরবর্তীতে ব্রহ্মার উপদেশে দেব ও অসুরেরা অমৃতের সন্ধানে সমুদ্র মন্থন করেন৷ সেই সময় সমুদ্র থেকে চন্দ্র, ঐরাবত, হস্তি, পারিজাত, ধন্বন্তরী, অমৃত ও দেবী লক্ষ্মী উঠে আসেন৷ তাই দেবী লক্ষ্মীকে সমুদ্র দুহিতাও বলা হয়৷ চণ্ডীতে মহামায়ার রূপের বর্ণনার সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীর রূপের বর্ণনা ‘যা দেবী সর্বভূতেষু লক্ষ্মীরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ’ বলা হয়েছে৷ লক্ষ্মীর ধ্যানমন্ত্রে‍ বলা হয়েছে ‘পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ – সৃণিভির্যাম্যসোম্যয়োঃ৷ পদ্মাসনস্থাং ধ্যায়েচ্চশ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম’ অর্থাৎ যার যাম্য তথা দ‍ক্ষিণ দুই হাতে পাশ ও অক্ষমালা এবং সৌম্য তথা বাম দুই হাতে পদ্ম ও অঙ্কুশ বিরাজ করছে৷ তিনি পদ্মাসনে উপবিষ্টা, শ্রী সম্পদ ও সৌন্দর্যের জননী৷ শুধুমাত্র ঐহিক ধনসম্পদের অধিকারিণী নন সঙ্গে সঙ্গে‍ পারমার্থিক ধন ঐশ্বর্য ও মুমুক্ষেরও অধিকারিণী৷

তারাপীঠ থেকে ১০ কি.মি. ও বীরচন্দ্রপুর থেকে ৪ কি.মি. পূর্বে পাকা রাস্তা ধরে গ্রামে প্রবেশের মুখে দেখা যাবে লক্ষ্মীমায়ের মন্দির– মন্দির সংলগ্ন দেবীকুণ্ড পুষ্করিণী ও প্রশস্ত ফাঁকা জায়গা–যা ছিল এককালের আমবাগান বর্তমানে লক্ষ্মীতলা প্রাঙ্গণ হিসেবে পরিচিত৷ গ্রামটি মন্দিরময়৷ গ্রামের দ‍ক্ষিণ দিকে দ‍ক্ষিণা কালী, পূর্বে বাগরণ চণ্ডীমা, উত্তরে ধর্মরাজতলা, লক্ষ্মীমাতা মন্দিরের অদূরে অশত্থবৃক্ষের নীচে পালযুগের বহু ভগ্ন মূর্তি ষষ্ঠীমাতারূপে বিরাজ করছে৷ গ্রামটিতে প্রবেশ করার মুখে প্রাকৃতিক শোভা আপনাকে মোহিত করে তুলবে৷

ঘোষগ্রাম গ্রামের নাম হলেও বর্তমানে এই গ্রামে এক ঘরও ঘোষ পদবির মানুষ বাস করে না৷ গ্রামের আরাধ্যা দেবী শ্রীশ্রীক্ষ্ণীমাতা৷ লক্ষ্মীমাতা কবে ঘোষগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস না থাকলেও প্রাচ্য বিদ্যা মহার্ণব স্বর্গীয় নগেন্দ্রনাথ বসু সিদ্ধান্ত বারিধি মহাশয়ের ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’-এর কায়স্থ খণ্ডে‍ উল্লেখ আছে‍ ‘ঘোষগ্রামে লক্ষ্মীমাতা বিরাজয়৷ বহু দেবোত্তর ভূমি আছয়ে উঁহায়৷ পায়সান্ন ভোগ হয় বারমাস৷’ বাংলায় শূর বংশীয় রাজাদের ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা আদিশূর ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে মতান্তরে ১০৪২ খ্রিস্টাব্দে পুত্র ভূশুরের মঙ্গল কামনায় যজ্ঞের জন্য বাংলায় ব্রাহ্মণ না থাকায় যুক্তপ্রদেশ বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের কণৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ ও পাঁচজন কায়স্থ আনেন৷ এই পাঁচজন কায়স্থের মধ্যে একজন সোম ঘোষ৷ স্বর্গীয় নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয়ের ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় আদিশূর সোম ঘোষকে ১২৭টি গ্রাম দান করেন যার মধ্যে ঘোষগ্রামেরও উল্লেখ আছে৷ তাই ঘোষগ্রাম নিঃসন্দেহে ১৫০০ বছরের অধিক পুরনো গ্রাম বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে৷ ঘোষগ্রামের আগে গ্রামটির নাম ছিল ভবেশ্বরপুর৷ পরবর্তীতে‍ সোম ঘোষের অধীনে গ্রামটি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারণে এবং লক্ষ্মীভক্ত দয়াল ঘোষের জন্য গ্রামটির নাম ঘোষগ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে৷ ঘোষগ্রামের পুরনো দিনের দলিলপত্রে ভবেশ্বরপুরের উল্লেখ আছে৷

ঘোষগ্রামে লক্ষ্মীমাতার অবস্থিতি স্মরণাতীত সময় থেকে৷ জনশ্রুতিতে ভিত্তি করেই লক্ষ্মীমাতার কাহিনি পল্লবিত হয়েছে৷ সামান্য যে ইতিহাস পাওয়া যায় তা বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সময় থেকেই৷ সেই সময় রাজশাহির জমিদার ছিলেন উদয়নারায়ণ রায় এবং তার অধীনস্থ বীরভূমের অনেক ছোটখাটো জমিদার ছিল৷ যেমন ঢাকার রাজা রামজীবন চৌধুরী, হাসানের জমিদার পাঁচথুপির জমিদার৷ তখন ঢেকার জমিদার রামজীবন চৌধুরী তারাপীঠের তারামায়ের মন্দির, কলেশ্বরের মন্দির ও ঢেকাতে একটি দিঘি খনন করে দেন৷ এই সময় (১৭০১-১৭২৫ খ্রি.) ঘোষগ্রামের নিবিড় আম্রকুঞ্জের মধ্যে কামদেব ব্রহ্মচারী নামে এক সাধক বৈষ্ণব মতে লক্ষ্মীমায়ের সাধনা করেছেন৷ কামদেব ব্রহ্মচারী ঘোষগ্রামের লক্ষ্মীমাতার সিদ্ধসাধক৷ মহামহোপাধ্যায় কামদেব তার্কিক রাঢ়দেশীয় ফরিদপুরের ব্রাহ্মণ৷ তিনি বৈষ্ণব ও শাক্তমতে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন৷ বৈষ্ণবমতে সাধনা করেছেন কান্দির রাধাবল্লভ মন্দিরে ঘোষগ্রামে দেবী লক্ষ্মী-মাতার, শাক্তমতে বড়তুড়িগ্রাম ও চণ্ডীপুর-তারাপীঠে৷ তারাপঠে তাঁর নামানুসারে একটি গ্রামের নাম কামদেবপুর৷ এবং কামদেবপুর মৌজায় তারাপীঠ মহাশ্মশান অবস্থিত৷ পরিব্রাজক এই সাধক মূর নদী বর্তমান নাম ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে জেমোকান্দিতে রুদ্রদেবের প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাধনা করেন৷ তাঁর দেহাবসানের পর তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে মূর নদীর তীরে হোমতলায় তাঁর চিতাভস্মকে সমাধিস্থ করা হয়৷ গেরুয়া বসন পরিহিত, হাতে লাঠি ও কাঁধে ভৈরব শিলা ও সাধন সামগ্রী ভর্তি ঝোলা নিয়ে তিনি বিভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমণ করতেন এবং স্থান মাহাত্ম্য মতে কখনও শাক্তমতে কখনও বা বৈষ্ণব মতে সাধনা করেছেন৷ তিনি যখন ঘোষগ্রামের আম্রকুঞ্জের পাশে নিমবৃক্ষের তলে বসে সাধনা করছেন তখন এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে৷ ঘটনাটি এইরকম, সেই সময় গ্রামের লক্ষ্মীভক্ত দয়াল ঘোষ জমিতে হলকর্ষণের সময় পুত্রের বায়না মতো পাশের কাঁদর হতে ভাসমান প্রস্ফুটিত পদ্মটিকে তুলতে গেলে পদ্ম সরে যায় তখন তিনি বিস্মিত হয়ে আম্রকুঞ্জের মধ্যে সাধনারত কামদেব ব্রহ্মচারীকে দিবা অবসানে এই অলৌকিক ঘটনাটি বলেন৷ কামদেব পরদিন দয়াল ঘোষকে তা তুলে দেওয়ার কথা বললেন৷ এদিকে কামদেব সেই রাত্রিতে লক্ষ্মীমা কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পদ্মটিকে তুলে মায়ের নির্দেশে আম্রকুঞ্জের একটি ঘটের উপর রেখে লক্ষ্মীপুজো শুরু করেন৷ এইভাবে গ্রামের মাঝে বিরাজিত দেবী লক্ষ্মী মনুষ্য মাঝেই প্রকটিত হলেন৷

মা লক্ষ্মী স্মরণাতীত কাল থেকে ঘোষগ্রামে ঘটে পটে পূজিত হয়ে আসছেন৷ তন্ত্র ও বৈষ্ণবসাধক কামদেবকে মা-লক্ষ্মী স্বপ্ন দিলেন তাঁর মূর্তি গড়ে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন প্রতিষ্ঠা করতে এবং আরও জানালেন, ‘দারুময়ী মূর্তি হবে জলাশয় নিকটবর্তী বাস্তুভিটা সংলগ্ন পদ্মচিহ্নযুক্ত একটি শাখাবিশিষ্ট নিম বৃক্ষের কাঠ দিয়ে, যে বৃক্ষে কোনও কোটর থাকেনি, কোনও পাখি বা সাপ বাসা বাঁধেনি, বৃক্ষের গায়ে পদ্মচিহ্ন থাকবে৷ মূর নদী থেকেই তুমি সে‍ই কাঠ সংগ্রহ করতে পারবে৷ আমি গঙ্গানদীর তীরে মুর্শিদাবাদের মণিগ্রামের রাজার তৈরি কনক লক্ষ্মীমন্দির থেকে রাজার উদাসীনতার জন্য বন্যার কারণে ভাসতে‍ ভাসতে কাঠ রূপে মূর নদীর কিনারাতে অবস্থান করব৷ তুমি সেই কাঠ সংগ্রহ করবে এবং তোমার ছিটেবেড়া ঘরে তোমার সাধনার জায়গায় মূর্তি গড়ে পূজার্চনার ব্যবস্থা করবে৷ তুমি যেহেতু তন্ত্র ও বৈষ্ণবমতের সাধক তাই আমাকে মহালক্ষ্মীরূপে দশমহাবিদ্যার দেবী কমলা জ্ঞানে আরাধনা করবে৷’

মহালক্ষ্মীমাতা

মায়ের প্রথম মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন লক্ষ্মীসাধক কামদেব ব্রহ্মচারী কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাত্রে৷ কারণ এই রাত্রে ‘নিশীথে বরদাঃ লক্ষ্মী কোজাগর্রীতিভাষিণী৷ তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ৷’ অর্থাৎ এই রাত্রিতে তমগুণের মানুষেরা আমার সাধনা অক্ষ অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে দিয়ে প্রভূত ধনসম্পদের অধিকারী হয়৷ কিন্তু তুমি সত্ত্ব গুণের অধিকারী তাই অক্ষ অর্থাৎ জপের মধ্যে আত্মচৈতন্যের মধ্যে তুমি সিদ্ধ হবে৷ তারপর গঙ্গানদী হতে স্বপ্নপ্রদত্ত কাঠ সংগ্রহ করে গঙ্গামৃত্তিকা দিয়ে দ্বিভূজা রূপে তৎকালীন আম্রকুঞ্জে তাঁর মাটির আশ্রমে মহালক্ষ্মীমূর্তি স্থাপন করলেন৷ লক্ষ্মীমূর্তিটি দারুময়ী৷ মূর্তিটির ডানপাশে কন্যা সন্তান ধন৷ বাম পাশে পুত্র সন্তান কুবের বিরাজ করছে৷ প্রতীক রূপে চালের গাই এখানে মায়ের মন্দিরে মায়ের হাতে বিরাজ করছে, যা তিনি কুবেরকে জনসাধারণের মধ্যে বিলি করার জন্য দিচ্ছেন৷ চালের গাই অর্থাৎ ধানের শিষের মতো চালের শিষের এক গুচ্ছ আঁটি‍৷ কথিত আছে সত্যযুগে মাঠে ধান না হয়ে সরাসরি চাল হত৷ জনৈক রাজা ক্ষুধায় কাতর হয়ে চাল ছিঁড়ে‍ খান৷ এ দেখে লক্ষ্মীমাতা বিচলিত হন এবং ভাবেন রাজাই যদি চাল ছিঁড়ে‍ খান, তাহলে প্রজারা তো তা নির্দ্বিধায় খাবেন৷ তাই তিনি চালের চারিদিকে খোসার আবরণ দিয়ে ধানের সৃষ্টি করেন৷ এই সময় ঘোষগ্রাম হাসনের, পাঁচথুপির ও এরোল গ্রামের জমিদারদের অধীন ছিল৷ ঘোষগ্রামে মা লক্ষ্মীর যে বহু দেবোত্তর ভূমি ছিল তা কামদেব ব্রহ্মচারীকে তদানীন্তন জমিদার সম্ভবত ঢেকার রাজা রামজীবনের উত্তরাধিকারী মহেশ রায় (আনুমানিক ১৭৩৫ খ্রিস্টাব্দ) দিয়েছিলেন৷ এ সম্পর্কে কিংবদন্তি হল জমিদার ঘোড়ায় চড়ে যখন ঘোষগ্রামের পাশ দিয়ে আম্রকুঞ্জের‍ দিকে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি কামদেব ব্রহ্মচারীকে নিমবৃক্ষের নীচে ঘটের মধ্যে প্রস্ফুটিত পদ্মকে লক্ষ্মী জ্ঞানে পুজো করতে দেখেন৷ লক্ষ্মীভক্ত মহেশ রায় কামদেবের প্রতি প্রসন্ন হয়ে কামদেবকে বলেন, তুমি মায়ের মন্দির নির্মাণ কর এবং মায়ের অবয়ব তৈরি করে বারোমাস পুজোর ব্যবস্থা কর, আমি দেবীর নামে লাখেরাজ সম্পত্তির বন্দোবস্ত করে দেব৷ তখন কামদেব জমিদারকে বললেন, আপার তো বিশাল মহাল, ঘোষগ্রাম আপনার অধীন, আপনি যদি মায়ের নামে জমি দান করেন তাহলে আমি তিনটি শাঁখের ফুঁ দিয়ে যে জমি প্রদক্ষিণ করতে পারব, সেই জমি তিনি যেন মায়ের নামে দান করেন এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিলেন৷ জমিদার ভাবলেন, এ আর এমনকী বিষয়!তিনি রাজি হলেন৷ কামদেব প্রথম শাঁখের ফুঁ দিয়ে একশো বিঘা এবং দ্বিতীয় বারে একশো বিঘা এবং তৃতীয় বারে তিনি যখন ৭২ বিঘা প্রদ‍ক্ষিণ করে ফেলেছেন তখন জমিদার জোড়হাতে সাধক কামদেবকে আর প্রদ‍ক্ষিণ না করতে অনুরোধ করেন এবং সেই থেকে তিনি ২৭২ বিঘা জমি লক্ষ্মীমায়ের মানে নিষ্কর হিসেবে দান করেন৷ যা আজ মহাকালের নিয়মে বেহাত হয়ে গেছে, অবশ্য হাঁসনের জমিদারের দেওয়া লক্ষ্মীমায়ের মন্দিরটির অবস্থানের জায়গাটি বর্তমান সেবাইতদের নামে নথিভুক্ত আছে৷ সেই সময় মায়ের মন্দি‍রের পাশে‍ একটি পুষ্করিণী খনন করা হয়৷ যা বর্তমানে দেবীকুণ্ড নামে পরিচিত৷ এই পুষ্করিণীর জল অতি পবিত্র৷ এখানে অবগাহন করে মায়ের পুজো নিবেদন করলে ভক্তের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য লাভ হয়৷

বর্তমানে লক্ষ্মীমাতার মন্দির বহু ভক্তের দানে দৃষ্টিনন্দন রূপে নবরূপে নির্মিত হয়েছে (২০১৬-২০১৮ খ্রিস্টাব্দে‍)৷ মন্দিরের সামনে নাটমন্দির৷ বর্তমানের আগের মন্দিরটি কান্দির রাজা লালাবাবু তৈরি করেন (১৮০৫-১৮১০ খ্রিস্টাব্দ) যার একটি কক্ষে লক্ষ্মীমাতা ও অন্য কক্ষে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা-হনুমান ও জগন্নাথের মূর্তি বিরাজ করত– যা নব নির্মিত মন্দিরে স্থানান্তরিত হয়েছে৷ এ সম্পর্কে জনশ্রুতি তিনিও একবার ঘোষগ্রামে লক্ষ্মীমায়ের অবস্থানের কথা শুনে এই গ্রামে আসেন এবং স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে বর্তমান মায়ের অবয়বে মূর্তি তৈরি ও মন্দির তৈরি করেন৷ এছাড়া লালাবাবুর তৈরি ধর্মরাজ, বাণঠাকুর, মদনেশ্বর, সিদ্ধেশ্বরী ও রামমন্দির ভগ্নদ্যোত হলে বর্তমানে ভক্তদের দানে নবরূপে (২০১৬-২০১৮ খ্রিস্টাব্দ) তৈরি হয়েছে৷ সিদ্ধেশ্বরী মাতার মূর্তিটি ছিল গুপ্তযুগের৷ যা তস্করের লোভের শিকার হয়ে এখান হতে অপহৃত হয়েছে৷ তারই স্মৃতি ধরে মূর্তির একটি প্রতিলিপি এই মন্দিরে বানানো হয়েছে৷

মাতৃ মহিমার কথা স্মরণ করা হলে একটি বহুল প্রচারিত প্রবাদবাক্য ‘ঘোষগ্রামে মা লক্ষ্মী উপলাই-এ বর’ প্রসঙ্গটি এসে যাবে৷ জনশ্রুতি, ঘোষগ্রামের পাশের গ্রাম উপলাই-এ ভবেশ মণ্ডল নামে এক লক্ষ্মীমাতার ভক্ত ছিল৷ এক সময় তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে গৃহছাড়া হতে মনস্থ করেন এবং রাত্রিতে পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে‍ ঘরের গোড়াতে রাখা চাল মেপে ঝোলা বন্দি করে গৃহ ছাড়বেন ঠিক করেছেন৷ মায়ের নাম করে চাল মাপা শুরু করলেন৷ সারারাত্রি ওই সামান্য গোড়াতে রাখা চাল মাপা শেষ হয় না, চাল ছাপিয়ে উঠোন ভরে ওঠে৷ এদিকে সকাল হয়ে এসেছে, দুটি চারটি পাখির কলরবে বাড়ির কর্ত্রী ঘুম থেকে উঠে কর্তাকে বলছে তোমার গোছগাছ সব হয়েছে এবং কর্তার চাল মাপার শব্দ শুনে মন্তব্য করে ‘ওই ক’টা চাল মাপা এখনও শেষ হয়নি’, সঙ্গে সঙ্গে চাল ফুরিয়ে গেল৷ চাষি হা-হুতাশ করতে থাকে কিন্তু যে চাল সারারাত্রি তিনি মেপেছেন তা দিয়ে তার ঋণ শোধ তো হয়েই গেল উপরন্তু ঘরে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এল, চাষিকে গ্রামছাড়া হতে হল না৷ সেই থেকে এই প্রবাদ বাক্য মানুষের মুখে মুখে ফেরে৷

বহু লক্ষ্মীভক্ত উপলাই গ্রামে থাকায় মা মাঝে মাঝে উপলাই গ্রামে যেতেন৷ একবার পূর্ণিমার মধ্যরাত্রিতে মা সালাঙ্কারা রমণীর বেশে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে‍ চলেছেন এবং যেতে যেতে তাঁর পায়ের নুপূর রাস্তায় পড়ে যায় এবং তার অন্বেষণে‍ তিনি ব্যস্ত থাকে‍ন, যা দেখে গ্রামের নৈশপ্রহরী মাদকাসক্ত সরল চৌকিদার তা খুঁজে বের করে দেন৷ লক্ষ্মীমা তার প্রতি প্রসন্ন হন এবং তাকে বর দিতে চান৷ কিন্তু মদ্যপানে আকৃষ্ট চৌকিদার প্রতিদিন যেন তার মদের অভাব না হয় এই বর চেয়ে নেন৷মা তখন বলেন, যখন সে মদের প্রয়োজন বোধ করবে তখন গ্রামের যে কোনও পুকুরের জলকে মদ্য হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে এবং এই বরদানের কথা যখন সে প্রকাশ করবে তখন তা আর কার্যকরী হবে না৷ কিন্তু নির্বোধ চৌকিদার একদিন প্রকাশ্যে তার অলৌকিক ক্ষমতার কথা লোকমধ্যে জাহির করেন এবং প্রমাণ করতে গিয়ে মা লক্ষ্মীর বরদানের শর্তের কথা বিস্মিত হন এবং ব্যর্থ হন৷ উপলাই গ্রামের মানুষ এখনও দেবী লক্ষ্মীমাতাকে তাদের গ্রামের প্রতি বরদানের দেবী হিসেবে মেনে চলেন এবং লক্ষ্মী মন্দিরে প্রতি বছর পুজো দিয়ে যান৷ পৌষ মাস, চৈত্র মাস ও ভাদ্র মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার প্রচুর ভক্ত মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে আসেন৷ প্রত্যহ পাঁচ সের দুধ, পাঁচ পোয়া আতপ ও পাঁচ ছটাক চিনি দিযে মায়ের পরমান্ন ভোগ হয়৷ বর্তমানে‍ নির্দিষ্ট সংখ্যক ভক্তদের জন্য মধ্যাহ্নকালীন সিদ্দেশ্বরী মায়ের অন্নভোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷

বর্তমান সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে পঞ্চমুণ্ডির আসনে সাধক কামদেবের পাশাপাশি পঞ্চতপা সাধক দুর্গাদাস সরস্বতীও এই মন্দিরে সাধনা করে সিদ্ধ হয়েছেন৷ পঞ্চতপা সাধক তাঁকেই বলা হয় যিনি গ্রীষ্মকালে মাথার উপর প্রখর রৌদ্রতাপে চতুর্দিকে কাষ্ঠ-প্রজ্জ্বলন করে তার মাঝখানে বসে যজ্ঞাদি সম্পন্ন করেন এবং প্রবল শীতে আকণ্ঠ জলে নিমজ্জিত করে অহরহ সাধনা করেন৷ সাধক বামাক্ষ্যাপাবাবা তারাপীঠ থেকে ঘোষগ্রামের লক্ষ্মীমন্দিরে লক্ষ্মীমাতা দর্শন করে বর্তমান মুর্শিদাবাদের এরোয়ালি গ্রামের সিংহবাহিনী দুর্গা ও কালীমাতা দর্শনে যেতেন এবং তখন লক্ষ্মী মন্দিরে পঞ্চমুম্ডির আসনে উপবিষ্ট পঞ্চতপা সাধক দুর্গাদাস সরস্বতীকে দেখে আগুন আগুন বলে চিৎকার করে উঠতেন৷ এই পঞ্চতপা সাধক দুর্গাদাস সরস্বতীর আশ্রম ছিল ঘোষগ্রাম সংলগ্ন ঈশিরা গ্রামে৷

ঘোষগ্রামে পৌষ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীমাতার পুজো দিতে একটা বড় সংখ্যক তীর্থযাত্রী অধিকাংশ কৃষিজীবী আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম, এমনকী, দূরদূরান্তের শহর থেকে আসেন৷ লক্ষ্মীমায়ের পুষ্করিণী দেবীকুণ্ডতে স্নান করে মায়ের পুজো দেন৷ শতাব্দী অধিক প্রাচীন এই মেলা বর্তমানে বিশাল আকার ধারণ করতে চলেছে৷ মেলার দর্শনার্থীরা মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে নাগরদোলায় চেপে লোহার খুন্তি, হাতা, শিল, নোড়া, মনোহারির টুকিটাকি, লক্ষ্মীমায়ের বাহন প্যঁচাঠাকুর, লক্ষ্মী-নারায়ণের পট এবং বিভিন্ন রকমের কড়ি সংগ্রহ করে আপন আপন বাড়ি ফেরে৷ মেলাতে এত সংখ্যক কড়ির আমদানি হয় যা দেখে মেলাকে কড়ির মেলা আখ্যা দেওয়া হয়৷ গৃহস্থেরা এই কড়ি সংগ্রহ করে মায়ের কাছে অভিষিক্ত করে বাড়িতে ঠাকুর ঘরে রেখে দেন মায়ের আশীর্বাদ পাওয়ার আশায়৷ বর্তমানে মেলা কমিটি ও পুলিশ প্রশাসন মেলার শান্তিরক্ষা করছে৷ মেলায় আগত দূরদূরান্তের তীর্থযাত্রীরা গ্রামের মানুষের পর্ণকুটিরে বাস করে আতিথেয়তায় প্রাণ মন আনন্দে পূর্ণ করে বাড়ি ফিরে যায়৷

ঘোষগ্রামে বসতবাটি থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্য সৈনিক স্বর্গীয় তারাকুমার চক্রবর্তী মহাশয়কে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মাননীয়া শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট তাম্রপত্র দিয়ে ভূষিত করেন৷ গ্রামের প্রবেশের মুখের কাঁদরের উপর নিমিত সাঁকোটি বীরভূমের রামপুরহাটের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব স্বর্গীয় জে. এল. বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় মাতৃভক্তির নিদর্শন স্বরূপ তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন৷ বর্তমানে ঘোষগ্রাম ও গ্রামের দেবী লক্ষ্মীমাতার অবস্থান এখন প্রচারের আলোতে এসেছে৷ মন্দির রক্ষণাবে‍ক্ষণ, পরিচালন ও পূজার্চনা মন্দির কমিটি ও সেবাইতরা করেন এবং আশা করি একদিন সরকারি বদান্যতায় গ্রামটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত হবে৷

শনিবারের চিঠি – শারদ সংখ্যা, ১৪২৬