ঐতিহ্যের ‘আবর্তন’

বর্তমান প্রজন্মের নানান পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিভাবান তবলাশিল্পী শঙ্খ চ্যাটার্জির শিষ্য শুভজ্যোতি গুহর প্রতিষ্ঠান ‘আবর্তন’ –এর ষষ্ঠবার্ষিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হল সম্প্রতি (পাঁচ ডিসেম্বর)।

অনুষ্ঠানের প্রথম শিল্পী আগ্রা ঘরানার বিখ্যাত শিল্পী ওয়াসিম আহমেদ খান। তাঁর সুরেলা গাম্ভীর্যময় কন্ঠে আগ্রা শৈলীর পরিবেশন বরাবরই বর্ণময় হয়ে ওঠে। এদিন আনন্দী কল্যাণ (নন্দ) রাগে ‘নোম তোম’ আলাপে ছিল স্বরক্ষেপণের আশ্চর্য কৌশলের প্রদর্শন। এখন এই ধরনের আলাপ বিশেষ একটা শোনা যায় না। বিলম্বিত একতাল বন্দিশে অপূর্ব স্বরের মোচড়, ‘কহন’ নিয়ে আলাপ, কন্ঠের উদাত্ততায় তার সপ্তকে স্বর জমানো, পুকার, বোলতান, বহলওয়া, বোলবাট, আকারান্ত সমান ওজনের উত্কৃষ্ট তানকারি এক অসাধারণ আবহের সৃষ্টি করেছিল। দ্রুত ত্রিতালে, অতি দ্রুত তানে ছিল স্বরনিয়ন্ত্রণের নৈপুণ্য। তাঁর সহযোগী শিষ্য শতানীক চ্যাটার্জির পরিবেশনের দক্ষতাও উল্লেখযোগ্য এবং প্রশংসনীয়। বাদ্যযন্ত্রে সুন্দর সহযোগিতা করেছেন হিরণ্ময় মিত্র (হারমোনিয়াম), বিভাস সাংঘাই (তবলা), সরবর হুসেন (সারেঙ্গি)।

ওয়াসিম আহমেদ
ওয়াসিম আহমেদ

প্রখ্যাত সেতার শিল্পী রীণা শ্রীবাস্তব এবং তাঁর পুত্র সরোদিয়া প্রতীক শ্রীবাস্তব এদিন পরিবেশন করেন রাগ হেমন্ত – আলাপ, ঝাঁপতাল, দ্রুত ত্রিতাল, ঝালা। কলকাতায় এটি তাঁদের সেতার-সরোদের প্রথম যুগলবন্দি। রীণার মোলায়েম স্ট্রোকের গভীরতাপূর্ণ মিষ্টত্বে সৌন্দর্যময় স্বরবিন্যাসের নৈপুণ্যে, স্বরের মোচড়ে, বোলবাণীর সুচারুতায় প্রকাশিত রাগটির রোমান্টিক মাধুর্য়। প্রতীকের অনায়াস বাদনকৌশলে, তন্ত্রীর মোচড়ে, মীড়ের যথার্থ প্রয়োগে বিকশিত রাগটির সুষমা। ঝাঁপতাল বন্দিশে ছিল বোলবাণীর বৈচিত্র্য এবং রীণার গায়কী অঙ্গের বাদনকৌশলের সৌন্দর্যময় নজির এবং প্রতীকের তালিমগত দক্ষতা। আগামীদিনে সরোদিয়াকে আরও পরিণতরূপে পাওয়ার আশা রইল। দুই শিল্পীর সমঝোতায় পরিবেশনটি ছিল আকর্ষণীয়। সঙ্গতে শুভজ্যোতির পরিচ্ছন্ন বাজের নমনীয়তা, স্বচ্ছতা ও বোল-টুকড়া ছিল উত্কৃষ্ট মানের। শেষে শিল্পীর যথার্থ ঝালা বাদনের সঙ্গে শুভজ্যোতি দেখিয়েছেন তাঁর বাদনকৌশলের দক্ষতা।

শেষ অনুষ্ঠান গুরু-শিষ্য পরম্পরাকে সামনে রেখে অরূপ চ্যাটার্জি ও শিষ্য অজিষ্ণু মুখার্জির দ্বৈত তবলাবাদন। ত্রিতালে উঠান, পেশকার, কায়দা, কায়দা-রেলা ইত্যাদিতে ছিল ফারুকাবাদ ঘরানার বিশেষত্ব। অরূপ চ্যাটার্জির কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রতিষ্ঠিত এই শিল্পীর বাদনকৌশলের পরিচ্ছন্নতা সুবিদিত। নবপ্রজন্মের প্রতিভা অজিষ্ণু প্রমাণ করলেন নিজেকে। অজিষ্ণুর অঙ্গুলিচালনা, অনায়াস স্ট্রোক প্রশংসনীয়। আহমেদজান থেরাকোয়া, মসিদ খাঁ, সংকীর্ণ জাতির কায়দা-রেলা (নয় ছন্দ), চরতাল-কি-সওয়ারী কায়দা ইত্যাদিতে গুরুর সঙ্গে সমান তালে অজিষ্ণু দেখিয়েছেন তালিমগত বাদনকৌশলের দক্ষতা।