গহিনগাঙ গহরজান
জোড়াসাঁকোর মল্লিকভবনে চিৎপুর রোডের পশ্চিমে ঘড়িওয়ালা বাড়িতে একটা জমজমাট বাইনাচের আসর বসেছে৷ গ্রীষ্মকালের সন্ধেবেলা৷ সালটা ১৯১৩, একশো বছরেরও বেশি সময়ের ব্যাপার৷ নাচবেন বিখ্যাত বাইজি, তিনি আসরে এসে হাজির৷ তাঁর মুজরোর দক্ষিণা নগদ পাঁচশো তঙ্কা৷ বাইজির বাজারে তিনি সবচেয়ে দামি৷
আসরে হাজির হাজারো চোখে ঝিলিক লাগিয়ে অঙ্গ দুলিয়ে বাই সাহেবা৷ তবলচি, সারেঙ্গি, হারমোনিয়াম বাদকেরা শির ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করলেন৷ সারা আসরে একটা নড়াচড়া৷ এক বাবুরা গোঁফ চুমড়োচ্ছেন তো অন্যজন উড়ুনিটা কাঁধে ঠিকঠাক বসিয়ে নিলেন— মৃদু গুঞ্জনের মধ্যে আসরে তিনি এলেন— সেখানে পিন-পতন নীরবতা৷ মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি চারপাশ দেখে নিলেন এবং তারপরেই একটা অশ্রুতপূর্ব আদেশ জারি করলেন, যাকে বলা যায় ফরমান৷
আসরের শ্রোতাদের দেখিয়ে আয়োজকদের বললেন— এঁরা যেভাবে বসে আছেন সেটা বিলকুল বদলে দিতে হবে৷ যাঁরা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে দেখছি সাহেবসুবো, বাঙালি, মারোয়াড়ি, পাঞ্জাবি সবাই মিলেমিশে আছেন৷ এঁদের একটু আলাদা করে বসানো যায় না৷
তাঁরা বুঝতে না পেরে চোখে জিজ্ঞাসা ফোটাতেই বাইজিসাহেবা বললেন— চারভাগে ভাগ করে দিন৷ সাহেব-মেমরা একদিকে, আর একদিকে শুধু পাঞ্জাবিরা, মাড়োয়ারিরা বসবেন হিন্দুস্থানিদের সঙ্গে আর বাঙালিরা আলাদা হয়ে৷ এখনি বুঝতে পারবেন— এমন ব্যবস্থা করতে কেন বলছি৷ তিনি যখন বলছেন, মানতেই হবে৷ প্রতিবাদ না করে নির্দেশমতো জায়গা বদল করে সবাই আসন গ্রহণ করলেন বিস্তীর্ণ জাজিমের নানা প্রান্তে৷
এবার মঞ্চ থেকে নেমে এলেন তিনি, তিনি মানে কিন্নরীশ্রেষ্ঠা গহরজান৷ সোজা চলে গেলেন সাহেব-মেমদের আসনের কাছে৷ তাঁদের নমস্কার করে তিনি গান ধরলেন— ইংরেজি গান, একেবারে নিখুঁত উচ্চারণে৷ নিখুঁত হবেই না কেন, তিনি যে…৷ তাঁর গান শুনে এক মুখ হেসে গলা বাড়িয়ে এক্সেলেন্ট, গ্রান্ড, বিউটিফুল ধ্বনি দিয়ে করতালিতে সমস্ত জলসাঘর ভরিয়ে দিলেন সাহেব মেমরা৷ এরপর যখন নাচলেন এবং পরেই আবার একটা ইংরেজি গান৷ ভিনি, ভিসি, ভিডি— এলাম, দেখলাম, জয় করলাম৷
এবার পাঞ্জাবিদের কাছে গিয়ে পাঞ্জাবি গান এবং গানের শেষে তদুচিত নাচ৷ করতালিভূষিত হয়ে ঠুংরি আর দাদরা শুনিয়ে বাহবা কেড়ে নিলেন মারোয়াড়ি, রাজস্থানি, হিন্দুস্থানিদের কাছ থেকে৷ সবশেষে বাঙালিদের দঙ্গলে— গান ধরলেন প্রত্যাশা মতো বাংলাতেই, দাদরা তালে৷
ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে গেল
আর এল না (অর এল না)৷
বুঝিবা প্রাণের ডোরে বেঁধেছে কেউ
প্রাণ ময়না৷৷
বল সখি কোথায় যাব,
কোথায় গেলে পাখি পাব৷
এমন ধনী কে শহরে আমার পাখি রাখলে ধরে,
দেখলে তারে কেড়ে নেব,
আর দেব না৷৷
এমনকী রবীন্দ্রনাথের গানও গেয়ে দিলেন—
কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না
(পথের) শুকনো ধূলি যত,
কে জানিত আসবে তুমি গো
(এমন) অনাহূতের মতো৷…
চার-চারটে গানে বাঙালি অভিভূত এবং গানের পরে নাচেও৷
চিকের আড়ালে মহিলারা বসে আছেন৷ তাঁদের ইচ্ছে বাইসাহেবা তাঁদের কাছে এসেও গান শোনান৷ তাঁদের ইচ্ছেও পূরণ করলেন তিনি৷ মারাঠি, উর্দু, ফার্সি গানেও তিনি স্বতঃস্ফূর্ত— সুযোগ পেলে আসরে সে গানেরও তিনি রানি৷ আর কত্থক নাচের তিনি তো মহারানি৷ জানতেন হিন্দি চটুল গানও— আসর বুঝে গেয়েই দিতেন৷
কিন্তু স্টার থিয়েটারে নাটক দেখতে আসতেন যাঁরা, তাঁদেরকে গান শুনিয়ে, নাচ দেখিয়ে তিনি পেতেন দেদার মজা৷ হল বাঙালি শ্রোতা দর্শকে টইটম্বুর৷ নানা গান গাইতে যখন বিলম্বিত লয়ে গান ধরলেন—
যদি নিমেষের দেখা পাই, পাই হে তোমারি৷
আচলে মুছাই যত বালাই তোমারি৷৷
কত আর স’ব বল তোমারি বিরহানল,
কত দিন ভালবাসা লুকাই তোমারি৷৷
লাজ নয়নে চকিত চাহনি,
সে যে গো বিষম দায়,
যৌবনে বধে বা প্রাণ অবলা আমারি৷৷
যদি দীর্ঘশ্বাস বয় প্রাণ পাখি উড়ে যায়,
জনমে জনমে রব আশায় তোমারি৷৷
এই প্রথম গানেই আসর মাত হয়ে গেল৷ আসলে এই গানটি গহরের নিজেরই বড্ড ভালবাসার ভাললাগার গান৷ পরে এটি তিনি রেকর্ডেও গেয়েছিলেন৷ পরে পরে একে একে গাইতে লেগেছিলেন—
যতনে গেঁথেছিলাম বকুল কুসুমশালা৷
পর’পর’ গলায় পর’, কোরো না শ্যাম অবহেলা৷৷
আমি ব্রজবাসিনী, হীরা মোতি নাহি চিনি,
মরমে মরে আছি, সয় না বিরহ জ্বালা৷৷
আর তার পরেই যেই নিধুবাবুর টপ্পা ধরলেন— শুধু বাঙালি মন কেন, আসরের সব শ্রোতারই চিত্ত যেন রসে টলটল করে উঠল—
যে যাতনা মনে মনে, মনই জানে৷
পাছে শত্রু হাসে, লোক লাজে প্রকাশ করিনে৷৷
প্রথম মিলনাবধি, যেন কত অপরাধী,
নিরবধি সাধি প্রাণপণে৷৷
তব সে ত’নাহি তোষে,
আরো রোষে অকারণে৷৷
সে যাতনা মনে মনে…
কখনও গাইলেন দাদরা তালে— ‘আজ কেন বঁধু অধর কোণেতে’, কখনও বা গাইছেন কীর্তন অঙ্গের সেই সুপ্রসিদ্ধ গান— যমুনে এই কি তুমি সেই যমুনে প্রবাহিনী…’৷ আর ভজন শুরু করা মাত্র সমস্ত সভা যেন কণ্ঠ মিলিয়ে দিলে—
রাধাকৃষ্ণ বোল মুখ সে রাধা কৃষ্ণ বোল্৷
তেরা কেয়া লাগো গো মোল্৷৷
আসলে তাঁকে বাইজি করার স্বপ্ন ছিল, তাই ছোট থেকেই তালিম দিয়েছিলেন তাঁর মা৷ তালিম পেয়েছেন কখনও কাশীর বেচু মিশ্রের কাছে, কখনও-বা কালে খাঁ৷ কলকাতায় নাড়া বেঁধেছিলেন গণপৎ রাওয়ের কাছে৷ গণপৎকে রইস লোকেরা জানতেন ভাইয়া সাহেব নামেই৷ ভালবাসতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত, প্রিয় গান ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না৷’ কিন্তু কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেননি৷ তাঁর কাছে গান শিখেছেন অনাথনাথ বসু, ইন্দুবালার মতো গায়ক-গায়িকারা৷ কলুটোলার নাখোদা মসজিদ আর তারাচাঁদ দত্ত স্ট্রিটের মাঝামাঝি পশ্চিমমুখী বিশাল বারান্দাওয়ালা বাড়ি ‘গউহর বিল্ডিং’ তাঁর একদা অস্তানা৷ তাঁকে দেখে তাঁর গুরু কালে খাঁর মতিভ্রম হয়েছিল, তাঁকে শরীরে পেতে চেয়েছিলেন৷
গহরজান কী করে বাই হয়ে গেলেন তার বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়নি৷ যে কোনও সূত্রে তাঁর কিশোরী বয়সে তিনি হায়দরাবাদের নিজামের কৃপাদৃষ্টিতে পড়েন— তিনিই তাঁকে কলকাতার সমাজে পরিচিত করে দেন৷ তারপরে তাঁর ক্রমবিকাশের ইতিহাস— সেই ইতিহাস তিনি কখনও বড়লাটের ভবনে মজলিশে ডাক পান, কখনও বা দূর লন্ডনে বসান মুজরোর আসর৷ বিখ্যাত বাঙালি শিল্পী অর্ধেন্দুকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি ও.সি. গাঙ্গুলি নামেই বিশেষ খ্যাত, আগে যিনি ছিলেন একজন অ্যাটর্নি, তিনি একটি মামলাসূত্রে গহরজানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন৷
কিন্তু কে এই গহরজান? সেকালের বাবুদের ‘জান’ এলেন কোত্থেকে? সে একটা গল্পের মতোই কহানিয়া৷
সেকালের কলকাতার বিদেশি সমাজে এক সাহেব থাকতেন— কেউ বলেন তিনি আর্মানি, কেউ বা ইহুদি, তবে অনেকেরই দাবি তিনি খাঁটি ইউরোপিয়ান৷ অতশত বুঝি না— আমাদের ভাষায়- সাহেব, নাম তাঁর রবার্ট উইলিয়াম ইওয়ার্ড৷ সঙ্গে আছেন মেম সাহেবও— শ্রীমতী এডেলাইন ভিক্টোরিয়া হেমিংস৷ তাঁর কোলে একটি ফুটফুটে শিশুকন্যা৷ বাবা আদর করে নাম রেখেছেন ইলিন এঞ্জেলিনা ইওয়ার্ড৷
বেশ চলছিল তাঁদের পারিবারিক জীবন৷ হঠাৎ বাড়ির এক কৃষ্ণকায় কর্মচারীর সঙ্গে শ্রীমতীর কী যে লটঘট ঘটে গেল— তাকে নিয়ে স্বামীকে ছেড়ে তিনি উধাও হয়ে গেলেন—‘সঙ্গে নিয়ে গেলেন শিশুকন্যা এঞ্জেলিনাকে৷ রবার্ট অনেক অনুসন্ধানেও তাঁকে পেলেন না৷ পাবেন কেমন করে, ততদিনে তো ভিক্টোরিয়া নামের মহিলার অস্তিত্বও নেই, তিনি বনে গেছেন মালকাজান আর মেয়ে হযেছে গউহরজান— সাধারণত উচ্চারণে গহরজান৷ মালকাজান নাম শুনে মনে হতে পারে তিনি বাইজি বনে গেছেন, আসলে তা নয়৷ ভিক্টোরিয়া কস্মিনকালেও নাচগান করেনি, সে বাই বনবে কেমন করে? তবে ব্যাভিচারিণী তো হয়েছেই৷ কিন্তু তিনি মালকাজান হয়েও কি কখনও ভেবেছিলেন তাঁর গউহর ভবিষ্যতে বাইজি বনে যাবে? তো সেটাই ঘটে গিয়েছিল৷ তবে মালকাজান নামে একাধিক বাইজির অস্তিত্ব তো ছিলই৷ সেজন্য যখন গহরজান বাই হয়ে গেলেন— লোকে ভাবল তাঁর মা-ও বুঝি বাইজি ছিলেন৷
গহরজান কী করে বাই হয়ে গেলেন তার বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়নি৷ যে কোনও সূত্রে তাঁর কিশোরী বয়সে তিনি হায়দরাবাদের নিজামের কৃপাদৃষ্টিতে পড়েন— তিনিই তাঁকে কলকাতার সমাজে পরিচিত করে দেন৷ তারপরে তাঁর ক্রমবিকাশের ইতিহাস— সেই ইতিহাস তিনি কখনও বড়লাটের ভবনে মজলিশে ডাক পান, কখনও বা দূর লন্ডনে বসান মুজরোর আসর৷ বিখ্যাত বাঙালি শিল্পী অর্ধেন্দুকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি ও.সি. গাঙ্গুলি নামেই বিশেষ খ্যাত, আগে যিনি ছিলেন একজন অ্যাটর্নি, তিনি একটি মামলাসূত্রে গহরজানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন৷ তাঁর আত্মজীবনীতে সেকথা লিখেও গেছেন৷ তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি গহরজানের বৈপিতা এবং শৈশবের সামান্য সমাচার৷
সেই গহরজান খ্যাতির চুড়োয় উঠলেন৷ কিন্তু সেই হাজার টাকা মুজরোর বাইজিই একসময়ে চরম দরিদ্র হয়ে পড়লেন এবং অন্য এক মালকাজান— আগ্রাওয়ালি মালকাজানের আশ্রিতায় পরিণত হলেন৷ তারপরের গল্প— সেটা আদৌ মনোহর কহানিয়া নয়— সেই গল্পে দরকার কীসের? মেমসাহেবের মেয়ে গহরজান স্বভাবতই একটা ভিন্নতর সৌন্দর্য নিয়ে জন্মেছিলেন৷ তাঁর সময়ে অনন্তযৌবনা এই নারীর সৌন্দর্যের পাশে দাঁড়াতে পারতেন না কেউ৷ শুধু দেহ-সৌন্দর্য নয়, শিল্প সৌন্দর্য— নাচে এবং গানে, হরেক কিসিমের নাচ আর হরেক বুলির গানের বুলবুলিয়া গহরজান একদিন হারিয়ে গেলেন, এ তো সব বাইজিরই পরিণাম! এঁর আরও কত কথাই এই জগতের আর এক কলাবন্ত দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায় কত কথা লিখেই আমাদের জানিয়ে গেছেন৷
রাজস্থানি বাইজি: হাল হকিকৎ
কেমন আছেন এখন রাজস্থানি ঘরানার বাইজিকুল? রোহিত পরিহার তার খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন৷ এই রাজস্থান থেকেই খানদানি তওয়াইফরা একদা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ এখনও হয়তো এমন এমন কোঠা আছে যার সিঁড়ি ক্রমাগত বাবুদের পায়ের জুতোর ঘসটানিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে আর চলার উপযোগী নেই৷ সিঁড়ির পাশ দিয়ে উঠে যাওয়া জলের পাইপটা ভাগ্যিস আছে, নইলে এখনও ‘মুজরো’র খোঁজে যে বাবুয়ারা কোঠার উপরে উঠতে চান— যেতেই পারতেন না৷
কিন্তু গিয়ে কী দেখতে পান রাইসওয়ালা আদমি! সেই প্রশস্ত ঘরটা আছে বটে, কিন্তু পলেস্তারা খসে পড়ে আর রং চটে গিয়ে দেওয়ালগুলো যেন ভেংচি কাটে৷ দেখতে পান তিনি ধূলিধূসরিত গালচের ওপর যেন একটা আয়ত মসনদ৷ সেখানে হারমোনিয়াম তবলা নিয়ে বাজনাদাররা বসে৷ এবং দু’জন তওয়াইফও যেন মুজরোর প্রতীক্ষায়৷ বড়জন – তনুজা উঠে এসে নাচ শুরু করেন— পরনে সালোয়ার কুর্তা৷ আগন্তুক বেজায় চটে গেলেন৷ কেন কী হলো? রাজস্থান মুজরোর পোশাক নেই কেন? আশেপাশে বসে থাকা নাচনিরা নিজেদের পোশাকের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন—সবাই যে একদম সাহেবি স্কার্ট পরে একেবারে আধুনিক৷ তাই তনুজার উত্তর— ইঁয়া তো সব চলতা হ্যায়৷ ঠিক আছে আপনার যদি তাই মর্জি হয় তো কাল আবার আসুন— আমরা জোগাড়যন্ত্র করে আপনার জন্যে রাজস্থানি মুজরোর পোশাক পরব৷ এমন সব কথাবার্তার মধ্যে একজন মেমসাহেবি বাই এসে গান ধরলেন— দিল তো পাগল হ্যায়, দিল দিওয়ানা হ্যায়৷ দিল দিওয়ানা হয়নি, দিন দিওয়ানা হয়ে গেছে— ওসব দিন বীত গয়া!
জয়পুরের চাঁদপোল বাজারের বাইজি মহলের এই হল হাল হকিকৎ৷ সেই পুরনো সংস্কৃতি কবেই কবরের শান্তিতে আসীন৷ সন্ধে সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত ফিল্মি গান আর চটুল তবলা লহরার সঙ্গে স্বল্পবাসনা নারীর বিভঙ্গ এখন মন মাতায়৷ অনেকখানি কাপড়ের কুঞ্চিত ভাঁজের মধ্যে লুকনো রহস্য এবং সুস্পষ্ট যৌনতায় শিহরণহীন৷ এখন খুঁজে পেতে কিছু আবিষ্কার করতে হয় না—সে এখন প্রকাশ্যে ধরা দেওয়ার জন্য আব্রুহীন— সবটাই বে-আব্রু হয়ে গেছে৷
৬৫ বছর বয়সি বান্নো বেগম দেড় দশক আগেই আক্ষেপ করে বলেছিলেন— দুনিয়াটাই বদলে গেছে তো আমরা তো বদলে যাবই৷ অথচ তাঁর কোঠাতেই ‘প্যারিসে নির্মিত’ ছাপওয়ালা হারমোনিয়ামের সুর প্রাণ পেত রাজস্থানি ঠুংরির ঠমকে-গমকে৷ সেই পুরনো সহবত দিয়ে কেউ আর এখানে খরিদ্দারদের কুর্নিশ জানায় না৷ বান্নো বেগম বলতেন— রাজা মানসিংহ যখন মজলিশে রানি এলিজাবেথকে ডাকতেন তখন তিনি ড্রেস-কোডের ঋত্ বা উৎসবানুসারী পোশাক আশাকের ওপর খুব জোর দিতেন— দেওয়ালিতে কালো, দশেরাতে বেগুনি রঙের জামা চাই৷ ক্যাবারে এসে তার গলা টিপে ধরেছে৷ ‘পাকিজা’ সিনেমাতে রাজকুমার যেমন করে মিনাকুমারীর পায়ে পড়েছিলেন— তেমনই করে আত্মসমর্পণের আবহাওয়া তৈরি করতে হবে৷ সর্বনাশ করেছে ওই টেলিভিশনটাই৷
তাই ওয়ালিবাই তাঁর কোঠার বিবর্ণ দেওয়াল ঘেঁষে লম্বমান সেই পুরনো আমলের আরশিটার দিকে তাকিয়েই হয়তো পুরনো কালের প্রতিচ্ছবি দেখতে চান৷ যে শাবানাকে তিনি কত কষ্ট করে তালিম দিয়ে নাচে-গানে পটিয়সী করে তুলেছিলেন, সেই শাবানা এখন ফিল্মে গান গাইবার জন্যে পাগল হয়ে থাকে৷ এখন এখানের গলিতে গলিতে ‘বিন্দিয়া চমকেগি’ সুরই এঁকে-বেঁকে বয়ে চলেছে৷ এখন আল্লা জিলা বাইয়ের দিনের শেষ, এখন করিশ্মা কাপুর সেই জায়গাটার দখল নিয়ে নিয়েছেন৷ এখন আর কেউ আতর-গোলাপজল ছড়ায় না, কেউ তাম্বুল করঙ্ক নিয়ে মিঠা পানর খিলি মিঠি আঙুলে মিঠি দিঠি দিয়ে ছুঁয়ে বাবুদের দেয় না৷ এখন আর বাবুর দাঁত দিয়ে ধরা নোটের গোছা ওষ্ঠাধর দিয়ে চেপে কেউ মজলিশ-রঞ্জন করে না, ঘুঙরু দিলে স্পন্দন জাগায় না৷
এখন কি রাজস্থানি বাইরা তবে গণিকা হয়ে গেছেন সবাই, নইলে মাঝে মাঝেই পুলিশ এসে চড়াও হয় কেন গণিকাপল্লির মতো! আগে বাইমহলে পুলিশ ঢুকবে ভাবাই যেত না৷ বড় বড় বাবুরা সব আসতেন— পুলিশও তাঁদের সম্ভ্রম-সমীহ করত৷ তাঁদের সাঁইত্রিশটা কোঠা গানে-নাচে মঞ্জুল-রঞ্জুল হয়ে থাকত৷ ধীরে ধীরে তার সংখ্যাও দুয়ের ঘরে নেমে এসেছে৷ সম্মান তো কবেই বিদেয় নিয়েছে৷
হ্যাঁ, তবে একটু কদর আছে তাঁদের, যাঁদের দুবাই গিয়ে মুজরো করার সুযোগ আছে৷ মাসে লাখখানেক রোজগার স্বপ্ন নয়, তাছাড়া থাকা-খাওয়া, বিমানভাড়া— সবই তো মাগনা৷ টাকা আছে বটে, কালচারটা কি আছে? তবে একটা আভিজাত্য তাঁরা বজায় রাখার চেষ্টা করেন বাইরের চাকচিক্যে৷ নইলে অন্তর এখন গায়—
আমি একটা ডাল থেকে খসে পড়া শাখা
তুমি আমায় দরো
আমি তো তোমারই, আমাকে বুকের মাঝখানে রাখো
গতকালটা বেশ ছিল,
আগামীকালটা কি সর্বনাশের?
এটা গান? নাকি সমাধিলিপি?
বাই বাই বাইজি
সেই সব বাইজিদের দিন গত হয়েছে৷ আর জলসাঘরের ঝাড়বাতি জ্বলে না, আর সেখানে মুজরো করার জন্যে গহরজানরা আসেন না৷ কী হলো সব তাঁদের— এই বদলের দুনিয়ায় সবই কি তবে বদলে গেল৷ সেই লখনউ, সেই বেনারস, সেই রাজস্থানি ঘরানার বাইজিরা কি তবে একেবারেই বিলুপ্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলেন? এই নিয়ে কত মানুষই ভাবনা-চিন্তা করছেন৷ আমি আনন্দবাজারে পড়েছি আলপনা ঘোষের প্রতিবেদন, পড়েছি যুগান্তরে মানসী মুখার্জির অনুসন্ধান অথবা প্রতিদিনের রবিশঙ্কর বলের সরেজমিন তদন্ত৷ সর্বত্র একটা ক্ষয়ের, একটা ভয়ের, একটা পরাজয়ের হাহাকার৷ কলকাতার ছবিটা দু’দশক আগে যা ছিল তার কথা বললেই এখনকার হালফিল অবস্থাটা অনুমান করতে বাধা থাকবে না৷
রুকশানা বাইয়ের ‘নথ ভেঙেছিলেন’ জনৈক ব্যবসায়ীবাবু খগেন মিত্তির মশাই৷ সেই সুবাদে তিনি তাঁর বাঁধাবাবু৷ এই রুকশানাই একদিন সিরাজি ভরে বিদেশি মদ দিয়ে তাঁর বাবুকে খুশি করতেন যখন তিনি শনি-রবিবার তাঁর আপন পরিবার ছেড়ে রুকশানার কাছ রাত কাটাতে আসতেন৷ কী চমৎকার দ্বিধাবিভক্ত জীবন৷ সপ্তাহের পাঁচদিন তিনি একেবারে ভদ্দরলোক— বউকে সোহাগ করতেন কিনা জানি না, রাতে তাঁর পাশে শয্যাভাগ করতেন কিনা জানি না তাও— কিন্তু এই ভদ্দরমানুষটাই শনিবার-রবিবারে একেবারে অন্য মানুষ৷ রুকশানা তাঁকে সেই আসবের বদলের বছর বিশেক আগেও ঠোঁটে তুলে দিতেন ব্লাডি মেরি— হাফ পেগ ভদকা৷ এক কাপ টম্যাটো জুস৷ একফালি কাঁচালঙ্কা৷ আর এক চিমটে নুন মিশিয়ে তাতে তিন ফোঁটা টোবাস্কো সস ঢেলে তৈরি হতো এই ব্লাডি মেরি৷ গেলাসে চুমুক দিতে দিতে খগেনবাবু বাহবা দিয়ে বলে উঠতেন—‘সাবাশ! এই নাহলে আর একালের বাইজি৷’ এই হল মডার্ন বাবুদের চাহিদা৷ কিন্তু রুকশানা নিজের গেলাসে ঢেলে নিতেন সেই দিশি মদ— পুরনো জীবনটাকেই আঁকড়ে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টায়৷ এই লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়৷
কৌতূহলীরা কলকাতা কর্পোরেশনের অ্যাসেসমেন্ট বিভাগে যদি একবার খোঁজখবর নিতে যান, জানতে পারবেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর প্রায় সত্তর এবং বউবাজারের খান তিরিশেক ঘরের বাসিন্দারা একদা বাইজি ছিলেন৷ ঠিকানা চাইছেন এঁদের নিজেদের হাল-হকিকৎ জানার জন্য? জানিয়ে দিই৷ হয়তো একটু আধটু বদল হয়েছে৷ বউবাজারের বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির স্ট্রিটের ৯০, ৯১, ৯২ এবং ১০৩, ১০৭ নম্বর বাড়ি; আর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-এর দুটো বাড়ি ৫২ আর ৫৭-ডি৷ আরও কৌতূহল? তবে চলে যান মধ্য কলকাতার বেগ সাহেবের মঞ্জিলে একটু খুঁজে পেতে অথবা রামকেলির বাড়িতে৷ খগেনবাবুদের আর পাবেন না— কিন্তু হয়তো কোনও নগেনবাবুদের সাক্ষাৎ পেয়ে যাবেন৷ সেখানের বাইজিরা আর মুজরো করেন কিনা জানি না— কিন্তু গণিকাদের সঙ্গে তাঁদের ফারাক আছে কি না তামা-তুলসি-গঙ্গাজল হাতে বলতে পারব না৷ কৌতূহলীরা আরও পড়বেন সোমনাথ চক্রবর্তীর সব খুঁজে পাওয়ার বই ‘বাইজি বিলাস’ও— তাতে এঁদের আরও বিচিত্র হদিশ পেয়ে যাবেন৷ সেখানে স্পষ্ট বুঝতে পারবেন কিন্তু বাইজিপাড়া আর গণিকাপল্লি কিন্তু এক নয়, কোথায় যেন একটা আভিজাত্যরে ফারাক রয়ে গেছে৷ তবে ঘরে ঢুকলেই দেখতে পাবেন প্রত্যেকের ঘরের দেওয়ালে তাঁদের ব্যবসায়িক ছাড়পত্র টাঙানো— লাইসেন্স৷
বাইজিদের ঘরে যখন ঠুংরি-গজল-দাদরার বদলে খরিদ্দারের মনোরঞ্জনের জন্য শস্তা পপ গানের রেকর্ড বাজাতে হয়, একজন খানদান-খানা বাইজির বুকে যে তাতে কত বেদনা সঞ্চারিত হয় একজন গণিকাসেবী খরিদ্দার সে কথা কী করে জানবেন! বাইজিরা যে গণিকা হতে চান না৷ বেশ্যাকে নথ ভাঙার প্রথা গণিকাদের মধ্যে নেই৷ বেশ্যারা তাঁদের খরিদ্দারদের সর্বদা রঞ্জিত করতে পারেন৷ কিন্তু বউবাজার-চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের বাইজিদের রাত এগারোটার পর একাজ আইনগতভাবে নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি এটি লঙ্ঘন করেন তার রোজগারে হাত পড়বে৷
এই যে বউবাজার বা চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ঘরবাড়ি— এর বাসিন্দাদের চরিত্রে যে একটা ফারাক আছে, তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই— ওয়াকিবহাল মানুষই জানেন এরা যথাক্রমে বেনারস আর লখনউ ঘরানার বাইজি৷ বউবাজারে ৩৫ আর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে ৭৫টি ঘর জুড়ে এদের বসবাস৷ কিছুদিন আগেও খগেনবাবুদের মতো ‘বাঁধা বাবু’দের বাইরে খুচরো-মুজরোর খদ্দেরদের দিতে হতো ঘণ্টা পিছু তিনশো টাকা৷ সবটাই বাইজিদের পাওনা হতো না— এর অর্ধেকটা দিতে হতো সঙ্গতকারদের৷ বাকি যা থাকে তার মোটা অংশই চলে যায় কর্পোরেশনের ট্যাক্স, ফুলদার আর খানাপিনার আয়োজন, মাস্তান আর তোলাবাজদের পকেটে এবং অবশ্যই পুলিশেরও৷
এই নিয়ে এক সময় ইউনিয়ন গড়ে ওঠে এইসব অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য৷ এই ইউনিয়নের দীর্ঘকাল সম্পাদক ছিলেন রামবাবু শ্রীবাস্তব৷ তিনিই বাইমহল্লার দেখভাল করতেন৷ পরে তাঁর জায়গায় আসেন সঙ্গীতা বাই এবং রেখা বাই৷ ‘এই ইউনিয়নই ঠিক করে দেয় মুজরোর রেট, সামাল দেয় মাস্তানের পয়দা, পুলিশের ঝামেলা, খদ্দেরদের বেয়াদপি৷’ সবই ভাবছি, কিন্তু এই বিশ বছরের মধ্যেও তো বদল হতে পারে, পেরেছেও৷ এখন কি আগের মতো খদ্দেররা ভিড় করে, ঠুংরির সঙ্গতকারেরা কি আগের মতোই সঙ্গত করতে আসেন?
এহি ঠাঁইযা মোতিয়া হিরায়ে পইলে রাম
না কোই আইল, না কোই যাইল
তোর বাধাহ, ঘরমে বাহার না যাইল
এখানেই হারিয়ে গেছে আমার হিরে, আমার মোতিগুলো৷ কেউ তো এখান দিয়ে আসা যাওয়া করেনি, কেউ ঘরের বাইরেও যায়নি, এমনকী কোনও চোরও আসেনি৷ সঙ্গীতাবাই তুমি এতখানিই নিঃস্ব, এতখানিই রিক্ত— সর্বহারা, সর্বস্বহারা৷ ১০৭ নম্বর বাড়িতেই তো একদিন তাঁর নথ ভাঙা হয়েছিল৷ এখানেই তাঁর বাঁধা বাবু তাঁকে আদর করে হিরে-মোতির গয়না দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন৷ মুজরোর টাকা জমিয়ে জমিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছেন তিনি৷ আর জীবনের এই পরিণাম! আর তো নথ ফিরিয়ে তিনি ভদ্রজীবনে ফিরে যেতে পারবেন না৷ তাঁর গলার গান এমনি করে মূক হয়ে যাবে, যে পায়ের ছন্দে কত কত বাবু বাঁধা পড়ে যেত— তাও কি এমন ছন্দহীন হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য?
একসময় এই বাইজিদের গান-নাচ এমনই অভিজাত মর্যাদায় উঠেছিল যে রেডিওতে বেহাগ রাগিণীতে মুশতরি বাই-এর গান শুনে রাইচাঁদ বড়ালকে ফোন করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কবে এই কিন্নরীকে দেখতে পাব?’ যে বাইনাচকে দুর্গাপুজোর অঙ্গ বলে একে মর্যাদা দিয়েছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়৷ ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে রাজা নবকৃষ্ণের মেহফিলেও পুজোর সময় বাইনাচের আসর বসত৷ সেই বাইজিদের ঘরে যখন ঠুংরি-গজল-দাদরার বদলে খরিদ্দারের মনোরঞ্জনের জন্য শস্তা পপ গানের রেকর্ড বাজাতে হয়, একজন খানদান-খানা বাইজির বুকে যে তাতে কত বেদনা সঞ্চারিত হয় একজন গণিকাসেবী খরিদ্দার সে কথা কী করে জানবেন! বাইজিরা যে গণিকা হতে চান না৷ বেশ্যাকে নথ ভাঙার প্রথা গণিকাদের মধ্যে নেই৷ বেশ্যারা তাঁদের খরিদ্দারদের সর্বদা রঞ্জিত করতে পারেন৷ কিন্তু বউবাজার-চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের বাইজিদের রাত এগারোটার পর একাজ আইনগতভাবে নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি এটি লঙ্ঘন করেন তার রোজগারে হাত পড়বে৷ পুরো এক সপ্তাহের জন্য তাঁর মুজরো নিষিদ্ধ৷ তখনকার বেদনা অনুপার্জনের তো বটেই, মনের মধ্যেও একটা উদাস ভাব৷ যৌবনের, কামনার একটা বেদনা কুরে কুরে খায়— সো পিয়া ন আ্ওল৷ ঘর করার ইচ্ছেও কি তাঁদের হয় না, না একটা যান্ত্রিকতাকেই তাঁরা মেনে নেন, মেনে নিতে বাধ্য হন? অবাধ্য মন কি শাসন মানেই? বাহবা, পেলা, সাবাস, একটু ছোঁয়া, সিরাজির পাশে শরীরটা কি একেবারেই কিছু চেয়ে বসে না৷ একটা সন্তান? তা-ও যে হয় না— তা নয়৷
সেই সন্তানের ভবিষ্যৎ তাঁরা এখন ভাবেন নতুন করে৷ একটা মেয়ে হলে সে-ও কি তওয়াইফ হয়ে যাবেই! তাঁরা কি লেখাপড়া শিখে ‘ভদ্দরলোক’ হয়ে উঠে মূলস্রোতে ফিরে আসতে পারবেন না? আবার পেশাতেই বা সুখ কই? যাঁরা আসেন তাঁরা তো তাঁদের তালিম পাওয়া গান শুনতে চান না, ঠুংরি তাঁদের মনে গুঞ্জন জাগায় না৷ নাচ দেখতে দেখতে তাঁরা ছন্দ বোঝেন না, খোঁজেন শরীরের ভাঁজ আর বক্ররেখার উচ্চাবচ৷ আর শেষ পর্যন্ত প্রার্থনা শরীরটাই৷ তাহলে বাইজির সম্মান আর ইজ্জত রইল কোথায়? সাধারণ বারবণিতার সঙ্গে তাঁদের ফারাকের সীমারেখাটি কি বার বার এমনি করেই ধর্ষিত হবে? আবার বলি ‘অন্নচিন্তা চমৎকারা’৷
তাই তাঁরা চান তাঁদের কন্যারা যেন এ পেশায় না আসেন৷ মানসী দেবী জানিয়েছেন রম্ভা বাইয়ের ছোট মেয়ের বিয়ে হয়েছিল একদা মধ্য কলকাতার এক ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সঙ্গে৷ সেই মেয়ে ‘বহাল তবিয়তে ঘর-সংসার’ করেছেন৷ এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের তুলসীবাই ও রোশনজানের ছেলেরা ‘বেসরকারি ফার্মের উঁচু পদে’ চাকরিতে আসীন৷ এবং তাঁরা ঘর-সংসার পেতে তাঁদের মা-দের নিয়ে গেছেন নিজের সংসারে— নাতিপুতি নিয়ে তাঁরা খুশি! তাঁরা খুশি, কিন্তু বাইজি সমাজ কী বলবে? একটা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কি অবলুপ্ত হয়ে যাবে? না কি এর অবলুপ্তিই প্রার্থিত! এঁদের সমাজে আবির্ভাব যে কারণে সেটা কি সত্যিই আর দরকারি নয়? সমাজতত্ত্ববিদেরা কী বলেন? এখন বিয়ে-শাদির আসরে ক’জন বাইনাচের আসর বসান? আঙুলে গোনা যায়৷ কৌলীন্যের ডাক শোনবার দিন সম্ভবত অবসানের পথে৷
অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি কলকাতায় এসেছিলেন দেড়শো বছরেরও আগে৷ তিনিই সসম্ভ্রমে বাইজিদের নিয়ে এসেছেন মেটিয়াবুরুজে৷ তখন থেকেই ‘রহিসওয়ালি’ বাইদের রমরমা কলকাতায়৷ আসরে আতরের বাষ্প আর গোলাপজলের সুগন্ধ মাতাল করত কত জলসাঘরকে৷ কত কত বিশ্বম্ভর রায় আসর বসিয়ে অম্বুরি তামাকে শিষ্টাচার জানাতেন মোসাহেবদের৷ তাকিয়া বিছানায়, তাওয়াইফদের ঘুঙুরের বাজনা কলকাতায় তখন নয়া রাসের বাইমুজরো৷ তাঁরা কি ভেবেছিলেন কখনও তাঁদের বংশের গায়ত্রী বাইরা পেশা ছেড়ে দিয়ে সংসারী হবেন অথবা রুকশানারা ভাববেন ‘বোনটা যদি বি.এ, এম.এ পাশ করে ভাল চাকরি পায় তাহলে গোটা পরিবারটাই বেঁচে যাবে৷’ এমনটা তো ভাবতেই হবে, কারণ যে বাইজির হাত থেকে পানের খিলি নিতে গিয়ে হাতের ছোঁয়ায় বাবুরা বিবশ হতেন, সেই পান খাওয়ার বিলাসিতার কথা এখনকার বাইরা ভাবতেই পারেন না৷ ওয়াজেদ আলি কি ভেবেছিলেন কখনও ঠুংরি গানের বদলে বাইজি বাড়িতে বাজবে ‘বেরিলি কি বাজার মে ঝুমকা গিরা রে’ অথবা ইলা অরুণের ‘চড়া গয়া উপর রে, অটরিয়া পে লোটন কবুতর রে’ সব বিপর্যস্ত, এলোমেলো, ছন্নছাড়া৷ সেই জীবনটাও ছিল ভিতরে ভিতরে ছন্নছাড়া এখন বাইরেটাও তাই৷
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা ১৪২১
লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হল