আলোছায়া

ছেলেবেলার বন্ধু তরুণের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে অমলেশ বলল, ‘আমার ধারণা ছিল আমি একবার দেখলেই লোক চিনতে পারি৷ বেশ কয়েকবার পেরেছিও সত্যি, কিন্তু এবার ডাহা ফেল৷ সন্ধেবেলায় যাকে দেখে মনে হয়েছিল এক নম্বরের বাউন্ডুলে, রাত দশটার সময় জানতে পারলাম সেই হচ্ছে টি পি মেনন৷’

ঢোঁক গিলে প্রশ্ন করল তরুণ, ‘টি পি মেনন কে?’

একটু কেশে গলা পরিষ্কার করল অমলেশ৷ ‘সত্যি কথা বলতে কী, গুণী মানুষদের ক’জনকেই বা আমরা চিনি? খুব বিখ্যাতদের নাম জানি, কিন্তু তার বাইরেও তো অনেক গুণী আছেন৷ টি পি মেনন যে তাঁদেরই একজন— ছবিগুলো না দেখলে জানতেই পারতাম না৷’

‘ছবি?কী ছবি?’

‘ফোটোগ্রাফ৷ মেননের কাছে একটা অ্যালবাম ছিল৷ সেটার পাতা উল্টে আমি তো থ৷ কার সঙ্গে না ওঁর ছবি আছে!প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার, এডুকেশন মিনিস্টার, ফিনান্স মিনিস্টার— কেউ বাদ নেই৷ জাস্ট একটা গ্রুপ ছবি‍— তা নয় কিন্তু৷ ছবি দেখলেই বোঝা যায়৷ ছবির এইসব বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে মেননের সম্পর্ক বেশ কাছের৷ কোথাও নমস্কার বিনিময়, কোথাও বা হ্যান্ডসেক৷ পাশাপাশি বসে থাকার ছবিও আছে বেশ কয়েকটা৷’

অমলেশের সম্ভ্রম দেখানোর ভঙ্গি তরুণকেও বোধ হয় খানিকটা প্রভাবিত করে ফেলেছিল৷ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী করেন ভদ্রলোক?’

‘বিরাট দার্শনিক৷ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন অনেক বছর৷ ওঁর একবার ভাইস-চ্যান্সেলর হওয়ার কথাও হয়েছিল৷ কিন্তু চাকরিই ছেড়ে দিলেন৷’

‘কেন?’

‘বই লেখার কাজে পুরো সময়টা দেবেন বলে৷ তবে পড়ানোর কাজটা একেবারে ছেড়ে দিতে পারেননি৷ ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে প্রায়ই বিদেশে যেতে হয় ওঁকে‍৷’

‘ভদ্রলোকের সঙ্গে তোর কোথায় পরিচয় হল?’

‘আমাদের বাড়িতে ছিলেন তিন দিন৷ গত সপ্তাহে তুই এলে তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতাম৷’

তরুণের ঠোঁটে‍ মৃদু হাসি ফুটে উঠেছিল৷ ‘তুই নিজে একজন সাকসেসফুল বিজনেসম্যান৷ তোর বাড়িতে তো মাঝেমধ্যে অন্য রাজ্যের ব্যবসায়ীরা অতিথি হিসেবে থেকে যান দু-একটা দিন৷ এবার বিজনেসম্যানের বদলে পণ্ডিত!’

‘আমার নয়, আসলে উনি ছিলেন ছোটবাবুর গেস্ট৷ ব্যবসার কাজে প্রায়ই তো বাইরে যেতে হয় ছোটবাবুকে৷ যাতায়াতের পথে ট্রেনে বা প্লেনে যাদের সঙ্গে আলাপ হয়, তাদের কাউকে কাউকে মাঝে মাঝে বাড়ি পর্যন্ত টেনে আনে৷ এ বাড়িতে মেননের আসা ওই হিসেবেই৷ উনি এখানে তিনদিন ছিলেন৷’

ছোটবাবু ওর ছোটভাই ত্রিদিবেশ৷ ওদের পারিবারিক ব্যবসার সুবাদে বাড়ির মধ্যে ছোটবাবু, মেজবাবু আর বড়বাবু ডাকের চল আছে খুব৷ তিন ভাইয়ের সম্পর্ক একেবারে বন্ধুর মতো৷ তবে তার মধ্যেই বড় ভাই একটু বেশি মাত্রায় কর্তব্যপরায়ণ৷ ছোটভাই একটু বেশি পরিমাণে ছেলেমানুষ৷

ছেলেমানুষ ছোটবাবুর কথা বলতে গিয়ে বড়বাবু অমলেশের মুখে একটু স্নেহের ছাপ ধরেছিল৷ সেই ছাপ গাঢ় হতেই বলল, ‘সেদিন সন্ধেবেলা আমি বাড়ি ফিরতেই ছোটবাবু বেশ ঘটা করে আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মেননের৷ কিন্তু প্রথম পরিচয়ে মানুষটিকে আমার একেবারেই সুবিধের ঠেকেনি৷ রোগা, লম্বা, মাথায় টেরিকাটা সাদা চুল৷ যেমন চেহারা, পোশাকআশাকও তেমন৷ দু-চারটে হুঁ-হ্যাঁ করেই কেটে পড়েছিলাম ওখান থেকে৷ পরে ছবি দেখে বুঝতে পারি উনি একজন বিখ্যাত মানুষ৷’

‘কীরকম?’

‘ওঁর সঙ্গে একটা ছবির অ্যালবাম ছিল৷ সেটা দেখার আগে ওঁর সম্পর্কে কোনও আগ্রহই তৈরি হয়নি আমার৷ হওয়ার কথাও নয়৷ বরং একটু রিপালসিভ বলেই মনে হয়েছিল৷ কিন্তু অ্যালবামের ছবিগুলো দেখেই চমকে উঠেছিলাম৷ আমাদের চরিত্র কেমন অদ্ভুত দেখ৷ একটু আগে যাকে দেখে মনে হয়েছিল— কোথাও কলকে পায় না৷ একটু পরে তাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম—সত্যিকারের একজন গুণী মানুষ কত বিনয়ী হয়৷ ছবির বিখ্যাত সব মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা নিয়ে আমাদের প্রশ্নের আর শেষ ছিল না৷ কিন্তু যত প্রশ্ন করা হচ্ছিল উনি তত লজ্জা পাচ্ছিলেন৷ শেষে ছবির অ্যালবামটা আমাদের হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিয়ে বললেন—‘না, এ নিয়ে আর একটাও প্রশ্ন নয়৷’ অসম্ভব গুণী মানুষ মেনন৷ দেশের মাথারা ওঁকে‍ মাথায় করে রাখে৷ ইচ্ছে করলেই উনি অনেককিছু গুছিয়ে নিতে পারতেন৷’

একটা সিগারেট ধরাল অমলেশ৷ নীলচে ধোঁয়া ওর মুখের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে৷ একটু বাদে নিজের মনে কথা বলার ভঙ্গিতে বলল, ‘তিনটে দিন ওই দার্শনিকের সঙ্গে খুব সুন্দরভাবে কেটে গেছে আমাদের৷ সত্যি, স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রতি মুহূর্তে আমরা কী না করি! কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দুনিয়া থেকে কেউ কিছুই তো নিয়ে যেতে পারব না৷ শুধু তাই নয়, আমরা যে চিরকালের জন্য থাকব না—এই কথাটাই আমরা ভুলে থাকি সব সময়৷

‘অবশ্যই পারতেন৷ দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাঁর ওইরকম সম্পর্ক৷ তবে নিজের লাভ-লোকসানের ব্যাপারে ভদ্রলোক বোধ হয় কিছুটা উদাসীন৷’

‘উদাসীন বললে কম বলা হয়৷ অনেকগুলো বড় বড় সরকারি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন৷ কয়েকটা কমিটির চেয়ারম্যান, অ্যাডভাইসার করতে চাওয়া হয়েছিল ওঁকে‍৷ সরকারের প্রস্তাব খুব পরিষ্কার ছিল৷ বলেছিল—আপনার লেখাপড়ার ক্ষতি করে কিছু করতে হবে না৷ মাঝে মাঝে দু-একটা মিটিংয়ে আসবেন৷ অল্প কিছুক্ষণ থেকে চলে যাবেন৷ যা করার কমিটির অন্যান্য মেম্বাররাই করবে৷ টেলিফোনে মাঝে মাঝে আপনি এদের একট পরামর্শ দিয়ে দেবেন৷ বিনিময়ে মোটা টাকার সম্মান-দক্ষিণা৷ এককথায় উনি ওইসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেছেন— কাজ না করে টাকা নিতে পারব না আমি৷ আর, আমি আমার বই লেখার কাজে এত ব্যস্ত যে, আপনাদের কাজে সময় দেওয়া আমার প‍ক্ষে একেবারেই অসম্ভব৷ সরকার কিছু মানুষকে কিছু পাইয়ে দেয়, না? ওই প্রস্তাবগুলো ছিল ওইরকম৷ কিন্তু অত্যন্ত সৎ প্রকৃতির মানুষটি কোনওরকম কম্প্রোমাইজের মধ্যে যেতে চাননি বলে লোভনীয় সব প্রস্তাব এককথায় নাকচ করে দিয়েছেন৷’

এইসব কথা শুনতে শুনতে অচেনা ওই মানুষটি সম্পর্কে বেশ একটা শ্রদ্ধার ভাব তৈরি হয়ে গিয়েছিল তরুণের মধ্যে৷ অমলেশ থামতেই প্রশ্ন করল, ‘নিজের সব খরচখরচা চালিয়ে নেওয়ার মতো ব্যালান্স আছে নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের?’

‘আমিও তাই ভেবেছিলাম প্রথমে৷ ভেবেছিলাম হয়তো বড়লোকের খেয়ালি ছেলে৷ শখ, খেয়াল মেটানোর মতো ব্যাঙ্ক ব্যালান্স আছে নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের৷ কিন্তু কথায় কথায় জানতে পেরেছিলাম, যা ভেবেছি আসল ছবিটা ঠিক তার উল্টো৷ কপর্দপশূন্য মানুষ বলতে যা বোঝায় টি পি মেনন ঠিক তাই৷ কী খাবেন, কোথায় থাকবেন— সেটাই ঠিক থাকে না অনেক সময়৷’

‘সে কী!’ তরুণ বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল৷

একটা সিগারেট ধরাল অমলেশ৷ নীলচে ধোঁয়া ওর মুখের ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে৷ একটু বাদে নিজের মনে কথা বলার ভঙ্গিতে বলল, ‘তিনটে দিন ওই দার্শনিকের সঙ্গে খুব সুন্দরভাবে কেটে গেছে আমাদের৷ সত্যি, স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রতি মুহূর্তে আমরা কী না করি! কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দুনিয়া থেকে কেউ কিছুই তো নিয়ে যেতে পারব না৷ শুধু তাই নয়, আমরা যে চিরকালের জন্য থাকব না—এই কথাটাই আমরা ভুলে থাকি সব সময়৷ মহাভারতের বনপর্বে আছে‍— যুধিষ্ঠির বলেছেন, জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের ঘটনা হল, প্রতি মুহূর্তে প্রাণিগণকে মারা যেতে দেখেও আমরা ভেবে থাকি আমরা কখনও মরব না৷ মহাভারত পড়েছিস?’

কিছু ভারী ভারী তত্ত্বকথা একদমে শোনার পর অমলেশ বলল, ‘দিল্লি ফিরে গেছে মেনন৷ আমি তিন সপ্তাহ বাদে দিল্লি যাচ্ছি শুনে আমার হাত চেপে ধরে বলল, মেক ইট আ পয়েন্ট— তুমি দিল্লিতে এসে অবশ্যই আমার গরিবখানায় একবার পায়ের ধুলো দেবে৷’

‘ভালো তো, দর্শনের আরও কিছু ভাল ভাল কথা শেখার সুযোগ পাবি৷’

‘হ্যাঁ, সেটা একটা আকর্ষণ নিঃসন্দেহে৷ তবে এবার দিল্লিতে আমার অসম্ভব টাইট শিডিউল৷ দু-একটা দিন যে বাড়তি থেকে যাব, তারও উপায় নেই৷ কলকাতা ফিরেই আবার চেম্বার অব কমার্সে‍র মিটিং৷’

আবার মেননের ওই সবে ফিরে এসেছিল অমলেশ৷ মেনন মানেই বুঝি দর্শন৷ হঠাৎই কথা থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বল তো আমাদের দুঃখের কারণ কী?’

‘আমাকে জিজ্ঞেস করছিস?’

একটু বুঝি বিরক্তই হলো ও৷ ‘তুই ছাড়া আর কে আছে এখানে?’

গতিক সুবিধের নয় দেখে প্রথমেই হাত তুলে দিয়েছিল তরুণ৷ ‘খুব কঠিন প্রশ্ন, উত্তর জানা নেই আমার৷’

অমলেশের চোখেমুখে আগের সেই প্রশান্তি ফিরে এসেছিল আবার৷ ‘ভয় আর অপূর্ণ বাসনাই আমাদের যাবতীয় দুঃখের কারণ৷ এই দুটোকে তাড়াতে পারলে মানুষের আর দুঃখই থাকবে না৷’

সকালের প্রথম দিকটা দর্শন চালালেও পরের দিকে নির্ভেজাল আড্ডায় ঢুকে গিয়েছিল অমলেশ৷ বেলা একটার সময় তরুণ বিদায় নেওয়ার সময় ও একটু আফশোসের গলায় বলেছিল, ‘তুই তো আজকাল আর দেখাই দিস না৷ কবে আসবি আবার? ফের মাসখানেক বাদে?’

হেসে উঠে‍ছিল তরুণ৷ ‘ঠিক বলেছিস, এই মাসটা উটকো কিছু কাজকর্মে ফেঁসে‍ থাকব৷ তুই দিল্লি থেকে ফেরার পরেই হাজির হয়ে যাব৷ মেননের গল্প শোনা যাবে তখন৷’

একটু আগের সেই কালো ছায়াটা আর একটু গাঢ় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অমলেশের মুখে৷ ‘ওই লোকটার সঙ্গে আমাদের এই মেননের চেহারার খুব মিল৷ ওইরকম রোগা, লম্বা, মাথায় টেরিকাটা সাদা চুল৷ কয়েক সেকেন্ডের ছবি৷ অত অল্প সময়ের মধ্যে লোকটা এই মেনন কি না বোঝা মুশকিল৷ তবে হ্যাঁ, দুজনের চেহারার মধ্যে বেশ মিল আছে৷ অবশ্য এরকম চেহারার লোকজন তো থাকে কিছু কিছু৷’

এক মাস পরেই এক রোববারের সকালে বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছে‍ গিয়েছিল তরুণ৷ রোববারের সকালটা বেশ আড্ডা মারার মেজাজে থাকে অমলেশ৷ চড়া গলায় অভ্যর্থনা জানিয়ে বসার ঘরে বসিয়ে দিল বন্ধুকে৷

দু-চারটে কথার পর তরুণ জিজ্ঞেস করল, ‘দিল্লি থেকে ফিরলি কবে?’

‘পরশু’৷

‘কাজকম’ কেমন হলো?’

‘খুব ভালো৷ একটা নতুন বিজনেস ডিলেরও প্রস্তাব পেয়েছি৷ ম্যাচিওর করলে দারুণ হবে৷’

কফি আর তিন-চার রকমের বিস্কুট এসে গিয়েছিল৷ কফির কাপে চুমুক দেওয়ার পরে তরুণ বলল, ‘তোর সেই বিখ্যাত দার্শনিক মেননের কথা বল৷ গিয়েছিল ওর বাড়িতে?’

প্রশ্নটা শুনে অমলেশের ঝলমলে মুখের ওপরে একখণ্ড কালো ছায়া পড়েছিল৷ শুকনো গলায় বলল, ‘গিয়েছিলাম৷ দেখা হয়নি৷’

‘সে কী! বিদেশ-টিদেশ চলে গেছেন আবার?’

‘না, মানে‍–‘

‘কী?’

‘মেনন যে ঠিকানা দিয়েছিল, বাড়ির কেয়ারটেকার বলল— ওই নামে ওই বাড়িতে কেউ থাকে না৷’

‘সে কী রে! ভুল ঠিকানা টুকেছিলি তাহলে?’

‘ঠিকানাটা আমি লিখিনি, মেননেরই লিখে দেওয়া৷’

‘কেয়ারটেকার বুঝতে ভুল করেনি তো?’

‘না না, নাম-ঠিকানা লেখা কাগজটাই তো ওর হাতে আমি তুলে দিয়েছিলাম৷ তাছাড়া অন্যভাবে খোঁজ নিয়েও জেনেছি‍— ওই নামে ওই বাড়িতে কস্মিনকালেও কেউ ছিল না৷’

মস্ত বড় একটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল তরুণ, ‘মানে?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ হয়ে থাকার পরে অমলেশ বলল, ‘সেই রাত্তিরে দিল্লি টিভির লোকাল চ্যানেলে একটা অদ্বুত খবর দেখেছিলাম৷’

‘কী?’

‘দিল্লির একটা ফ্রড ধরা পড়েছে৷ বাড়তি সুবিধে পাইয়ে দেবে বলে জনাতিনেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়েছিল প্রতারকটা৷ সুব্রহ্মমণিয়ম না কী যেন নাম!আসলে লোকটা নিজেকে খুব ওয়েল-কানেকটেড লোক বলে পরিচয় দিয়েছিল৷ মন্ত্রীদের সঙ্গে তোলা বেশ কয়েকটা ছবি দেখিয়েছিল ওই ব্যবসায়ীদের৷ পরে জানা যায়, ছবিগুলো সুপারইম্পোজ করা৷ লোকটা কথাবার্তায় খুব তুখোড়৷ বড় ব্যবসা পাইয়ে দেবে বলে অনেকগুলো টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে৷ পরে ধরা পড়ে যায়৷ নিউজ ক্লিপিংযে লোকটার একটা ছবিও দেখানো হয়েছিল৷ পুলিশের পাহারায় কোর্টে তোলা হচ্ছে লোকটাকে—

একটা ঢোক গিলে থেমে গিয়েছিল অমলেশ৷

‘লোকটাকে কী?’

একটু আগের সেই কালো ছায়াটা আর একটু গাঢ় হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল অমলেশের মুখে৷ ‘ওই লোকটার সঙ্গে আমাদের এই মেননের চেহারার খুব মিল৷ ওইরকম রোগা, লম্বা, মাথায় টেরিকাটা সাদা চুল৷ কয়েক সেকেন্ডের ছবি৷ অত অল্প সময়ের মধ্যে লোকটা এই মেনন কি না বোঝা মুশকিল৷ তবে হ্যাঁ, দুজনের চেহারার মধ্যে বেশ মিল আছে৷ অবশ্য এরকম চেহারার লোকজন তো থাকে কিছু কিছু৷’

চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছিল তরুণের৷ মহাত্মা এক দার্শনিকের এইরকম একটা ছবি ও ওর কল্পনার ধারেকাছেও আনতে পারেনি৷ একটু ইতস্তত করে বলল, ‘একরকম চেহারার দু’জন লোক কিন্তু দেখা যায় মাঝেমধ্যে৷ এই মেনন লোকটা যদি সত্যিই চিট হতো, তোদের বাড়ি থেকে কিছু হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়তে পারত৷ ও চলে যাওয়ার পরে বাড়ি থেকে কিছু খোয়া গিয়েছে কি?’

‘না, আসলে এটা মিসপ্লেসড্ও হতে পারে‍—

‘কী? জিনিসটা কী?’

‘গোল্ডপ্লেটেড ছোট একটা ঘড়ি৷ সুইজারল্যান্ডের পুরনো আমলের একটা প্রোডাক্ট৷ ঘরের শো-কেসে ওটা একটা শো-পিস হিসেবে থাকত৷ মেনন আমাদের বাড়ি‍ থেকে চলে যাওয়ার কিছুদিন পরে চোখে পড়ে‍— ওটা আর ওখানে নেই৷ তবে অন্য কেউ হয়তো—৷ আমি কাউকে সন্দেহ করছি না, তবে বাড়িতে জনাদুয়েক নতুন কাজের লোক এসেছে৷’

‘তোদের কারও কাছ থেকে কোনও টাকাপয়সা—৷’

‘না না, আমার কাছে কিছু চায়নি৷ তবে ছোটবাবু বলছিল—

‘কী?’

‘মেনন যাওয়ার দিন ওর কাছ থেকে কুড়ি হাজার টাকা ধার নিয়েছিল৷ বিলিতি বইপত্তরের কী একটা কনসাইনমেন্ট ছাড়াতে হবে বলে৷ বলেছিল, দিল্লিতে গিয়েই টাকাটা পাঠিয়ে দেবে৷’

‘দেয়নি?’

‘না, দু-তিন দিন আগে পর্যন্ত ছোটবাবু পায়নি৷’

কফি শেষ হওয়ার পর অমলেশ বলল, ‘মেনন দর্শন নিয়ে যে সব কথা বলেছে, কথাগুলো খুব ভাল৷ তবে মনে হয় না কথাগুলো নতুন৷ আসলে আমরা তো আর দর্শন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি‍ করি না—৷ যাকগে এসব কথা, আইপিএল-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখলি? এটা কিন্তু এখন একটা হুজুগে‍ দাঁড়িয়ে গিয়েছে, দেখেছিস?’

তরুণ বুঝতে পেরেছিল, মেননের প্রসঙ্গ জোর করে চাপা দেওয়ার জন্যই অমলেশ ক্রিকেটের কথা তুলেছে৷ তরুণও আর মেননের প্রসঙ্গে না গিয়ে ক্রিকেটের মধ্যেই ঢুকে গিয়েছিল৷

আস্তে আস্তে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল৷ অমলেশের মুখে সেই কালো ছায়াটা এখন আর নেই৷

  অঙ্কন: ডি’সুজা

শনিবারের চিঠি, মে, ২০১৩ সংখ্যা