“শনিবারের চিঠি” পত্রিকার প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক হিসেবে দেশজোড়া খ্যাতি ছিল সজনীকান্ত দাসের। বাংলা ছবিতেও তাঁর ভূমিকাকে অবশ্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়।
“শনিবারের চিঠি”র ১০০ বছর চলছে। সেই সঙ্গে সজনীকান্ত দাসের জন্মের ১২৫ বছর আগত প্রায়। এই লেখার মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধার স্মরণ করছি সজনীকান্ত দাসকে এবং স্মরণ করছি “শনিবারের চিঠি” পত্রিকাকেও।
“শনিবারের চিঠি” পত্রিকার সম্পাদনার পাশাপাশি বিচিত্র সব ছদ্মনাম নিয়ে কত ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক রচনা যে সজনীকান্ত দাস প্রকাশ করেছিলেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি হুলস্থুল বাধিয়ে দিয়েছিলেন। সাহিত্যিক বন্ধুদের বিরাগভাজনও হয়েছেন বহুবার। পরে অবশ্য তাঁদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুতাও হয়েছিল। সেই বন্ধুতার সূত্র ধরে তাঁর জীবনে এসেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিক। এঁদের নাম উল্লেখ করলাম এই কারণে যে এঁরা সকলেই তখন বাংলা ছবির জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র ও শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় নিজেদের লেখা কাহিনি অবলম্বনে ছবি পরিচালনা করাও শুরু করে দিয়েছিলেন। নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ ততদিনে চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজের কাহিনির চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেছিলেন। এসবের প্রভাব স্বভাবতই পড়েছিল সজনীকান্ত দাসের উপরে। তিনি বাংলা ছবির জগতের সঙ্গে যুক্ত হলেন। মূলত চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা ও গীতিকার হিসেবে।
প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত “মুক্তি” ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৭ সালে। নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে নির্মিত সেই ছবির কাহিনিকার ও চিত্রনাট্যকার তিনজন:প্রমথেশ বড়ুয়া, ফণী মজুমদার ও সজনীকান্ত দাস। ছবির নায়িকা কানন দেবীর সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্কের সূত্রপাত এই ছবি থেকে। ছবিতে অধিকাংশ গানই হল রবীন্দ্রসংগীত। কানন দেবী ও পঙ্কজকুমার মল্লিক গেয়েছিলেন গানগুলি। কিন্তু এর মধ্যে একটি গানের রচয়িতা ছিলেন সজনীকান্ত। গানটি হল “ওগো সুন্দর মনের গহনে তোমার মুরতিখানি”। সেই সময় অনেকেরই ভুল ধারণা হয়েছিল যে এই গানটি বোধহয় রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু তা নয়। গীতিকার সজনীকান্ত। সুরকার পঙ্কজ কুমার মল্লিক। ছবিটির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পরবর্তীকালে সজনীকান্ত দাস যেসব ছবির চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেছিলেন, তার মধ্যে বেশিরভাগই বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যকীর্তি থেকে উঠে এসেছে। বম্বে টকিজের ব্যানারে এই বাংলায় তখন ছবি নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলেন সজনীকান্ত। বিখ্যাত পরিচালক নীতিন বসুর পরিচালনায় ১৯৪৭ সালে নির্মিত হয় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে “নৌকাডুবি”। চিত্রনাট্যকার সজনীকান্ত দাস। পরবর্তীকালে যিনি বোম্বেতে (এখন মুম্বই)প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন ক্যামেরাম্যান হিসেবে, সেই রাধু কর্মকার, তিনি এই ছবির চিত্রগ্রাহক। মুখ্য ভূমিকাগুলিতে রূপদান করলেন অভি ভট্টাচার্য, পাহাড়ি সান্যাল প্রমুখ শিল্পী। সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন অনাদি দস্তিদার।
নীতিন বসুর পরবর্তী ছবির কাহিনিকারও রবীন্দ্রনাথ। ছবির নাম “দৃষ্টিদান” (১৯৪৮)। চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা সজনীকান্ত। সুরকার তিমিরবরণ। চিত্রগ্রাহক রাধু কর্মকার। ছবির নায়ক ছিলেন অসিতবরণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই ছবিতে অসিতবরণের বাল্য ও কৈশোর চরিত্রে রূপদান করেছিলেন অরুন কুমার। এই অরুন কুমারই পরবর্তীকালে উত্তমকুমার, যাঁর পরিচয় নতুন করে দেয়ার প্রয়োজন হয় না বাঙালির কাছে। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, সন্ধ্যারানী, কেতকী দত্ত প্রমুখ শিল্পী।
বঙ্কিমচন্দ্রের “রাধারানী” গল্পের চিত্ররূপ দিলেন পরিচালক সুধীশ ঘটক। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫০ সালে।চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেন সজনীকান্ত।গীতরচনাও তাঁর। সুরকার অনিল বাগচী। নাম ভূমিকায় ছিলেন দীপ্তি রায়। তাঁর মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন মলিনা দেবী। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন মিহির ভট্টাচার্য, তুলসী চক্রবর্তী।১৯৫০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শ্রী, হিন্দ প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মুক্তি পায়।
১৯৫০ সালে ফের বম্বে টকিজের ব্যানারে ছবি নির্মিত হয়। নাম “সমর”। বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস “রজনী” অবলম্বনে ছবিটি নির্মিত।পরিচালক সেই নীতিন বসু। আবার চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনা করার জন্য ডাক পড়ল সজনীকান্তের। শচীন দেববর্মন ছবির সুরকার। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, মোহিনী চৌধুরী সঙ্গে গীতিকার হিসেবে ছিলেন সজনীকান্ত দাস। চিত্রগ্রাহক রাধু কর্মকার। এটি রুমা গুহঠাকুরতার প্রথম ছবি। তিনি রজনী চরিত্রের শিল্পী। তাঁর বিপরীতে সকলের প্রিয় দাদামনি অর্থাৎ অশোক কুমার। তিনি অমরনাথের চরিত্রে। লবঙ্গলতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুমিত্রা দেবী। ছবি মুক্তি পায় ১৯৫০ সালের ৬ অক্টোবর।
কানন দেবীর সঙ্গে সুসম্পর্কের জন্য হরিদাস ভট্টাচার্য ডেকে নেন সজনীকান্তকে। সেই সময়ে শ্রীমতী পিকচার্সের ব্যানারে নির্মিত হচ্ছে “মেজদিদি”।শরৎচন্দ্রের সেই বিখ্যাত কাহিনির চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য। সংলাপ রচনা করলেন সজনীকান্ত।। এছাড়া ছবির গানগুলি রচনা করলেন সজনীকান্ত। সেই ছবিতে কানন দেবীর কন্ঠে সজনীকান্তের লেখা দুটি গান “প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম” এবং “কুঁচবরণ রাজকন্যা” পূর্বের দর্শকদের কাছে যেমন আকর্ষণীয় ছিল এখনকার দর্শকদের কাছেও তেমনি আকর্ষণীয় হয়েই আছে। সুরকার ছিলেন কালীপদ সেন। নাম ভূমিকায় কানন দেবী। অন্যান্য শিল্পীরা হলেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়, রেনুকা রায়, তুলসী চক্রবর্তী, শিখারানী বাগ, শোভা সেন, আশা দেবী, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫০ সালের ১০ই নভেম্বর এই ছবি মুক্তি পায় শ্রী, পূর্ণ, ছায়া প্রেক্ষাগৃহে।
শ্রীমতী পিকচারসের ব্যানারে নির্মিত অপর ছবি “দর্পচূর্ণ”।পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য। গীতিকার সজনীকান্ত। সুরকার কালীপদ সেন। এখানে অভিনয় করেছেন কানন দেবী, রাধামোহন ভট্টাচার্য, পদ্মা দেবী, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী। শ্রী, পূর্ণ, প্রাচী প্রেক্ষাগৃহে ১৯৫২ সালের ১২ ডিসেম্বর এই ছবি মুক্তি পায়।
শরৎচন্দ্রের “পল্লীসমাজ” উপন্যাসের চিত্ররূপ দিতে এগিয়ে এলেন নীরেন লাহিড়ী। কাহিনিকার শরৎচন্দ্র। চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করলেন সজনীকান্ত। রমার চরিত্রে সুনন্দা বন্দোপাধ্যায় এবং বিশ্বেশ্বরীর চরিত্রে মলিনা দেবীর অভিনয় দর্শক চিত্তে স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রধান চরিত্রগুলিতে রূপদান করেন জহর গঙ্গোপাধ্যায়, বীরেন চট্টোপাধ্যায়, কানু বন্দোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পী। চিত্রনাট্যকার হিসেবে ততদিনে সজনীকান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। ১৯৫২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই ছবি মুক্তি পায় মিনার, বিজলী, ছবিঘর প্রেক্ষাগৃহে ।
শ্রীমতী পিকচার্সের আরেকটি স্মরণীয় ছবি হল “নববিধান” ।শরৎচন্দ্রের কাহিনি। পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য। চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করলেন সজনীকান্ত। গীতিকার প্রণব রায়ের পাশাপাশি এই ছবিটিতে গীত রচনাও করলেন সজনীকান্ত। সুরসংযোজনার দায়িত্বে ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। এই ছবির নায়িকা গায়িকা কানন দেবী। তাঁর বিপরীতে কমল মিত্র। অন্যান্য চরিত্রের রূপকার হলেন মঞ্জু দে, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, জীবেন বসু প্রমুখ। শ্রীমতী পিকচারস এ ছবির নির্মাতা। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালের ১৯মার্চ রাধা, পূর্ণ,প্রাচী প্রেক্ষাগৃহে।
নিরুপমা দেবীর কাহিনী অবলম্বনে শ্রীমতী পিকচার্সের ব্যানারে নির্মিত আরেকটি ছবি হল “দেবত্র”। কানন দেবী মুখ্য নারী চরিত্রে। পরিচালক হরিদাস ভট্টাচার্য। চিত্রনাট্যকার ও গীতিকার সজনীকান্ত দাস। এই একটি মাত্র ছবিতে কানন দেবী ও উত্তমকুমার একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। ছবির সুরকার কালীপদ সেন। সজনীকান্তের কথায় কালীপদ সেনের সুরে গান গাইলেন কানন দেবী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও মৃণাল চক্রবর্তী। সিনেমায় কানন দেবীর গাওয়া শেষ গান “আনো মা আনন্দময়ী আনন্দেরই সুর” যা দর্শকচিত্তকে আলোড়িত করে তুলেছিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ এই ছবির আরেকটি আকর্ষণ। অন্যান্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, সবিতা বসু, অনুপকুমার, শিপ্রা মিত্র, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মলিনা দেবী ও জহর গঙ্গোপাধ্যায় ।
গোলক চন্দ্র ধাঁধা, অনুপ্রাসরঞ্জন সেন, অরসিক রায়, নববিষ্ণু শর্মা, বটুকলাল ভট্ট বা গাজী আব্বাস বিটকেল। এমন সব অদ্ভুত ছদ্মনামে সজনীকান্ত “শনিবার চিঠি”তে লিখে গেছেন বহু লেখা। অল্প দিনে নিন্দা বিশারদ সম্পাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিষয়টি ঢেকে গিয়েছিল তাঁর চরিত্রের অন্যান্য বড় দিকগুলির জন্য। তা না হলে বাংলা ছবির স্বর্ণযুগে সজনীকান্তের চিত্রনাট্য রচনা, সংলাপ ও গীতরচনা যে তাঁর বহুমুখী প্রতিভাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই “শনিবারের চিঠি”র ১০০ বছর চলছে। সেই সঙ্গে সজনীকান্ত দাসের জন্মের ১২৫ বছর আগত প্রায়। এই লেখার মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধার স্মরণ করছি সজনীকান্ত দাসকে এবং স্মরণ করছি “শনিবারের চিঠি” পত্রিকাকেও ।