অঞ্জনা রাত্রে বিছানা করে মশারি টাঙাতে টাঙাতে তার স্বামী সোমেশকে বলে, ‘আমি ঠিক করেছি, কিছু একটা করব, করবই৷ সবসময় তোমার কাছে হাত পেতে থাকতে আমার ইচ্ছে করে না৷’
সোমেশ সহাস্য মুখে বলে, ‘নিজের স্বামীর কাছে হাত পাততে লজ্জা কীসের? তুমি তো বাইরের কারোর কাছে তো হাত পাতছ না? আমার সামর্থ বেশি নেই, কিন্তু যেটুকু পারি তোমায় দেওয়ার চেষ্টা করি বই কী!’
–তুমি গতকাল বলেছিলে, বিনা পয়সায় ভাত-কাপড় পাচ্ছ, আবার কী দরকার? আমার অপরাধ, আমি একটা সেন্ট কেনবার টাকা তোমার কাছে চেয়েছিলাম৷ তুমি বলেছিলে, খাওয়া-পরা দিচ্ছি, বিলাসিতার জন্য টাকা দিতে পারব না৷
অঞ্জনার গলা শেষের দিকে ধরে এসেছিল৷ চোখে জল এসে যায় তার৷ মশারি গুঁজতে গুঁজতে শাড়ির প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছে নেয় সে৷ সোমেশ বসেছিল চেয়ারে, উঠে এসে স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখে, মুখে বলে—‘সমস্ত সংসারের খরচটা আমায় একা চালাতে হয়, বোঝ না, কত বড় চাপ আমার ওপর?’
অঞ্জনা স্বামীর হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে দেয়; মুখে বলে, ‘এই জন্যেই তো বলছিলাম নিজে কিছু একটা আমি করবই৷ তোমার ওপর চাপটাও কমিয়ে আনব আমি৷’
সোমেশ বলে, ‘করবেটা কী? চাকরি-বাকরি কি এত সোজা জিনিস নাকি? কত এম.এ পাশ ছেলেমেয়ে বেকার বসে আছে৷ তুমি তো মাত্র হায়ার সেকেন্ডারি পাশ৷ তার চেয়ে মন দিয়ে সংসার করো৷’
অঞ্জনা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ঘরের আলোর সুইচ বন্ধ করে দেয়৷ প্রথমে সোমেশ পরে অঞ্জনা বিছানায় আশ্রয় নেয়৷ অঞ্জনা পাশ ফিরে শোয়, পিঠে হাত দিয়ে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে সোমেশ৷ তাদের ছেলের সঙ্গে ঠাকুমার ভাব বেশি, সে শোয় ঠাকুমার ঘরে৷ আগেকার দিনের বড় খাটে নাতিকে পাশে গল্প বলতে বলতে ঘুম পাড়ান সোমেশের মা চন্দ্রাদেবী৷ চন্দ্রাদেবী অঞ্জনার সঙ্গে যত খারাপ ব্যবহারই করুন না কেন,নাতি-অন্ত-প্রাণ এই বর্ষীয়সী মহিলা৷
স্বামীর আকর্ষণে স্বামীর দিকে ফিরে শোয় অঞ্জনা, ফিরে আধো অন্ধকারে স্বামীর দিকে তাকায় সে, বলে, ‘আমাকে তো তুমি চাও, আবার চাও-ও না, আমি বহুদিন থেকে চেয়েছি সব সংসার খরচটা তুমি আমার হাতে তুলে দাও, আমি তো সংসারী নারী, বাচ্চার মা, তোমার গৃহিণী, কেন তুমি আমার হাতে সংসার খরচ দেবে না?’
তার স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই, একথাটা বুঝে যায় অঞ্জনা৷ এই যে পারিশ্রমিক-বিহীন পরিশ্রম, স্বীকৃতি-বিহীন কাজ— এসবে তার মন মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ করতে চায়৷ চায়, কিন্তু পারে না৷
‘তোমাকে দিলে মায়ের কাছে কী জবাব দেব, বলো৷ মা এখনও আছেন এবং সুস্থই আছেন মোটামুটি৷ মায়ের হাতে সংসার খরচ না দিয়ে তোমার হাতে তুলে দিলে মাকে অপমান করা হয়৷ বেশ তো খেয়ে দেয়ে আছ, ঝামেলা করছ কেন? এসো, কাছে এসো’, বলে তাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে সোমেশ৷
সকালে উঠে ছেলেকে স্কুলের জন্য তৈরি করা, রান্নার ঝামেলা সামলানো, শাশুড়ি-মায়ের নানা ফরমাশ, সোমেশের অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি – কোথা থেকে কেটে যায় সকালটা বুঝতে পারে না অঞ্জনা, সোমেশ অফিস বেরিয়ে যায়; ছেলেকে স্কুলের বাসে তুলে দেয় অঞ্জনা, পাড়ার মোড় থেকে ফেরে, পাড়ার দোকান থেকে পাউরুটি, বিস্কুট এইসব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে, বাড়ি ফিরে এসে দু’কাপ চা বানায়, এক কাপ চা টিভির সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত শাশুড়ি-মাকে দিয়ে নিজে এক কাপ চা নিয়ে সকালের সংবাদপত্রটি খুলে একটু বসে৷ এইটুকু সময় তার ভাললাগার৷ এই গরম চায়ের কাপ আর প্রিয় খবরের কাগজ নিয়ে বসা৷ শাশুড়ি-মা নানা মন্তব্য করতে থাকেন, সাবান কাচার কাপড়জামা ভেজানো হয়েছে কিনা, তাঁর ছেলে ও নাতিকে ঠিকমতো টিফিন দেওয়া হয়েছে কিনা, জামাকাপড় ইস্ত্রিতে দেওয়া হয়েছে কিনা, যাবতীয় খুঁটিনাটির হিসেব দিতে হয় শাশুড়ি-মা’কে৷ তার স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই, একথাটা বুঝে যায় অঞ্জনা৷ এই যে পারিশ্রমিক-বিহীন পরিশ্রম, স্বীকৃতি-বিহীন কাজ— এসবে তার মন মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ করতে চায়৷ চায়, কিন্তু পারে না৷ দুপুরবেলা তার নিজের ও শাশুড়ি-মায়ের খাওয়া হয়ে গেলে, উদ্বৃত্ত খাবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে, টেবিল পরিষ্কার করে সে যখন একটু শুতে যাবে, তখনই শাশুড়ি-মা বলতে থাকেন, ‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আরাম আয়েস কোরো না যেন, ছেলেকে আনতে যেতে হবে মনে রেখো৷’
ঘুম হয় না অঞ্জনার৷ জেগে জেগে টিভি দেখে অঞ্জনা, তা-ও শাশুড়ির পছন্দ করা সিরিয়ালটাই তাকে দেখতে হয়৷ তিনটে বাজলেই ছেলেকে আনতে ছোটে সে৷ ছেলেকে স্কুলবাস নামিয়ে দেয় পাড়ার মোড়ে৷ ছেলে বুবাইকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরে তাকে খেতে দিয়ে তার সামান্য বিশ্রামের পর ছেলের হোমটাস্ক নিয়ে বসতে হয় তাকে৷ তার নিজের সময়, নিজের বিশ্রাম বলে কিচুই নেই৷ দমবন্ধ লাগে অঞ্জনার মাঝেমধ্যে৷ ছিটকে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু নিরুপায়৷ শেকল পরানো আছে পায়ে, উড়বে সে কোথায়? কোন আকাশে?
একদিন বিকেলে ছেলে একটু খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করছে ঠাকুমার ঘরে, ফোন বেজে ওঠে অঞ্জনার মোবাইলে, ওপারে তার ছেলেবেলাকার বন্ধু রত্নাবলী ফোন করছে৷ রত্না বলে, ‘শোন, তোদের পাড়ায় একটা জেরক্সের দোকান খুলছি, একজন সহকারী চাই, করবি তুই কাজ আমার সঙ্গে?’
‘আমার তো নানা দায়িত্ব আছে, মাইনেপত্র কত দিবি বল?আমাকে তাহলে তো রান্নার লোক রাখতে হবে৷ ভাল কাজের লোক লাগবে, তার মাইনে তো আমাকেই দিতে হবে রে৷’
কথাবার্তা শেষ করে রাত্রি সাড়ে আটটার সময় বাড়ি ফিরে দেখে শাশুড়ি মা ও তাঁর ছেলে অর্থাৎ অঞ্জনার বরের মুখ থমথম করছে৷ অঞ্জনাকে দেখে মা আর ছেলে কোনও কথা না বলে মন দিয়ে টিভি সিরিয়াল দেখছে৷ অঞ্জনা ছেলের পড়বার ঘরে ঢুকে যায়৷
‘সেসব কথা হবে, আমি তোর ছোটবেলাকার বন্ধু, তোর সুবিধে-অসুবিধে আমি বুঝব না, বলছিস?শোন আজ সন্ধ্যায় তুই আমার বাড়িতে আসবি৷ সামনাসামনি বসে কথা বলব আমরা৷ সন্ধেবেলা আসবি কিন্তু, ঠিকঠাক কথাবার্তা হয়ে যাবে৷’ ফোন রেখে দেয় বন্ধু রত্না৷ সন্ধেবেলায় ছেলেকে পড়তে বসিয়ে অঞ্জনা শাশুড়ি-মাকে বলে, ‘মা, আমি আমার বন্ধু রত্নার বাড়িতে একটু যাচ্ছি৷ রত্না আমাকে ডেকেছে, যাচ্ছি, আমি চলে আসব তাড়াতাড়ি-ই৷’ বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে দরজা টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় অঞ্জনা৷
রত্না এসে দরজা খুলে দেয়, মুখে খুশির হাসি, ‘আয়, আয়, আমি অপেক্ষা করছি তোর জন্যেই৷’ ঘরের ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে অঞ্জনা৷ রত্নার মা রত্নার সঙ্গে থাকেন, তিনি এসে সামনে বসেন; বলেন, ‘তোমার বন্ধু তো জেরক্স মেশিন কিনেছে, দোকানঘর ভাড়া নিয়েছে, আগামী জন্মাষ্টমীর দিনে দোকান খুলবে বলছে, তুমি কি ওর সঙ্গে কাজ করবে? দুই বন্ধু মিলে দোকানটা চালিয়ে নাও৷’
অঞ্জনা বলে— মাসিমা, আমার বড্ড সময় কম, ঘর-সংসারের সব কাজ সামলাতে হয়৷ আমার শাশুড়ি কিছুই করেন না৷ আমি তো রত্নার সঙ্গে কাজ করতেও চাই৷ কিন্তু মাসিমা, আমার সংসারের ঝক্কি-ঝামেলা সামলাবে কে? এতে আমার নিজের উপার্জনের স্বাদও আমি পেতাম৷ দেখি কী করি৷’ বলতে বলতে রত্না এসে দাঁড়ায় ঘরের মাঝখানে, তার পেছন পেছন আসে তাদের রান্নার মাসি, ট্রে-তে চা এবং সামান্য জলখাবার, টেবিলে নামিয়ে রাখে রান্নার মাসি; রত্না বলে—‘নে, চা খা, শোন দু’জনে মিলে জেরক্সের দোকানটা চালাব৷ সঙ্গে ফোন করার ব্যবস্থাও থাকবে— তুই যদি আমার সঙ্গে কাজ করিস, তাহলে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে কাজ করতে পারব, বুঝলি!’
চা খেতে খেতে অঞ্জনা নিজের অসহায়তার কথা বন্ধু রত্নাকে জানায়৷ রত্না তাকে বলে ‘তোর মাইনের টাকা থেকেই তুই একটা রান্নার লোক রেখে দিবি, এসে রান্না করে দিয়ে যাবে৷ তোর একটা কাজ হল, সেই মহিলারও একটা সংস্থান হল— শাশুড়ি-মা’কে বুঝিয়ে বল আজ রাত্রেই৷ আগামী জন্মাষ্টমীর দিনটা ভাল দিন, সেই দিনই আরম্ভ করব আমাদের দোকান খোলার কাজ৷ তুই তোর বরের সঙ্গে আগে কথা বলে নে, দুই বন্ধু মিলে থাকব, সময়টাও ভাল কাটবে৷’
কথাবার্তা শেষ করে রাত্রি সাড়ে আটটার সময় বাড়ি ফিরে দেখে শাশুড়ি মা ও তাঁর ছেলে অর্থাৎ অঞ্জনার বরের মুখ থমথম করছে৷ অঞ্জনাকে দেখে মা আর ছেলে কোনও কথা না বলে মন দিয়ে টিভি সিরিয়াল দেখছে৷ অঞ্জনা ছেলের পড়বার ঘরে ঢুকে যায়৷
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর শোওয়ার ঘরে এসে বাইরের ড্রেস ছেড়ে অঞ্জনা নাইটি পরছে, সোমেশ বলে ওঠে, ‘তা তোমার বান্ধবী তোমায় কত টাকা মাইনের চাকরি দিচ্ছে? কবে থেকে জয়েন করছ তুমি? ওই সস্তার চাকরি করতে গেলে তোমার ঘর-সংসার, তোমার ছেলেকে সামলাবে কে?’ অঞ্জনা সোজা তাকায় স্বামীর দিকে, বলে, ‘সব দিকই সামলে নেব৷ আর একটা সেন্ট কিনতে, ব্লাউজ-পিস কিনতে তোমার কাছে হাত পাতব না৷ নিচের ফ্ল্যাটের রান্নার মাসির সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা, কাজ করবে আমাদের বাড়িতে৷ ছেলে বড় হয়ে গেছে, নিজেই পারবে পাড়ার মোড়ে গিয়ে বাস ধরতে, আমি না হয় সকালে ওকে পৌঁছে দিয়ে কাজে যাব৷ ভেবো না, সব দিক ঠিক সামলে নেব৷ আজকাল মেয়েরা ঘরে-বাইরে সব সামলে নিচ্ছে, না পারে কী? সব পারে৷’
সোমেশ অসহায় ক্রোধে বলে, ‘ওই ক’টা টাকার জন্য তুমি ওই প্রাণপাত খাটবে? কেন আমিই তো সংসার চালিয়ে নিচ্ছি৷’
অঞ্জনা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আয়নার মধ্য দিয়ে স্বামীর দিকে তাকায়, বলে, ‘তোমার কাছ হাত-খরচের জন্য আর হাত পাতব না, মনে রেখ!’
সোমেশের অঞ্জনাকে, এতদিনের চেনা স্ত্রীকে কেমন অচেনা লাগে, আজ, এতদিন পর৷
অলঙ্করণ : চন্দ্র চক্রবর্তী
শনিবারের চিঠি, শারদসংখ্যা, ১৪১৯