বৈচিত্রলোভী রবীন বারবার ছুটে ছুটে যান দেশ থেকে দেশান্তরে জীবন বৈচিত্র্যের সন্ধানে। হঠাৎ করে তিনি তাঁর অন্তরে শুনলেন সমুদ্রের আহ্বান। পুরীর একখানা টিকিট কিনে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে তিনি পরিচিত হলেন বড়দি, সেজদি আর শিবিদির সঙ্গে। এঁরাও পুরী চলেছিলেন জগন্নাথ দর্শনে।রবীনের পোশাক-আশাক দেখে তাকে অবাঙালি বলে মনে করেছিলেন তাঁরা। এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন। তাঁর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পেতে বিলম্ব হল না। অন্তরের সংকীর্ণতা সব সরিয়ে রেখে রবীন তাঁদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁরা স্নেহ মমতা দিয়ে তাঁকে কাছে টেনে নিলেন। আর পেলেন ছোট বউদিকে। সবদিক থেকেই তিনি যেন নিজেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে রেখেছিলেন। আর রবীন দেখতে পেলেন রেনুকে। দেখে অবাকই হলেন। পুরীর ধর্মশালায় এসেও যখন ঘটনাচক্রে রবীন এঁদের সকলের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হলেন তখন সকলেই খুব খুশি হলেন। এঁরা এঁদের না পাওয়ার ব্যথাটা কিছুটা ভুলতে চাইলেন রবীনকে পাওয়ার আনন্দের মধ্যে। কিন্তু ভবঘুরে রবীন এঁদের ছেড়ে উঠলেন এক হোটেলে। কিন্তু এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। রবীন সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন রেনুর কাছে। তাঁর সহানুভূতির স্পর্শে রেনু আস্তে আস্তে তার জীবনের বেদনাবিধুর ঘটনাগুলো তুলে ধরেছিলেন। নিখিলকে ভালবাসার মাঝে কোন ফাঁক ছিল না। ছিল জাতিগত বিভেদ। প্রতারিত অপমানিত ব্যথাহত রেনুর এই বিপর্যয়ের দিনে যাঁরা তাঁর কাছে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরাই এসেছিলেন সমালোচনার জ্বালা নিয়ে। রবীন রেনুর জন্য মনেতে বেদনা বোধ করেন। রেনু অন্য সকলের সঙ্গে এরপর গিয়েছেন ভুবনেশ্বর উদয়গিরি খণ্ডগিরি কোনারক। জেনেছেন সকল মানুষের জীবনের দুঃখের কথা। রেনু ও রবীনের জীবনযাত্রার মাঝখানে একদিন হঠাৎ নিখিল এসে হাজির। তাঁদের পুরনো দিনে ফিরে যাওয়ার জন্য জানিয়েছেন করুন আকুতি। কিন্তু রবীনের কাছে রেনু পেয়েছেন নিশ্চিন্ততার নির্ভয়। যে ছবির গল্প এতক্ষণ আপনাদের বললাম সেই ছবির নাম “নির্জন সৈকতে”, পরিচালক তপন সিংহ।
এই ছবি নির্মাণের পিছনেও একটা ইতিহাস রয়েছে। সমরেশ বসু কালকূট ছদ্মনামে যে লিখতেন সেখানে “অমৃতকুম্ভের সন্ধানে” পড়ে তপন সিংহ এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তার চিত্ররূপ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সমরেশ বসু জানালেন যে বিমল রায় এই গল্পের চিত্রস্বত্ব কিনে রেখেছেন, তাই তিনি দিতে পারবেন না। তপন সিংহকে সমরেশ বসু অনুরোধ করলেন তাঁর “নির্জন সৈকতে” উপন্যাসটি পড়বার জন্য।
উপন্যাসটি পড়ে তপন সিংহের এত ভালো লেগে গেল যে তিনি সমরেশ বসুকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন পুরীতে। সেখানে বসে চিত্রনাট্য লিখলেন। তারপর তিনি এই ছবি করতে নামলেন। বিরাট কাস্টিং ছিল এই ছবিতে। ছায়া দেবী, ভারতী দেবী, রেনুকা রায়, রুমা গুহঠাকুরতা, অনিল চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, রবি ঘোষ প্রমুখ। ছবিটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
সেই তপন সিংহের জন্ম ১৯২৪ সালের ২ অক্টোবর এই কলকাতায়। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন ভাগলপুরের দুর্গাচরণ এম ই স্কুলে। সেখান থেকে স্কুলের ডিগ্রি পাস করার পর তিনি পাটনা ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি পাশ করলেন পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে তিনি পদার্থবিদ্যাতে এম এস সি পাস করলেন। সিনেমার প্রতি তাঁর আকুতি, তাঁর ভালোবাসা, ছাত্র জীবন থেকে। বিশেষ করে আমেরিকা এবং ব্রিটিশ ফিল্ম তাঁকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করত এবং সে আকর্ষণের তালিকায় যাঁরা ছিলেন তাঁরা হলেন বিলি উইল্ডার, জন ফোর্ড, ক্যারল রিড প্রমুখ। নিউ থিয়েটারর্স স্টুডিওতে তপন সিংহ সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রবেশ করলেন ১৯৪৬ সালে। এরপর তিনি ক্রমশ ধাপে ধাপে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর পাশাপাশি ছবি পরিচালনার দিকেও ঢুকলেন।
তপন সিংহ পরিচালিত ছবিগুলির নাম দেখা যাক। অংকুশ( ১৯৫৪), উপহার (১৯৫৫), টনসিল (১৯৫৬), কাবুলিওয়ালা( ১৯৫৭), লৌহ কপাট (১৯৫৮), কালামাটি( ১৯৫৮), ক্ষুধিত পাষান (১৯৬০), ঝিন্দের বন্দি (১৯৬১), হাঁসুলি বাঁকের উপকথা (১৯৬২) নির্জন সৈকতে (১৯৬৩) জতুগৃহ এবং আরোহী (১৯৬৪) গল্প হলেও সত্যি( ১৯৬৬) হাটে বাজারে (১৯৬৭), আপনজন(১৯৬৮) সগিনা মাহাতো (১৯৭০) এখনই (১৯৭১ )আঁধার পেরিয়ে( ১৯৭৩) রাজা (১৯৭৫) হারমোনিয়াম (১৯৭৬) এক যে ছিল দেশ (১৯৭৭ ),সবুজ দ্বীপের রাজা (১৯৭৯), বানছারামের বাগান (১৯৮০), আদালত একটি মেয়ে( ১৯৮২), বৈদুর্য্য রহস্য (১৯৮৫) আতঙ্ক (,১৯৮৬) অন্তর্ধান( ১৯৯২) হুইলচেয়ার( ১৯৯৪) প্রভৃতি ছবি তিনি পরিচালনা করেছেন।
তিনি যে শুধুমাত্র বাংলা ছবি পরিচালনা করেছেন এমনটি নয়। তিনি হিন্দি ছবি অনেকগুলি পরিচালনা করেছেন। তাঁর “ক্ষণিকের অতিথি” তিনি হিন্দিতে করলেন “জিন্দেগি জিন্দেগী” নামে। “সাগিনা মাহাতো”র হিন্দি করলেন “সাগিনা” নাম দিয়ে। এছাড়া করলেন সফেদ হাতি, আজ কা রবিনহূড, এক ডাক্তার কি মৌত প্রভৃতি ছবিগুলি। অধিকাংশ ছবিই তাঁর উঠে এসেছে কিন্তু সাহিত্যের পাতা থেকে। আবার নিজের লেখা গল্পেরও তিনি চিত্ররূপ দিয়েছেন। তার প্রমাণ রয়েছে গল্প হলেও সত্যি, আতঙ্ক, হুইলচেয়ার প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথ সর্বদাই তাঁর প্রিয় লেখক। তাই রবীন্দ্রনাথের তিন তিনটি ছোট গল্পের তিনি চিত্ররূপ দিয়েছেন, যেগুলি হল ক্ষুধিত পাষাণ, কাবুলিওয়ালা এবং অতিথি।
শেষের দিকে তিনি সত্যজিৎ রায়ের মতো নিজের ছবিতে নিজেই সুর সংযোজনা করেছেন এবং তার মধ্যে বেশ কিছু গান জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। “সাগিনা মাহাতো” ছবিতেই যেমন “ছোটিসি পনছি ছোট্ট ঠোটে রে” গানটি অনুপ ঘোষাল ও আরতি মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে তিনি এই গান গাইয়েছিলেন। “অতিথি” ছবিতে তিনি তাঁর নিজের কথা ও সুরে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় উৎপলা সেনকে দিয়ে গাইয়েছিলেন “মাঝে নদী বহেরে ওপারে তুমি শ্যাম এপারে আমি।” বোম্বে তারকাদেরও তিনি বেশ কয়েকবার বাংলা ছবিতে এনে তাঁদের ব্যবহার করেছেন। যাঁর মধ্যে রয়েছেন দিলীপকুমার ও সায়রা বানু “সাগিনা মাহাতো” ছবিতে। বৈজয়ন্তীমালা “হাটে বাজারে” ছবিতে।
তপন সিংহের সঙ্গে বিয়ে হয় অভিনেত্রী অরুন্ধতী দেবীর। তাঁদের একটি পুত্র সন্তান। তাঁর নাম অনিন্দ্য সিংহ(ইন্ডিয়ান সায়েন্টিস্ট প্রফেসর)। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “মনে পড়ে” যে কোনও রসিক পাঠকের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় গ্রন্থ।
তপন সিংহ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি। দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। চলচ্চিত্রে ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ পুরস্কার হল দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। সে পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। সেই বরেণ্য পরিচালকের জন্মের শতবর্ষে, জন্মদিনের প্রাক্কালে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে রইল আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
ছবিগুলি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে