গণতন্ত্রের বীরেন্দ্র

তিনি মলয় রায়চেৌধুরী নন কিংবা পাবলো নেরুদা নন, আবার কবি সুকান্তের মতো তিনি সংযত নন, তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বামপন্থী চেতনা আর অনুশীলন সমিতির আদর্শ তাঁর রক্তে। তাঁর প্রতিটা লেখায় ধরা পড়ে সমকাল। তাঁর শব্দে ধরা পড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ঢাকার সাম্প্রদায়িক আন্দোলন, মন্বন্তর, তেভাগা আন্দোলন। দেশকাল তাঁকে বিদ্ধ করেছে। তিনি যে কেবল দেশীয় পরিস্থিতির শিকার তা নয়, কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় উঠে এসেছে মুজিবুর থেকে হোচিমিন।

আসলে তিনি এক বিশেষ সময়ের নাগরিক যখন দেশ তথা বিশ্বের পট পরিবর্তন হচ্ছে, মানুষের চেনা ভাবনায় আঘাত আসছে প্রতিদিন, দখল করছে নিত্যনতুন ধারণা। তিনি বিজন ভট্টাচার্যের মতো সময়কে উপেক্ষা করেননি। বরং সময়কে বুঝেছেন, সময়কে দিয়েছেন তার শব্দ রূপ, কখনও উত্তরণের রাস্তা দেখাবার চেষ্টা করেছেন। সত্যি কথা বলতে, কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও অসহায় সময়ের কাছে। অক্টোভিওপেজের কথায়, ‘আননোইং উই আন্ডারস্ট্যান্ডিং ‘’ কারণ ‘স্টারস রাইট’। সময়ই নিয়তি। কালবেলাতেই জীবনের বেলাশেষ। তবে কবি পলাতক নন, তিনি পদাতিক। তিনি মানুষের পাশে। ব্রিটিশ কবি আলেকজান্ডার পপ বা ড্রিদেনের মতো তিনি দেখেছেন রাজনীতির নগ্নতা, বৈষম্য। কবিতায় ব্যবহার করেছেন স্যাটায়ার। ‘ভোট দিও না হাতিকে / ভোট দিও তার নাতিকে / ভোট দিও না গাধাকে / ভোট দিও তার দাদাকে।’ গণতন্ত্রের অধিকারে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবিতায় প্রশ্রয় দিয়েছেন আইরনি। রূপকের আশ্রয়ে পরিষ্কার করেছেন তাঁর ভাব। ভাবনার হাইপারবল নয়, তিন বিষয়ের রেটরিকের জন্ম দিতে চেয়েছেন। তাই হাতি, গাধা শব্দের পরিবর্তে তিনি বিশ্বাস রাখতে চান নাতি, দাদার উপর। কারণ ইনোসেন্স আর এক্সপিরিয়েন্স নিজেই জীবন, যা কবি ব্লেক বলেছিলেন। তিনি রোমান্টিক হতে পারেননি। বরং শেলীর মতো তিনি রক্তাক্ত। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ওয়েস্ট উইন্ডের মতো গডফাদার নেই। তাই হাজারদুয়ারী জীবনে তিনি বন্দী। ভলতেয়ারের মতো তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘যেখানে সমাজের হত্তা কর্তারাই ভুল সেখানে সঠিক হতে চাওয়া বিপদজনক।’ তাই তিনি তাঁর কবিতার ডাইরিতে এঁকেছেন ডাইআসটোপিয়ার ছবি। কারণ এডিসনের মতো কবি জানেন রাজনীতির বিষ কতটা টক্সিক!

এ যেন জীবনানন্দের বেলা অবেলা কালবেলার চল্লিশ দশক। শুধু রক্ত আর রক্ত বমিতে শেষ একটা তরুণ প্রজন্ম। শিক্ষার সিঁড়িতে রক্তের দাগ। বোধের মৃত্যু ঘটেছে। ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে রাক্ষসও পরাজিত। শুধু বাহবা পাবার ইচ্ছা। অবক্ষয়ের উন্নয়ন। কেউ থামবে না। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাই সংঘবদ্ধ বিদ্রোহের ডাক দেন। গণ চেতনার ডাক দেন। বিপ্লবের মধ্যেই উত্থান। দরকারে ছিনিয়ে নিতে হবে নিজেদের অধিকার। 

উত্তরপাড়া কলেজ কবিতায় কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘রক্ত রক্ত শুধু রক্ত, দেখতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায় / শিক্ষক ছাত্রের রক্ত প্রতিটি সিঁড়িতে /… কাউকে ছুঁড়ে দিয়েছে পুলিশ / রক্ত বলি করে আজ হাসপাতালে এই বাংলায় কিশোর গোঙায় / এই তোমার রাজত্বে খুনি! তার উপর কি বাহবা চাও? / আমরা দেখবো, তুমি কতো দিন এই ভাবে রাক্ষস নাচাও।’

কবি অসহায়। এ যেন জীবনানন্দের বেলা অবেলা কালবেলার চল্লিশ দশক। শুধু রক্ত আর রক্ত বমিতে শেষ একটা তরুণ প্রজন্ম। শিক্ষার সিঁড়িতে রক্তের দাগ। বোধের মৃত্যু ঘটেছে। ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে রাক্ষসও পরাজিত। শুধু বাহবা পাবার ইচ্ছা। অবক্ষয়ের উন্নয়ন। কেউ থামবে না। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাই সংঘবদ্ধ বিদ্রোহের ডাক দেন। গণ চেতনার ডাক দেন। বিপ্লবের মধ্যেই উত্থান। দরকারে ছিনিয়ে নিতে হবে নিজেদের অধিকার। কবি চরমপন্থী।  শাসকের প্রলোভনে পা ফেলা যাবেনা। কবি ইউলিসিস। তিনিই ঘোষণা করেন, ‘বিপ্লব হক দীর্ঘজীবি। / … প্রেতের মত ধুঁকছে মিছিল / উড়ছে পায়রা নোধর কান্তি।’

অনাহার, অপুষ্টির প্রতিরোধে খাদ্যের প্রয়োজন। চল্লিশের মজুতদারির বিরুদ্ধে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রতিবাদ শানিয়েছেন। তিনি অমর্ত্য সেনের মতো বিশ্বাস করেন, খাদ্যাভাব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হয় না, মানুষের কালোবাজারির বা অসাধুতার জন্য দুর্ভিক্ষ হয়। উন্নয়নে যদি প্রাথমিক চাহিদাগুলো নাগরিক জীবনে পরিপূর্ণ না হয় তাহলে শাসকের উন্নতি তো শাজাহানের রাজত্বকাল!

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবি সমর সেনের মতো কবিতা থেকে নির্বাসন নেননি। বরং কবিতাকে সামনে রেখে আমরণ লড়াই চালিয়ে গেছেন। কবিতার মেটাফরে ধরা পড়েছে নাগরিক জীবনের করুণ কোলাজ। তাঁর কবিতা পাড়াতে প্রতিবেশী হয়েছে উদ্বাস্তু জীবন। শুধু শব্দে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন বোধ। তাঁর কবিতায় রয়েছে মানুষের সভা, যেখানে মানুষ বলবে মানুষের কথা। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজের কবিতায় নতুন ধারার প্রবর্তন করেন, যা ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা কোলড্রিজের মত নয়। তিনি লিরিকাল ব্যালাডের মতো সহজ নয়, তিনি ডিকেন্সের হার্ড টাইমসের মতো বাস্তববাদী। কবি উত্তাল সময়ে ফিরে তাকাতে পারেননি। তাঁর যুগ সন্ধিক্ষণে টেনিশন বা হার্ডির দ্বন্দ্ব নেই। তিনি সময়ই বয়ে গেছেন, থামার সময় পাননি, আবার অ্যাবসার্ডদের মত অপেক্ষা করেননি। তিনি যেন ‘নবান্ন’ নাটকের কুঞ্জ রাধিকা। অভাব অনটন, দাঙ্গা, রক্তপাত, দেশভাগ সবই তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর কবিতায় তাই প্রতিফলিত হয়েছে পার্টিশন লিটারেচার। তিনিই লিখতে পারেন, ‘আমার ভারতবর্ষ / পঞ্চাশ কোটি নগ্ন মানুষের / যারা সারাদিন রৌদ্রে খাটে, সারা রাত ঘুমুতে পারে না।’ তিনি মানুষের কথাই বলতে বেশি ভালোবাসেন। নিজের অন্তরালে রেখেছেন ফ্রয়েডকে। বিশ্বাস করেছেন সমাজ রাজনীতির চড়াই উতরাই। পাশে পেয়েছেন জুয়ান, বন্দুরার মতো সমাজবিজ্ঞানীদের। তিনি মানুষ হয়ে মানুষের অধিকার ফেরাবার দাবি তোলেন। তাঁর কবিতা উপন্যাসের মত প্রকাশ পায়। কবিতার শব্দে লুকিয়ে থাকা যুক্তি বিদ্ধ করে নাগরিক জীবনকে। তিনি লিখেছেন, ‘হোক পোড়া বাসি ভেজাল মেশান রুটি / … রুটি দাও, রুটি দাও।’ রুটি বড়ো দরকার। অনাহার, অপুষ্টির প্রতিরোধে খাদ্যের প্রয়োজন। চল্লিশের মজুতদারির বিরুদ্ধে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রতিবাদ শানিয়েছেন। তিনি অমর্ত্য সেনের মতো বিশ্বাস করেন, খাদ্যাভাব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হয় না, মানুষের কালোবাজারির বা অসাধুতার জন্য দুর্ভিক্ষ হয়। উন্নয়নে যদি প্রাথমিক চাহিদাগুলো নাগরিক জীবনে পরিপূর্ণ না হয় তাহলে শাসকের উন্নতি তো শাজাহানের রাজত্বকাল!

জীবনের মান উন্নত হলে মানবশ্রম উন্নত হবে, মেধার বিকাশ ঘটবে, আসবে রাষ্ট্রের প্রগতি। অথচ কবি দেখেছেন শাসকের নির্মম চরিত্র। ভাত চাইতে গেলে গুলি, মিছিল করতে গেলে গুলি। রাষ্ট্র বা শাসকের বিরুদ্ধে মুখ খোলা অপরাধ। তুমি নীরব দর্শক। তুমি প্রশ্ন করতে পারবে না। মানুষের ক্রোমোজোমে দাসত্ব ঢুকিয়ে দাও। কবি তাই গণতন্ত্রের প্রশ্নে তিনি বিরক্ত। তিনি বলেন, ‘এই না হলে শাসন? / ভাত চাইতে গুলি, মিছিল করলে গুলি, বাংলা বনধ গুলির মুখে উড়িয়ে দেওয়া চাই / … একেই বলে গণতন্ত্র / গুলিবিদ্ধ রক্তে ভাসে আমার ঘরের বোন, আমার ভাই।’

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় নতুনত্ব কিছু নেই, শেখার কিছু নেই। তবু তাঁর কবিতা ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। শব্দের লেন্সে উদ্ভাসিত সময় যা চিরকাল অমলিন। তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে কথা তাঁদের উপন্যাসে তুলে ধরেছেন কবি তাঁদের মত একই বিষয় তুলে ধরেছেন। তবে কবি কবিতায় সীমাবদ্ধ থেকেও তিনি সাহসী।

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় এসেছে বিষ্ণু দে’র প্রভাব। এ ব্যাপারে তিনি আর সমর সেন একই। তবে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সে প্রভাব কাটিয়ে উঠেছেন পরবর্তীকালে। অনেকে তাঁর লেখায় রাশিয়া বা বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ কবিদের ছায়া দেখেছেন। তাঁর চেতনায় হোমিংওয়ে মঘম রয়েছে। তবে তিনি তাঁর মাটির গন্ধে ভুলে যাননি স্বদেশ। আমার চোখে তিনি এক মোহিনী মোহন গঙ্গোপাধ্যায়।

তিনি কবিতাকে গড়পড়তা অলঙ্কারে না সাজিয়ে নাগরিক ভাষায় কবিতা সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কবিতা নগর জীবনের খাসখবর। শিরোনামে উঠে এসেছে সময়ের বিভিন্ন স্তর ও তার অবক্ষয়। তিনি ধর্মের প্রতি সংশয় প্রদর্শন করেছেন। মানুষ মানবতা ছাড়া কোনও ধর্ম হয় না। তাই দ্বিধা দ্বন্দ্বে তিনি উল্লেখ করেছেন মথুরা অযোধ্যার কথা। নবারুণের মৃত্যু উপত্যকা তাঁরও পছন্দ নয়। তিনি লেখেন, ‘সাপ খেলানোর নেশা মৃত্যু দিয়ে কোন বাজিকর / দেখিনি, এমন ছবি মথুরায় কিংবা অযোধ্যায় কোনোদিন।’ সাপ পাশবিকতার প্রতীক। কবি আদিমতার থেকে রাজনীতিকেই বেশি ভয়ানক বলে মনে করেন। শাসক বাজিকর। কবি জানেন, শুধু ভোটের জন্য জনকল্যাণকে বাজি ধরে শাসক। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় নতুনত্ব কিছু নেই, শেখার কিছু নেই। তবু তাঁর কবিতা ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে। শব্দের লেন্সে উদ্ভাসিত সময় যা চিরকাল অমলিন। তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে কথা তাঁদের উপন্যাসে তুলে ধরেছেন কবি তাঁদের মত একই বিষয় তুলে ধরেছেন। তবে কবি কবিতায় সীমাবদ্ধ থেকেও তিনি সাহসী। তিনি লিখেছেন, ‘রাজা আসে যায় রাজা বদলায় / কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে  তার লড়াই চলছে, চলবে /পেটের ভিতর কবে যে আগুন জ্বলছে এখনো জ্বলবে / …তুমি বদলাও না, সেও বদলায় না।’ শাসক বদলায়, শাসন বদলায় না। মানুষের অভাব শাসকের অস্ত্র। মানুষ স্বনির্ভর হলে শাসক কাকে শোষণ করবে? পৃথিবীর ইতিহাসে শাসক তাই নির্দয়।

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে বিশ্বাস করেন। কিন্তু বিপরীত ধারণা তৈরি করতে গেলে বিরোধী মতামত দরকার, জনগণের বিবেক দরকার। প্রজা বিক্রি হলে, চেতনা বিক্রি হলে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম হবে। কবি জনগণের উপর বিশ্বাস রাখেন। আজ বা কাল নাগরিক জীবনে চেতনা ফিরবেই। পরিবর্তনের ডাক আসবেই। কালেকটিভ কনশাসনেসের মাধ্যমে নতুন সভ্যতার সূচনা হবে। তিনি লিখেছিলেন, ‘সে জাগবেই। জাগবেই। আমি তাকে কোলে বসে আছি রক্ত পুঁজ মাখামাখি রাত্রি…।’ কারণ তাকে জাগাতেই হবে, নাহলে শোষণের সব সীমা লঙ্ঘন করবে শাসক। চালু হবে পুনরায় দাস প্রথা। কবি জানেন, মানুষকে বোঝালে সে বুঝবে। অস্থির সময়ে সে দিশাহীন। শাসক গ্রাস করছে সবকিছু। তাই কবিতায় ঝরে পড়ে আক্ষেপ, ‘কোথাও মানুষ ভালো রয়ে গেছে বলে / আজও তার নিশ্বাসের বাতাস নির্মল / … তথাপি মানুষ আজও শিশুকে দেখলে /নম্র হয়, জননীর কোলে মাথা রাখে / উপসেও রমণীকে বুকে টানে…’। সত্যের বিকৃত ঘটছে। সংশয়ে হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তির সুখ। কবি জানেন, তাঁর ধর্ম, তিনি মানুষ। তিনি তাই মানুষের বাইরে কাউকে ঈশ্বর বলে মনে করেন না। তিনি সমাজকে বলে দিতে পারেন, ‘আমার ঈশ্বর নেই বলে /সবাই আমাকে উপহার ছুঁড়ে দেয়।’

কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবসে ‘শনিবারের চিঠি’র পক্ষ থেকে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হল