মহামিলনক্ষেত্র শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথের রথযাত্রা

কথায় আছে দেবানুগ্রহ ছাড়া নাকি দেবদর্শন হয় না। তাই বোধ হয় ছোটবেলা থেকে অনেকবার পুরী ভ্রমণ করলেও রথে জগন্নাথ দর্শন অদেখাই থেকে গেছে। কিন্তু সেবার সুযোগ মিলে গেল অভাবিত ভাবে। মাঝে একবার সংবাদ সংগ্রহের কাজে যেতে হল কটক। কাজের শেষে শুনলুম উল্টোরথযাত্রা নাকি সন্নিকটে? সুতরাং আশায় আশায় কাজের শেষে পুরীই রওনা হয়ে গেলুম। পরের দিন জগন্নাথের পুনর্যাত্ৰা। সকাল থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়, ঐ আসে ঐ আসে ভৈরব হরষে, তার আগে চলমান কালো মাথার মেঘের পাহাড়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন মনে করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষামান। কিন্তু একি হঠাৎ শুনি! রথ নাকি সেদিন আর আসবে না তাহলে বোধহয় জগন্নাথ দর্শন আমাদের ভাগ্যে নেই। কেননা তার পরদিনই দুপুরে কলকাতা ফেরার ট্রেনের টিকিট।

হন্যে হয়ে পার্শ্ববর্তী দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলুম একি কথা ভাই, আজ জগন্নাথ দেবের পুনর্যাত্ৰার বিধি আর রথ নাকি আজ আসবে না? তিনি কিন্তু কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হয়ে বললেন, সবই মহাপ্রভুর ইচ্ছা। তাঁর তো আপনার মতন অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। আজ আসে নাই কাল আসিবে। বিফল মনোরথ হয়ে বাসায় ফিরে গেলুম। কিন্তু রাখে জগন্নাথ মারে কে!

পরের দিন ট্রেনের জন্য কিছু কেনাকাটি করতে বাজারে বেরিয়েছি দেখি গড়গড়িয়ে জগন্নাথের রথ আসছে। পুলকিত অন্তরে আমরা গিয়ে রথের রশি স্পর্শ করে জীবন সার্থক করলুম। তবে রথে বামন দর্শন আর হল না। এটা রাজনীতির রথে হামেশাই দেখার জন্য বোধহয় তোলা রইল।

রথযাত্রার মেলা

রথের কথা রামায়ণ মহাভারতে পড়া ছিল। রামায়ণে লঙ্কাজয়ের পরে পুষ্পক রথে রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের কথা আছে। মহাভারতে রথে চড়ে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা আছে। কিন্তু রথযাত্রা বলতে এখন একমাত্র জগন্নাথের রথযাত্রাকেই বোঝায়। তার মধ্যে শ্রীক্ষেত্র পুরীধামের রথ সর্বপ্রসিদ্ধ। আমাদের বাংলায় পুন্যর্থীদের জন্য চালু হয় মাহেশের রথ। যেখানে অন্ধ বালিকা রাধারানী পুষ্পমালা বিক্রি করতে গিয়ে অসামান্য সম্পদের অধিকারী হন। আমাদের ঠাকুমার বাপের বাড়ি ছিল শ্রীরামপুর। তাই আমাদেরও মাঝে মাঝে মাহেশের রথযাত্রার মেলা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সে এক বিপুল আয়োজন চার-পাঁচ মাইল রাস্তা জুড়ে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল গাছপালা বিক্রির সমারোহ।

সেই থেকেই বোধহয় রথ দেখা এবং কলা বেচার কথা চালু হয়েছে। শুধু কলা বেচা নয়, সে সময় এক এক জায়গায় থাকত কাঁঠালের পাহাড়। এবং প্রকাশ্যেই দেখা যেত কাঁঠালের উপর ধপাধপ হাতুড়ির কোপ। অর্থাৎ কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো। একটা পাকা কাঁঠাল প্রদর্শনীর জন্য রেখে বিশাল কাঠালের সংগ্রহ। যাতে নরম বোঝা যায় তাই ছিল হাতুড়িপেটা। প্রকাশ্যে হাতুড়িপেটা দেখে যদি জিজ্ঞেস করা হত, ও তো কাঁঠাল না পেকে দরকচা হয়ে যাবে। ব্যাপারীরা বলতো তা হোক কিন্তু বিক্রি তো হবে। কাঁঠালের পাকার জন্য অপেক্ষা করলে তো রথযাত্রা পার হয়ে যাবে তখন এই কাঁঠাল কিনবে কে?

আমাদের ছোটবেলায় চড়কের পরেই আসত এই রথযাত্রা উৎসব। অনেক বড় আকারে অনেক জিনিসের পসার ও বিকিকিনি। আসলে এটি ছিল একটি বিরাট লোক উৎসব তথা পার্বনী উৎসব। তার বড় আয়োজন হত শ্রীক্ষেত্র তথা পুরীতে। তথাকথিত জাতপাত বিচারের এই হিন্দুসমাজে এই শ্রীক্ষেত্র হয়ে উঠত এক মিলনক্ষেত্র। কেননা সাধারণ ভক্তের সমাগমে দর্শনদানের জন্য জগন্নাথের এই পথে নেমে আসা এক অতি আশ্চর্য মহামিলন ক্ষেত্র।মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ তথা ভক্তি নিবেদনের কাঠের কঠোর নিয়ম ভেঙে জগন্নাথ পথে বেরিয়ে আসেন আপামর ভক্ত সাধারণকে দর্শন দিতে। সেদিক দিয়ে দেখলে লোকপাবন ও লোকপ্লাবন এই জগন্নাথের রথযাত্রা ভক্তের হৃদয়ে এক অনন্য স্থান লাভ করেছে।

পুরীর জগন্নাথ স্বামীই মন্দিরের বাইরে এসে প্রমাণ করেছেন, “যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন/ সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে/ সবার পিছে সবার নিচে, সবহারাদের মাঝে। “– (রবীন্দ্রনাথ)
শ্রীক্ষেত্রের এই রথযাত্রার উৎসব সেই সব উচ্চ তথাকথিত উচ্চ-নীচ ভক্তদের অনায়াস অধিকারে একাকার করে দিয়েছে এক পরম পূর্ণতায়। তাই দেখি, “রথযাত্রার লোকারণ্য মহা ধুমধাম, /ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।/ পথ ভাবে দেব রথ ভাবে আমি,/মূর্তি ভাবে আমি দেব — হাসে অন্তর্যামী। ” ভক্ত ও ভগবানের এক মিলনের ছবি।