নৈসর্গিক কথাশিল্পীর সাহিত্যচর্চা

— ‘জ্যোৎস্না আরো ফুটিয়াছে, নক্ষত্রদল জ্যোৎস্নাগুলোকে প্রায় অদৃশ্য, চারিধারে চাহিয়া মনে হয় এ সে পৃথিবী নয় এতদিন যাহাকে জানিতাম, এ স্বপ্নভূমি, এই দিগন্তব্যাপী জ্যোৎস্নায় অপার্থিব জীবেরা এখানে নামে গভীর রাত্রে, তারা তপস্যার বস্তু, কল্পনা ও স্বপ্নের বস্তু, বনের ফুল যারা ভালবাসে না, সুন্দরকে চেনে না, দিগ্বলয়রেখা যাদের কখনো হাতছানি দিয়া ডাকে নাই, তাদের কাছে এ পৃথিবী ধরা দেয় না কোনো কালেই।’

— ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যা লিখেছেন তা আমাদের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিল। বিভূতিভূষণের সৃষ্ট রচনাগুলো নিয়ে লিখতে গিয়ে তাঁর এই প্রাকৃতিক অনুভূতি আমার মননে এক গভীর শ্রদ্ধাবোধ কাজ জাগায়। আর তাই এই প্রবন্ধের প্রারম্ভিক পর্বে এই মধ্যবর্তী এবং সমাপ্তিকরণে তাঁরই উক্তি দিয়ে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি শব্দমালায় সাজানো হল।

বিভূতিভূষণ আবার এও লিখে দিলেন, — ‘এই জনহীন প্রান্তর, এই রহস্যময়ী রাত্রি, অচেনা নক্ষত্রে ভরা আকাশ, এই বিপদের আশঙ্কা – এই তো জীবন। শান্ত নিরাপদ জীবন নিরীহ কেরানীর জীবন হতে পারে – তার নয়।’

প্রকৃতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ আমাদের গভীর জীবনদৃষ্টিকেও তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনচিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও সমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে মানুষের ব্যথার কথা বলে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন। 

অসম্ভব ভাবনা। পৃথিবীর রূপে মুগ্ধতার তাঁর এই সুন্দর বহিঃপ্রকাশ যা আচ্ছন্ন করে দেয় আমাদের দেহ মন। নৈসর্গিক দুনিয়ার কথা লিখতে বিভূতিভূষণই প্রথম সাহিত্যিক যিনি এই সাহিত্যের জগতে অগ্রণী ভূমিকায় তাঁর কলমের আঁচড় দিলেন। পৃথিবীর বৈচিত্রময় রূপে আকৃষ্ট হয়ে আমাদের মনের রাঙামাটির ঘরকে তার যাদু কলমতুলির টানে নানান রঙে রাঙিয়ে দিলেন তিনিই।

নিভৃতচারী এই কথাশিল্পীর রচনায় পল্লীর জীবন ও নিসর্গ রূপায়ণে বাংলার আবহমানকালের চালচিত্র ও মানবজীবনের অন্তর্লীন সত্তা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনায় প্রকৃতি কেবল প্রকৃতিরূপেই আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রকৃতি ও মানবজীবন একীভূত হয়ে অভিনব রসমূর্তি ধারণ করেছে। সব মানুষ যে প্রকৃতিরই সন্তান এই সত্য তাঁর বিভিন্ন রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। এছাড়াও প্রকৃতির লতাপাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে স্ব স্বভাবে তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ আমাদের গভীর জীবনদৃষ্টিকেও তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনচিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও সমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে মানুষের ব্যথার কথা বলে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন।

ইংরেজি সাল ১৯২১-এ প্রবাসী পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় ‘উপেক্ষিতা’ নামে গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ভাগলপুরে কাজ করার সময় ১৯২৫ সালে তিনি ‘পথের পাঁচালী’ রচনা শুরু করেন। এ বই লেখার কাজ শেষ হয় ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে। এটি বিভূতিভূষণের প্রথম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা। সাহিত্যিক-সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় এ লেখাটি পছন্দ করে বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশ করলে লেখক বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের কাহিনিকে চলচ্চিত্রে রূপদানের মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা করেছিলেন। এ সিনেমাটির নামও ছিল ‘পথের পাঁচালী’।

উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ হল প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি বিখ্যাত সৃষ্টি। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে দুই ভাইবোন অপু আর দুর্গার বেড়ে ওঠার আর জীবনযাপন নিয়ে রচিত হয় এই বিখ্যাত উপন্যাসটি। ছোটদের জন্য তিনি যে সংস্করণটি লেখেন তার নাম ‘আম আঁটির ভেঁপু’। বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় এই পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী নির্মাণ করেন যা পৃথিবী বিখ্যাত চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

পথের পাঁচালীর বিষয়ে তিনি লিখেছেন,

–‘মা ছেলেকে স্নেহ দিয়া মানুষ করিয়া তোলে, যুগে যুগে মায়ের গৌরবগাথা তাই সকল জনমনের বার্তায় ব্যক্ত। কিন্তু শিশু যা মাকে দেয়, তাই কি কম?সে নিঃস্ব আসে বটে, কিন্তু তার মন-কাড়িয়া-লওয়া হাসি, শৈশবতারল্য, চাঁদ ছানিয়া গড়া মুখ, আধ আধ আবোল-তাবোল বকুনির দাম কে দেয়? ওই তার ঐশ্বর্য, ওরই বদলে সে সেবা নেয়, রিক্ত হাতে ভিক্ষুকের মতো নেয় না।’

— বল্লালী-বালাই, উপন্যাস – ‘পথের পাঁচালী’ ।

পথের পাঁচালীর প্রচ্ছদ

পথের পাঁচালী এক গরিব ঘরের পারিবারিক বিয়োগান্তক কাহিনি যার প্রথম প্রকাশ হল রঞ্জন প্রকাশালয়, ১৯২৯ সাল। উপন্যাসটি তিনটি খণ্ডে ও মোট পঁয়ত্রিশটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। খণ্ড তিনটি যথাক্রমে বল্লালী বালাই– যেখানে ইন্দির ঠাকরুণের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। উপন্যাসের বিভিন্ন খণ্ডে বর্ণিত ঘটনাবলীর প্রকাশ হয় এই পরিবারটির জীবনযাপনের নানান ঘটনা। আম-আঁটির ভেঁপু – যেখানে অপু-দুর্গার একসাথে বেড়ে ওঠা, চঞ্চল শৈশব, দুর্গার মৃত্যু, অপুর সপরিবারে কাশীযাত্রা চিত্রিত হয়েছে। এবং অক্রুর সংবাদ – যেখানে অপুদের কাশীজীবন, হরিহরের মৃত্যু, সর্বজয়ার কাজের জন্য কাশীত্যাগ এবং পরিশেষে নিশ্চিন্দিপুরে ফিরে আসার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

এরপর বিভূতিভূষণ ‘অপরাজিত’ উপন্যাসটি রচনা করেন, যেটি ‘পথের পাঁচালী’রই পরবর্তী অংশ। সত্যজিৎ এ উপন্যাস নিয়েও দুটি চলচ্চিত্র রচনা করেন, যা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উভয় উপন্যাসেই তার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিফলন ঘটেছে। পথের পাঁচালী উপন্যাসটি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা এবং ইংরেজি ও ফরাসি সহ বিভিন্ন পাশ্চাত্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অপরাজিত’। এটি ‘প্রবাসী’ মাসিকপত্রে ১৩৩৬ সালের পৌষ সংখ্যা থেকে ১৩৩৮-এর আশ্বিন সংখ্যা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছিলেন তার মাতাকে।

এই উপন্যাসের মূল সংলাপ, ‘জীবনকে খুব কম মানুষেই চেনে। জন্মগত ভুল সংস্কারের চোখে সবাই জীবনকে বুঝিবার চেষ্টা করে, দেখিবার চেষ্টা করে, দেখাও হয় না, বোঝাও হয় না। তাছাড়া সে চেষ্টাই বা ক’জন করে?’ — উপন্যাস ‘অপরাজিত’।

তিনি এই উপন্যাসে ‘অপরাজিত’ সাময়িকপত্রে মুদ্রণের আগে তার পরিকল্পিত নামে ‘আলোর সারথি’ রেখেছিলেন। কিন্তু ‘প্রবাসী’’তে ছাপানোর সময়েই শিরোনাম পরিবর্তন করে ‘’অপরাজিত’ রেখে দেন।

পথের পাঁচালীর সম্প্রসারণ অপরাজিত অপু-দুর্গার কাহিনি। পরে কোনও এক সময়ে অপুর সন্তান কাজলকে নিয়ে উপন্যাস রচনার ইচ্ছা তার মনে ছিল। ‘তৃণাঙ্কুর’ দিনলিপিতে তিনি লিখেছেনও সে কথা। — ‘অপুকে জন্ম থেকে ৩৪ বৎসর বয়স পর্যন্ত আমি কলমের ডগায় সৃষ্টি করেচি। তাকে ছাড়তে সত্যিকার বেদনা অনুভব করচি, তবে সে ছিল অনেকখানিই আমার নিজের সঙ্গে জড়ানো, সেইজন্যে বেশি কষ্ট হচ্ছে বিদায় দিতে কাজলকে, লীলাকে, দুর্গাকে, রাণুদি’কে। এরা সত্য সত্যই কল্পনাসৃষ্ট প্রাণী। কোনোদিকে এদের কোনো ভিত্তি নেই।’ — বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, কাজলকে নিয়ে কাহিনী সৃষ্টির পূর্বেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যান। তাঁর একমাত্র পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অপু-কাহিনীর তৃতীয় খণ্ড হিসেবে বহু পরে উপন্যাস ‘কাজল’ রচনা করেন। বিভূতিভূষণ মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে ‘কথাসাহিত্য’ পত্রিকার কাগজেই ১৩৫৭-র পৌষ সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘কাজল’ প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। এ থেকে প্রমাণ হয়, পিতার সেই অতৃপ্ত বাসনা চরিতার্থ করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রমথনাথ বিশী বলেছেন – ‘বিভূতিভূষণের বিশ্ব একটি সুবৃহৎ ও সুবিচিত্র খেলাঘর,  তাহার অধিবাসীরা সকলেই বালক-বালিকা, সেখানকার পাহাড়পর্বত অরণ্য প্রান্তর সবই খেলাঘরের মাপের।’

বিভূতিভূষণের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গল্পগ্রন্থ হল: মেঘমল্লার, মৌরীফুল, যাত্রাবদল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উপন্যাসসমূহের পাশাপাশি তাঁর ছোটগল্পগুলোও পাঠকর মহলে বিশেষভাবে সমাদৃত। সেকালের রীতিনীতি, বিচার-আচার, শিল্প-সংস্কৃতি, মানুষ ও প্রকৃতির অভিন্ন সম্পর্ক, গ্রামবাংলা, ভৌতিক রহস্য– এইসব বিষয়ের দেখা মিলবে তাঁর ছোটগল্পে।

‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ শীর্ষক এই সংকলনে স্থান পেয়েছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঠেরোটি ছোটগল্প–যেখানে রয়েছে জলসত্র, মেঘমল্লার, পুঁই মাচা, কিন্নর দল-এর মতো বিখ্যাত গল্পসমূহ। প্রতিটি গল্পই হৃদয়কে মানুষের কথা বলে। এছাড়াও এ সংকলনে স্থান পেয়েছে মৌরীফুল, ক্যানভাসার কৃষ্ণলাল, দ্রবময়ীর কাশীবাস, একটি ভ্রমণকাহিনী, ভণ্ডুলমামার বাড়ি, কনে দেখা প্রভৃতি।

‘মৌরীফুল’ গল্পে আমরা দেখি এক মৌরীফুলকে। সুশীলা নাম্নী, যার ভাগ্যের নির্মম কথা মেনে নিতে পাঠকেরও হৃদয় ব্যথিত হয়। ‘কনে দেখা’ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন প্রকৃতির অন্য এক নতুন রূপ।

লেখক প্রতিটি গল্পই লিখেছেন ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। প্রতিটি গল্পেই তিনি জীবন ও চারপাশের মানুষকে দেখিয়েছেন তাঁর চুল চেরা বিশ্লেষণে। এ যেন জীবনের অন্য এক রূপ যেখানে সূক্ষ্ণ থেকে সূক্ষ্ণতর আনন্দ-বেদনার কথাই আলোচিত হয়েছে।

তাই প্রসঙ্গত প্রমথনাথ বিশী বলেছেন – ‘বিভূতিভূষণের বিশ্ব একটি সুবৃহৎ ও সুবিচিত্র খেলাঘর,  তাহার অধিবাসীরা সকলেই বালক-বালিকা, সেখানকার পাহাড়পর্বত অরণ্য প্রান্তর সবই খেলাঘরের মাপের।’ তাঁর মতে, ‘তিনি কৈশোরের কবি, সরল, সৌন্দর্যের সন্ধানী।’

বিভূতিভূষণের লেখা ‘চাঁদের পাহাড়’ একটি অনবদ্য অভিযানমূলক কাহিনী, যার পটভূমি আফ্রিকা। ২০১৩ সালে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জী ‘চাঁদের পাহাড়’কে বাংলা চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেন। এ চলচ্চিত্রটিও বাংলা চলচ্চিত্র জগতে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করে।

চাঁদের পাহা়ড়ের প্রচ্ছদ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় শুরুতেই লিখেছেন— ‘কিন্তু মানুষের জীবনে এমন সব অদ্ভূত ঘটনা ঘটে তা উপন্যাসে ঘটাতে গেলে পাঠকরা বিশ্বাস করতে চাইবে না, হেসেই উড়িয়ে দেবে।’

চাঁদের পাহাড়-এর কাহিনি এক বাঙালি নায়ক অভিযাত্রীর ওপর ভিত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, যে ১৯০৯-১৯১০ সাল নাগাদ আফ্রিকায় কাজ করতে যায়। শঙ্কর রায় চৌধুরী, এই উপন্যাসের নায়ক, গ্র্যাজুয়েশন করার পর পাটকলে চাকরি পায়। তার এ চাকরি ভালো লাগে না কারণ সে রোমাঞ্চ খোঁজে।

অবশেষে তার গ্রামের এক অধিবাসী, যে আফ্রিকায় কাজ করে, তার সহায়তায় সে আফ্রিকায় উগান্ডা রেলওয়ে কোম্পানির ক্লার্ক হিসেবে কাজ পায় এবং উগান্ডা রেলওয়েতে চাকরি পায়। কিন্তু সেখানে মানুষখেকো সিংহের সাথে তার যুদ্ধও হয়। এছাড়্যাও এখানে তার উপর ব্ল্যাক মাম্বা সাপের আক্রমণ হয়। এখানেই সে পর্তুগিজ অভিযাত্রী ও স্বর্ণসন্ধানী ডিয়েগো আলভারেজ-এর দেখা পায়। আলভারেজ তাকে তার সময়ের ঘটনা বলে। সে এবং তার সঙ্গী জিম কার্টার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হীরক খনির সন্ধানে বেরিয়েও ফিরে আসে। ভয়ঙ্কর জন্তু বুনিপ তার সঙ্গী জিমকে মেরে ফেলে এবং আলভারেজ ফিরে আসতে বাধ্য হয়।

সব শুনে শঙ্কর ক্লার্কের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আলভারেজের সঙ্গে খনি অনুসন্ধানে বের হয়। তারা ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করে। পথে তাদের অবর্ণনীয় অসুবিধা হয়। জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি তাদের পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে আলভারেজকেও সেই বুনিপ মেরে ফেলে। শঙ্কর একা হয়ে পড়ে।

সে নিজের অজান্তেই হীরকের খনি খুঁজে পায়। সেই গুহায় সে পথ হারিয়ে ফেলে। এক পর্যায়ে কিছু পাথরের সহায়তায় সে গুহা থেকে বের হতে সক্ষম হয়। সে সঙ্গে করে কিছু পাথর নিয়ে ফিরতে পারে আসলে সেই পাথরগুলো আর কিছুই নয়, কাঁচা হীরা। ইতালীয় অভিযাত্রীক আত্তিলীয় গাত্তির নোট থেকে জানতে পারে, আসলে সে যে গুহায় পৌঁছেছিল, সেই গুহাই বিখ্যাত হীরক খনি, যার জন্য জিম ও আলভারেজ তাদের জীবন হারিয়েছে।

শঙ্কের ততক্ষণে কালাহারি মরুভূমিতে পথ হারিয়েছে। নিজের প্রাণ বাঁচানোই তখন দুষ্কর। মরুভূমিতে সে জলের অভাবে প্রায় মৃত্যুবরণ করেছিল। তার মাথার উপর শকুনেরা ঘোরাফেরা করে। পথে সিংহের সঙ্গে তার যুদ্ধ হয়। অবশেষে এক সার্ভে টিম তাকে খুঁজে পায় এবং মুমূর্ষু অবস্থায় সলসবেরি, রোডেশিয়ায় নিয়ে গিয়ে তার প্রাণ বাঁচায়। সে আবার বড় দল নিয়ে এসে এই হীরক খনির সন্ধান করবে, যার জন্য আলভারেজ, কার্টার ও আত্তিলীয় জীবন দিয়েছে– এই আশা নিয়ে শংকর বেঁচে থাকে, গল্প শেষ হয়।

‘বর্ষার দিনে এই ইছামতীর কুলেকুলে ভরা ঢলঢল রূপে সেই অজানা মহাসমুদ্রের তীরহীন অসীমতার স্বপ্ন দেখতে পায় কেউ কেউ… কত যাওয়া-আসার অতীত ইতিহাস মাখানো ঐ সব মাঠ, ঐ সব নির্জন ভিটের ঢিপি– কত লুপ্ত হয়ে যাওয়া মায়ের হাসি ওতে অদৃশ্য রেখায় আঁকা। আকাশের প্রথম তারারা তার খবর রাখে হয়তো।’

— ‘যে জিনিস যত দুষ্প্রাপ্য মানুষের মনের কাছে তাহার মূল্য অনেক বেশি। এ কথা খুবই সত্য যে, এই মূল্য মানুষের মনগড়া একটি কৃত্রিম মূল্য, প্রার্থিত জিনিসের সত্যকার উৎকর্ষ বা অপকর্ষের সঙ্গে এর কোনও সম্বন্ধ নাই। কিন্তু জগতের অধিকাংশ জিনিসের উপরই একটি কৃত্রিম মূল্য আরোপ করিয়াই তো আমরা তাকে বড় বা ছোট করি।’– উপন্যাস ‘আরণ্যক’ থেকেই উপলব্ধ।

তাঁর রচিত আরও অনেক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ আছে। তাঁর সাহিত্যকর্মের বিশাল নদী যেন বিপুল জলরাশি নিয়ে ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে প্রবলভাবে আছড়ে পড়েছে আমাদের গ্রন্থাগারে যা আজও আমাদের এই প্রজন্মের পাঠকের কাছেও অমূল্য সম্পদ হয়ে রয়ে গেছে।

তিনি জন্মেছিলেন কাঁচড়াপাড়ায়, মাতুলালয়ে সালটা ১৯২১ আর ইহজগৎ ত্যাগ করেন ১৯৫০-এ ঘাটশিলায়। এই জীবনকালে তার সৃজনশীল ক্ষমতার ঢেউ আছড়ে পড়ে সাহিত্যকুলে। ১৯৩১ সালে অপরাজিত ও মেঘমল্লার, ১৯৩২-এ মৌরীফুল, যাত্রাবদল’, ১৯৩৪ সালে, চাঁদের পাহাড়’ এল ১৯৩৭ সালে কিন্নরদল ১৯৩৮-এ, ১৯৩৯ সালে আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, মরণের ডঙ্কা বাজে ওই ১৯৪০ সালেই। স্মৃতির রেখা’ ১৯৪১, দেবযান ১৯৪৪, হীরামানিক জ্বলে ১৯৪৬, উৎকর্ণ ১৯৪৬, হে অরণ্য কথা কও ১৯৪৮ সালে। ইছামতী ১৯৫০ এবং অশনি সংকেত ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়।

সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি বিভূতিভূষণ সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৩০ সালে তিনি চিত্রলেখা নামে একটি সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাছাড়া হেমন্তকুমার গুপ্তের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি দীপক ১৯৩২ সালে একটি পত্রিকা সম্পাদনাও করেন।

উল্লেখ্য বিষয় ১৯৫০ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান, থেমে যায় তার সচল কলম। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ধারাবাহিক ভাবে লেখনীতে যে অমূল্য রচনাশৈলী উপহার দিয়ে গেলেন, যার রস আস্বাদনে আপামর পাঠক আজও তৃপ্ত এবং ধন্য।

তাঁরই সৃষ্ট ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ লাভ করেন ১৯৫১ সালে। — ‘বর্ষার দিনে এই ইছামতীর কুলেকুলে ভরা ঢলঢল রূপে সেই অজানা মহাসমুদ্রের তীরহীন অসীমতার স্বপ্ন দেখতে পায় কেউ কেউ… কত যাওয়া-আসার অতীত ইতিহাস মাখানো ঐ সব মাঠ, ঐ সব নির্জন ভিটের ঢিপি– কত লুপ্ত হয়ে যাওয়া মায়ের হাসি ওতে অদৃশ্য রেখায় আঁকা। আকাশের প্রথম তারারা তার খবর রাখে হয়তো।’

–‘এসব ভবিষতের মেয়ে, অনাগত দিনের আগমনী এদের অলক্তরাগরক্ত চরণধ্বনিতে বেজে উঠেছে, কেউ কেউ শুনতে পায়। আজ গ্রাম্য সমাজের পুঞ্জীকৃত অন্ধকারে এইসব সাহসিকা তরুণীর দল অপাংক্তেয়– প্রত্যেক চণ্ডীমণ্ডপে গ্রাম্য বৃদ্ধদের মধ্যে ওদের বিরুদ্ধে ঘোঁট চলচে, জটলা চলচে, কিন্তু ওরাই আবাহন করে আনচে সেই অনাগত দিনটিকে।’– ‘ইছামতী’ উপন্যাস প্রাসঙ্গিক উক্তি।

পরবর্তী প্রজন্মে আরও অনেক বিখ্যাত লেখক সাহিত্যিক প্রসব করেছেন আমাদের বঙ্গমাতা, আমরা ধন্য এই জন্মভূমিতে তাঁদের জন্য, অমর সেই সব লেখককূল যাদের মৃত্যু ঠিক সেই অর্থে মৃত্যু নয় যেমনভাবে নিসর্গের স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আজও আমাদের মণিকোঠায় অমর হয়ে রয়ে গেছেন।

প্রণাম স্রষ্টা, তোমায় প্রণাম। প্রণাম জানাই তোমার চিন্তায় তোমার কথায়, — ‘মানুষ কি চায়–উন্নতি, না আনন্দ?উন্নতি করিয়া কি হইবে যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে? আমি এমন কত লোকের কথা জানি, যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে, কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে। অতিরিক্ত ভোগে মনোবৃত্তির ধার ক্ষইয়া ভোঁতা– এখন আর কিছুতেই তেমন আনন্দ পায় না, জীবন তাহাদের নিকট একঘেয়ে, একরঙা, অর্থহীন। মন শান-বাঁধানো– রস ঢুকিতে পায় না।’

— ‘আরণ্যক’ উপন্যাস প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অসামান্য মূল্যায়ন আমাদের এই সামান্য কলমকে যথেষ্ট প্রবাহিত করে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই।