‘ডিভোর্স! কিছুতেই নয়৷’
কাঁপা গলায় সিদ্ধান্ত জানাল রূপম৷ সবে অষ্টমঙ্গলা পেরিয়েছে৷ উপহারের প্যাকেটগুলোও সব খোলা হয়নি৷ ফুরোয়নি আয়োজনের প্রসংসাও৷ তারই মধ্যে ডিভোর্স? আজকাল অবশ্য ডিভোর্স নিয়ে মানুষের সংকোচ অনেকটাই কম৷ পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে তাই প্রচুর ডিভোর্সি৷ আধুনিকমনস্ক মানুষ হতাশা প্রশ্রয় দেয় না, ‘লেটস ট্রাই অ্যাগেন’-এ বিশ্বাসী৷ একবার ফেলিয়োর হয়েছ তো কী? পরের বার নিশ্চয়ই ক্লিক করবে৷ কিন্তু বাবার সামনে এসব যুক্তি অচল৷ নিজের পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে টিকল না, কিছুতেই মানতে পারবেন না৷ আসলে মানতে পারবেন না যে, নিজের সিদ্ধান্তে কোনও গলদ থাকতে পারে৷ লোকের চোখে জেদি, একগুঁয়ে ঠেকলেও, রূপম জানে মানুষটার আত্মবিশ্বাস প্রবল৷ শুনলেই গুম মেরে যাবেন, আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হবেন, তারপর অসুস্থ৷ দু’বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে৷ আর ঝুঁকি নেওয়া যায়?
বিয়েটা হয়েছিল সম্বন্ধ করে, ঘটকমশাইয়ের সৌজন্যে৷ পাত্রী বারাসতের৷ পালটি ঘর৷ ঠিকুজিও রাজযোটক৷ চার হাত এক হতে দেরি হয়নি৷ বারাসত থেকে সাড়ম্বরে হাবড়ায় এসে উঠেছিল সালঙ্কারা মৃত্তিকা৷ তারপর রাজারহাটের ফ্ল্যাটে৷ ফ্ল্যাট বুকিং করেছিল বাবা-ই৷ স্কুল শিক্ষকের সামান্য মাইনেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি৷ প্রখর দূরদৃষ্টিতে বুঝেছিলেন, একসময় ছেলের কলকাতায় থাকার প্রয়োজন পড়বেই৷ তাই কষ্ট হলেও নিয়মিত মিটিয়েছেন কিস্তির টাকা৷ পড়াশুনায় রূপম বরাবরই ভাল৷ ক্লাসে ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি কখনও৷ জয়েন্টও এক চান্সেই৷ তারপর সেক্টর ফাইভে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার৷ বিয়ের আগেই ছেলের নামে ফ্ল্যাট লিখে দিয়েছিলেন বাবা৷ বেশিরভাগের মতো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আঁকড়ে থাকেননি৷ নিজের জন্য হাবড়ার বাড়িই যথেষ্ট৷ এইরকম একজন আত্মত্যাগী মানুষ যিনি সারাটা জীবন ব্যয় করলেন সন্তানের মঙ্গল কামনায়, তাকে কেমন করে বলবে ডিভোর্সের কথা? তাও বিয়ে মিটতে না মিটতেই৷
প্রথমে রূপম, মৃত্তিকা কেউই সমস্যাটা বুঝতে পারেনি৷ ফুলশয্যার রাত যেন ঘোর লাগা৷ দু’জনেরই বিপরীত লিঙ্গের প্রথম সান্নিধ্য৷ স্বপ্ন, বাস্তব মিলেমিশে একাকার৷ আদরে, কথায়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রাত কাবার৷ পরদিনও বুঝতে পারেনি৷ তারপর দিনও না৷ মনে হয়েছিল নতুন নতুন বোধহয় এরকমই হয়৷ আনকোরা অভিজ্ঞতায় অনভ্যস্ত শরীর-মনকে বোঝাপড়ার সময় দিতে হয়৷ প্রথম বুঝল মৃত্তিকা, অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি গিযে বান্ধবীদের কাছে তাদের বিবাহোত্তর অভিজ্ঞতা শুনে আশঙ্কা জাগল৷ ফিরে এসেই লজ্জা, সংকোচ ত্যাগ করে রূপমকে বাধ্য করল আপ্রাণ প্রচেষ্টায়৷ একবার নয়, বারবার৷ অবশেষে ক্লান্ত অনুনয়, ‘আমি ডিভোর্স চাই৷’
ডিভোর্সে সম্মতি না দিলেও চিকিৎসায় সম্মতি দিল রূপম৷ মেনে নিল নিজের অক্ষমতা৷ স্বাভাবিকভাবেই বাতিল হল হানিমুনের প্ল্যান৷ মৃত্তিকার মায়ের আচমকা শরীর খারাপ অজুহাতের সুবিধে করে দিল৷ রূপম একাই ফিরে এল রাজারহাটে৷ খামোখা অফিসে ছুটি নষ্ট করার কোনও মানে হয় না৷
রূপম চেষ্টা করতে চাইলে নির্দ্বিধায় সাড়া দেয়৷ অসাড় সাড়া৷ নগ্ন, শীতল দেহ এলিয়ে পড়ে থাকা৷ মৃত্তিকার নিস্পৃহভাব একসময় হিংস্র করে তুলল রূপমকে৷ কিছুতেই মানতে পারল না সামান্য এক নারীর কাছে পরাজয়ের গ্লানি৷ শুরু হল নির্যাতন৷ কখনও যৌন উৎপীড়ন৷
এই ধরনের সংকটে সাধারণত বন্ধুরাই সহায় হয়৷ কিন্তু রূপমের এমন কোনও বন্ধু নেই যার কাছে অকপট হওয়া যায়৷ রাজারহাটে ভাল করে পরিচয়ই হয়নি কারও সঙ্গে৷ স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই বহুদিন৷ হাবড়ার পাড়াতেও তেমনভাবে মেশেনি কখনও৷ স্কুল, লাইব্রেরি আর পড়ার টেবিলেই সময় কাটিয়েছে৷ বাবারও কড়া নির্দেশ ছিল পাড়ায় না মেশবার৷ সবাই নাকি অপগণ্ড, মিশলে ভবিষ্যৎ দফারফা৷ নইলে প্রায় সব পাড়াতেই একাধিক যৌন বিশেষজ্ঞ থাকে৷ রূপমদের পাড়াতেও হয়তো ছিল৷ তাদেরই কেউ না কেউ নিশ্চিতভাবে একটা উপায় বাতলাতো৷
বাবাকে বলার প্রশ্ন নেই৷ আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও তেমন ঘনিষ্ঠ কেউ নেই৷ থাকলেও নির্গাত ভ্রূ কোঁচকাতো৷ এ আবার কী উটকো ঝামেলা? ছেলেমেয়ের বিয়ে হলে ক’দিন আমোদ-আহ্লাদ করবে, তারপর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নিশ্চিন্ত ঘরকন্না৷ এভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত আটপৌরে মানসিকতা৷ সাহায্য তো মিলবেই না, অযথা উপদেশ সহানুভূতিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে৷ তাই ইন্টারনেটের সাহায্য নিল রূপম৷ অনেক খুঁজে পেতে বিদেশি ডিগ্রিধারী একজন ডাক্তার নির্বাচন করল৷ শুরু হল চিকিৎসা৷ বিস্তর টেস্ট, ওষুধের সঙ্গে সপ্তাহে দু’দিন কাউন্সেলিং৷ ফল মিলবে মাসখানেক পর৷ শাশুড়ির শরীর খারাপ সারলেও মৃত্তিকাকে ফ্ল্যাটে আনল না রূপম৷ বিষাদ প্রতিমা দেখতে কারই বা ভাল লাগে? চিকিৎসার মেয়াদ পূর্ণ হতেই আকুল আহ্বান৷ সুখী দাম্পত্য সাকার করতে মৃত্তিকাও এগিয়ে এল৷ কিন্তু বারংবার চেষ্টাতেও সুখ ধরা দিল না কিছুতেই৷ এবার অনুনয়ের সঙ্গে কান্না, ‘আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট কোরো না রূপম৷ আমাকে ছেড়ে দাও…’
হার না মনাটা বোধ হয় কিছু মানুষের জন্মসিদ্ধ৷ পাশার দানে সর্বস্ব পণ রাখতেও দ্বিধা হয় না৷ অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মৃত্তিকাকে নিরস্ত করল রূপম৷ চাইল আরও কিছু সময়৷ সাময়িক আবেগ ধ্বংসের স্পৃহা জাগালেও, ঠান্টা মাথায় স্থির পরিস্থিতি অস্থির করা সহজ কথা নয়৷ তাই রূপমের প্রস্তাবে রাজি হল মৃত্তিকা৷
এবার নতুন ডাক্তার৷ ট্রিটমেন্ট প্রসিডিওর একেবারেই আলাদা৷ টেস্ট এবং ওষুধের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই প্রয়োজন৷ দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর তাগিদে সঙ্গ দিল মৃত্তিকা৷ ডাক্তার ওষুধের সঙ্গে দিলেন সুখী দাম্পত্যরে গাইডলাইন৷ মেনে চললে অব্যর্থ ফল৷ নিষ্ঠা সহকারে মানাও হল বেশ কিছুদিন৷ তবুও দাম্পত্য সুখ অধরাই৷ এবার গর্জে উঠল মৃত্তিকা, ‘কালই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব৷’
চলে গেলেও ফিরতে হল পরদিনই৷ বাবা নিজে এসে পৌঁছে দিয়ে গেলেন৷ বাড়ি ছাড়ার কারণটা একজন অপরিণত যুবতীর পক্ষে অসামান্য হলেও, অভিজ্ঞ বাপ-মায়ের কাছে ততটা নয়৷ বাড়ির সম্মান, সমাজ, লোকলজ্জা, অনেক কিছুই ভাবতে হয়৷ এত সহজে রূপমের মতো পাত্র হাতছাড়া করাও কাজের কথা নয়৷ তা ছাড়া ডাক্তারি চিকিৎসাই তো একমাত্র উপায় নয়৷ ঈশ্বর আছেন, গুরুদেব আছেন, আছে শেকড়-কবচ-মহামূল্য রত্নও৷ পাড়ার গণশা প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিল, সেরে উঠল তো তন্ত্র-মন্ত্রের জোরেই৷ বলাইবাবুরা দশ বছর সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত ছিলেন৷ গুরুদেবের আশীর্বাদে কোল আলো করে ছেলে এল৷ তাই মেয়েকে ফেরত পাঠিয়ে মা হত্যে দিলেন ঠাকুরের থানে, গুরুদেবের আশ্রমে, জ্যোতিষদের চেম্বারে৷ মিরাকেল আজও ঘটে৷
ভয়ে বা লজ্জায় মানুষ প্রথমে পিছোতে থাকে৷ কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আক্রমণই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি৷ রূপম নিজের অক্ষমতা মেনে নিয়েছিল সাফল্যের বিশ্বাসে৷ আপাতত হেরে গেলেও, জিত সময়ের অপেক্ষামাত্র৷ কিন্তু নিরন্তর চেষ্টা করেও যখন ফল মিলল না, তখন রুখে দাঁড়াল৷ দায়ী করল মৃত্তিকাকে৷ মৃত্তিকার অসহযোগিতার জন্যই নাকি চিকিৎসার পূর্ণ ফল লাভ সম্ভব হচ্ছে না৷ মিথ্যে অনুযোগেও মৃত্তিকা নির্বিকার৷ ও-বাড়ি থেকে ফিরেই বিদ্রোহের আগুন নিভে গিযেছে৷ জানা হয়ে গিযেছে আজীবন গুমরে মরার ভবিতব্য৷ তাই রূপম চেষ্টা করতে চাইলে নির্দ্বিধায় সাড়া দেয়৷ অসাড় সাড়া৷ নগ্ন, শীতল দেহ এলিয়ে পড়ে থাকা৷ মৃত্তিকার নিস্পৃহভাব একসময় হিংস্র করে তুলল রূপমকে৷ কিছুতেই মানতে পারল না সামান্য এক নারীর কাছে পরাজয়ের গ্লানি৷শুরু হল নির্যাতন৷ কখনও যৌন উৎপীড়ন৷ দু’বাড়ির কেউ জানতেও পারল না, ভরা নদীতে চর পড়ছে৷
অত্যাচারে সাময়িক তৃপ্তি মিললেও, পরাজয়ের গ্লানি মোছে না৷ জেদ বাড়তে লাগল রূপমের৷ ইতিমধ্যে খান দশেক ডাক্তার পাল্টেছে৷ সকলেরই এক রা— স্ট্রেস, স্ট্রেন, অ্যাংজাইটি, টেনশনই মূল শত্রু৷ গুচ্ছের ওষুধ আর কাউন্সেলিংয়েই মুক্তি৷ কাউন্সেলিং তো নয়, যেন পুলিশি জেরা৷ মনটাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো ফুটবল খেলা৷ একসময় বিরক্ত হল রূপম৷ তা ছাড়া টাকা, সময় নষ্টের ফল কী হচ্ছে, তাও জানার উপায় নেই৷ মৃত্তিকার মধ্যে সুখ খোঁজা অর্থহীন৷ মরা নদীতে জোয়ার আসে না৷
কাগজে আজকাল নানারকম বন্ধুত্বের আহ্বান৷ তাদের মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নিলেই হয়তো মিলতে পারে সুখের চাবিকাঠি৷ ভরসা পেল না রূপম৷ অজানা প্রলোভনে বিপদের সম্ভাবনাও কম নয়৷ মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে স্পা, ম্যাসাজ পার্লারের নানারকম কেচ্ছা বেরোয়৷ বাড়িতে জানাজানি হলে কেলেংকারির একশেষ৷ সেদিক দিয়ে সোনাগাছি সুবিধেজনক৷ খোলা বাজারে ফেলো কড়ি মাখো তেল৷ আগে কখনও না গেলেও, জায়গাটা চেনা৷ কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েও গলির ভেতরে ঢোকেনি৷ প্ররোচনা, প্রলোভনও টলাতে পারেনি৷ পিতৃদত্ত আদর্শ, নৈতিকতা৷ কিন্তু পরিস্থিতির চাপে এবার বেপরোয়া হতেই হল৷ রোগের ভয় থাকলে, সুরক্ষাও আছে৷ দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে পা বাড়ালো সোনাগাছির দিকে৷
সোনাগাছিতে ঢুকে চোখ ধাঁধিয়ে গেল রূপমের৷ একসঙ্গে এত মেয়ে জীবনে দেখেনি৷ রাস্তায় সার দিয়ে দাঁড়ানো মেয়ের দল৷ বিভিন্ন বয়সি৷ পোশাকও হরেকরকম৷ রূপমের অনভিজ্ঞতা ধরা পড়তে দেরি হল না ওদের অভিজ্ঞ চোখে৷ শুরু হল ইশারা, ইঙ্গিত, হাত ধরে টানাটানি৷ কেউ কেউ টোন-টিটকিরিও করল৷ কুঁকড়ে গেল রূপম৷ লজ্জা, ভয় যেন একসঙ্গে চেপে ধরতে চাইল৷ ফিরে যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতেই, কে যেন কনুইয়ের পাশ দিয়ে হাত গলিয়ে দিল৷ অচেনা স্পর্শে শিউরে উঠল রূপম৷ দেখল লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ, খোলা চুলের একটি মেয়ে৷ ফর্সা মুখে লাল লিপস্টিক৷ যেন লালপরী৷ লতার মতো জড়িয়ে ধরেছে৷ রূপম কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাদুকণ্ঠে বলল, ‘চলো…’, যেন কতকালের চেনা৷
আবার ও-পাড়ায় যেতে হল রূপমকে৷ এবার হাড়কাটা৷ হাকিমসাহেবের কথা মতো নির্দিষ্ট বাড়িতে গিয়ে চপলামাসির সঙ্গে দেখা করল৷ তিনিই নিয়ে এলেন বছর কুড়ির প্রতিমাকে৷ দেখেই পছন্দ হল রূপমের ফর্সা রং, গোল মুখ, টানা চোখ, অনেকটাই যেন আসল প্রতিমা৷ সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগেই রয়েছে৷ রেটও কম, পাঁচশো৷ সানন্দে রাজি হয়ে গেল রূপম৷
মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলল রূপম৷ কোথায় যাবে, কত টাকা দিতে হবে, কিছুই জিজ্ঞাসা করার কতা মাথায় এল না৷ লালপরী নিয়ে চলল রূপকথার রাজবাড়িতে৷
ব্রিটিশ আমলের জীর্ণ বাড়ি৷ লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল দোতলায়৷ ছোট্ট একটা ঘরের তালা খুলে আলো জ্বালল মেয়েটি৷ তারপর জাদুকণ্ঠের আহ্বান, ‘ভেতরে এসো…’
নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো এগিয়ে গেল রূপম৷
‘জুতো বাইরে…জুতো বাইরে’, জাদুকণ্ঠে ঈষৎ ভাটা৷
বাইরে জুতো খুলে ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ৷
জাদুকন্ঠ উধাও হয়ে কেঠো ব্যাবসা৷
ঘোর কাটল রূপমের৷ টাকা দিতে হবে জানত, কিন্তু সে প্রসঙ্গ যে প্রথমেই আসবে জানা ছিল না৷ ভেবেছিল সুখের চাবিকাঠি হাতে ধরিয়ে তারপর টাকা চাইবে৷ কাঁপা গলায় বলল, ‘কত?’
একটু থমকাল মেয়েটি৷ আপাদমস্তক রূপমকে জরিপ করে বলল, ‘’সাতশো…’
মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করে দিল রূপম৷ টাকা গুনতে গুনতে মেয়েটি বলল, ‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন? তাড়াতাড়ি কাজ না সারলে আরও বেশি লাগবে কিন্তু…’
‘কাজ!’ অজান্তেই বলে ফেলল রূপম৷ বিষয়টা যে ‘কাজ’-এর পর্যায়ে পড়ে কল্পনার অতীত৷
‘ওরে আমার ন্যাকা চৈতন্য রে!কাজ করবে না তো কী করবে? ওসব ছবি-টবি আমি তুলতে দিই না৷ কাজ করবে তো করো, নইলে কেটে পড়ো’, আচমকাই পরী যেন রাক্ষসী৷ ঠোঁটে সদ্য চোষা রক্ত৷
দমে গেল রূপম৷ সুখের চাবিকাঠি যে এখানে মিলবে না নিশ্চিত হল৷
বেরোতে গিয়েও বাধা৷ দরজা আগলে মেয়েটি বলল, ‘আরও শ’দুয়েক দাও৷ মেজাজ খিঁচড়ে গেছে, একটু মাল না টানলে মুড আসবে না’, মুরগি যখন মিলেইছে, তখন জবাই করতে দোষ কী? পরের খদ্দের নাও জুটতে পারে৷
ন্যায্য যুক্তি মেনে আরও শ’দুয়েক খসাতেই হল রূপমকে৷
নরম মাটি পেয়ে হালকা আঁচড় কাটল মেয়েটি৷ পিঠে হাত বুলিয়ে মোলায়েম আদার, ‘পুরোপুরি হাজারই দাও…’
শরীর আর মন যেন হাত ধরাধরি করে চলে৷ শরীর খারাপ হলে মন খারাপ হয়, আবার মনের অসুখ শরীরকেও প্রভাবিত করে৷ মনের উত্তেজনা তো শরীরকে উসকে দেয়ই, শরীরও মাঝেমধ্যে মনকে উসকায়৷ রূপমের শরীর, মন কিছুতেই যেন একসঙ্গে চলতে চায় না৷ অথচ একটা সময় পর্যন্ত কিন্তু হাত ধরাধরি অটুটই থাকে৷ আগুন জ্বলে একসঙ্গেই৷ আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মনের মানুষকে৷ কখন যে আবরণ খসে যায় হুঁসও থাকে না৷ তারপরেই ছাড়াছাড়ি৷ শরীর উল্টো মুখে হাঁটা লাগায়৷ হাজার ডাকেও সাড়া মেলে না৷
কারণটা যে একেবারেই অজানা তা নয়৷ ভাবলেই লজ্জা, অনুশোচনায় কুঁকড়ে যায় মন৷ কদর্য অতীত যে মন-মস্তিষ্ককে এইভাবে ছেয়ে ফেলবে ভাবতেও পারেনি৷ তবুও অস্বীকার করতে চেয়েছে, ভুলে যেতে চেয়েছে৷ আপ্রাণ চেষ্টা করেছে মনকে বোঝাতে যে, কোনওরকম অন্যায় ঘটেনি৷ বৃথা চেষ্টা৷ তবে সেই কারণেই এই অক্ষমতা কিনা সঠিক জানা নেই৷ শুধুই অনুমান৷ কিনারায় পৌঁছে দেওয়ারই কেউ নেই৷ ডাক্তারবাবুরও নয়৷ ওঁরাও তো মানুষ৷ মানুষের কাছে মনুষ্যতের আচরণের কথা বলা যায় কখনও?
বিছানা এক থাকলেও, শোয়ার ভঙ্গি পাল্টেছে অনেকদিনই৷ দু’পাশ ফিরে দু’কোণায়৷ সারাদিনে কেজো কথা ছাড়া কথাও হয় না৷ তবুও আজকাল বউকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে রূপমের৷ সোনাগাছির অভিজ্ঞতার পরে বাইরের মেয়েমানুষে আর ভরসা নেই৷ সবাই লোভী, সুযোগসন্ধানী৷ কিন্তু বউকে কাছে পাবার উপায় আর নেই৷ মৃত্তিকা যেন ঘুমন্ত রাজকন্যা৷ রূপমের কাছে নেই জিওনকাঠি৷ তাই ফিরিয়ে নেয় প্রসারিত হাত৷ গুমরে কাটায় কালরাত্রি৷
হঠাৎই এক হাকিমের সন্ধান পেল রূপম৷ মোগল আমলে হাকিমরা নাকি অসাধ্য সাধন করত৷ অন্তত প্রস্রাবাগারের বিজ্ঞাপনে তেমনটাই দাবি করা হযেছে৷ কয়েকজনের বাস্তব অভিজ্ঞতার বিবরণও রয়েছে৷ দেশি-বিদেশি ডিগ্রির পেচনে চুটে লাভ কিছুই হয়নি, তাই মল্লিকবাজারের গলি-ঘুঁজি পেরিয়ে রূপম হাজির হল সেই হাকিমের কাছে৷ বৃদ্ধ হাকিমসাহেব মন দিয়ে সমস্যা শুনলে, তারপর ওষুধ দিলেন৷ সপ্তাহ দুয়েক পরে আবার আসতে বললেন৷
শ্বশুর-শাশুড়ি যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া৷ রূপমের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও মেয়ে-জামাই দু’জনকেই গুরুদেবের কবচ, জ্যোতিষিদের রত্ন ধারণ করিযেছেন৷ বারবার স্মরণ করিয়েছেন পেঁয়াজ, রসুন যেন কিছুতেই না খাওয়া হয়৷ তা হলে কবচের ফল মিলবে না৷ শনিবার অবশ্যই নিরামিষ৷ অগ্রাহ্য করারও উপায় নেই৷ মাজেমাঝেই উজিয়ে এসে বিরক্তিকর তদারক৷ বাবা এত কিছু জানেন না৷ তবুও রূপমরা হাবড়ায় গেলে ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা ভাল আছ তো?’
দু’সপ্তাহ ওষুধ খাবার পর আবার মল্লিকবাজারে গেল রূপম৷ হাকিমসাহেব অনেকক্ষণ নাড়ি ধরে বসে রইলেন৷ তারপর গম্ভীর মুখে জানালেন, ওষুধের কাজ শুরু হযেছে৷ তবে কতটা কাজ হয়েছে সেটা বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝতে হবে৷ ফ্যাসাদে পড়ল রূপম৷ মৃত্তিকার সঙ্গে আর এক্সপেরিমেন্ট সম্ভব নয়৷ এদিকে পরীক্ষা না করেও উপায় নেই৷ বলা যায় না, বিজ্ঞাপনের কথা হয়তো মিথ্যে নয়৷ সমাধান বাতলালেন হাকিমসাহেব৷
আবার ও-পাড়ায় যেতে হল রূপমকে৷ এবার হাড়কাটা৷ হাকিমসাহেবের কথা মতো নির্দিষ্ট বাড়িতে গিয়ে চপলামাসির সঙ্গে দেখা করল৷ তিনিই নিয়ে এলেন বছর কুড়ির প্রতিমাকে৷ দেখেই পছন্দ হল রূপমের ফর্সা রং, গোল মুখ, টানা চোখ, অনেকটাই যেন আসল প্রতিমা৷ সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগেই রয়েছে৷ রেটও কম, পাঁচশো৷ সানন্দে রাজি হয়ে গেল রূপম৷ ঠিক করল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কিছু বকশিশও দেবে৷
বেশ খাতির করেই ঘরে নিয়ে এল প্রতিমা৷ ঘর আহামরি কিছু না হলেও চলনসই৷ দুষ্টু হেসে বলল, ‘বিয়ার খাবে?’
‘আমি তো… মানে… মদ খাই না…’, বলতে যেন বাধল রূপমের৷
‘ওমা বিয়ার আবার মদ নাকি!তা হলে একটা সিগারেট দাও’, প্রতিমার আদুরে আবদার৷
‘সিগারেট মানে… আমি তো খাই না’, লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল রূপমের৷
‘তুমি তো ভাল ছেলে গো!তা এ পাড়ায় কেন? বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া?’ হাসিতে ঢলে পড়ল প্রতিমা৷
রূপম উত্তর দিল না৷ প্রতিমার ব্যবহারে প্রথম থেকেই মুগ্ধ৷ প্রতিটা কথাই হাসিমাখা, আন্তরিক৷ টাকাও চায়নি৷ মনে মনে ধন্যবাদ জানাল হাকিমসাহেবকে৷ শরীরও জেগে উঠছে৷ নিশ্চিত সাফল্যের আশায় শিহরণ জাগল৷
‘কী গো…চুপ করে রইলে যে?বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছো, না?’ প্রতিমা প্রায় মুখের কাছে৷ রূপমের ইচ্ছে করল জড়িয়ে ধরতে৷ তখনই ফোন৷ সামান্য ‘হাঁ’, ‘হুঁ’ করেই ফোন ছাড়ল প্রতিমা৷ তারপর রূপমের গাল টিপে বলল, ‘তুমি একটুখানি বোসো, আমি এক্ষুনি আসছি৷’
আপত্তি করল না রূপম৷ মানুষের দরকার থাকতেই পারে৷ তা ছাড়া মেওয়া ফলাতে গেলে একটু সবুর করতেই হয়৷ প্রতিমা দরজা ভেজিয়ে চলে গেলে বিছানায় আধশোয়া হল৷ মজে গেল সুখস্বপ্নের৷
‘ওমা… তুমি একলা যে!প্রতিমা কোথায়?’
চমকে উঠল রূপম৷ দরজায় চপলামাসি, সঙ্গে মাঝবয়েসি এক মহিলা৷ তড়াক করে উঠে দাঁড়াল৷ আমতা-আমতা করে বলল, ‘একটু বাইরে গেছে…দরকারে৷’
‘দরকার না ছাই…গেছে ওই অটোওয়ালা কানুর খাঁই মেটাতে’, ঝাঁঝিয়ে উঠল সঙ্গে মহিলাটি৷
‘তা বলে ঘরে খদ্দের বসিয়ে চলে যাবে?’,চপলা বিরক্ত৷
‘যাবে না কেন?কানু যে বিয়ের লোভ দেখাচ্ছে’, মহিলার মুখ বিকৃতি৷
‘থাক…আমায় আর শেখাস না মালতী৷মাগী পাড়ার মেয়ে নিয়ে সংসার পাতবে ওই হারামজাদা?অত ধক আছে ওর?’ গর্জে উঠল চপলা৷ জীবনে পুরুষমানুষ কিছু কম দেখল না৷
‘আমার অত জানার দরকার নেই মাসি৷ কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে৷ তোমার ঘর হবে, নাকি অন্য ঘর দেখব?’ মালতীর সাফ কথা৷
বিচলিত হল চপলা৷ বেবেছিল প্রতিমার ‘কাজ’ হয়ে গিয়েছে, মালতীকে ঘর দিতে সমস্যা হবে না৷ এখন মালতী অন্য ঘরে যাওয়া মানে সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা৷ কিন্তু এই খদ্দের হেকিমসাহেবের পাঠানো৷ অবহেলা করলে অসন্তুষ্ট হবেন৷ আগে নিয়মিতই আসতেন৷ এখন প্রয়োজন পড়লে আসেন, মেয়েদের চিকিৎসা করেন৷ ভাল মানুষটাকে চটাতে মন চাইল না৷ অথচ প্রতিমাও যে কতক্ষণে আসবে তার কোনও ঠিক নেই৷ পরিস্থিতি সামলাতে রূপমকে বলল, ‘আমি বাইরে চেয়ার দিচ্ছি, তুমি একটু বোসো বাছা৷ প্রতিমা আসুক, তারপর…’
ছিটকে বেরিয়ে এল রূপম৷ অপমানে মাথা ঝাঁঝাঁ করছে৷ হাকিমসাহেবের সুপারিশে এসেছে, তাও ঘর থেকে বের করে দিল? বললে নয় বেশি টাকাই দিত৷ সব রাগ গিয়ে পড়ল হাকিমসাহেবের ওপর৷ ফোনে যাচ্ছেতাই গালাগাল করল৷ ওখানে যে আর কখনওই যাবে না, সেটাও জানিয়ে দিল৷ রাগে গজগজ করতে করতে আনমনেই চলে এল মেডিকেল কলেজের সামনে৷ তারপর ছানাপট্টির পাশের গলিটায়৷ হঠাৎই চোখে পড়ল, ‘প্রসন্নময়ী ঔষধালয়৷ আয়ুর্বেদীয় প্রতিষ্ঠান৷ স্থাপিত ১৯২৫৷ প্রতিষ্ঠাতা: বৈদ্যনাথ কাব্যতীর্থ (যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ)’ ‘শালা…এটাও বা বাদ থাকে কেন?’ দপদপিয়ে ঢুকে পড়ল রূপম৷
কবিরাজমশাই ষাটের কোঠায়৷ ফাঁকা দোকানে পেসেন্স খেলছিলেন৷ রূপম ঢুকতেই মুচকি হাসলেন৷ বাধ্য হয়েই প্রপিতামহের নামের তলায় বন্ধনির বাক্যটা জুড়েছেন৷ এলাকায় কদর পেতে সুবিধে৷ ছেলেটি যে ওইটির জন্যই ঢুকেছে বুঝতে অসুবিধে হয়নি৷ নইলে আজকাল আর বিশেষ কেউ কবিরাজি চিকিৎসায় ভরসা রাখে না৷ ইয়ং জেনারেশন তো নয়ই৷ রূপমকে বসতে ইশারা করলেন৷ তারপর মুখে এক খিলি পান ফেলে বললেন, ‘এ পাড়ায় এলে রোগ হবেই, বুঝলেন৷ শিবের বাপেরও সাধ্যি নেই আটকায়৷ তবে আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ চিন্তা নেই৷ যত ইচ্ছে রোগ বাধান, ঠিক সারিয়ে দেব৷’
মায়ের কাছে বয়স না বাড়লেও, মহিলাদের কাপড় বদলানোর দৃশ্য যে দেখা উচিত নয়, সে জ্ঞান তখন রূপমের হয়েছে৷ তবুও সংবরণ করতে পারল না৷ হয়তো অ-দেখার কৌতূহল অথবা নিষিদ্ধের স্বাদ আহরণ৷ একসময় আনমনেই ঘুরে দাঁড়াল মা৷ সম্মোহিত রূপম ভুলে গেল চোখ বন্ধ করতে৷ প্রথমে বিস্ময় তারপর একরাশ ঘৃণা ঠিকরে উঠল মায়ের মুখে৷
‘এডস হলেও?’ গরম মাথায় হামবড়াভাব সহ্য হল না রূপমের৷ প্রশ্নটা করেই ফেলল৷
‘হয়েছে নাকি?’, চশমার ফাঁক দিয়ে কবিরাজের কৌতূহল৷
‘হয়নি…কিন্তু হলে সারাতে পারবেন?’ রূপম চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে৷
‘পরীক্ষা?…টেস্ট?’ভ্রূ কোঁচকালেন কবিরাজ৷ ‘শুনুন মশাই, আমরা পাঁচ পুরুষের কবিরাজ৷ যমেও ভয় পায় আমাদের৷’
রূপম বুঝল কথা বাড়িয়ে লাভ নেই৷ খামোখা ঝগড়া বাধবে৷ মাথা নেড়ে সায় দিল৷ খুশি হলেন কবিরাজ৷ ইশারায় পাশের চেম্বারে ডাকলেন৷ ঢুকতেই নিরুত্তাপ নির্দেশ, ‘নিন…খুলে ফেলুন৷’
‘মানে?’ ঝাঁঝিয়ে উঠল রূপম৷ প্রথম থেকেই লোকটার হাবভাব কেমন যেন গা জ্বালানো৷
‘প্যান্ট না খুললে রোগ বুঝব কী করে?’ডাক্তারের মুখে মুচকি হাসি৷ ‘শালারা মাগীদের সামনে উদোম হবে, অথচ ডাক্তারের কাছে লজ্জা!’
‘না না…ওসব রোগের ব্যাপার নয়৷ আমার অন্য সমস্যা৪, তাচ্ছিল্য ঝরাল রূপম৷ অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস অসহ্য৷
‘সমস্যাটা কী?’
বছর নয় কি দশ৷ গরমের ছুটিতে খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল৷ পড়তে পড়তেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে৷ কারও নড়াচড়ার শব্দে আচমকাই ঘুম ভাঙল৷ চোখ মেলেই সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ৷ ততক্ষণে বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে৷ খানিক বাদে চোখ খুলতেই হল৷ প্রথমে পিটপিট, তারপর ড্যাবড্যাব৷ দশ হাত তফাতেই মা কাপড় বদলাচ্ছে৷ ঘর একটাই, অন্য সময় হলে বাইরেই যেতে বলত৷ কন্তিু কচি ছেলের ঘুম ভাঙাতে বোধহয় মন চায়নি৷ মায়ের কাছে বয়স না বাড়লেও, মহিলাদের কাপড় বদলানোর দৃশ্য যে দেখা উচিত নয়, সে জ্ঞান তখন রূপমের হয়েছে৷ তবুও সংবরণ করতে পারল না৷ হয়তো অ-দেখার কৌতূহল অথবা নিষিদ্ধের স্বাদ আহরণ৷ একসময় আনমনেই ঘুরে দাঁড়াল মা৷ সম্মোহিত রূপম ভুলে গেল চোখ বন্ধ করতে৷ প্রথমে বিস্ময় তারপর একরাশ ঘৃণা ঠিকরে উঠল মায়ের মুখে৷ কোনওরকমে কাপড় সামলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ মাসখানেকের মধ্যেই গলায় দড়ি দিল মা৷ পাপ, অপরাধবোধ গ্রাস করল রূপমকে৷
আসল ঘটনাটা জেনেছিল অনেক পরে৷ মা সংসারে স্বচ্ছলতা চেয়েছিল৷ দিনরাত বাবাকে তাগাদা দিত প্রাইভেট টিউশনের জন্য৷ বাবার বন্ধুরা অনেকেই করত৷ কিন্তু বাবা নীতিগত কারণেই কিছুতেই প্রাইভেট টিউশন করবেন না৷টিভি নেই, ফ্রিজ নেই, টেলিফোন নেই, ভাল শাড়ি বা গয়নাও নেই৷ নেই-রাজ্যে কিছুতেই মানাতে পারল না মা৷ তার ওপর বাড়িটাও শেষ করলেন না বাবা৷ তার আগেই ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজারহাটে ফ্ল্যাট বুক করে বসলেন৷ ইঁটের গাঁথনির ওপর অ্যাসবেস্টসের চালে থাকতে মায়ের সম্মানে বাধত৷ রোজই ঝগড়া, অশান্তি৷ কিন্তু বাবা নিজ সিদ্ধান্তে অটল৷ ছেলেকে কিছুতেই হাবড়ার এঁদো পাড়ায় থাকতে দেবেন না৷ উচ্চশিক্ষিত করে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত করবেন৷ যদি কলকাতার বাইরেও যায়, তা হলেও তো ফ্ল্যাটটা ছেলের ইনভেস্টমেন্ট হয়ে থাকবে৷ এই সব যুক্তি মানতে মা নারাজ৷ বর্তমান ছেড়ে ভবিষ্যতের পেছনে ছোটে কোন আহম্মক? অশান্তি চরমে পৌঁছল, যেদিন বাবা, মায়ের এক আত্মীয়ের বিয়েতে সোনার গয়না দিতে অস্বীকার করলেন৷ বাবার সরল যুক্তি, নিজের ক্ষমতায় সীমাবদ্ধ থাকা৷ এদিকে সোনার গয়না না দিলে বাপের বাড়িতে মায়ের মান থাকে না৷ সেদিন রাতেই আত্মহত্যা করল মা৷
‘আপনার মা বুঝি খুব সুন্দরী ছিলেন?’
উত্তর করল না রূপম৷ স্মৃতিতে নাড়াচাড়া পড়ায় বিহ্বল৷ যে কথা আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি, আজ রাগের মাথায় কবিরাজকে উগরে দিয়েছে৷
‘আমি বলছিলাম…আপনার মা নিশ্চয়ই ফর্সা ছিলেন৷মুখশ্রী সুন্দর, ফিগার দারুণ, তাই না?চুল কি মাঝারি ছিল, নাকি বড়?’ হঠাৎ করেই কবিরাজ যেন পিঁপড়ে৷ রসের সন্ধান পেয়েছে৷ একঘেয়ে জীবনে এরকম খোরাক বড় একটা জোটে না৷
রূপমের বুঝতে অসুবিধে হয়নি কবিরাজের উদ্দেশ্য৷ তবুও আমল দিল না৷ বহু বছর বাদে মায়ের চেহারাটা ভাবতে চেষ্টা করল৷ আবছা ছেঁড়া-ছেঁড়া টুকরো মনপর্দায় ভেসে উঠলেও, সম্পূর্ণ অবয়বটা কিছুতেই গড়তে পারল না৷ নিজের জন্মদাত্রীকে ভুলে গেল! আশ্চর্য লাগল রূপমের৷ মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ঘরে কোনও ছবি রাখেনি৷ হয়তো ইচ্ছে করেই৷ কুড়ি বছরের ওপর না-দেখা একটা চেহারা ভুলে যাওয়াই তো স্বাভাবিক৷ তবে চেহারাটা মনে করতে পারলে বোধহয় ভালোই হত৷ একবার যদি মায়ের হাসিমুখের একটা ছবি দেখতে পেত, তা হলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি মিলত৷ শত চেষ্টাতেও রূপম মায়ের কোনও ছবি আঁকতে পারল না৷
কিন্তু চেহারা ভুলে গেলেও রূপম ভুলতে পারেনি ছোটবেলার সেই অবাঞ্ছিত ঘটনা৷ মায়ের আত্মহত্যার আসল কারণ জেনেও নিজেকে পুরোপুরি নির্দোষ ভাবতে পারেনি৷ কখন যে ভাবনাটা মনের গভীরে চারিয়ে গিয়েছে বুঝতেও পারেনি৷ পারল বিয়ের পর৷ মৃত্তিকা আবরিত থাকলে কোনও অসুবিধেই নেই৷ স্বাভাবিক মানুষের মতোই উত্তেজনা জাগে৷ কিন্তু আবরণহীন হলেই মনে পড়ে যায় সেই অমার্জনীয় অপরাধ৷ জাগে পাপ, অপরাধবোধ৷ চোখের সামনে তখন নিকষ কালো অন্ধকার৷ বিদ্যুৎগতিতে শরীর ধাবিত হয় সেই অন্ধকারের দিকে৷ মনের কথা মনেও পড়ে না৷
‘আপনার মা কি অভিনয়-টভিনয় করতেন?মানে ফিল্ম অ্যাকট্রেস বা…’, রসের নাগাল পেতে পিঁপড়ে মরিয়া৷
‘আমার মা খুবই কুৎসিত ছিলেন’, নিস্পৃহ গলায় বলল রূপম৷ বুড়ো ভিমরতি না থামালেই নয়৷
‘ও… আচ্ছা আচ্ছা…’, নিজেকে সামাল নিলেন কবিরাজ৷ খদ্দের চটলে লক্ষ্মীও বিরূপ হবেন৷ মোলায়েম হেসে বললেন, ‘তা…কী চান আমার কাছে?’
রূপম শেষভাগটাও বলল৷ সবটা শোনার পর কিছুক্ষণ থম মারলেন কবিরাজ৷ তারপর বললেন, ‘আপনাকে একটা ওষুধ দিচ্ছি৷ তিনদিন এক দাগ করে দু’বেলা খাবেন৷ যদি সমস্যা না মেটে ফোনে আমাকে জানাবেন৷’
সেই এক গেরো৷ বউয়ের সহযোগিতা যে পাওয়া যাবে না, স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন রূপম৷ কবিরাজ একগাল হেসে অভয় দিলেন, ‘বেশ… সে দায়িত্বও নিলাম৷’
‘ক’দিনের জন্য বারাসত যাব৷ মায়ের শরীরটা বিশেষ ভাল নয়৷ দিন চারেকের রান্না ফ্রিজে রাখা আছে, মাইক্রোতে গরম করে নিও৷’
আপত্তি করল না রূপম৷ গুমোট পরিবেশে কারই বা ভালো লাগে? রাজারহাটের মতো নির্জন জায়গায় একা একা বেরনোও ভয়ের ব্যাপার৷ সারাদিন তাই ফ্ল্যাটবন্দি হয়েই কাটাতে হয় মৃত্তিকাকে৷ আগে রেস্টুরেন্ট বা শপিং মলে গেলেও অনেকদিনই সে পার্ট চুকেছে৷ এক ছাদের তলায় থেকেও, দু’জনে যেন ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা৷
প্রথম দিন খেয়েই রূপম বুঝল ওষুধটা অন্যরকম৷ কাজ হবার সম্বাবনা আছে৷ খাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি৷ কেউ যেন শরীরময় সুড়সুড়ি দিচ্ছে, চিমটি কাটছে৷ মনও ফুরফুরে৷ দ্বিতীয়দিন আরও নিশ্চিত হল৷ তৃতীয়দিন পুরোপুরি৷ আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, তাই কবিরাজকে আর ফোন করার প্রয়োজন বোধ করল না৷ আবার কী ফ্যাসাদে পড়তে হয় কে জানে! ছুটল শ্বশুরবাড়ি৷ আচমকা আগমনে মৃত্তিকা অবাক৷ গাঁইগুঁই করলেও, শাশুড়ি জোর করে পাঠিয়ে দিলেন৷ বউ নিয়ে সোজা শপিং-মলে৷ মৃত্তিকাকে একটা দামি শাড়ি কিনে দিল রূপম৷ তারপর রেস্টুরেন্টে খাওয়া৷ অবাক হলেও প্রকাশ করল না মৃত্তিকা৷ হয়তো খুশিই হল৷ অসহায় মেয়েদের অ-সুখের মধ্যেই ক্ষণিকের সুখ খোঁজা ছাড়া উপায় কি?
ফ্ল্যাটে ঢুকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল রূপম৷ মৃত্তিকাও সাড়া দিয়ে ফেলল৷ শরীর নিজের প্রয়োজনেই নীরস মনকে সরস করে তুলল৷ সারাদিন রূপমের ব্যবহারেও অন্যরকম ইঙ্গিত৷ হযতো চিকিৎসায় ফল মিলেছে৷ তা ছাড়া মিথ্যের জোয়ারেও কি কখনও কখনও ভাসতে ইচ্ছে করে না? মরীচিকা তো মানুষই দেখে৷ মৃত্তিকাও দেখল৷ চাতকের মতো চুটে গেল তৃষ্ণা নিবারণের আশায়৷ শৃঙ্গারের চরম পর্যায়ে খসে পড়ল আবরণ৷ তারপরেই বিপত্তি৷ নির্দ্বিধায মনের সঙ্গ ত্যাগ করে শরীর ছুটল অন্ধকার পানে৷ কিছুতেই মোড় ঘোরাতে পারল না রূপম৷ মৃত্তিকা আবারও রূপান্তরিত হল পাষাণ প্রতিমায়৷
ওষুধের উত্তেজনাও অতিক্রম করতে পারল না মনের অপরাধবোধ৷ তবুও হাল ছাড়ল না রূপম৷ শরীরের অনুভূতিই বলে দিচ্ছে কাজ হবে৷ হয়তো মাত্রা একটু বাড়াতে হবে৷ কোর্স শেষ হলেও রয়ে গিযেছে বেশ খানিকটা ওষুধ৷ একসঙ্গে দু’দাগ গলায় ঢালল রূপম৷ অ্যাকশন শুরু হতেই আবার ঝাঁপাল৷ তবুও ফিরে এল অন্ধকার৷ এবার পুরো বোতালটাই শেষ করল৷ শরীর যেন আগুনের গোলা, হৃৎপিণ্ডে অশ্বের গতি৷ টলোমলো পায়ে আবারও ঝাঁপাল৷ এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না মৃত্তিকা৷ হিংস্র বাঘিনীর মতো থাবা বসাল রূপমের গালে৷ আকস্মিক আক্রমণে রূপম হতভম্ব৷ সম্বিৎ ফিরতেই বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট ছেড়ে৷
‘করেছেন কি মশাই?মারা পড়বেন যে!’
রূপমের ফোনে আঁতকে উঠলেন কবিরাজ৷ ওষুধটা নিজস্ব আবিষ্কারই বলা যায়৷ আয়ুর্বেদ, ইউনানী, অ্যালোপ্যাথির অদ্ভুত মিশ্রণ৷ নিজের ওপরেও প্রয়োগ করেছেন৷ ফল ভালই৷ বাজার চলতি ওষুধগুলোর চেয়ে তো বটেই৷ পঞ্চাশেও পঁচিশের জোশ এনে দেয়৷তাই মওকা বুঝে দামও নিয়েছেন চড়া৷ কিন্তু ছেলেটির যে কেন কাজ হল না, বুঝতে পারলেন না৷ তা ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত সেবনে কী রিঅ্যাকশন হতে পারে একেবারেই জানা নেই৷ জানার প্রয়োজনও পড়েনি কখনও৷ তবে ভাল কিছু যে হবে না, সেটা নিশ্চিত৷ ছেলেটিও যে কেন অসহযোগী বউয়ের সঙ্গে খামোখা লিপ্ত হতে গেল, ভেবে পেলেন না৷ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে মারিয়া গোমসের সঙ্গে তোফা ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন৷ অভিজ্ঞ, লাস্যময়ী, ছোকরার আড় ভাঙতে দশ মিনিটও সময় লাগত না৷ নিজেরও ফাউ জুটত৷ কিন্তু সেসব চুলোয় দিয়ে এখন প্রাণ বাঁচানোই দায়৷ ফোনে যে পরিমাণ উত্তেজনার আঁচ পেলেন, তাতে দোকানে ঝামেলা অবধারিত৷ তড়িঘড়ি ঝাঁপ বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই৷ ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম৷’
‘শালা…আটশো টাকা নিয়ে জোচ্চুরি!’
বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আস্ফালন করা ছাড়া উপায় রইল না রূপমের৷ বেগতিক বুঝে কবিরাজ ফোনও সুইচ-অফ করে দিয়েছেন৷ কবিরাজকে ধমক-ধামক, মারধর দিলে হয়তো উত্তেজনা কিছুটা কমত৷ তা না হওয়াতে দিশেহারা হয়ে পড়ল রূপম৷ শরীরময় যেন হাজারও সাপের ছোবল৷ ইচ্ছে করছে পৃথিবীটা ভেঙে-চুরে তছনছ করে ফেলতে৷ আচমকাই প্রতিমার কথা মনে পড়ল৷ ও-ই পারবে যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে৷ হন্তদন্ত হয়ে চলল চপলামাসির বাড়ি৷ কিন্তু বিধি বাম, প্রতিমা অন্য খদ্দেরে ব্যস্ত৷ অপেক্ষা করতে বললেও মানতে নারাজ রূপম৷ পাগলের মতো দরজায় লাথি, ধাক্কা সঙ্গে গালাগাল৷ বাড়িময় হইচই৷ কিচুতেই সামলানো যাচ্ছে না উন্মত্ত খদ্দেরকে৷ শেষে পাড়ার ছেলেদের ডেকে একরকম জোর করেই রূপমকে বাড়ি থেকে বের করে দিল চপলা৷
ক্রমাগত ব্যর্থতায় রূপম হতোদ্যম৷ টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সামনে৷ হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল৷ সামলালেন এক বৃদ্ধা মহিলা৷ ধমকের সুরে বললেন, ‘কী রে ছেলে, সামলাতে পারিস না তো মদ গিলিস কেন?’
মাথায় রক্ত চড়ল রূপমের৷ জীবনে কোনওদিন মদ ছুঁয়েও দেখল না, আর এই মহিলা কিনা বলছেন মদ গিলেছে? ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘কী ভুলভাল বকছেন৷ কে আপনি?’
‘আমি তোর মা রে’, অবলীলায় বললেন মহিলা৷
গায়ে কাঁটা দিল রূপমের৷ মন যেন তৈরি হয়েই ছিল৷ চুম্বকের মতো ‘’মা’ শব্দটা গেঁথে নিল৷ নিমেষে এঁকে ফেলল পূর্ণ অবয়ব৷ লালপাড় সাদা শাড়ি, মাথায় জটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, এই তো মা! কই মায়ের মুখে তো কোনও ঘেন্না নেই? বরং মিটিমিটি হাসছেন৷ তা হলে কি ক্ষমা করেছেন অবোধ সন্তানকে? অপ্রকৃতিস্থ হলেও মস্তিষ্ক যেন দ্বিধাগ্রস্ত৷ ঘোর লাগা চোখে রূপম বলল, ‘আপনি আমার… কে বললেন?’
‘মা রে মা…আমি তোর মা৷ এখন দশটা টাকা দে তো, ঘুগনি-মুড়ি খাই৷’
‘মা’ ছাড়া আর কোনও শব্দই কানে ঢুকল না রূপমের৷ মস্তিষ্কও মেনে নিল মনের কথা৷ অপলকে চেয়ে রইল মহিলার দিকে৷ মহিলার হাসি যেন পবিত্র জলের ধারা৷ পাপ, অপরাধবোধ ধুয়ে-মুছে সাফ৷
‘কী রে ছেলে…দে৷ দোকান বন্ধ হয়ে যাবে যে..’, মহিলা আন্তরিক৷ যেন নিজের ছেলের কাছেই চাইছেন৷ সম্মোহিতের মতো পঞ্চাশ টাকা দিল রূপম৷ হাসিমুখে আশীর্বাদ করলেন মহিলা, ‘স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখী হও বাবা’৷ তারপর জনারণ্যে মিলিয়ে গেলেন৷ রূপমকে দিয়ে গেলেন পরম প্রাপ্তি৷ কদর্য অতীত রূপান্তরিত হল নির্মল বর্তমানে৷
দুশ্চিন্তায় ঘুম নেই মৃত্তিকার৷ আফশোসও হচ্ছে৷ অতটা বাড়াবাড়ি না করলেও চলত৷ নিজের অক্ষমতায় তো কোনও হাত নেই রূপমের৷ বরং কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে৷ তারই মন্দ ভাগ্য যে, এইরকম একজনের সঙ্গে বিয়ে হল৷ তবে বিয়ের আগে রূপম যে সমস্যার কথা জানত না এটা নিশ্চিত৷ তবুও মাথা ঠিক রাখা মুশকিল৷ এত বড় বঞ্চনা মেনে নেওয়া বড়ই যন্ত্রণার৷ কিন্তু অপমানিত হয়ে রূপম যদি কিছু করে বসে? কী জবাব দেবে সবার কাছে? মোবাইলে ফোন করলেও ধরছে না৷ মেসেজ করলেও উত্তর আসছে না৷ অনুতপ্ত মৃত্তিকা ক্রমাগত ঘর-বারান্দা করতে লাগল৷
ভোর রাতে রূপম ফিরল৷ শান্ত, সমাহিত৷ চুপ করে সোফায় বসে রইল৷ যেন বসেই থাকবে অনন্তকাল৷ রূপমের এমন রূপ মৃত্তিকার অদেখা৷ কেমন যেন মায়া হল৷ সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার অনভ্যস্ততায় হাত রাখল রূপমের কাঁধে৷ বোঝাতে চাইল আফশোস, অনুতাপ৷ সমাহিত রূপম গ্রাহ্য করল না৷ কানে ক্রমাগত বেজেই চলেছে, ‘স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখী হও…৷’
এমন করে তো কেউ কোনওদিন বলেনি৷ বউ গায়ে হাত তুললে পৌরুষে আঘাত লাগাটা খুবই স্বাভাবিক৷ মানসিক ভারসাম্য হারালে দায়ভার কি তার উপরেই বর্তাবে না? এক ঝটকায় রূপমের মাথাটা বুকে চেপে শক্ত করে বেড় দিল মৃত্তিকা৷ তারপর আদরে আদরেই যেন ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল৷ কখন যে নিজের শরীরে মিশিয়ে নিয়েছে টেরও পেল না৷ একসময় রূপম অনুভব করল শরীর, মন নিশ্চিন্তে হাত ধরাধরি করে চলেছে৷ পাড়ি দিয়েছে অনন্ত পথ৷ অতিক্রম করেছে কৃষ্ণগহ্বর৷
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪২৬
অঙ্কন: নির্মলেন্দু মণ্ডল