জাহাজের নাম মোম্বাসা৷ ব্রিটিশ ইন্ডিয়া লাইনার৷ ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডার মধ্যে জাহাজঘাটা থেকে উঠতে হয়েছে মার্গটকে৷ মিস মার্গারেট সি. নোবল৷ ১৮৯৮৷ জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ৷
দীর্ঘ শরীর৷ স্বচ্ছ নীল চোখ৷ উজ্জ্বল আগুনরঙা চুল৷
টিনবেরি বন্দর থেকে জাহাজ চলেছে কলকাতা৷ এই জাহাজ ওকে নিয়ে যাবে এক আশ্চর্য যাত্রায়৷
কেন এমন যাত্রা? সুদূর পূব দেশের কোন আলোর দিকে ওর দৃষ্টি? কার উ্দ্দেশে যাওয়া?
এসব প্রশ্নের উত্তর মার্গটের বুকে গোপন গোলাপের সৌরভ ছড়িয়ে রেখেছে৷
জাহাজের ডেকের উপর স্থির দাঁড়িয়ে ও৷ জাহাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে৷ ব্যাগের ভেতর দস্তানা খোলা হাত দিয়ে কিছু খোঁজে মার্গট৷ ওর উষ্ণ মুঠোয় একটু পরেই উঠে আসে একটি চিঠি৷
চিঠির তারিখ ২৯ জুলাই, ১৮৯৭৷ আলমোড়া থেকে এসেছে৷ স্বামী বিবেকানন্দ লিখে পাঠিয়েছেন৷ ওর উইম্বলডনের ঠিকানায়৷ ব্রান্টউড, ওরপল রোড৷ হ্যাঁ, ইংল্যান্ডের এই বাসা ছেড়েই ও চলেছে অজানা কলকাতায়৷
ওই চিঠির কয়েকটি অক্ষর প্রাণ পেয়ে দপ্দপ্ করেছে মার্গটের হাতের তালুতে,—কথা দিচ্ছি, আমরণ তোমার পাশেই থাকব— তা তুমি ভারতবর্ষের জন্য কাজ কর আর নাই কর৷ বেদান্ত-ধর্ম ত্যাগই কর আর ধরেই থাক৷ জানো তো আমাদের দেশে একটা কথা চালু রয়েছে, ‘মরদ কি বাত হাথি কা দাঁত’৷ হাতির দাঁত যেমন বেরিয়ে পড়লে আর ঢোকে না তেমনি পুরুষের প্রতিশ্রুতির নড়চড় হয় না৷
এই কথাক’টি দীপ্র সত্য হয়ে মার্গটকে ডাক দিয়েছে ইংল্যান্ড থেকে অবিরত দরিদ্রের দেশ ভারতের পথে৷ ও সবরকমভাবে নিজেকে ভরিয়ে তুলতে চায় সেই গৈরিক সন্ন্যাসী ও তাঁর দেশকে ভালবেসে৷
(২)
প্রায় এক মাসের সমুদ্রযাত্রার শেষে জাহাজ ঢোকে গঙ্গার মোহনায়৷ জল কেটে ধীরে ধীরে এগোয় মোম্বাসা৷ এখানে ওখানে চর৷ নৌকো ভাসছে কয়েকখানা৷ ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা, শুশুক লাফিয়ে উঠছে হঠাৎ৷ একটু পরেই দেখা গেল সোনালি বালির ডাঙা৷ এবার সবুজ রং দেখা যেতে লাগল৷ মার্গট ডেকের উপর দাঁড়িয়ে উষ্ণ রোদ গায়ে মাখছে৷
দেখা গেল জনপদ৷ মনে মনে প্রণাম জানায় মার্গট ভারতবর্ষের ওই ভূমিকে৷
প্রায় একদিন লাগল ইট-কাঠ-পাথরের খাঁচায় বেড়ে ওঠা কলকাতা বন্দরে পৌঁছতে৷ চারদিকে হইচই৷ তুমুল ব্যস্ততা মানুষের৷
ভিড়ের ধাক্কায় নিজেকে সামলে মার্গট নামে৷ চোখদুটো তাকিয়ে থাকে মানুষের জটলার ওপর দিয়ে৷
ওই তো, উনি আছেন! চারপাশের সবাইকে ছাপিয়ে কত বড় লাগছে ওই মানুষটিকে৷ গেরুয়া পাগড়ি মাথায়৷ গায়ে একই রঙের আলখাল্লা চাপিয়ে স্বামীজি এসে পৌঁছলেন দৃপ্ত ভঙ্গিতে৷
মার্গটের মাথা নীচু হয়ে আসে৷ তাঁর বাদামি পেলব পায়ে এক জোড়া চপ্পল৷ মোজা পরেননি৷ প্রণাম করবে মার্গট— এতদিনের অদেখার পর এই মানুষটিকে, যাকে সর্বস্ব দিতে এসেছে তাঁর পায়ে নিজের ব্যগ্র হাত রাখবে ও৷
তার আগেই মার্গটকে অবাক করে অন্য এক সন্ন্যাসী এগিয়ে আসেন৷ সাদা জুঁই আর লাল গোলাপে গাঁথা, জরি-জড়ানো এক মালা তার গলায় পরিয়ে দেওয়া হল৷
মার্গটের গায়ে কাঁটা দেয়৷ এ মালা তো ও দেবীপ্রতিমার গলায় দেখেছে৷ আজ তাই দিয়ে ওকে বরণ করা হল! এক স্নিগ্ধ অনুভূতিতে ছেয়ে গেল ওর মন৷
পথ ছাড়, পথ ছাড়! এমনই এক ভঙ্গিতে অপরিচিত ভাষায় স্বামীজি ভিড় সরাতে সরাতে নিয়ে চললেন ওকে৷ স্বামীজির প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনে ওর পা পড়তে লাগল৷ গাড়িতে উঠলেন স্বামীজি, সঙ্গে মার্গট৷ ঘোড়ায় টানা গাড়ি৷ কাঠের খড়খড়িগুলো নামানো৷
এতক্ষণে স্বামীজি ওর সঙ্গে কথা বললেন, কেমন আছ মার্গট? তোমার মা, বন্ধুরা সবাই ভালো তো?
স্বামীজির এই কয়েকটা কথাতেই কত শান্তি পেল মার্গট যা কাউকে বোঝানো যাবে না৷
পার্ক স্ট্রিটের ৪৯ নং বাড়িতে ওকে নামিয়ে দিয়ে স্বামীজি বললেন, অনেক ধকল গেছে, জিরিয়ে নাও মার্গট৷ তবে আমি বলি, কাল থেকেই তোমার কাজ শুরু হোক৷ সবচেয়ে আগে তুমি বাংলা শিখতে থাক৷
মার্গট তো তাই চায়৷ সে তো সন্ন্যাসীর কাজের যোগ্য হতেই এসেছে৷ তাই কোনও আপত্তি না করে ও মাথা নাড়ে৷
সেদিন রাত্রে মার্গট লিখে রাখে, ২৮ জানুয়ারি ১৮৯৮৷ আজ আমি জয়ী৷
এর কিছুদিন পরেই মার্গট হয় নিবেদিতা৷ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা৷ স্বামীজির সঙ্গে শুরু হয় তীব্র টানাপোড়েনের সম্পর্ক৷ সুযোগ পেলে যা নিয়ে বলা যেতে পারে৷
(৩)
মার্গটের জীবনে বারে বারে ঘুরে ফিরে আসে স্বামীজির শেষের কয়েকটি দিনের ছবি৷ ১৯০২ সাল৷
সেদিন বুধবার, ২ জুলাই৷ প্রচণ্ড গুমোট গরম৷ মার্গটের ভেতরও কেবল দমবন্ধ ভাব৷ ওর সেদিন বেলুড় যাওয়ার কথা নয়৷ তবু কী এক টানে ও চলে আসে৷
স্বামীজি ওকে ডেকে পাঠান নিজের ঘরে৷
মার্গট, তুমি ঠিক দিনেই এসেছ৷–কেমন দেখছ আমায়?
স্বামীজি! প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে মার্গট৷ রুগ্ন শরীরে যেন এক আগুনের শিখা ক্রমাগত ওপর পানে উঠছে৷
ও বুঝতে পারে এক অসহ্য কষ্ট যেন জ্যোতির্ময় আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে৷ ওর ভেতরের নারী হাহাকার করে ওঠে৷
স্বামীজি ইঙ্গিতে ওকে পাশে বসতে বললেন৷ সাধুদের একজনকে ডেকে বলেন, মার্গটের খাওয়ার ব্যবস্থা কর৷
না, না, স্বামীজি৷ –- আজ একাদশী, আপনি উপোস করে আছেন৷ এখন এসব থাক৷
তোমায় আমি দাড়িয়ে থেকে খাওয়াব, এই আমার ইচ্ছে৷ তুমি, রাজি হবে না?
স্বামীজির গলায় এ কীসের সুর? গায়ের ত্বক কেঁপে ওঠে ওর৷ ও ঠোঁট চেপে নিজের কষ্ট চাপা দেয়৷ শুধু মাথা নেড়ে সায় জানায়৷
স্বামীজি যত্ন করে ওকে খাওয়ান৷ ভাত, আলুসেদ্ধ, কাঁঠালের বীজ সেদ্ধ৷ সামান্য ঠান্ডা দই আর অল্প একটু ফলও খায় মার্গট৷ খাওয়া শেষে উঠতে যায় ও৷
স্বামীজি ওকে হাত তুলে বারণ করেন৷ অন্যের কাছ থেকে জলের ঘটি আর তোয়ালে চেয়ে নিয়ে মার্গটের হাতে জল ঢালেন৷ তোয়ালেতে হাত মুছিয়ে দেন৷
অস্ফুট স্বরে মার্গট বলে, এ আপনি কী করলেন স্বামীজি! আমারই তো আপনাকে সেবা করার কথা৷
স্বামীজির মুখে সামান্য হাসির ঝিলিক ওঠে৷ গাঢ় স্বরে বলেন, তুমি ভুলে গেছ? যিশু তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন না!
সে তে শেষের দিন, কথাটা বলতে গিয়েও থেমে যায় মার্গট৷ আতঙ্কে ওর শরীর শিউরে ওঠে৷ ওর মনে পড়ে একটু আগেই স্বামীজি বলেছেন, আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি৷
একটা মহা তপস্যা আর ধ্যানের ভাব আমার ভেতরে ছড়িয়ে যাচ্ছে৷
সেদিন মাত্র তিন ঘণ্টা মার্গট ছিল৷ কিন্তু ওর ফিরে এসে মনে হয়েছিল ওকে নিরন্তর আশীর্বাদ করে গিয়েছেন সন্ন্যাসী৷
৫ জুলাই৷ তখনও আকাশে আলো ফোটেনি৷ মার্গট শুনতে পায় কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে৷
মার্গট সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দাঁড়ায়৷ হাতে চিরকুট নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে৷ ভাঁজকরা কাগজ খুলে দেখে স্বামী সারদানন্দ লিখেছেন, সব শেষ৷ কাল রাত ৯টায় স্বামীজি ঘুমিয়ে পড়েছেন চিরদিনের জন্য৷
মার্গটের সমস্ত অনুভূতি যেন মুহূর্তের জন্য অসাড় হয়ে পড়ে৷ চমক ভাঙে পিছনে কান্নার আওয়াজে৷ ফিরে দেখে ওর অসুস্থ কাজের মেয়ে বেট কাঁদছে৷
কিরে, তুই কাঁদছিস কেন? কিছু বুঝেছিস?
বেট মাথা নাড়ে৷
মার্গট চিঠি নিয়ে আসা ছেলেটিকে বলে, তুমি দাঁড়াও৷ আমি এখুনি আসছি৷
মঠে এসেই মার্গট ঢুকে পড়ে স্বামীজির ঘরে৷ মঠে লোক ঢুকছে কাতারে কাতারে৷ সিঁড়িতেও প্রচুর লোকের ভিড়৷
ঘরের ভেতর অন্ধকার৷ জানলার পাল্লাগুলো সব বন্ধ৷ গেরুয়া পরা স্বামীজির শরীর মেঝেতে মাদুরে শোয়ানো৷ মাথায় গেরুয়া পাগড়ি৷ হলুদ ফুলে ঢাকা তার প্রাণের দেবতা৷ মৃত নয়, যেন সুস্থ, জীবন্ত! যেন সমাধিতে থাকা মহাদেব!
মার্গট স্বামীজির মাথার পাশে বসে পড়ে৷ দু’হাতে ধরে ওঁর মাথা তুলে নেয় নিজের কোলে৷ তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করতে থাকে৷ ফিসফিস করে যেন বলে, তোমার বড় কষ্ট হচ্ছিল, তাই না! ঘুমোও এবার৷ আমি হাওয়া করে দিচ্ছি৷
মার্গট মাথা ঝুঁকিয়ে তার বড় আদরের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে৷ ওর চোখে জল নেই৷ মুখে নেই শোকের চিহ্ন৷ ওর সব দুঃখ যেন ফুরিয়ে গিয়েছে৷
বেলা প্রায় দুটো৷ মার্গট শেষবারের মতো স্বামীজিকে ছুঁয়ে দেখে৷ তারপর ওঁর মাথা নামিয়ে রাখে গোছা গোছা ফুলের ওপর৷ পায়ে ব্যথা লাগে ওঁর৷
স্বামীজির শরীর নীচে নামিয়ে পালঙ্কে শোয়ানো হয়৷ গেরুয়া চাদরের ওপর৷
মার্গট পাশে এসে দাঁড়ায়৷ চল্লিশ বছরও তো পার হয়নি৷ আজ যেন বয়স আরও কম লাগছে৷ এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন স্বামজি৷ তিনি তো সবার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন৷ এমন মানুষকেও ছেড়ে দিতে হবে? মার্গট বার বার প্রশ্ন করেন নিজেকে৷
মঠের পূর্বদিকে বেলগাছের কাছে স্বামীজির দেহ নিয়ে আসা হল৷ ওখান থেকে সামান্য দূরে গঙ্গার তীর৷ ঢালু পাড়ের পাশে চিতা সাজানো হচ্ছে৷
মার্গটের মনে পড়ল, শেষবার স্বামীজিকে ওই পেতে রাখা কাপড় পরতে দেখেছিল ও৷ এও কি আগুনে গিলে নেবে?
ওর প্রশ্ন শুনে স্বামী সদানন্দ জানায়, চাইলে ওই কাপড় ও মার্গটকে দিতে পারে৷
মার্গট রাজি হয় না৷ অশোভন মনে হয় নিজের চাওয়া৷
দেখতে দেখতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে চিতার চারপাশে৷ ওর রাজার শরীর ভস্ম হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে৷ হঠাৎ কান্নার স্রোত নেমে আসে মার্গেটের দু’চোখে৷ কাপড়ে মুখ ঢেকে কাঁপতে থাকে ও৷
সন্ধ্যা প্রায় ছ’টা৷ চিতা নিভে আসছে৷ হঠাৎ মার্গটের মনে হয়, কে যেন ওর জামার হাতা ধরে টেনে ধরল৷
মার্গট নীচের দিকে তাকায়৷ জ্বলন্ত আগুন থেকে ঝলসে যাওয়া সেই কাপড়ের এক ফালি উড়ে এসে পড়েছে৷ ও সাগ্রহে তুলে নেয়৷ ও দেখতে পায় ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে স্বামী সদানন্দ৷ তার চোখও ভেজা৷
মার্গট উঠে দাঁড়ায়৷ কে যেন ওকে ভেতর দিয়ে ডাক দিয়েছে৷ ওর জীবনদেবতার শরীর ছাই হয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ছে৷ ওকে ছড়িয়ে যেতে হবে অজস্র কাজের মাঝে৷
তিনি কথা রেখেছেন৷ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সত্যিকারের পুরুষের মতো মার্গটের পাশেই থেকেছেন৷ এবার মার্গটকে কথা রাখতে হবে৷
শনিবারের চিঠি, জানুয়ারি, ২০১৩