পিঠে খেলে পেটে সয়

পিঠে খেলে পেটে সয়

বাঙালির কাছে শীতকাল সব সময়ই স্পেশাল। কারণ শীত মানেই রঙিন পোশাক, সব্জির রঙিন পসরা, আগুন পোহানো উষ্ণতা, ভালোবাসার উষ্ণ আলিঙ্গন আর পিঠে পুলির মরসুম। আর শীতকাল যদি প্রেমের কবিতা হয়, তাহলে ছন্দ নিশ্চিতভাবেই পৌষ-মাঘ মাস। আর এর মধ্যে পৌষ সংক্রান্তির তিথিটা এলে তো আর কথাই নেই। বড়দিনের কেকের মতোই সেদিন পিঠে পুলিতে স্বাদ নেওয়াটা একটা বড় রিচ্যুয়ালের মতো।  

‘পিঠে’ শব্দটা শুনলেই বাঙালির জিভে কোথা থেকে যেন জল চলে আসে। বাঙালির প্লেটে এখন পিজ্জা এসেছে, মোমো জুটেছে, ধোকলার উদয় হয়েছে। কিন্তু আধুনিকতার মাঝেও বাঙালির প্লেটের  নস্ট্যালজিয়ার সঙ্গে ট্র্যাডিশন মেলানোর মতোই গুড়ের সঙ্গে চালের গুঁড়ো কিংবা ডাল মিশিয়ে তৈরি করে ফেলা হয় পিঠে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পেটে ও পিঠে’ হাস্যকৌতুকে তিনকড়িকে দিয়ে বলিয়েছিলেন পেটে খেলে পিঠে সয়। কিন্তু কবি যা-ই বলুন, আমরা জানি পৌষ সংক্রান্তির দিনে পিঠে খেলে পেটে সইতেই হবে। আর তা সওয়াতে স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য একটু কষ্ট করলে পিঠের পীঠস্থান হতে রোজকার হেঁসেল।

আর তাই শিখে রাখুন স্বাদে অতুলনীয় পিঠে তৈরির বেশ কয়েকটি রেসিপি।যাতে বাঙালির চিরকালীন ফেভারিট পিঠে ঠোঁটে নিয়েই বলে ফেলা যায় রোদে পিঠ-মুখে পিঠে, শীতকাল ভারী মিঠে।

ভাপা পিঠে

ভাপা পিঠে
ভাপা পিঠে

উপকরণঃ

চালের গুঁড়ো– ২ কাপ, নারকেল কোরা– ১ কাপ, ভাঙা পাটালি গুড়– ১ কাপ, ছোটো এলাচ গুঁড়ো– ১/২ চা-চামচ, নুন স্বাদমতো, পরিমাণ মতো জল।

প্রণালীঃ

প্রথমে চালের গুঁড়ো ভালো করে চেলে নিতে হবে। এবার তাতে স্বাদমতো নুন মিশিয়ে, হাত দিয়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে জল দিতে হবে। জলের পরিমাণ এমন হবে যেন চালের গুঁড়ো ভেজা অথচ ঝুরঝুরে থাকে। এরপর আবার চালের গুঁড়োটা চেলে নিতে হবে। এবার একটা পাত্রে নারকেল কোরা এবং ভাঙা পাটালি গুড় দিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করে পাক তৈরি করতে হবে। নারকেলের পুর একটু শুকনো হয়ে এলে ছোটো এলাচ গুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে। তারপর একটা পাত্রে জল গরম করতে বসিয়ে অন্যদিকে একটা ছোটো মাপের বাটিতে প্রথমে অল্প চালের গুঁড়ো দিয়ে তার ওপরে নারকেলের পুর দিতে হবে, আবার একবার ওপরে চালের গুঁড়ো দিতে হবে। এবার একটা সাদা সুতির কাপড় দিয়ে ঢাকা দিয়ে চেপে মুড়ে নিতে হবে। এবার ফুটন্ত জলের ওপর একটা ঝাঝরি থালা বসিয়ে তার ওপরে কাপড় মোড়া বাটিগুলো বসিয়ে ৫ মিনিট ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। এবার ঢাকা খুলে কাপড় থেকে বাটি বের করে উল্টে নিলেই পাওয়া যাবে হাতে গরম ভাপা পিঠে।

নকশি পিঠে

নকশি পিঠে
নকশি পিঠে

উপকরণঃ

চালের গুঁড়ো– ১ কাপ, নুন স্বাদমতো, খেজুর গুড়– ১ কাপ, সাদা তেল– ১/২ কাপ।

প্রণালীঃ

প্রথমে একটা পাত্রে খেজুর গুড় ও ১/২ কাপ জল মিশিয়ে, ভালো করে ফুটিয়ে একটা সিরা তৈরি করে রাখতে হবে। এবার কড়াইতে ১/২ কাপ জল ও স্বাদমতো নুন দিয়ে ভালো করে ফুটে উঠলে চালের গুঁড়ো ঢেলে মিশিয়ে নিয়ে, গ্যাসটা বন্ধ করে দিতে হবে।

এবার মন্ডটা একটু ঠান্ডা হলে, হাত দিয়ে ভালো করে মেখে নিতে হবে। মাখা হয়ে গেলে এর থেকে লেচি কেটে একটু মোটা করে বেলে নিয়ে, এর ওপর তেল মাখিয়ে টুথপিক দিয়ে নিজের পছন্দমতো নকশা করে নিতে হবে। এইভাবে সবগুলো পিঠে বানিয়ে নিতে হবে। এবার কড়াইতে সাদা তেল গরম করে পিঠে গুলো লাল করে ভেজে, আগে থেকে বানিয়ে রাখা গুড়ের সিরায় দিয়ে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রেখে তুলে নিলেই তৈরি হয়ে যাবে নকশি পিঠে।

পাটিসাপটা

পাটিসাপটা
পাটিসাপটা

উপকরণঃ

চালের গুঁড়ো– ২ কাপ, ময়দা– ১ কাপ, সুজি– ১/২ কাপ, দুধ পরিমাণমতো, পাটালি গুড়– ১/২ কাপ, ঘি প্রয়োজনমতো, খোয়া ক্ষীর– ১০০ গ্রাম, কোরানো নারকেল– ১ টা, কাজু-কিশমিশ– ২৫ গ্রাম, ছোটো এলাচ গুঁড়ো– ১/২ চা-চামচ।

প্রণালীঃ

প্রথমে একটা পাত্রে নারকেল কোরা, পাটালি গুড়, খোয়া ক্ষীর ও কাজু-কিশমিশ নিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করে, ছোটো এলাচ গুঁড়ো ছড়িয়ে পুর বানিয়ে প্লেটে নামিয়ে নিতে হবে। তারপর অন্য একটা পাত্রে সব উপকরণ (চালের গুঁড়ো, ময়দা, সুজি) একসঙ্গে মিশিয়ে পরিমাণমতো দুধে মেখে একটা ব্যাটার বানিয়ে ৩০ মিনিট মতো রেখে দিতে হবে। এবার গ্যাস জ্বালিয়ে প্যান বসিয়ে গরম হলে ঘি মাখিয়ে নিতে হবে। এরপর একটা গোল হাতা বা চামচ-এর সাহায্যে অল্প করে ব্যাটার নিয়ে ছোট ছোট গোল পিঠে বানিয়ে নিতে হবে। পিঠের ওপর দিকের অংশ একটু হলেই নারকেলের পুর দিয়ে পাটির মতো একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত গুটিয়ে নিতে হবে। এইভাবে সবগুলো পিঠে তৈরি করে নিতে হবে। সবগুলো পাটিসাপটা পিঠে তৈরি হয়ে গেলে সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশন করতে হবে।

গোকুল পিঠে

গোকুল পিঠে
গোকুল পিঠে

উপকরণঃ

নারকেল– ১টি (কোরানো), খোয়া ক্ষীর– ১০০ গ্রাম, নলেন গুড়– ১০০ গ্রাম, ময়দা: ১ কাপ, চালের গুঁড়ো– ১/২ কাপ, চিনি– ২ কাপ, ছোটো এলাচ গুঁড়ো অল্প, নুন স্বাদমতো, সাদা তেল প্রয়োজনমতো, জল– ২ কাপ, পেস্তা কুচি– ৮-১০ টা।

প্রণালীঃ

প্রথমে কড়াইতে নারকেল কোরা, খোয়া ক্ষীর ও নলেন গুড় দিয়ে অল্প আঁচে ভালো করে পাক দিয়ে পুর তৈরি করতে হবে। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলে সব উপকরণ একসঙ্গে ভালো করে মিশে গিয়ে একটি মণ্ড তৈরি হবে। মণ্ডটা বেশ শুকনো হয়ে এলে ছোটো এলাচ গুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। এবার একটি পাত্রে দু’কাপ চিনি আর দু’কাপ জল দিয়ে অল্প আঁচে চিনির সিরা বানিয়ে নিতে হবে। চিনি জলের সঙ্গে মিশে বেশ ঘন হয়ে এলে ছোটো এলাচ গুঁড়ো ছড়িয়ে নামিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। এরপর একটি পাত্রে ময়দা, চালের গুঁড়ো আর স্বাদমতো নুন নিয়ে অল্প জল দিয়ে গুলে নিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে মিশ্রণটা যেন বেশি পাতলা না হয়ে যায়। একটু ঘন হবে এই মিশ্রণটা। এবার নারকেলের পুরের থেকে কিছুটা করে নিয়ে ছোট ছোট গোল মণ্ড মতো করে নিতে হবে। তারপর সেই মণ্ডগুলো এক এক করে চালের গুঁড়োর মিশ্রণে ডুবিয়ে সাদা তেল গরম করে তাতে লালচে করে ভেজে তুলে নিতে হবে। তারপর ভাজা পিঠেগুলো চিনির রসে দিয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে। পিঠের ভেতরে ভালোভাবে রস ঢুকে গেলে ওপরে পেস্তা কুচি ছড়িয়ে, ছোট ছোট বাটিতে অল্প রস-সহ পরিবেশন করতে হবে গোকুল পিঠে।

রস বড়া

রস বড়া
রস বড়া

উপকরণঃ

বিউলি ডাল– ২৫০ গ্রাম, গোটা মৌরি– ১ চামচ, ছোটো এলাচ গুঁড়ো– ১/২ চামচ, পাটালি গুড় পরিমাণমতো, নুন স্বাদমতো, সাদা তেল (ভাজার জন্য) প্রয়োজনমতো।

প্রণালীঃ

আগের দিন রাত্রে বিউলি ডাল খুব ভালো করে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরদিন আরও একবার ভালোভাবে ডাল ধুয়ে স্বাদমতো নুন দিয়ে বেটে নিতে হবে। তারপর তাতে থেতো করা মৌরি মিশিয়ে খুব ভালোভাবে ফেটিয়ে নিতে হবে (একটা বাটিতে জল নিয়ে তাতে ফেটানো ডাল থেকে অল্প পরিমাণে দিয়ে দেখতে হবে, যদি সেটা ভেসে ওঠে তাহলে ফেটানো একদম ঠিক আছে)। এবার একটা পাত্রে অল্প জল, পাটালি গুড় আর ছোটো এলাচ গুঁড়ো মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে রস তৈরি করে রাখতে হবে। এরপর কড়াইতে সাদা তেল গরম করে তাতে ডালের ছোটো ছোটো বড়া ভেজে, আগে থেকে তৈরি করে রাখা গুড়ের রসে কিছুক্ষন ডুবিয়ে রাখলেই পরিবেশনের জন্য তৈরি রসে ভরা রস বড়া।

কলার পিঠে

কলার পিঠে
কলার পিঠে

উপকরণঃ

পাকা কলা– ৫-৬ টা, বাদাম গুঁড়ো– ৫০ গ্রাম, নারকেল কোরা– ১ কাপ, ঘি– ১ চামচ, চালের গুঁড়ো– ১ কাপ, খেজুরের গুড় পরিমাণমতো, নুন স্বাদমতো, সাদা তেল (ভাজার জন্য) প্রয়োজনমতো।

প্রণালীঃ

প্রথমে একটা পাত্রে অল্প জল আর খেজুরের গুড় মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে রস তৈরি করে রাখতে হবে। তারপর অন্য একটি পাত্রে পাকা কলা, স্বাদমতো নুন, বাদাম গুঁড়ো, নারকেল কোরা, ঘি ও চালের গুঁড়ো নিয়ে চটকে মেখে নিতে হবে। তারপর ওই মাখা থেকে অল্প করে নিয়ে ছোটো ছোটো বড়ার আকারে নিয়ে ডুবো তেলে ভেজে তুলে নিতে হবে। এবার ভাজা কলার পিঠেগুলো আগে থেকে তৈরি করে রাখা গুড়ের রসে ডুবিয়ে, ১০-১৫ মিনিট পর পরিবেশন করতে হবে।