বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের অগণিত সৃষ্টির মত তাঁর বিষয়ে এবং তাঁর করা বিজ্ঞাপনের সংখ্যাও অগণিত! এইচ. বসুর কুন্তলীন কেশ তেলের বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিজ্ঞাপনটিতে কবির ছবির পাশে তেলের গুণ সম্পর্কে ৬ লাইন প্রশস্তি লেখা রয়েছে আর নীচে কবির সাক্ষর। এই বিজ্ঞাপনের ওপরে এক জায়গায় লেখা আছে,  ‘কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন:-কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে নূতন কেশ হইয়াছেকুন্তলীনের গুণে মুগ্ধ হইয়াই কবি গাহিয়েছিলেন, “কেশে মাখ কুন্তলীনরুমালেতে দেলখোশপানে খাও তাম্বুলীনধন্য হোক এইচ বোস।” 

আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়েও এইচ বোস যুগান্তকারী কাজ করেছিল। ১৮৯৬-৯৭ সালের মধ্যে এই সংস্থা টমাস আলভা এডিসনের আবিষ্কার শব্দগ্রাহক যন্ত্র ফোনোগ্রাফকে কলকাতার রসিকমহলে পরিচিত করান। অন্যদিকে আবার ১৯০২-০৩ সালের মধ্যে ফরাসি প্যাথোফোন নিয়ে আসেন। অতীতের বহু সংগীতশিল্পীদের গান এবং কণ্ঠস্বর এই দুই যন্ত্রের কল্যাণে রেকর্ড করতে সক্ষম হন এইচ বোস, এই প্যাথোফোনেই রেকর্ড করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের গাওয়া বন্দেমাতরমগানটি এবং সোনার তরীকবিতাটি।  

সেই যুগের বিভিন্ন পণ্য বাজারে নিয়ে এসে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন এইচ বোস। তাদের আর একটি বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ, মতিলাল নেহেরু, লালা লাজপত রায় এবং রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ছবি এবং উক্তি ব্যবহার করা হয়। বিশেষ এই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয় ভারতবর্ষ পত্রিকার ১৩৩৮-এর কার্তিক মাসের নির্ধারিত সংখ্যায়এই পরিবারেরই কৃতী সন্তানদের মধ্যে ছিলেন চলচ্চিত্রনির্মাতা নীতিন বোস, শব্দযন্ত্রী মুকুল বোস, সংগীতশিল্পী মালতি ঘোষাল, ক্রিকেট খেলোয়াড় কার্তিক বোস। 

মিষ্টি প্রস্তুতকারক সংস্থা, এয়ারলাইন্স, জীবনবীমার কোম্পানি থেকে শুরু করে পাগলের ঔষুধ, সবখানেই কবির অনায়াস বিচরণ অবাক করে। দেশ পত্রিকার ১৩৬০-এর আশ্বিন সংখ্যায় রয়াপিলা শীর্ষক পাগলের ঔষুধ সম্পর্কে গুণগান গেয়েছিলেন বিশ্বকবি এবং বাংলার নবরূপকার ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। ডোয়ার্কিনের হারমোনিয়াম কেনার ইচ্ছাপ্রকাশ করে ১২২০ সালে হারমোনিয়াম প্রস্তুতকারক সংস্থার কর্তৃপক্ষকে ১০ নম্বর উড স্ট্রিট থেকে কবি একটি পত্র লিখেছিলেন, যেখানে তিনি হারমোনিয়ামকে ফ্লুট বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেই ফ্লুটের দামও জানতে চেয়েছেন। সেই পত্রের প্রতিলিপি সম্বলিত একটি বিজ্ঞাপনে কবির বাংলা স্বাক্ষরটি আমাদের দেখা কবির অন্যান্য স্বাক্ষরের থেকে সম্পূর্ণ সতন্ত্র। 

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত বিজ্ঞাপনের বিষয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে বিশ্বভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত একটি মজার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল, সেটি হল শান্তিনিকেতন ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড-এর শেয়ার বিক্রির উদ্দেশে আবেদন করে একটি বিজ্ঞাপনে লেখা রয়েছে, ‘রেজিস্টার্ড অফিস-পি. ৩১১, সাদার্ন এভেনিউ, কলিকাতাপরিচালক সংঘের মধ্যে নাম রয়েছে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ, রায়পুরের জমিদার সুধীরকুমার সিংহসহ আরও কয়েকজনের। 

এর আগে চায়ের বিজ্ঞাপনে কবির অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেছি, আবারও চায়ের পাতায় রবীন্দ্রনাথের গান সামনে এল। মহিলা পত্রিকার ১৩৫৯-এর আশ্বিন সংখ্যায় সেন্ট্রাল টি বোর্ড কর্তৃক প্রচারিত ঋতুচক্রের উৎসবে চায়ের ভূমিকা সম্পর্কে প্রকাশিত ৬টি বিজ্ঞাপনের একটিতে দেখতে পাই রবীন্দ্রসংগীতের কটি লাইন, ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’, সঙ্গে শরৎ প্রকৃতির ছবি। অন্য দুটি বর্ষা আর শীত সংক্রান্ত। বর্ষার বিজ্ঞাপনে লেখা বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ়আর পাতা ঝরার মরশুমে রয়েছে শীতের হাওয়ায় লাগল নাচনগান দুটি। অন্য তিনটে ঋতু বিষয়ক বিজ্ঞাপনের সন্ধান পাইনি। 

এবারে চলে যাই রবীন্দ্রনাথের যৌবনে, যখন তাঁর মাত্র ২২ বছর বয়স, তখন প্রকাশিত হয়েছিল বৌ ঠাকুরানীর হাটসন্ধ্যাসংগীতবিশ্বভারতী গ্রন্থণ বিভাগের অস্তিত্ব তো তখন ছিল না সুতরাং বই দুটি প্রকাশিত হয়েছিল ক্যানিং লাইব্রেরি থেকে। মাসিক বামাবোধিনী পত্রিকার পাতায় নব প্রকাশিত বইগুলির বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। এই একই পত্রিকার অন্য একটি সংখ্যায় কবির প্রভাতসঙ্গীতএর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, এই দুটি বিজ্ঞাপনের একটিতে বিশ্বকবিকে শ্রীযুক্ত বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে পরিচয় করানো হয়েছে, সেই সময় অবশ্য যুবক রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হননি। সন্ধ্যাসঙ্গীত প্রকাশিত হওয়ার পরে বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তিগতভাবে যুবক রবীন্দ্রনাথকে অভিনন্দিত করেন।

অতীতে যেমন তাঁর গানকে রবীন্দ্রসংগীতের বদলে বলা হত রবিবাবুর গান, ঠিক তেমনই এই বইগুলির বিজ্ঞাপনেও বাবু রবীন্দ্রনাথ হিসেবে তাঁকে সম্বোধন করা হয়েছে। কবির প্রয়াণের পরেও বিভিন্ন সংস্থা থেকে তাঁর ছবি, গান, কবিতা ইত্যাদি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। কবির নামের জোরেই যে তাদের পণ্য বিক্রি হয়ে যাবে বা যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, তা সফল হবেই, এই প্রত্যয় তাদের ছিল। 

বালক সত্যজিৎ রায়ের অটোগ্রাফ খাতায় রবীন্দ্রনাথ একটি ৮ লাইনের কবিতা লিখে দিয়েছিলেন যার প্রথম লাইনটি হল, ‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে।…রায়মশাইয়ের বয়স তখন ছিল সম্ভবত ৬ বছর। কবি বালক সত্যজিতকে বলেছিলেন, ‘এখন এই কবিতার মানে বুঝতে পারবে না, বড় হয়ে বুঝবে।এই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘কবিতাটা অনেকদিন ধরে শুধুমাত্র আমার ছিল, পরে দেখলাম সবার হয়ে গেছে।১৩৭২ সালের জলসা পত্রিকার পুজো সংখ্যায় প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিস্ট ব্যুরো-র একটি বিজ্ঞাপনে এই কবিতাটি ব্যবহার করা হয়েছিল। 

কেশ পরিচর্যার জন্য ব্যবহৃত লক্ষ্মীবিলাস তেল কোম্পানি ১৩৬০ সালের কবিপক্ষে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনে গীতাঞ্জলি’-এর প্রতি প্রণতি নিবেদন করে। সেখানে বইটির প্রচ্ছদ (সম্ভবত কাল্পনিক) আর ৬ লাইনের প্রশস্তি ছাপা হয়। চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনেও কবির বাণী এবং আশীর্বচন একাধিকবার ব্যবহার করেছে প্রযোজক সংস্থা। 

আগে লিখেছিলাম অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত কিছুক্ষনছবির বিজ্ঞাপনের কথা। সম্প্রতি আবিষ্কার করলাম কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত, ‘মহাপ্রস্থানের পথে’-এর বিজ্ঞাপনে গল্পের লেখক প্রবোধকুমার সান্যালকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির অংশবিশেষ ছবির প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছে। ছবির প্রচারে ব্যবহার করা অনেকগুলি বিজ্ঞাপনের মধ্যে একটি প্রকাশিত হয় মাসিক বসুমতী পত্রিকায়। 

রাজা রামমোহন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে একজন আদর্শ পুরুষ। কবি রাজাকে ভারতপথিকউপাধি প্রদান করেন। ১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বিজয় বসু পরিচালিত বাংলা ছায়াছবি, ‘রাজা রামমোহন’-এর প্রচারের জন্য নির্মিত বিজ্ঞাপনে রাজার প্রতি রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রশস্তি ব্যবহৃত হয়, এমনকী ছবির শেষ দৃশ্যতেও কবির লেখা, “মৃত্যু অন্তরাল ভেদি দাও তব অন্তহীন দান, যাহা কিছু জরাজীর্ণ তাহাতে জাগাও নবপ্রাণ”, এই দুটি লাইন পর্দায় ভেসে ওঠে। ছবির পোস্টার, বুকলেট এবং একটি ছোট ফোল্ডারেও একই লাইন ছাপা হয়। রামমোহনের প্রতি কবির গভীর শ্রদ্ধা ছিল। রামমোহন রায়ের প্রতি প্রণতি নিবেদন করে রবীন্দ্রনাথ কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরা আসো গানটি রচনা করেন।

দেবকীকুমার বসু পরিচালিত রবীন্দ্রনাটক, ‘চিরকুমার সভাযখন ছায়াছবি হিসেবে মুক্তি পায় তখন ছবির বিজ্ঞাপনে কবির ছবি ছাড়াও লেখা ছিল, “গগনে গগনে নব-নব দেশে রবি নব প্রাতে জাগে- নূতন জনম লভিতার নীচে লেখা কবিগুরুর জন্মদিনের স্মৃতি-পূজায় নিবেদিত দেবকীকুমারের শ্রদ্ধাঞ্জলি।এই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয় ১৩৬৩-র দেশ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায়। 

একটি ইংরেজি বিজ্ঞাপনে ‘bournvita’-র প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এটি খুব কমই চোখে পড়ে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে কবির মহাপ্রয়াণের পরে কলকাতা পুরসভা থেকে প্রকাশিত ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেট’-র বিশেষ সংখ্যায় বিজ্ঞাপনটি ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সেটাই প্রথম নয়, তার আগে প্রবাসী বা ভারতবর্ষে এই বিজ্ঞাপনটি সম্ভবত প্রকাশ পেয়েছিল। গোদরেজ সাবানের একটি বিজ্ঞাপনে তিনজন বিখ্যাত মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও ছিলেন চক্রবর্তী রাজগোপালচারী আর অ্যানি বেশান্ত। বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি সাবানের মোড়কের মধ্যেও এঁদের তিনজনের উক্তি সম্বলিত একটা কার্ডও পরিবেশন করা হয়েছিল। 

রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর সময় বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থা একাধিক পত্র-পত্রিকায় কবিকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে হরেকরকম বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিল। কোনটায় কবির প্রতিকৃতি, কোনটায় তাঁর গান বা কবিতার লাইন আবার কোনটায় বা শুধুমাত্র তাঁর জন্মশতবর্ষের উল্লেখ। 

একটিমাত্র লেখায় রবীন্দ্রনাথ এবং বিজ্ঞাপনের বিষয়টাকে সম্পূর্ণভাবে ধরা সম্ভব নয়। অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছি, আবার অন্যদিকে মনে হয় আরও অনেক খবর অজানাই রয়ে গেল। ভবিষ্যতে হয়ত বা সেইসব তথ্যও আমাদের সামনে প্রকাশিত হবে। আসলে সব শেষে যেটা মনে হয়, সেটা হল— শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে!