শিল্পবোদ্ধা রামমোহন

‘রাজা’র জন্মের সার্ধ-দ্বিশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁর রাজকীয় কর্মকান্ড ও চিন্তাভান্ড নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। কারন রামমোহন তো ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসেও ‘রাজা’। আমাদের নবজাগরণের নায়কেরা শুধুমাত্র সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংস্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তাঁরা শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও ছিলেন। যেমন রামমোহন ও দ্বারকানাথ এই দুই জুড়িঘোড়ার টানেই আধুনিক সভ্যতার রথ বাংলাদেশে প্রথম প্রবেশ করেছিল। 

রামমোহনের ভাবশিষ্য তথা তাঁর ‘দক্ষিণ হস্ত’ দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন শিল্পসংগ্রাহক, তাঁর বেলগাছিয়া ভিলা ছিল  আর্ট গ্যালারির দৃষ্টান্ত। অথচ রামমোহনের শিল্পভাবনা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে যখনই এ-বই ও-বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছি, তখনই একদিন সন্ধান পেলাম রামমোহন রায়ের লিথোচিত্রটির স্রষ্টা ফরাসি মিনিয়েচার শিল্পী জঁ জ্যাক বেলনসের সহধর্মিনী সোফি শার্লোট বেলনস- এর “Twenty four plates Illustrative of Hindoo and European Manners in Bengal” ছবির বইটার। ১৮৩০ খ্রীস্টাব্দে লন্ডন থেকে বইটি প্রকাশ করেন পর্তুগীজ জাতীয়া বেলনস। বেলনসের এই ছবির অ্যালবামটি বড়ো আকারের, দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০ ইঞ্চি, প্রস্থে ১১ ইঞ্চি। পাথরে আঁকা ২৫টি ছবির প্রতিলিপি এই বইতে আছে। ছবিগুলোর বর্ণনা ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় দেওয়া আছে। এক পৃষ্ঠায় ইংরেজি অন্য পৃষ্ঠায় ফরাসি। বেলনস ভারতীয় না হলেও তাঁর রেখায় ভারতীয় জীবনযাত্রার খুঁটিনাটি- এদেশের উৎসব, যাত্রা ও দৈনন্দিন জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ধরা আছে। ছবিগুলো বাঙালি জীবনের ছবি। বাঙালির বিবর্তন যাত্রার ইতিহাসে ছবিগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য আছে। বইখানির ইংরেজি ভূমিকায় বেলনস গৃহিণী নিজেকে ‘a native of the Country’ ‘এতদ্দেশবাসী’ অথাৎ ভারতবর্ষের অধিবাসী বলে বর্ণনা করেছেন। বইটি বিলাতের রয়াল- এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক অনুমোদিত  হয়েছিল। সোসাইটির তরফ থেকে Graves C. Haughton হটন সাহেব একখানি অনুমোদন পত্র দিয়েছিলেন। হটন সাহেবের সেই পত্রের সঙ্গে রাজা রামমোহন  রায়ের লেখা নিম্নলিখিত পত্রখানি বেলনস গৃহিণী তাঁর বইতে প্রকাশ করেছিলেন। 

শিল্পী বেলনস রামমোহন রায়কে মুখোমুখি বসিয়ে তাঁর প্রতিকৃতিটি আঁকেন। রামমোহন রায়ের লিথো-প্রতিকৃতিটিতে শিল্পী বেলনস তাঁর চরিত্রের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ‘রেনেসাঁস বিষণ্ণতা’ খুব  সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

রামমোহন তখন লন্ডনের ৪৮ বেডফোর্ড স্কোয়ার-এ ডেভিড হেয়ার-এর ভাইদের কাছে থাকতেন। সেখান থেকে ১৮৩২ সালের ৫ ই মার্চ রামমোহন মিসেস বেলনস কে লিখছেন- “I have with great pleasure looked over your drawings, and read your descriptions of them, and I now have the satisfaction to inform you, that they are true representations of nature, so much that they have served to bring to my recollection, the real scenes alluded to of that unhappy country. 

The drawings are so expressive in themselves, that the descriptions, however excellent, are scarcely necessary to any acquainted with India. 

I have retained the copy handed over to me, and wishing you every success in your present undertaking.”

উপরোক্ত  চিঠি  পড়ে রামমোহনের শিল্পসচেতন মনের পরিচয়  পাওয়া  যায়, শত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি তাঁর শিল্পী সত্তাকে উপবাসী রাখেননি, তার প্রমাণ এই চিঠি। রামমোহন  যে ‘অসুখী’ পরাধীন ভারতবর্ষের প্রজা ছিলেন সেই দেশের প্রাকৃতিক বর্ণনা বেলনসের তুলিতে কতটা জীবন্ত হয়ে উঠেছিল তা বোঝা যায় রামমোহনের লেখায়।

এবার  আমরা রামমোহনের প্রতিকৃতি ও প্রতিমূর্তি তে রামমোহনের শিল্পচেতনা খোঁজার চেষ্টা করব। রামমোহনের জন্মের সার্ধ-দ্বিশতবর্ষে  রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম যে ‘রামমোহন ২৫০ স্মারকগ্রন্থ’ প্রকাশ করেছে সেখানে রামমোহনের সর্বমোট ২২ টি প্রতিকৃতি বিস্তারিত বিবরণসহ তুলে ধরা হয়েছে। 

ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল মিউজিয়াম এন্ড আর্ট গ্যালারিতে রক্ষিত এই প্রতিকৃতি সম্পর্কে  রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম থেকে প্রকাশিত ‘রামমোহন ২৫০’ স্মারক গ্রন্থে লেখা  হয়েছে- “রামমোহন  রায়ের  প্রয়াণের পর প্রকাশিত এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রামমোহন  রায় তাঁর এই প্রতিকৃতিটি পচ্ছন্দ করেননি। সম্ভবত ছবিতে তাঁর গাত্রবর্ণ তাঁকে খুশি করতে পারেনি, তিনি এ বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর  ছিলেন।”

২২ টি প্রতিকৃতির মধ্যে ৪ টি প্রতিকৃতিতে রামমোহনের সাক্ষর আছে। ২২টি   প্রতিকৃতির মধ্যে ৪ টি প্রতিকৃতির জন্য শিল্পী বরাত পেয়েছিলেন, না নিজের আগ্রহেই এঁকেছিলেন তা বলা শক্ত। কারন তা স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই। তবে একথা নিশ্চিত সেই সময়ে প্রতিকৃতির নিচে সাক্ষর প্রমাণ করে, যাঁর প্রতিকৃতি আঁকা হচ্ছে তাঁর সম্মতিতে যে আঁকা হত এবং তিনি যে সিটিং দিয়েছিলেন। মানে, কল্পিত চিত্র যে নয় তা সুস্পষ্ট। রামমোহনের এতে পূর্ণ সম্মতি ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রামমোহন তাঁর প্রতিকৃতি দেখে নিশ্চিত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন তাই সম্মতি দিয়েছিলেন। 

রামমোহনের সম্মতি দেখে ধরা যেতেই পারে প্রতিকৃতি আঁকানো তাঁর পছন্দের বিষয় ছিল। ইংরেজ শিল্পী হেনরি পেরোনেট ব্রিগস এর আঁকা রামমোহনের তৈলচিত্রটি রামমোহন রায়ের একমাত্র পূর্ণাবয়ব প্রতিকৃতি হিসেবে ধরা হয়, যে প্রতিকৃতিতে দেখা যায় রামমোহন বই হাতে দাঁড়িয়ে  আছেন। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল মিউজিয়াম এন্ড আর্ট গ্যালারিতে রক্ষিত এই প্রতিকৃতি সম্পর্কে  রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম থেকে প্রকাশিত ‘রামমোহন ২৫০’ স্মারক গ্রন্থে লেখা  হয়েছে- “রামমোহন  রায়ের  প্রয়াণের পর প্রকাশিত এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রামমোহন  রায় তাঁর এই প্রতিকৃতিটি পচ্ছন্দ করেননি। সম্ভবত ছবিতে তাঁর গাত্রবর্ণ তাঁকে খুশি করতে পারেনি, তিনি এ বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর  ছিলেন।” 

এই কথার প্রাথমিক উৎস হিসেবে ১৮৩৩ সালে  The Asiatic Journal and Monthly Register-এর New Series, Vol.XII . No.47( September-December 1833 ) সংখ্যার পাদটীকার উল্লেখ  করা হয়েছে- “The best portrait of him extant  is a full-sized one by Briggs. It is good picture as well as an admirable likeness; but the deceased always felt an accountable aversion to it. Perhaps it did not flatter him sufficiently in respect to complexion, a point on which he was very sensitive.” 

এই উক্তি রামমোহনের শিল্প সত্তার পরিচয় বহন করে। রামমোহন কেবলমাত্র ফরমায়েশ করে তাঁর  ছবি আঁকতে শিল্পীকে বরাত দেননি, ছবির প্রতিটি বৈশিষ্ট্য তাঁর শৈল্পিক চোখ এড়ায়নি। তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ  করে, নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন। ছবি শুধুমাত্র ব্যক্তির হয় না, সমসাময়িক মুহূর্তকথাও ছবিতে ধরা থাকে। রামমোহন রায়ের জীবন- প্রেক্ষাপটে ‘কর্নেল ব্রেরেটনের বিচার’ ছবিটি তেমনই এক ঐতিহাসিক  ছবি। শিল্পী রোলিন্ডা শার্পলস কর্নেল এর আঁকা ব্রেরেটনের বিচারের দৃশ্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- ‘১৮৩১ সালে ব্রিস্টলে রিফর্ম বিল নিয়ে যে দাঙ্গা হয়, সেটি রোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কর্নেল ব্রেরেটনের বিচার শুরু হয় ৯ই জানুয়ারি ১৮৩২ সালে ব্রিস্টলের মার্চেন্ট হলে। বিচারের  কার্যধারা চারটি বৈঠকের পর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়, এক আসামীর আত্মহত্যার কারনে। বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি সেই বিখ্যাত বিচার শুনতে মার্চেন্ট হলে উপস্থিত ছিলেন। রামমোহন রায়ও ছিলেন। ইংল্যান্ডের রিফর্ম বিল নিয়ে চরম আগ্রহী ও কৌতূহলী রামমোহন রায়ের ছবিটি তাঁর আগ্রহ ও কৌতূহলের উজ্জ্বল সাক্ষর। 

শিল্পী বেলনস রামমোহন রায়কে মুখোমুখি বসিয়ে তাঁর প্রতিকৃতিটি আঁকেন। রামমোহন রায়ের লিথো-প্রতিকৃতিটিতে শিল্পী বেলনস তাঁর চরিত্রের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য ‘রেনেসাঁস বিষণ্ণতা’ খুব  সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বেলনসের এই প্রতিকৃতি অঙ্কনে রামমোহনের পূর্ণ সমর্থন ছিল। কারণ, ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি রামমোহন চিঠিতে বেলনসের সহধর্মিণীর শিল্পসত্তার ভূয়সী প্রশংসা  করেছেন। ভারতীয় রেনেসাঁসের জনক বেলনসের ‘রেনেসাঁস বিষণ্ণতা’য় অমর হয়ে রইলেন।

রামমোহনের শিল্প ভাবনা নিয়ে কোনও কাজ চোখে পড়ে না, কারণ, উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের  অভাব। অথচ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে তাঁর পত্র বিনিময় হত। উদাহরণ  হিসেবে শিল্পী বেলনসের মতো আমেরিকার প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রেমব্রান্ট পিল এর কথা বলা যায়। এই বিষয়ে  রামমোহনের লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্র বা নানা আর্কাইভে রাখা কাগজপত্রের যদি সুলুকসন্ধান করা যায় তবে বোধহয় এই বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কাজ করা সম্ভব।

প্রতিমূর্তি বিষয়ে  রামমোহনের মনোভাব প্রসঙ্গে শিল্প-ইতিহাসবেত্তা উইলসন বলেছেন- ‘Rammohan Roy had a dislike of portraits and personal adulation.’ তবুও আমরা দেখেছি রামমোহন সম্মত হয়েছিলেন। উইলসন বলেছেন, রামমোহন  ‘agreed to sit to the sculptor as a favour to Basil Montagu, whose own bust had earlier been carved by Clarke. Montague was a friend of Rammohan Roy, and held literary soirees at his house in Bedford Square, very near to the  house of the Hare bothers at which Rammohan Roy lived while in London.” রামমোহন রায়ের  জীবিতকালে তাঁর একটি মার্বেল পাথরের আবক্ষ মূর্তি তৈরি করেছিলেন ইংরেজ ভাস্কর জর্জ ক্লার্ক। কিন্তু সেই আবক্ষ মূর্তি পাওয়া যায়নি। তবে জর্জ ক্লার্ক কৃত  সেই আবক্ষ মূর্তি সম্পর্কে রামমোহনের মনোভাব জানা যায় উইলসন যখন বলেন- ‘Rammohan Roy had a dislike of portraits and personal  adulation–.’  কিন্তু  উইলসনের বক্তব্যের পরের অংশটি গুরুত্বপূর্ণ- Rammohan Roy had his features immortalised by one of the greatest artists of the day, George Clarke, and therefore Cheverton’s exact replica in ivory of Clarke’s missing bust is very significant in the iconography of Rammohan Roy. বোঝা যাচ্ছে ছবির মত ভাস্কর্যেও রামমোহনের আগ্রহ ছিল এবং শিল্পের এই দুই শাখার বিষয়ে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। ইতালীর নবজাগরণের নায়কদের মত আমাদের জাগরণের পথিকৃৎ রামমোহন ও শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।

সমাজ সংস্কার, ধর্ম, শিক্ষা, রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক আন্দোলনে রামমোহনের অগ্রণী ভূমিকার কথা বহুচর্চিত। রেনেসাঁসে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ভূমিকা অনস্বীকার্য। নবজাগরণের  নায়কেরা সকলেই যে চিত্রকলা বা ভাস্কর্যে তাঁদের সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছিলেন তা কিন্তু নয়, নীরবে, পর্দার পিছনে থেকে তাঁরা শিল্পীদের উৎসাহ দিয়ে, সাহায্য করে পৃষ্ঠপোষকতার কাজ করেছিলেন। 

রামমোহনের চাইতে বাইশ বছরের ছোট দ্বারকানাথ ঠাকুরের এই ভূমিকার কথা বহু আলোচিত না হলেও তথ্য প্রমাণের অভাব নেই যে তিনি শিল্প সংগ্রাহক ছিলেন, বিখ্যাত শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে নিয়েছিলেন, নিজের মত তাঁর গুরু রামমোহনের মূর্তিও তৈরি করিয়েছেন বিদেশী শিল্পীকে দিয়ে। রামমোহনের শিল্প ভাবনা নিয়ে কোনও কাজ চোখে পড়ে না, কারণ, উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের  অভাব। অথচ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে তাঁর পত্র বিনিময় হত। উদাহরণ  হিসেবে শিল্পী বেলনসের মতো আমেরিকার প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রেমব্রান্ট পিল এর কথা বলা যায়। এই বিষয়ে  রামমোহনের লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্র বা নানা আর্কাইভে রাখা কাগজপত্রের যদি সুলুকসন্ধান করা যায় তবে বোধহয় এই বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কাজ করা সম্ভব।

তথ্যঋণ- ‘বাঙ্গালীর সংস্কৃতি’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘রামমোহন ২৫০ স্মারকগ্রন্থ’- রামমোহন লাইব্রেরি অ্যান্ড ফ্রি রিডিং রুম।

রামমোহন রায়ের ২৫৪ তম জন্মদিবস উপলক্ষে  ‘শনিবারের চিঠি’র শ্রদ্ধার্ঘ্য এই প্রবন্ধটি