রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ (পর্ব – ১১, ১২)

অক্টারলোনি ও দ্বারকানাথ

দ্বারকানাথ হৃদয়ের দিক দিয়েও ‘প্রিন্স’ ছিলেন। দেশী- বিদেশী, সরকারী ও বেসরকারী কর্মচারীকে যে তিনি কত টাকা দিয়ে বা অন্য উপায়ে সাহায্য করেছেন বা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে তাঁর ঔদার্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তার হিসেব পাওয়া মুশকিল। দ্বারকানাথের প্রথম জীবনীকার কিশোরীচাঁদ মিত্র জাতি-ধর্ম-বর্ণ বৈষম্যের বেড়া ডিঙিয়ে সকলের প্রতি দ্বারকানাথের দয়া-দাক্ষিণ্যের একাধিক উদাহরণ দিয়েছেন। অক্টারলোনি নামে তরুণ সামরিক অফিসারের বাগদত্তাকে এদেশে নিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট অর্থ না থাকায় দ্বারকানাথের কাছে অর্থ সাহায্য চাওয়া এবং তৎক্ষনাৎ তার প্রার্থনা পূর্ণ হওয়ার গল্প এমনই দ্বারকানাথের পারিবারিক মহলে প্রচলিত একটি গল্প।

গল্পের শুরুর আগে গল্পের নায়ক অক্টারলোনির পরিচয় দেওয়াটা জরুরি। অক্টারলোনির নামে কলকাতা গড়ের মাঠে অক্টারলোনি মনুমেন্ট(বর্তমানে যার নাম শহীদ মিনার)৩৫০০০ টাকা খরচ করে স্থাপিত হয়েছে। অক্টারলোনি হায়দার আলীর সময় থেকে কোম্পানি বাহাদুরের যোদ্ধারূপে প্রতিটি বড় বড় যুদ্ধে নেমেছিলেন। সদ্বংশের এই তরুণ মিলিটারি অফিসারটি সদ্য বিলেত থেকে এসে কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত এবং সারাক্ষণ মদে বুঁদ হয়ে থাকে, কাজে কোন তৎপরতা নেই। অক্টারলোনির অফিসার বন্ধুরা বিষয়টা লক্ষ্ করে তরুণ বন্ধুটির মনোবেদনার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তখন অক্টারলোনি খোলসা করে তাঁর দুঃখের কারণ বলেন।

অক্টারলোনি বিলাতে একটি মেয়েকে ভালোবাসত। সে ভেবেছিল এদেশে এসে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে এবং সে মেয়েটিকে বিয়ে করবে। ভারতবর্ষে এসে তাঁর মোহভঙ্গ হয়; সরেজমিনে সবকিছু দেখে তাঁর মনে হয়েছে সেই আশা দুরাশা মাত্র। তাই মনের দুঃখ ভোলার জন্য সে মদে ডুবে থাকে। অক্টারলোনি ও তাঁর বাগদত্তার করুণ কাহিনি শুনে তাঁর বন্ধু হিতৈষীরা কিছুটা সমবেদনায়, কিছুটা পরিহাস রসিকতায় বলেন কলিকাতা শহরে ঈপ্সিত সৌভাগ্য লাভ করতে হলে দুটো রাস্তার কথা আছে। প্রথমতঃ কালীঘাটে মানত করতে-যেখানে মহামান্য কোম্পানিরও পূজা চড়ে। দ্বিতীয়তঃ দ্বিতীয় দলের বক্তব্য হল এই কালোদেশের দেবদেবীর শরণাপন্ন না হয়ে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে গিয়ে চোগা-চাপকানে সুসজ্জিত নরদেবতা দ্বারকানাথ ঠাকুরের শরণ নেওয়া।

অক্টারলোনি তখন সবে কলকাতায় এসেছে রসিকতাটা বুঝতে না পেরে বলেনঃ ‘বেশ ত, দু’জায়গাতেই মানত করা যাক। মন্দির দুটি কোথায় বাৎলে দাও।’ বন্ধুটি বলে ‘ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের ডিরেক্টরের ঘরে।’ তখন রসিকতা বুঝতে পেরে অক্টারলোনি আক্ষেপ করলেন আমার কাছে যেটা জীবন মরণ প্রশ্ন, আপনাদের কাছে সেটা হাসির বিষয়। কিন্তু তাঁর বাগদত্তার কথা ভেবে তিনি ভাবলেন শেষ চেষ্টা করতে দোষ কী, ডুবন্ত মানুষ খড়কুটোকে ধরে বাঁচাতে চায়, শেষ দেখা যাক না। একথা ভেবে তিনি একদিন সত্যি সত্যি গিয়ে হাজির হলেন ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের দোতলায় দ্বারকানাথের ঘরের সামনে।

ডিরেক্টরের দফতরে গিয়ে অক্টারলোনি দেখলেন দ্বারকানাথ বেঞ্চিতে বসে ‘হরকরা’ কাগজ পড়ছেন। প্রসঙ্গত গদি-আঁটা কুর্সির চেয়ে হাতাহীন বেঞ্চি ছিল দ্বারকানাথের বেশি পছন্দ। তাতে বসে তিনি কাজ করতেন আর ভাবনার কোন বিষয় উপস্থিত হলে গোঁফে তা দিতেন। গোঁফের উপর হাত বুলিয়ে ডগাটাকে পাকিয়ে নেওয়া- এ ছিল তাঁর মুদ্রাদোষ। এ নিয়ে প্রচলিত ছিল- ‘দ্বারকানাথের গোঁফের এক মোড়া, লাখ টাকার তোড়া।’ সাহেবকে দেখে কাগজ নামিয়ে দ্বারকানাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাকে ত’ চিনতে পারছি না।আপনি কে এবং কী চান?’ সাহেব তার পরিচয় দিয়ে ইতস্তত করার পর সমস্ত কাহিনি দ্বারকানাথকে বললেন। মানবচরিত্র ভালো করে বুঝতে পারতেন দ্বারকানাথ, অক্টারলোনিকে স্টাডি করতে দ্বারকানাথকে বেগ পেতে হয়নি। দ্বারকানাথ সবটা শুনে ‘হরকরা’ -এর ধারের সাদা অংশ খানিকটা ছিঁড়ে তাতে ইংরেজিতে লিখে দিলেনঃ ‘Pay Rs.10,000/DT’ এবং অফিসার কে বললেন, নিচের তলায় গিয়ে কাগজের টুকরোটা ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার এর হাতে দিতে। পরক্ষণেই আবার খবরের কাগজের পাতায় মনোনিবেশ করলেন। কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে সাহেব ত’ ভীষণ চটে গেল। ভাবল এ আরেক রকম রসিকতা। খুব একচোট শুনিয়ে দেবে ভাবলে যে কালা আদমির সাহেবদের সঙ্গে এরকম রসিকতার ভালো হয় না, কিন্তু সুযোগ পেলে না কারণ, কালা আদমিটি নিবিষ্ট মনে কাগজ পড়তে লাগল। তারপর পাতা ওল্টাতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়তে সাহেব দাঁড়িয়ে আছে, তিনি সাহেবকে বললেন-‘দাঁড়িয়ে কেন? বল্লাম ত কেশিয়ারের কাছে যাও।’ তারপর বেয়ারাকে ডেকে সঙ্গে করে কেশিয়ারের কাছে নিয়ে যেতে বল্লেন। সাহেব তখনও বুঝতে পারছেন না, এটা রসিকতা কিনা। যদি রসিকতাই হয় তবে তার শেষ দেখার জন্য সাহেব বেয়ারার সঙ্গে নেমে ক্যাশঘরে গিয়ে ক্যাশিয়ারের হাতে চিরকুটটা দিলেন। ক্যাশিয়ার গম্ভীর সুরে জিজ্ঞেস করলেন-‘নোটে না টাকায়?’ হতভম্ব অফিসার অস্ফুট জবাবে জানালেন, ‘কারেন্সি নোট হলেই সুবিধা।’ নোট গুণে নিয়ে বেরোনোর সময় তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল সেই অবিশ্বাস্য দাতা ভদ্রলোককে একটা ধন্যবাদ জানানো তো হল না। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখলেন ভদ্রলোক তখনো খবরকাগজে মশগুল। ধন্যবাদ না দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়ে একটা হ্যান্ডনোট লিখে দিতে চাইল। দ্বারকানাথ কাগজ থেকে চোখ তুলে মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি ভদ্রলোক হন ত হ্যান্ডনোটের দরকার হবে না, ঠিকই টাকাটা ফেরৎ দিবেন; আর ভদ্রলোক না হলে ত হ্যান্ডনোটের কোন মূল্যই নেই।’ বলা বাহুল্য, অক্টারলোনি সাহেব পরে টাকাটা ফেরত তো দিয়েছিলেনই, সারাজীবনের রোজগারও ওই ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে রাখতেন- বন্ধুদের বলতেন তাঁর সমস্ত সৌভাগ্যের মূলে ছিলেন সদয় ও সহৃদয় দ্বারকানাথ। তারপর যখন ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ফেল হয় তখন তিনি বেঁচে ছিলেন না কিন্তু তাঁর স্ত্রী সর্বস্বান্ত হন।

প্রিন্স ও কুইন

প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও রাণী ভিক্টোরিয়াকে ঘিরে নানারকম মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে। ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে দ্বারকানাথের সাক্ষাৎ, বাকিংহাম প্যালেসের ভোজসভায় যোগদান, মহারাণীর হস্তচুম্বন, রয়্যাল নার্সারি দেখা ইত্যাদি নানা ঘটনার কথা শোনা যায়। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি হল দ্বারকানাথের অনুরোধে মহারাণী ভিক্টোরিয়া একটি ভারতীয় শাড়িতে সুসজ্জিত হয়ে প্রিন্সের সামনে এসে দাঁড়ালে প্রিন্স তাঁর কপালে সিন্দুঁর পরিয়ে বলেন তাঁকে ঠিক যেন ভারতীয় বঁধূর মতো দেখাচ্ছে। মহারাণী তখন দ্বারকানাথকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ আপনি কি আমার কাছে কোন সম্মানজনক উপাধি গ্রহণ করবেন?’

দ্বারকানাথ তখন নাকি প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, ‘সম্মানজনক উপাধি?’ মহামান্যা মহারাণি আমায় কী এমন উপাধি দিতে পারেন যা আমার নামের চেয়েও বড়ো। আমি তো ঠাকুর- ভারতে ঠাকুর মানে স্বয়ং ভগবান।’ সেই উত্তর শুনে মহারাণী চুপ করে যান।

ঠাকুর পরিবারের জনৈক নিকট আত্মীয়ের লেখা চিঠিতে অভিজাত সমাজে প্রচলিত এরূপ গুজবধর্মী গল্পের উল্লেখ আছে।  প্রচলিত গল্প সম্বদ্ধে দ্বারকানাথের জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনীর বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ-‘নিঃসন্দেহে গল্পটা নেহাৎই অলীক, কিন্তু এরকম কাহিনি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় দ্বারকানাথের ব্যক্তিত্ব সমসাময়িকদের চোখে কীরকম মোহিনী মায়া বিস্তার করে থাকবে।’

 


“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ১ এবং পর্ব ২ পড়তে হলে ক্লিক করুন
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৩ এবং পর্ব ৪ পড়তে হলে ক্লিক করুন
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৫ এবং পর্ব ৬ পড়তে হলে ক্লিক করুন
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৭ এবং পর্ব ৮ পড়তে হলে ক্লিক করুন
“রূপকথার রাজপুত্র : দ্বারকানাথ” এর পর্ব ৯ এবং পর্ব ১0 পড়তে হলে ক্লিক করুন