১৯০৫ সাল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। সারা দেশ বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে মুখর। মুকুন্দদাস কি চুপ করে থাকতে পারেন? মুখে মুখে গান লিখলেন। সুর দিলেন। আসরে আসরে সেই সব গানকে দেশমাতৃকার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হলেন। সেই গানে মুগ্ধ হয়ে অশ্বিনীকুমার দত্ত তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে ‘চারণ কবি মুকুন্দদাস’ নামে অভিহিত করলেন। মুকুন্দদাসের কন্ঠ নিঃসৃত সংগীতের বাণী আর সুর সমস্ত দেশবাসীকে মাতিয়ে তুলল। ১৯৩৪ সালে কলকাতার কোম্পানির বাগানে স্বদেশী যাত্রার বিরাট আসর। বিরাট জনসভা। মুকুন্দদাস গাইছেন, ‘সাবধান সাবধান ওই আসিছে নামিয়া ন্যায়ের দন্ড’। ছন্দপতন ঘটে। সুর থেমে যায়। আসরের মাঝেই লুকিয়ে পড়েন মুকুন্দদাস। এই হল চারণকবি মুকুন্দদাসের জীবন। সেই জীবনকথাকে সেলুলয়েডে ধরে রাখলেন পরিচালক নির্মল চৌধুরী। ছবির নাম ‘চারণকবি মুকুন্দদাস’।
নাম ভূমিকার শিল্পী হিসেবে পরিচালক যাঁকে বেছে নিলেন সেই সবিতাব্রত দত্তের ওই চরিত্রের অভিনয় সর্বকালের স্মরণীয় অভিনয় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। একদিকে অভিনয়, অপরদিকে নিজের গান নিজের গলায় গাওয়া। তাও একটি দুটি নয়। বিধির বাধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, বন্দেমাতারাম বলে নাচ রে সকলে, সকল কাজের মিলবে সময়, পণ করে সব লাগরে কাজে, বাবুদের পায়ে নমস্কার, ছেড়ে দাও রেশমি চুরি বঙ্গনারী, ছলচাতুরি কপটতা মেকিমাল আর চলবে কদিন, জাগো রে জাগো জননী, সাবধান সাবধান প্রভৃতি গানগুলি ওই ছবিতে নেপথ্যে গেয়েছেন সবিতাব্রত দত্ত। চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার জন্য তরুণ মজুমদার যখন ‘বালিকা বধূ’ ছবি করছেন তখন তিনি ছবির প্রয়োজনে মুকুন্দদাসের চরিত্রটি নিয়ে এসেছিলেন। তখন এই চরিত্রে সবিতাব্রত দত্ত অভিনয় করেছিলেন। এমনকী ওই ছবিতে ‘ছেড়ে দাও রেশমি চুরি’ গানটিও তিনি গিয়েছিলেন।
১৯২৪ সালের ১৪ জানুয়ারি সবিতাব্রত দত্তের জন্ম কলকাতায়। পিতার নাম সুরেন্দ্রনাথ দত্ত। সাউথ সুবার্বন ব্রাঞ্চ স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে কিছুদিন সাউথ সিটি কলেজে পড়েছেন। গান কারও কাছে শেখেননি। স্বরলিপি অনুসরণ করতে জানতেন না।‘ব্যাপিকা বিদ্যায়’ নাটকে বারোটি গানের সুর নিজে করে, নিজের স্মৃতিতে ধরে রেখেছিলেন।
১৯৫৩ সালে দেবকী কুমার বসু পরিচালিত ‘পথিক’ ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পান। এরপর তিনি যেসব ছবিতে কাজ করেছেন তার মধ্যে রয়েছে খেলাঘর, স্মৃতিটুকু থাক, কাঁচের স্বর্গ, বালিকা বধূ, নয়ন, মান অভিমান,শঙ্করনারায়ণ ব্যাংক, সুশান্ত শা, শাস্তি, প্রবেশ নিষেধ, মহাকবি গিরিশচন্দ্র, আহ্বান, শেষ থেকে শুরু প্রভৃতি।
পেশাদারী রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহুদিন। স্টার থিয়েটারে আশাপূর্ণা দেবীর ‘মঞ্জরী’ নাটকে নায়িকা সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়ের ভবঘুরে গায়ক স্বামীর চরিত্রে সবিতাব্রতের অভিনয় স্মরণযোগ্য। কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে ‘এন্টনি কবিয়াল’ নাটকে তিনি কবিয়াল। বিপরীতে কেতকী দত্ত। গানে অভিনয়ে জমিয়ে দিয়েছিলেন সবিতাব্রত। রংমহল থিয়েটারে ‘কথা কও’ নাটকে তিনি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে। বিশ্বরূপাতে ‘বেগম মেরি বিশ্বাস’ নাটকে সবিতাব্রত জয়শ্রী সেনের বিপরীতে। পেশাদার মঞ্চে অন্যান্য অভিনীত নাটকের মধ্যে রয়েছে স্বীকৃতি, নাম বিভ্রাট, টাকার রং কালো, বিদ্রোহী নায়ক প্রভৃতি।
অপেশাদারভাবে যুক্ত ছিলেন বহুরূপী গোষ্ঠীর সঙ্গে। সেখানে তিনি অভিনয় করেছেন উলুখাগড়া, ছেঁড়াতার, অচলায়তন, চার অধ্যায়, দশচক্র, পথিক প্রভৃতি নাটকে। প্রখ্যাত শিল্পী মোঃ ইসরাইলের সঙ্গে ‘রূপকার’ গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরা অভিনয় করেন ব্যাপিকা বিদায় নাটকে। সেটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ভি বালসারার সংগীত পরিচালনায় তিনি পার্থপ্রতিম চৌধুরী পরিচালিত ‘শুভা ও দেবতার গ্রাস’ ছবিতেও গান গেয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে অভিনয় ক্ষেত্রে তাঁর অমূল্য অবদানের জন্য সংগীত নাটক একাডেমী পুরস্কারে ভূষিত হন।
অভিনয় জীবন, নাট্য প্রযোজনার পাশাপাশি সবিতাব্রত আইনজীবী হিসেবেও নিজেকে কর্মব্যস্ত রেখেছিলেন। স্ত্রী গীতা দত্তও নাট্য জগতের এক স্মরণীয় শিল্পী। ১৯৯৪ সালে তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়। সবিতাব্রত দত্ত ১৯৯৫ সালের ২১ নভেম্বর ল্যান্সডাউন নার্সিংহোমে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।। উদাত্ত কণ্ঠস্বরকে সম্পদ করে সবিতাবব্রত দত্ত মঞ্চ এবং পর্দায় দাপিয়ে বেরিয়েছেন। জন্মশতবর্ষের প্রয়াণমাসে তাঁর উদ্দেশে রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম।