গীতিকার পবিত্র মিত্রের কথায় নবাগত এক সুরকার ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরে তারার পানে চেয়ে’ গানটি সুর দেওয়ার পর ভাবলেন পান্নালাল ভট্টাচার্যকে দিয়ে এই আধুনিক গানটি তিনি রেকর্ড করাবেন। সুরকারের স্ত্রী তিনিও নামকরা গায়িকা। তিনি আপত্তি করলেন।এমন কথা এত সুন্দর সুর লতা মঙ্গেসকারকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্য স্ত্রী অনুরোধ জানালেন। সুরকার জানতেন পান্নালাল খুব গুণী শিল্পী।তবু স্ত্রীর পরামর্শ মতো গানটি তিনি লতাকে দিয়ে রেকর্ড করালেন। বেসিক রেকর্ড। রেকর্ডের অপর পিঠের গানটি ‘কত নিশি গেছে নিদ হারা’ গান দু’টি বাজারে প্রকাশিত হওয়ার পরই দারুণ জনপ্রিয়তা পেল। লোকের মুখে ফিরল গান। ইতিহাস তৈরি হয়ে গেল। সেই গান দুটির সুরকার হলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনি বাংলা গানের স্মরণীয় শিল্পীও বটে। সতীনাথের স্ত্রী উৎপলা সেন। এই শিল্পী দম্পতি বাঙালির অন্তর জুড়ে আছেন।
সেই সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯২৩ সালের ৭ জুন। হুগলি জেলার চুঁচুড়া শহরের ছেলে তিনি। সেখানেই বেড়ে উঠেছেন। এই চুঁচুড়া শহর শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে একটা জায়গা করে নিয়েছিল। পিতা তারকনাথ মুখোপাধ্যায়ের মামা বাড়ি হচ্ছে লখনউতে। সেখানে তিনি বড়দের হাত ধরে হাজির হতেন সংগীতের জলসায়। বিভোর হয়ে থাকতেন। বাবা ভালো প্রাচীন বাংলা গান, শ্যামাসংগীত গাইতেন। দাদু বাজাতেন বেহালা। এসব সতীনাথের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। চুঁচুড়ার ট্রেনিং স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। হুগলি মহসিন কলেজ থেকে বৃত্তিসহ আইএ পাশ করেন। বি. এ পাশ করেন। সংগীত শিক্ষা শুরু করেছিলেন প্রমথ ঘোষালের কাছে। পরে তিনি সংগীত শিক্ষক ধীরেন্দ্র ভট্টাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ইনি সতীনাথের সংগীতের জীবনটাকে তৈরি করে দেন। পরে তিনি চলে আসেন পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। চিন্ময় লাহিড়ী যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন সতীনাথ তাঁর কাছেই শিক্ষা নিতেন। এটা প্রমাণ করে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সংগীত শিক্ষা সবটা জুড়ে রয়েছে শাস্ত্রীয় সংগীত। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়ে বাংলা গানের জগতে তিনি প্রবেশ করেছিলেন।
১৯৪৭ সালে তাঁর গানের প্রথম রেকর্ডটি বার হয় ‘ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি’ এবং ‘এইটুকু শুধু জানি’। গোপন মল্লিকের সুরে গান দুটি গেয়েছিলেন। এই গান দুটি তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ছায়াছবিতে তাঁর প্রথম প্লেব্যাক ‘যুগদেবতা’ ছবিতে। পরের ছবি ‘পথ হারার কান্না’ । সুরকার রামচন্দ্র পাল। রামচন্দ্র পালের সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি সংগীত পরিচালনা করলেন ‘মর্যাদা’ ও ‘অনুরাগ’ ছবি দুটিতে। ১৯৫২ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর একটি রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ‘আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ এবং ‘এই জীবনে যেন আর’ – শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে গেল গান দুটি। আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কখনও ।
বেসিক রেকর্ডে তাঁর বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে রয়েছে ‘এল বরষা যে সহসা মনে তাই’, ‘আকাশ এত মেঘলা যেও না তো একলা’, ‘দুটি জলে ভেজা চোখ’, ‘আজ মনে হয় এই নিরালায়’, ‘আজও তো এলো না সে’, ‘বোঝনা কেন আমি যে কত একা’, ‘রাধিকা বিহনে কাঁদে’, ‘আজ তুমি নেই বলে’, ‘সূর্যমুখী আর সূর্য দেখবে না’, ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’, ‘রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ঘিরে’, ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’, ‘বালুকাবেলায় কুড়াই ঝিনুক’, ‘না যেও না’, ‘ভেবেছ তোমাদের একার আছে জলসাঘর’, ‘যদি সহেলি আমার কানে কানে কিছু বলে’, ‘এই দূর আলেয়ার একটু আলো’ প্রভৃতি গানগুলি।
সতীনাথের সুরে শুধুমাত্র লতা মঙ্গেসকার নন, বহু বিখ্যাত শিল্পী গেয়েছেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই), শ্যামল মিত্র(তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর), মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়(তুমি ফিরায়ে দিয়েছো বলে), উৎপলা সেন(কিংশুক ফুল হিংসুক ভারী), মহম্মদ রফি(তোমার নীল দোপাটি চোখ)প্রভৃতি। সতীনাথ সংগীত শিক্ষকও বটে। তাঁর কাছে গান শিখে পরবর্তীকালে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, দীপক মৈত্র, রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ দত্তের মত গুণী শিল্পীরা।
সতীনাথ ছায়াছবিতে গান গেয়েছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য অনুপম ঘটকের সুরে অগ্নিপরীক্ষা ছবিতে ‘জীবন নদীর জোয়ার ভাটায়’ গানটি। এছাড়া তিনি গান গেয়েছেন রানী রাসমণি, রাতভোর, সাগরিকা, অসমাপ্ত ছবিগুলিতে।নিজের স্ত্রী উৎপলা সেনের সঙ্গে দ্বৈত কন্ঠে একাধিক ছবিতে তিনি গান গেয়েছেন। তপন সিংহের সুরে ‘অতিথি’ ছবিতে স্বামী-স্ত্রী মিলে গেয়েছেন ‘মাঝে নদী বহেরে ওপারে তুমি শ্যাম এপারে আমি’। অনল চট্টোপাধ্যায় সুরে ‘মায়াবিনী লেন’ ছবিতে এই শিল্পী দম্পতি গেয়েছেন ‘হায় রামজি রামজি জয় জয় জয়কার’। ‘ভাগ্যচক্র’ ছবিতে নিজের সুরে তাঁরা মিলে গেয়েছেন ‘ভাগ্যের চাকাটা যে ঘুরছে’। উত্তম কুমার পরিচালিত ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিতে একাধিক সুরকার। তার মধ্যে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন অন্যতম। সতীনাথের সুরে ওই ছবিতে নিজে গেয়েছেন ‘এই তো ভবের খেলা’ আর স্ত্রীকে দিয়ে গাওয়ালেন ‘বহুদিন পরে ভ্রমর এসেছে কুঞ্জবনে’। শুধু বাংলা আধুনিক গান নয়, তিনি নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন। নজরুল গীতিগুলি হল ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মনে’, ‘রুমঝুম রুমঝুম কে এলে নূপুর পায়ে’। স্বামী-স্ত্রী মিলে রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছেন রেডিওতে ‘সর্ব খর্ব তারে দাও’ এবং ‘আমি ভয় করব না ভয় করব না’। বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে তিনি গান গেয়েছেন। যেমন গৃহলক্ষী, ফয়সালা, আজাদী কে বাদ প্রভৃতি ছবিতে তিনি গান গেয়েছেন।
সতীনাথের মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ এই পার হল।অনেকদিন আগে তিনি গেয়েছিলেন একটি গান ‘জানি একদিন আমার জীবনী লেখা হবে/সে জীবনী লিখে রেখো তোমাদের গানের খাতায়’।সত্যি কথাটাই যেন উঠে এসেছে সেই গানের মধ্য দিয়ে। জন্মশতবর্ষে সেই শিল্পীর উদ্দেশে রইল আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম।