অচলায়তন নাটকের গান

রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন নাটকটি রূপক সাংকেতিক নাটক। এই নাটকে তিনি আমাদের দেশের রক্ষণশীল হিন্দু ধর্মের অন্তঃসারশূন্য আচার সর্বস্বতাকে বিদ্রূপ করেছেন। নাটকের বক্তব্য, ‘জগতের যেখানেই ধর্মকে অভিভূত করিয়া আচার আপনি বড় হইয়া উঠে, সেখানে মানুষের চিত্তকে সে রুদ্ধ করিয়া দেয়, এটা একটা বিশ্বজনীন সত্য।’

রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য নাটকের মতো অচলায়তনেও সংগীতের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্র-নাটকে গান নাটকের অনেক বক্তব্যকে তুলে ধরেছে। কখনও তা ব্যঞ্জনার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে।  গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য রচনার সময় এই নাটক রচিত হলেও এতে অধ্যাত্মভাবনার প্রকাশ তেমন নেই। নাটকে মোট কুড়িটি গান রয়েছে। তার মধ্যে পূজা পর্যায়ের গান হল— তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে, এই পথ গেছে কোনখানে, আমি কারে ডাকি গো, সকল জনম ভরে, যিনি সকল কাজের কাজি, আমি যে সব দিতে চাই, আর নহে আর নয় ইত্যাদি

নাটকের প্রধান চরিত্র পঞ্চকের কন্ঠে মোট বারোটি গান রয়েছে এই নাটকে এই নাটকে পঞ্চক অচলায়তনে মুক্তির দূত, নিয়ম না মানা মূর্তিমান বিদ্রোহ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে প্রথম দৃশ্যের শুরুতে পঞ্চকের কন্ঠে তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে – গানের মধ্যে নাটকের অন্তর্নিহিত বক্তব্যটি প্রকাশিত হয়েছে বদ্ধ অচলায়তনে পঞ্চকের প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। সেখানে প্রাণহীন নিয়মাচার, মন্ত্রপাঠ প্রথাবদ্ধ শিক্ষা পঞ্চককে অস্থির করে তোলে অথচ সে এই প্রথা সর্বস্বতা থেকে বেরিয়ে যেতেও সাহস পায় না ফলে তার অন্তরের দ্বিধা, সংশয়, আর্তি তার ব্যবহারে, কথায় ও গানে ফুটে ওঠে আবার কখনও মুক্ত জীবনের প্রতি পঞ্চকের আকুলতা-উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেয়েছে তার গানে তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে, দূরে কোথায় দূরে দূরে, এ পথ গেছে কোনখানে, ঘরেতে ভ্রমর এলো, আমি আমি কারে ডাকি গো, আজ যেমন করে গাইছে আকাশ, হারে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দেরে রে রে, ওরে ওরে আমার মন মেতেছে, এই মৌমাছিদের ঘরছাড়া কে করেছে, সকল জনম ভরে ও মোর দরদিয়া, আমি যে সব দিতে চাই, আর নহে আর নয়।

অচলায়তন নাটকে দাদাঠাকুর একটি বিশিষ্ট চরিত্র তিনি অচলায়তনের গুরু আয়তনের আচার্য অধীনপুণ্য, আয়তনের পূজোর ফুল তুলে যে এবং যে শাঁখ বাজায় যে- এই ক’জন শুধু গুরুকে চেনেআর কেউ তাঁকে দেখেনি শোণপাংশুদের অচলায়তনে প্রবেশ নিষেধ তারা নিজেদের মতো নাচগান করে, চাষ করে, একসঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেতাদের কাছে গুরু হলেন দাদাঠাকুর তারা তাঁকে নিজের মানুষ করে নিয়েছে তাদের ভাষায়, ‘উনি আমাদের সকল দলের শতদল পদ্ম।’

নাটকের শেষে শোণপাংশুদের সহায়তায় দাদাঠাকুর তথা গুরু, যোদ্ধার দেশে এসে অচলায়তনের আকাশচুম্বী দেওয়াল ভেঙে আলোর প্রবেশ ঘটান এইভাবেই সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, অন্তঃসারশূন্য আচারসর্বস্বতাকে ধ্বংস করে আধুনিকতার প্রবেশ ঘটান।

শোণপাংশুদের কন্ঠে এই গান আছে যেমন— আমরা চাষ করি আনন্দে, কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, সব কাজে হাত লাগাই মোরা, এই একলা মোদের হাজার মানুষ দাদাঠাকুর, যিনি সকল কাজের কাজি। দেখা যাচ্ছে, শোণপাংশুদের অধিকাংশ গান কর্মচঞ্চলতার গান।

এই নাটকে দাদাঠাকুরের কন্ঠে দুটিমাত্র গান আছেকারণ তিনি সংগীতময় চরিত্র নন। গান দু’টি হল— যা হবার তা হবে এবং বুঝি এল, বুঝি এল, ওরে প্রাণ।

নাটকে দর্ভকদল বলে আর একটি অন্ত্যজ শ্রেণীর চরিত্র আছে তারা অশিক্ষিত দরিদ্র হলেও কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী। এদের কাছে দাদাঠাকুর হলেন আপন মানুষ পঞ্চক ও আচার্যের উদার মনোভাব অচলায়তনের অতিরিক্ত নিয়মনিষ্ঠ মহাপঞ্চক ও রাজার সহ্য না হওয়ায় তাঁরা পঞ্চক ও  আচার্যকে দর্ভকপল্লীতে নির্বাসন দিয়েছেন। অচলায়তন নাটকে দর্ভকদলের কন্ঠে তিনটি গান আছেযেমন, ও অকূলের কূল, আমি তারেই জানি তারেই জানি, উতল ধারা বাদল ঝরে।

নাটকের প্রথম বালকের কন্ঠে একটি গান রয়েছে— আলো আমার আলো ওগো এই গানে অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোয় প্রবেশের আভাস আছেনাটকের শেষে শোনপ্রাংশুদের সহায়তায় দাদাঠাকুর তথা গুরু, যোদ্ধার দেশে এসে অচলায়তনের আকাশচুম্বী দেওয়াল ভেঙে আলোর প্রবেশ ঘটান এইভাবেই সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, অন্তঃসারশূন্য আচারসর্বস্বতাকে ধ্বংস করে আধুনিকতার প্রবেশ ঘটান। পঞ্চককে তিনি অচলায়তনের দায়িত্ব অর্পণ করেনএই হল অচলায়তন নাটকের অন্তর্নিহিত বক্তব্য। এই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে নাটকের গান।