১৯৫৫ সালের যে দিনটিতে সোভিয়েত রাশিয়ার বুলগানিন আর ক্রুশ্চভ কলকাতায় এসেছিলেন, সেদিন গোটা কলকাতার মানুষ উদ্বেল। বিশেষ করে বিবেকানন্দ রোডে লক্ষ লক্ষ মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দুই নেতাকে দেখবার জন্য, ঠিক ঐ সময় প্রযোজক অসিত চৌধুরী তপন সিংহকে অফার দিলেন ‘কাবুলিওয়ালা’ করবার জন্য। শুনে লাফিয়ে উঠেছিলেন তপন সিংহ। সেই সময় ফিল্ম লাইনে মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ অপাঙক্তেয়। তাঁর গল্পের ছবি পয়সা দেয় না। তিনি নাকি কেবলমাত্র ইন্টেলেকচুয়ালদের জন্য সংরক্ষিত। সেই রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে ছবি করবার জন্য একজন প্রোডিউসার নিজে থেকে অফার দিচ্ছেন! তপনবাবু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন পাছে প্রযোজক তাঁর মৌনতাকে অস্বীকৃতি ভেবে মত বদলে ফেলেন। কিন্তু শর্ত ছিল ছবিটা খুব কষ্ট করে করতে হবে। টাকা খুবই কম। ছবির কাজ চলাকালীন মাসে তিনশো টাকা করে দেওয়া হবে।
তপন সিংহ একটি সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, ‘…ওটাই তখন আমার কাছে তথন অনেক। একটা পয়সা না পেলেও এ ছবি আমি করতাম। যে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে আমার জীবন আবর্তিত হচ্ছে, যে রবীন্দ্রনাথের আমি একলব্য শিষ্য, যিনি আমার জীবনের ধ্রুবতারা – তাঁর কাহিনি নিয়ে ছবি করার সুযোগ পাচ্ছি এটাই তো আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ পাওয়া।’ এই ছবি প্রসঙ্গে তিনি আরও জানাচ্ছেন, ‘…ছবি করার জন্য যা দরকার সেই মূল ব্যাপারটাই রবীন্দ্রনাথ করে রেখে দিয়েছেন তাঁর কাহিনিতে। সেটা আহরণ করতে গেলে রবীন্দ্রনাথকে ভালো করে বোঝা দরকার। সেই অনুভূতি যাঁদের নেই তাঁদের কাছে ব্যাপারটা শক্ত মনে হবে। সত্যজিৎবাবুর কথা ভাবুন না। তিনি রবীন্দ্রনাথের যে ক’টি গল্প করেছেন সবগুলি সাকসেসফুল। আমার ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির কথা ভাবুন না। আমার তো করার কিছুই ছিল না। নিষ্ঠাভরে রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করতে পেরেছি, তাঁর স্পিরিটটাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছি, তাই তো অত সাকসেস। ‘কাবুলিওয়ালা’ আমাদের এখানে বছরের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পেয়েছে, বার্লিন ফেস্টিভালে বেস্ট মিউজিকের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। আমাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে অভিনয়ের ব্যাপারটা নিয়ে। বাচ্চাদের দিয়ে অভিনয় করানো শক্ত। প্রচন্ড ধৈর্যের প্রয়োজন, অফুরন্ত ভালোবাসার প্রয়োজন।’
‘কাবুলিওয়ালা’ চলচ্চিত্রটি আবারও করতে উৎসাহী ছিলেন তপনবাবু। তিনি মনে করতেন, এই গল্পের যা মূল বক্তব্য, ‘ভালোবাসা’, তার চিরকালীন যে আবেদন তা আছে এবং থাকবে সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে। কেবল এই ছবিরই রি–মেক তিনি করতে চেয়েছিলেন। তাঁর আর কোনো ছবির নয়।
‘কাবুলিওয়ালা’ চলচ্চিত্রই তপন সিংহকে দেশের আপামর জনসাধারনের কাছে একজন দক্ষ চলচ্চিত্র নির্মাতার স্বীকৃতি এনে দেয়।
তাই ভারতীয় চলচ্চিত্রের এই উজ্জ্বল নাগরিক তপন সিংহের জন্মশতবর্ষে জীবনস্মৃতি আর্কাইভের শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘কাবুলিওয়ালা’ চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি প্রদর্শনী। ‘কাবুলিওয়ালা’ শিরোনামে প্রদর্শনীটি ডিসেম্বর মাসভর (৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত)দেখা যাবে উত্তরপাড়ার জীবনস্মৃতি আর্কাইভে। প্রদর্শনীর বিষয় ভাবনা ও রূপায়ণ জীবনস্মৃতির প্রাণপুরুষ অরিন্দম সাহা সরদারের।
প্রদর্শনীতে রয়েছে ‘কাবুলিওয়ালা’ চলচ্চিত্রের মূল পাণ্ডুলিপি, চিত্র সমালোচনার মূল সংবাদ-কর্তৃকা,
পোস্টার, লবিকার্ড, ফিল্ম-বুকলেট, স্থিরচিত্র, অপ্রকাশিত অসম্পূর্ণ বিজ্ঞাপনের মূল খসড়া এবং তপন সিংহ ও তাঁর চলচ্চিত্র বিষয়ক দুষ্প্রাপ্য পত্র-পত্রিকা।
তপন সিংহের জন্মদিনে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র প্রণেতা রাজা সেন। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট স্থপতি আশিস আচার্য।বিশেষ এই দিনটিতে রাজা সেনকে তাঁর জীবনব্যাপী চলচ্চিত্রশিল্প-সাধনার জন্য ‘শতবর্ষে তপন সিংহ স্মরণ’ উপলক্ষ্যে ‘জীবনস্মৃতি সম্মাননা-২০২৪’-এ বরণ করে নেওয়া হয়েছিল। সম্মাননা জ্ঞাপন করেছিলেন জীবনস্মৃতি-র চালিকাশক্তি অণিমা সাহা সরদার এবং আশিস আচার্য।
এছাড়া প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, মন্ত্রপাঠ, গান, এস্রাজ, প্রবন্ধপাঠ এবং আলোচনাসভা অনুষ্ঠানটি ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠে। অংশগ্রহণে ছিলেন সুজাতা সাহা, বিয়াস ঘোষ, নিবেদিতা বিশ্বাস, সঞ্জয় দাস এবং রূপকথা সাহা সরদার।