সামাজিক রীতি
টোটোরা এখনও নিজেদের সামজিক রীতিনীতিতে আবদ্ধ৷ অত্যন্ত গণতান্ত্রিক ছন্দবদ্ধ ও নিয়মানুবর্তিতায় বাধা টোটোদের সমাজজীবন৷ টোটোদের সমাজ ব্যবস্থায় দু’ধরনের রীতি৷ একটি ধর্মীয়৷ অন্যটি সামাজিক৷ টোটো সমাজে সবচেয়ে উঁচু পদমর্যাদায় রয়েছেন ধর্মীয় প্রধান সুব্বা বা কাইজি৷ এর পরের স্থান সমাজ প্রধান গাপ্পু বা মোড়লের৷ পদমর্যাদায় ওপরে থাকলেও কাইজি শুধু ধর্মীয় প্রধান৷ কিন্তু গাপ্পু সমাজ প্রধান হওয়ার সুবাদে রাজনৈতিক এবং বিচার ব্যবস্থারও প্রধান৷ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও তাঁর৷ সামাজিক বিষয়ে গাপ্পুকে সহায়তা করার জন্য রয়েছে একটি পরিষদ, লাঠি জাংগোয়া৷ এর সভায় উপস্থিত থাকেন কাইজি এবং গাপ্পু৷ বিচার বিষয়ে সহায়তা করার জন্য রয়েছে জুরি পরিষদ, জংসুয়া৷ আমাদের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হওয়ার অনেক আগে থেকে টোটোদের আর্থ সামাজিক নীতি ঠিক করার জন্য এবং কাইজি ও গাপ্পুকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য রয়েছে পঞ্চাৎ৷ এর সদস্যদের বলে পঞ্চা৷ গাপ্পু এককভাবে কোনও বিষয়েই ক্ষমতার অধিকারী নন৷ পরিষদগুলির পরামর্শে চলতে হয় গাপ্পুকে৷ প্রবীণরা এসব পরিষদের সদস্য মনোনীত করেন৷ আজ পর্যন্ত এ বিষয় নিয়ে কখনও কোনও বিরোধ হয়নি৷ টোটোরা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয়৷ সহজ সরল৷ চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, নারী অপহরণ এসবের কোনও নজির নেই টোটোদের মধ্যে৷ পুলিশকেও কখনও যেতেও হয় না সেখানে৷ সামান্য ছোট ছোট কোনও বিষয় বা বিরোধ মীমাংসার জন্য বসে লাঠি জাংগোয়া এবং জংসুয়ার সভা৷ হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে মিটে যায় বিরোধ৷ সবচেয়ে কঠোর সাজা দেওয়া হয় বেত্রাঘাত অথবা বকাঝকা৷ সাধারণত দোষী সাব্যস্ত হলে সাজা হিসেবে অপরাধীকে দিতে হয় এক হাঁড়ি বা দুই হাঁড়ি জিউ (ঘরে তৈরি মদ)৷ হুল্লোড়ের মধ্যে শেষ হয় বিচার৷ তবে গুরুতর সামাজিক বিধি লঙ্ঘনের দায়ে সমাজ থেকে বহিষ্কারের মতো কঠোর সাজাও দেওয়া হয়৷ এর নজিরও আছে৷ সব কিছুই হয় সর্বসম্মতভাবে৷ কখনও কোনও বিষয়ে বিরোধ হয় না৷
টোটোদের সমাজে বিধবা বিবাহ বিধিসম্মত৷ তবে বিধবা হওয়ার এক বছর পর৷ রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো সমাজ সংস্কারক ছাড়াই টোটো সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত৷ তবে মেয়েদের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার নেই৷ তবে পিতৃ বা স্বামীর গৃহে মর্যাদা নিয়ে থাকার অধিকার রয়েছে৷
আর্থিক দিক থেকে টোটোরা অনেক পিছিয়ে৷ ওদের অন্যতম প্রধান পেশা কৃষি কাজ এবং মোট বওয়া৷ ভুটানের অধীনে থাকার সময় ক্রীতদাস হিসেবে এ কাজ ওদের করতে হত৷ এখনও টোটোরা কমলার মরসুমে ভুটানে গিয়ে কমলার মোট বওয়ার কাজ করে৷ কৃষিকাজে ওরা উন্নত নয়৷ পাহাড়ি মাটিও চাষের অযোগ্য৷ টোটোদের প্রধান কৃষি ফলন সুপারি, আদা, ভুট্টা, মারোয়া ইত্যাদি৷ এসব ফসলের আবাদ করে টোটোরা৷ টোটো সমাজে ঘরে তৈরি মদ, জিউয়ের ব্যাপক ব্যবহার৷ জিউ তৈরি হয় সর্ষে দানার মতো মারোয়া থেকে৷ টোটোদের সামাজিক ধর্মীয় এবং অন্য সব উৎসব অনুষ্ঠানে জিউ অন্যতম আবশ্যিক বিষয়৷ ১৯৩০ সাল পর্যন্ত টোটোপাড়ায় হত প্রচুর উন্নত কমলার ফলন৷ এখন আর সেখানে কমলা আবাদ নেই৷ তবে সামান্য কিছু কমলা গাছ এখনও রয়েছে৷ টোটো মেয়েরা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে কাঠ শুকনো পাতা৷ এসব ওদের জ্বালানি৷ টেটোদের প্রধান খাদ্য ভুট্টা৷ জাঁতায় (ওয়াংটা) ভুট্টা ভেঙে তৈরি হয় ভুট্টার চাল ও আটা৷ এই চাল ও আটাই টোটোদের প্রধান খাদ্য৷ মাংস মাছ টোটোদের প্রিয়৷ সবচেয়ে প্রিয় শুকর, গরু, মুরগি৷
মাটি থেকে অনেকটা উঁচু বাঁশের মেঝে (কাইবু) এবং খড়ের দেওয়াল ও খড়ের চালের ঘরে টোটোদের বাস৷ ঘরটি হয় লম্বায় প্রায় ১০/১২ ফুট৷ সামনে বাঁশের বারান্দা৷ একটি মাত্র ঘর৷ সেখানেই মেঝেতে পরিবারের সকলের শয্যা৷ একপাশে বালির ঢিপ৷ তার উপর রান্নার চুলা৷ ঘরে একটি দরজা৷ ঘর যেহেতু একটি তাই ছেলে বড় হলে অন্যত্র শুতে যায়৷ মেয়েরা অবশ্য বাড়িতেই থাকে৷
টোটোরা অত্যন্ত স্বল্পায়ু৷ ৫০/৬০ বছর৷ ৭০ বছর ছুঁতে পারে খুব কম টোটো মানুষ৷ মৃতদেহ কবর দেয় টোটোরা৷
বিয়ে রীতি
টোটোদের বিয়ের পদ্ধতি চলে দু’পর্যায়ে৷ অভিভাবকদের মধ্যে প্রাথমিক কথাবার্তার পর নির্দিষ্ট দিনে সকালে ছেলের বাড়ির আত্মীয়স্বজন দুই কলসি জিউ (ঘরে তৈরি মদ) নিয়ে যায় মেয়ের বাড়ি৷ মেয়ের বাড়ি সম্মত হলে ছেলের বড়ির লোকেরা মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই ফিরে আসে ছেলের বাড়ি৷ বাড়ির পুরুষরা তখন যায় গাছের পাতা সংগ্রহে৷ মেয়েরা যায় কাঠ কুড়োতে৷ অংশ নেয় প্রতিবেশি আত্মীয়স্বজনরাও৷ এরপর একসঙ্গে চলে জিউ পান৷ সামর্থ অনুযায়ী হয় শুকর মুরগি বলি৷ চলে খাওয়াদাওয়া৷ পরদিন মেয়ের বাড়িতেও হয় একই অনুষ্ঠান৷ এভাবে চলে টানা ৬ দিন৷ তৃতীয় দিনে মুরগি উৎসর্গ করে দেবতার অনুমোদন চাওয়া হয় বিয়েতে৷ মেয়ে থেকে যায় ছেলের বাড়িতেই৷ বিয়ের এই প্রাক পর্ব হল সামোবিহও৷ এই প্রাক বিয়ের পর ছেলের বাড়িতেই ছেলেমেয়ে থাকে স্বামী-স্ত্রীর মতো৷ মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হলে হয় চূড়ান্ত বিয়ে, দেববিহও৷ মেয়ের অন্তঃসত্ত্বার ৫, ৭ বা ৯ মাসে হয় এই চূড়ান্ত বিয়ে৷ মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা না হলে চূড়ান্ত বিয়ে হয় না৷ মেয়ে তখন পাত্র বদল করতে পারে৷ পিতৃগৃহেও ফিরতে পারে৷ পাত্রপাত্রীর নিজেদের পছন্দের বিয়ে সমাজে অনুমোদিত৷ বিবাহ বিচ্ছেদ টোটো সমাজে স্বীকৃত৷ এক্ষেত্রে স্ত্রীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়৷ সমগোত্রে বিয়ে হয় না৷ টোটোদের সমাজে বিধবা বিবাহ বিধিসম্মত৷ তবে বিধবা হওয়ার এক বছর পর৷ রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো সমাজ সংস্কারক ছাড়াই টোটো সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত৷ তবে মেয়েদের পিতার সম্পত্তিতে অধিকার নেই৷ তবে পিতৃ বা স্বামীর গৃহে মর্যাদা নিয়ে থাকার অধিকার রয়েছে৷
ধর্মাচার
টোটোদের ধর্মাচারে কোনও দেবদেবী নেই৷ শক্ত শেকড় থাকলেও টোটোদের ধর্মাচারে কোনও বিগ্রহ নেই৷ তাঁদের ধর্মাচার সম্পূর্ণ জীবনবোধ থেকে উৎসারিত৷ টোটোদের ধর্মাচার জীবন ধারনের অভিজ্ঞতার বোধ থেকে আহত৷ মানুষের জীবনধারণ প্রকৃতি নির্ভর৷ টোটোরা তাই প্রকৃতির উপাসক৷ জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন সূর্য, বাতাস, মাটি, জল, ফলন, নদী, পাহাড়, পাথর, গাছ ইত্যাদির৷ টোটোরা প্রকৃতি প্রদত্ত এসবের উপাসক৷ টোটোদের সম্মিলিত শ্রেষ্ঠ সামাজিক উৎসব হয় শরতে৷ তিন পর্যায়ে হয় এই উৎসব৷ প্রথমে হয় শারদে বা ডিউ৷ এরপর অংচু৷ শেষে মঞই৷ বর্ষার শেষে হয় শারদে৷ শরতের সূচনায় হয় অংচু৷ শরৎ যখন যাই যাই রূপে তখন হয় মঞ্চই৷ শারদে এবং অংচু একদিনের উৎসব৷ মঞই চলে তিনদিন৷ লাঠি জাংগোয়ার সভা ডেকে ধর্মীয় প্রধান কাইজি ঠিক করেন উৎসবের দিনক্ষণ৷শারদে মূলত নদীর উপাসনা৷ নদী যাতে অনুকূলে থাকে৷ বন্যা যাতে না হয়৷ সেচের জল যাতে ঠিকঠাক পাওয়া যায় তাই হয় এই ধর্মাচার৷ আরাধনা হয় দাতিনতি, দীপতি, জৈতি, গোঁয়াতি এবং ন্যাটু এই পাঁচ নদীতে৷ পূজায় লকু (আতপ চাল), মেদে (মারোয়া) এবং নতুন আদা ও নতুন জাম্বুরার ওপর মুরগি বলির রক্ত ছিটিয়ে করা হয় পুজোর নৈবেদ্য৷ মুরগি বলিতেও আছে রীতি৷ দীপতি নদীর আরাধনায় বলি হয় লাল মোরগ৷ জৈতিতে দিতে হয় লাল মুরগি৷ দাতিনতিতে কালো মোরগ৷ কলাপাতায় মুড়ে এই নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়৷ যা হয়ে যায় প্রসাদ৷ সন্ধ্যায় কালীশ্বর পূজাগাঁও পাহাড় চূড়ায় টোটোদের উপাসনা স্থল ডেনসা মন্দিরে হয় উপাসনা ও উৎসব৷ ১৮ বছরের ওপর নারী ও পুরুষকে নিয়ে যেতে হয় কলসি ভরা জিউ৷ টোটোদের রয়েছে বর্ণাঢ্য নৃত্য গীতের সংস্কৃতি৷ তাঁরই প্রতীক হিসেবে ডেনসায় রাখা থাকে দুটি ঢোল৷ ডেনসায় কাইজির আরাধনার পর এই দুটি ঢোল নিয়ে চলে টোটোদের সেঞ্জা, টুংটুংকামু, দিরে, বেড়া, সেনচাখাপু ইত্যাদি নাচ-গানের আসর৷ সঙ্গে জিউয়ের ফোয়ারা৷ মঞই উৎসবের সূচনার দিন সকালে টোটোরা যায় পবিত্র ইম্পা পাহাড়ে৷ তারপর সেখান থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ডেনসা মন্দিরে৷ কাইজির আরাধনা শেষে গোঁয়াতি নদীর ধারে হয় পূজা৷ বলি দেওয়া হয় দুটি শুকর৷ ৬টি মুরগি৷ কলাপাতার ওপর আতপ চাল, নতুন আদা, কমলা, জাম্বুরার ওপর বলির রক্ত ছিটিয়ে ৯ ভাগে ভাগ করে করা হয় নৈবেদ্য৷ কলাপাতায় মুড়ে এই প্রসাদ ও জিউ পাঠান হয় শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের৷ এরপর সারারাত ধরে চলে সেঞ্জা, টুংটুংকামু ইত্যাদি নাচগানের আসর৷ টোটোরা সেদিন টোটো ভাষায় গেয়ে চলে তাঁদের চিরাচরিত বিভিন্ন গান৷
যেমন, টোটোবি কো লোইতা কো সা
নিনা ইয়ঙকো নিনা ডেনসা
জেজেঙকোইওয়া ইচো নিনা ইয়ঙকো ডেনসা ও বারবাই
নিনা ইয়ঙকো ডেনসা৷
(বাংলায়)— টোটোদের গ্রাম টোটোদের ঘর
আছে আমাদের সানঝা মন্দির
সুন্দর ডেনসা ও বন্ধু আমাদের ডেনসা
মঞই পূজায় ও পাড়ার মানুষ এ পাড়ায়৷
এসব গানের সঙ্গে চলে নাচ৷ ছন্দবদ্ধ তালে এসব নাচগানের মিছিল চলে রাস্তায় রাস্তায়৷ সঙ্গে জিউয়ের ফোয়ারা৷ ঘরে ঘরে সেদিন হয় ভোজ৷ টানা তিনদিন পর ডেনসায় হয় সমাপ্তি উৎসব৷ ডেনসা মন্দিরে সেদিন চিরেমু এবং মুগেইমু নামের পবিত্র ঢোল দুটি রেখে প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা করেন কাইজি৷ টোটোদের বর্ণাঢ্য সংস্কৃতির প্রতীক এই দু’টি ঢোল৷ ধর্মীয় এই পুজো উৎসব ছাড়াও বাড়ি বাড়িতে এবং গোষ্ঠীগত ভাবেও ফলন, বৃক্ষ, পাথর, নদী ইত্যাদি প্রকৃতির দান নিয়ে হয় আরাধনা৷ এসব পুজো আরাধনার দায়িত্ব পালন করেন কাইজির নীচের ধাপের পুরোহিত পাউ৷
উত্তরণ
বাইরের সমাজের সঙ্গে টোটোদের মেলামেশা বাড়ছে৷ সামাজিক বিভিন্ন দিক থেকে উন্নয়নের ছটা পড়ছে টোটোপাড়ায়৷ টোটোদের সমাজজীবনে আসছে পরিবর্তন৷ ভাঙছে প্রাচীন রীতিনীতি৷ পোষাক পরিচ্ছদ থেকে ঘরবাড়ি স্বাস্থ্য সবেতেই পরিবর্তন৷
১৯৫০-এর পর থেকে অবস্থা পাল্টানোর শুরু৷ সূচনায় ছিল ধীরে, পরে অত্যন্ত দ্রুত টোটোপাড়ায় জনবিন্যাস পাল্টাতে থাকে৷ টোটোপাড়ায় নেপালীদের জমি দখলে বাধা দিতে পারেনি শান্তিপ্রিয় টোটোরা৷ টোটোপাড়ায় টোটো ভোটারের চেয়ে অনেক বেশি ভোটার এখন নেপালীরা৷
টোটোপাড়ায় হয়েছে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক৷ হয়েছে সমবায় বিপণন কেন্দ্র৷ ৬ শয্যার হাসপাতাল৷ হয়েছে ডাকঘর, গ্রন্থাগার৷ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার এখন টোটোদেরই একজন৷ ভক্ত টেটো৷ যিনি ১৯৮১ সালে টোটোদের মধ্যে প্রথম দশম শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়ার সুবাদে মাধ্যমিক পাশের মর্যাদা পেয়েছিলেন৷ টোটোদের থেকেই হযেছেন এখন গ্রন্থাগারিক এবং পোষ্টমাস্টার৷ সরকার থেকে পাকা বাড়ি করে দেওয়া হচ্ছে টোটোদের৷ টোটোপাড়ায় এসেছে বিজলি বাতি৷ পানীয় জল৷ টোটোপাড়ায় প্রায় নিশ্চিন্ন হয়ে যাওয়া কমলা আবাদকে আবার ফিরিয়ে আনতে ন্যাশনাল হর্টিকালচার মিশন কাজ শুরু করেছে৷ উত্তরণের পথে পা বাড়িয়েছে টোটোরা৷
শিক্ষার আলো
শিক্ষার আলোর ছটা ক্রমেই আছড়ে পড়ছে টোটোপাড়ায়৷ সেখানে ১৯৫১ সালে ভারত মহাজাতি মণ্ডলী প্রথম শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করে৷ সরকারি অনুমোদন নিয়ে ১৯৬৭ সালে প্রথম ৭ জন টোটো যুবককে বৃত্তিমূলক কৃষি বিষয়ে শিক্ষার জন্য সুইডিস মিশনের উদ্যোগে কোচবিহারে নিয়ে যাওয়া হয়৷ এরপর সুইডিস মিশন এবং লুথার্ন ওয়ান্ড সার্ভিস টোটোদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করে৷ মিশন ২০ জন টোটো ছেলেমেয়েকে টোটোপাড়ার বাইরে নিয়ে যায় লেখাপড়া শেখানোর জন্য৷ এদের মধ্যে তিনজন মেয়ে৷ গৌরী, বানী এবং সূচনা টোটো৷ ১৯৭২ সালে সেখানে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় অবৈতনিক বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়৷ এরপর অনগ্রসর শ্রেণী কল্যাণ দপ্তর টোটোপাড়ার পোয়ারগাঁওতে স্থাপন করে আরও একটি প্রাতমিক বিদ্যালয়৷ ১৯৮০-তে সুইডিশ মিশন টোটোপাড়ায় স্থাপন করে প্রয়াত গাপ্পু (টোটোদের সামাজিক প্রধান বা মোড়ল) ধনপতি টোটোর নামে ধনপতি মেমোরিয়াল জুনিয়র হাইস্কুল৷ এটি এখন মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত৷ টোটোদের মধ্যে প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেন চিত্তরঞ্জন টোটো৷ কিন্তু টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি প্রয়াত৷ টোটোপাড়ার ছেলেমেয়েরা এখন রাঙ্গালিবাজনা, মহাকালগুড়ি, শিশুবাড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়িতে থেকে পড়ছে৷ টোটোদের মধ্যে স্নাতক এখন ৭ জন৷ এদের মধ্যে ৫ জন ছেলে এবং ২ জন মেয়ে৷ প্রথম স্নাতক সঞ্জীব টোটো (১৯৯৯)৷ তিনি এখন টোটোপাড়ার অনগ্রসর শ্রেণী কল্যাণ দপ্তরের আধিকারিক৷ এমএ পড়ছে একজন, জগদীশ টোটো৷ উচ্চমাধ্যমিক পাশ ১৪ জন৷ এদের মধ্যে ১১ জন ছেলে এবং ৩ জন মেয়ে৷ মাধ্যমিক পাশ ৬১ জন৷ এদের মধ্যে ৪৫ জন ছেলে এবং ১৬ জন মেয়ে৷ টোটো মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্নাতক হয়ে চমক লাগিয়েছিলেন রীতা টোটো৷ ২০১০ সালে জলপাইগুড়ির পি ডি মহিলা কলেজ থেকে তিনি স্নাতক হন৷ তাঁর এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিতে তাঁকে সে বছর রাজ্য সমাজ কল্যাণ দপ্তরে টোটোপাড়াতেই চাকরি দেওয়া হয়৷ টোটো ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে প্রথম অনার্স স্নাতক সঞ্চিতা টোটো৷ সঞ্চিতা জলপাইগুড়ির পিডি মহিলা কলেজ এতকে ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাশ করেছে৷ এর আগে ২০১০ সালে সঞ্চিতা ও শোভা দুই বোন টোটোদের মধ্যে প্রথম উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন৷ সঞ্চিতা ২০০৮ সালে মাধ্যমিকে প্রথম টোটো হিসাবে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন৷ ২০০৭ সালে টোটো মেযেদের মধ্যে প্রথম উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন রীতা টোটো৷ প্রথম স্কুলমুখী টোটো মহিলা দেবী টোটো (১৯৬৬)৷ চতুর্থ শ্রেণি উত্তীর্ণ প্রথম টোটো রবি টোটো (১৯৬৬)৷ অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ প্রথম টোটো মুক্তারাম টোটো ৯১৯৭৫)৷ ২০০৬ সালে একসঙ্গে রেকড৩ সংখ্যক ৫ জন টোটো মাধ্যমিক পাশ করায় টোটোপাড়ায় নেমেছিল জমাটি উৎসব৷ ১৯৯৩ সালে রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় থেকে টোটো মেয়েদের মধ্যে প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন সূচনা টোটো৷ তখন তিনি এক সন্তানের মা৷ ১৯৯১ সালে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়৷ ছেদ পড়ে যায় পড়াশুনোয়৷ মুক্ত বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে তিনি আবার পড়া শুরু করে পরীক্ষায় বসেছিলেন৷ ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রথম মাধ্যমিক উত্তীর্ণ টোটো মেযে হওয়ার কৃতিত্বের সুবাদে সূচনাকে প্রাথমিক শিক্ষিকা পদে নিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়৷ তিনি এখন টোটোপাড়া বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা৷ শিক্ষার প্রতি টোটোদের আগ্রহের প্রতীক হয়ে ২০০৭ সালে নজির গড়েছেন টোটোদের প্রধান ধর্মগুরু বর্তমান কাইজি শচীন টোটো৷ রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় থেকে ৪২ বছর বয়সে তিনি সেবার মাধ্যমিক পাশ করেছেন৷ ১৯৮১ সালে তাঁর লেখাপড়ায় ছেদ পড়েছিল৷ ছেদ পড়ার ২৪ বছর পর ২০০৭ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেছেন৷ কাইজি শচীন টোটো টোটোপাড়ার উপ ডাকঘরের পোষ্টমাস্টার৷ তাঁর সঙ্গেই একই বছরে মাধ্যমিক পাশ করেছেন তাঁর বড় ছেলে সুশান্ত৷ ধর্মীয় প্রধান কাইজির মাধ্যমিক পাশের নজির টোটো ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়াশুনায় জুগিয়েছে বাড়তি উৎসাহ৷
অশনি সংকেত
সবদিক থেকেই টোটোপাড়ায় এখন পরিবর্তন ও উত্তরণের ছোঁয়া৷ পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য-সংস্কৃতি, রীতি-নীতি সব দিক থেকেই দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে টোটোপাড়া৷ পিছিয়ে নেই মেয়েরাও৷ মেয়েদের ১৪টা স্বনির্ভর গোষ্ঠী রমরমিয়ে চলছে টোটোপাড়ায়৷ এরই মাঝে টোটোপাড়ায়৷ এরই মাঝে টোটোপাড়ার আকাশে জমছে ঘন কালো মেঘের অশনি সংকেত৷ বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে৷ তাঁদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে৷ কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না৷ টোটোরা নিজেদের মধ্যে সমাজবদ্ধ হয়ে থাকতে অভ্যস্ত৷ কিন্তু টোটোপাড়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রায় নেই৷ বাইরে গিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকেও তাঁরা বঞ্চিত৷ শুধু মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাশে বাইরে গিয়ে চাকরির প্রতিযোগিতায় তাঁরা সফল হয় না৷ এছাড়াও অন্য আর এক বড় আশঙ্কার কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে টোটোপাড়া৷ নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর আশঙ্কায় শঙ্কিত টোটোরা৷ সমস্যাটি টোটোপাড়ার জমিকে কেন্দ্র করে৷ টোটোপাড়ায় জমির মালিকানা এবং জনসংখ্যা দু’দিক থেকেই টোটোরা এখন সংখ্যালঘু৷ এই অবস্থার সূচনা ৫০-এর দশক থেকে৷ এখন টোটোপাড়ায় ভূমিপুত্র টোটোরা কোণঠাসা৷ অতীতে টোটোদের ব্যক্তি মালিকানায় কোনও জমি ছিল না৷ ভুটানের কাছ থেকে ইংরেজদের হাতে আসার পর টোটোপাড়ার সব জমি (১৯৯৬.৯৬ একর) সমষ্ঠিগতভাবে চিহ্নিত করে ১৮৯৫ সালে টোটোদের সামাজিক প্রধান গাপ্পুর নামে নথিভুক্ত করা হয়৷ গাপ্পু বিভিন্ন টোটো পরিবারকে জমিতে বসবাস এবং চাষবাসের অধিকার দিতেন৷ ১৯৬৯ সালের ভূমি ও ভূমি রাজস্ব আইন বলে জরিপের পর টোটোপাড়ায় ৮৯ জন টোটো পরিবারের মধ্যে ৩৪৭.৪৩ একর জমি বণ্টন করা হয় ও পাট্টা দেওয়া হয়৷ বাকি সমস্ত জমি সরকারিভাবে খাস করা হয়৷ কাউকে জমির অধিকার দেওয়ার গাপ্পুর ক্ষমতাও বাতিল করা হয়৷ সেই থেকে পরিবার ও জনসংখ্যা বাড়লেও আর কোনও টোটো পরিবার জমির অধিকার বা মালিকানা পায়নি৷ গত পাঁচ দশকে বাইরে থেকে টোটোপাড়ায় হু হু করে এসে বসতি গড়েছে নেপালীরা৷ এরা সরকারি খাস জমির পাট্টা মালিকানাও পেয়ে যায়৷ ১৯৬৯ সালে সরকারি পাট্টা দেওয়ার সময় টোটোপাড়ায় টোটোদের পরিবারের সংখ্যা ছিল ৮৯টি৷ তখন তাঁদের সবাই জমিও পেয়েছে৷ কিন্তু এখন টোটোপাড়ায় টোটো পরিবারের সংখ্যা ২৯৭৷ এরা মালিকানাহীনভাবে সরকারি খাস জমি দখল করে আছে৷ ১৯৬৯ সালে ৮৯টি পরিবারকে পাট্টা দেওয়া মোট জমির পরিমান ছিল ৩৪৭.৪৩ একর৷ টোটোদের টোটো কল্যাণ সমিতির অভিযোগ এই জমির মধ্যেও ২১৭ বিঘা জমি মাত্র ১৫,২৬০ টাকার বিনিময়ে চলে গেছে নেপালীদের হাতে৷ টোটো কল্যাণ সমিতির প্রাক্তন সভাপতি ও প্রাক্তন সম্পাদক ভক্ত টোটো এবং ধনিরাম টোটো এ বিষয়ে সমীক্ষা চালিয়ে এই তথ্য পেয়েছেন৷ সরল টোটোদের দুর্দশার সুযোগ নিযে তাঁদের ঠকিএয় এই জমি গ্রাস করেছে নেপালীরা৷ এমনকী কোনও অর্থ না দিয়ে শুধু একটি ছাগল অথবা একটি চাদরের বিনিময়েও জমির মালিকানা নেওয়ার নজিরও আছে টোটো কল্যাণ সমিতির হাতে৷ টোটোপাড়ায় টোটোদের জনসংখ্যা এখন ১৪০৭ জন৷ এর মধ্যে পুরুষ ৭৪৮, নারী ৬৫৯ জন৷ সে জায়গায় নেপালী ও অন্যান্যদের সংখ্যা এখন ১৮০০-র ওপর৷ ১৯০১ সালে টোটোপাড়ার মোট জনসংখ্যার ১৭২ জনের সকলেই ছিল টোটো৷ ১৯৫০-এর পর থেকে অবস্থা পাল্টানোর শুরু৷ সূচনায় ছিল ধীরে, পরে অত্যন্ত দ্রুত টোটোপাড়ায় জনবিন্যাস পাল্টাতে থাকে৷ টোটোপাড়ায় নেপালীদের জমি দখলে বাধা দিতে পারেনি শান্তিপ্রিয় টোটোরা৷ টোটোপাড়ায় টোটো ভোটারের চেয়ে অনেক বেশি ভোটার এখন নেপালীরা৷ টোটোপাড়া রয়েছে টোটোপাড়া বল্লালগুড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের আওতায়৷ এই পঞ্চায়েতে আসন সংখ্যা ৫টি৷ বরাবরই এগুলিতে নির্বাচিত সদস্যরা থাকতেন টোটোরা৷ গত দু’টি পঞ্চায়েতের আগের পঞ্চায়েতে একজনও টোটো সদস্য ছিল না৷ নির্বাচিত সব সদস্যই ছিলেন নেপালী৷ টোটোপাড়ার বর্তমান গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্বাচিত পাঁচ সদস্যরে মধ্যে শিবরাত্রির সলতের মতো শুধুমাত্র একজন টোটো, রূপচাঁদ টোটো রয়েছেন৷ বাকি ৪ জন সদস্য নেপালী৷ নিজভূমে এভাবে পরবাসী হয়ে যাওয়া কিছুতেই মানতে পারছে না শান্তিপ্রিয় তরুণ টোটো প্রজন্ম৷ তাঁদের আশঙ্কা, এমনটা চললে এক জায়গায় আবদ্ধ বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র আদিম জনগোষ্ঠীর টোটোরা হারিয়ে ফেলবে নিজেদের স্বতন্ত্রতা, স্বকীয়তা, সংস্কৃতি এবং রীতিনীতি৷ বিপন্ন হবে তাঁদের অস্তিত্বও৷ বিবিধের মাঝে মিলনের সুর সৃষ্টিতে থাকবে না টোটোদের কোনও ভূমিকা৷