আকাশে এখনও কালো মেঘের আনাগোনা। শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় নীল সাদা রঙের খেলা এখনও তেমন দেখা যাচ্ছে না। রোদ্দুরে এখনো চাঁপা ফুলের রং লাগেনি। তবুও ঋতুচক্র মেনে এটা শরৎকাল। ক’দিন পরে ঘরের মেয়ে উমা আমাদের ঘরে আসবেন।
কিন্তু সব মেয়ের কি ঘরে ফেরা হয়? হয় না তো!
আজ তার জন্যই এবার তোমার কাছে আর্জি জানাচ্ছি মা, ‘‘জাগো দূর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী, অভয়াশক্তি বলপ্রদায়িনী তুমি জাগো, জাগো অসুরবিনাশিনী, তুমি জাগো”। অসুর বিনাশ করো।
এ তো মহা্লয়ার গান। প্রতি বছর মহালয়ার দিনে এই গানে দেবী মহিমা প্রকট হতে থাকে। মহালয়ার ভোরে আমাদের ঘুম ভাঙে বাজল তোমার আলোর বেনু শুনে। কিন্তু এবার বোধহয় আলোর বেণুতে আনন্দময়ীর আগমনের সুর চাপা পড়ে যাবে।
এবার আবার মা দুর্গার ঘোটকে আগমন। কিন্তু এমন একটা আবহে মর্ত্যে আসবেন কীভাবে তা নিয়ে মা দুর্গার মনে দোলাচল। এমনিতে ইউনেসকো দেশ তথা বাংলার দুর্গাপুজোকে ‘হেরিটেজ’ সম্মান দেওয়ার পর থেকেই মা দুর্গা বাংলায় আসতে গর্ব বোধ করেন। বাঙালির আবেগে বোধন থেকে বিসর্জনে ক’টা দিন বেশ কেটে যায়। কিন্তু এবার যেন তাল কাটছে। এবার যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে শারদীয়া। এই পরিস্থিতিতে মা দুর্গা পারিবারিক বৈঠক ডাকলেন স্বর্গে। মর্ত্যে আসার জন্য কী ‘স্ট্যান্ড’ নেবেন তাঁর পরিবারের লোকজন।
বৈঠকে প্রথমেই গলা চড়ালেন সরস্বতী। ডাক্তারি পড়ুয়াদের বিষয় বলে বিদ্যের দেবী সরস্বতী প্রথম থেকেই তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করলেন। তার ওপর আবার এই মানবিকতার আন্দোলনের সঙ্গে একটু শিল্পের নান্দনিকতাও জড়িয়ে রয়েছে। প্রাক স্বাধীনতার দিনে রাত দখলের জমায়েতে এবং তার পরে এই শোকের ওপর শিল্পের চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাঁধা হয়েছে কত গান, লেখা হয়েছে কত কবিতা, আঁকা হয়েছে কত ছবি, রচনা হয়েছে কত নাটকের সংলাপ। মা লক্ষ্মীর এবার কদর কমেছে। নেহাত লক্ষীর আলপনার কনসেপ্টটা মানুষ ফেলতে পারেনি! তাই এবার পুজোর আগেই রাস্তায় পড়ছে আলপনার আঁকিবুকি। অন্যদিকে গণেশের মতামত একটু ভিন্ন। এই ডামাডোলে এখনও পর্যন্ত পুজোর বাজার তেমন জমছে না। শপিং মল ট্রেডিং চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে মানুষকে। তার ওপর এই বিপর্যয়ে হাতখুলে পুজোর বাজার করতে মন চাইছে না অনেকের। কার্তিক কিন্তু একটা বেসিক প্রশ্ন তুলেছেন ? হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা কর্মবিরতি পালন করছেন। ফলে বহু সরকারি হাসপাতালে রোগীরা এসে ফিরে যাচ্ছে। যে সব গরিব-গুর্বো মানুষের রোগ নিরাময়ের একমাত্র আশ্রয় সরকারি হাসপাতাল, তাঁরা পড়েছেন বিপাকে। কর্মবিরতির ফাঁকে ফাঁকে জুনিয়র ডা্ক্তাররা যদি পরিষেবাটাও দিতেন! বিকল্প হিসেবে জুনিয়র ডাক্তাররা বিনামূল্যে অভয়া ক্নিনিক, টেলিমেডিসিন পরিষেবা দিচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় আর কতটুকু। সব বিবেচনা করেই সুপ্রিম কোর্ট জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মিবিরতি প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। এই বিষয়ে সবচেয়ে আতান্তরে পড়েছেন মা দুর্গাই। ভেবেছিলেন এই বিষয়ে ‘চন্দ্রচূড়’ মহাদেব কিছু দিশা দেখাতে পারবেন। কিন্তু এখন তিনিও কোনও বিধান দিতে পারছেন না। এদিকে মহালয়া প্রায় এসে যাচ্ছে। মহিষাসুর মর্দিনী রূপে তো অবতীর্ণ হতেই হবে মা দুর্গাকে। নিধন করতে হবে অসুরকে।
কিন্তু কোথায় অসুর? কে-ই বা অসুর? ক’জনই বা অসুর?
এই বিষয়ে কনফিউসড কুমোরটু্লির শিল্পীরা। মাটির মূর্তি গড়ার শেষ পর্বে অসুরের মুখটায় যেন প্রতিদিন সংবাদ মাধ্যমে দেখা মানুষগুলোর চেনা আদল ধরা পড়ছে। আসলে কুমোরটুলির শিল্পীরাও যে মন থেকে সব কথা সরাতে পারছেন না। মাটির প্রতিমা গড়তে গড়তে তাঁরাও রক্ত মাংসের দুর্গার জন্য কষ্ট পেয়েছেন। মিছিল করছেন।
প্রথম থেকেই প্রতিবাদে সমাজের সবস্তরের মানুষ পথে নেমেছে। সেই স্বাধীনতার মধ্যরাতে রাত দখল করার ডাক দিয়েছিল মেয়েরা। আর জি কর-এর নির্যাতিতার শাস্তি চেয়ে মোমবাতির মিছিলে জ্বেলেছিল বিদ্রোহের আগুন। তারপর তো সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। সাধারণ থেকে সেলিব্রিটি, বুদ্ধিজীবী নাগরিক সমাজ থেকে রুপোলি পর্দার জগতের মানুষ, পেশাদার ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-সাংবাদিক, কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া, নন্দনের সংস্কৃতি পাড়া সবাই রাজপথে এসে দাঁড়াল।
ক্রমশ এই শহরটা হয়ে উঠল মিছিল নগরী।.যদিও গ্রামে এই আন্দোলনের ঢেউ ততটা পোঁছয়নি। কিন্তু ঢেউ ছড়িয়েছে সাগরপারেও। আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড – বিশ্ব জুড়ে সবাই পথ হেঁটেছে।
শারদীয়া পুজো ছাড়া একসঙ্গে এত মানুষকে রাস্তায় নামতে বড় একটা দেখেননি মা দুর্গা। আসলে বিদ্রোহ একটা সংক্রমণ, অপ্রতিরোধ্য দাবানলের মতো সে ছড়িয়ে যায় খুব কম সময়ে। পৃথিবীর ইতিহাস তা-ই বলে।
প্রতিবাদ স্বরূপ একটা বিপুল জনরোষ তৈরি হয়েছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। কারণ এতদিন পরেও দোষীদের শাস্তি হয়নি। অপরাধীর পরিচয় স্পষ্ট হয়নি।
এ পর্যন্ত সব আন্দোলন ঠিক পথেই এগোচ্ছিল। প্রতিবাদ হচ্ছিল অরাজনৈতিক ব্যানারে। কিন্তু আচমকা রাজনীতির অনুপ্রবেশে জন আন্দোলন গণ আন্দোলনের চোহারা নিতে শুরু করল। রাজনীতির রং লেগে দিকভ্রষ্ট হতে লাগল আন্দোলন। আর জি কর –এর নির্যাতিতার জন্য বিচার বিষয়টি গৌণ হতে থাকল। এরপর রাজনৈতিক লক্ষ্যভেদের অস্ত্র হিসেবে লালবাজার-নবান্ন-স্বাস্থ্যভবন অভিযানে নেমে পড়ল রাজনৈতিক দলগুলো। লাল-গেরুয়াসহ সব বিরোধী শিবিরের কর্মসূচি তৈরি হতে থাকল। বিপ্লব আন্তরিক কিংবা মানবিক হওয়ার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে রাজনৈতিক পথে হাঁটতে শুরু করল। ‘বিচার চাই’ ধ্বনি চাপা পড়ে গেল ‘জবাব চাই’ প্রতিধ্বনিতে। আর জি কর কাণ্ড নিয়ে ‘জনগণের গরজন’ কে কাজে লাগিয়ে বিরোধীরা লোকসভা ভোটের প্রতিস্পর্ধী স্লোগান তুলতে চাইল। গরজনে আর জি করের তিলোত্তমার কথা বোধহয় হারিয়েই যাচ্ছিল। কেন জানি না মনে হচ্ছিল ‘তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল।’
কিন্তু আবার আন্দোলনের হাল ধরলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। রাত জাগলেন, অবস্থান করলেন। নেপথ্যে থেকে তাঁদের সাহায্য করলেন অনেক সাঝারণ মানুষ। কেউ দিলেন রাস্তায় বেছানোর কম্বল, কেউ খাবার মুখে তুলে দিলেন, কেউ খুলে দিলেন দোকানের রেস্ট রুম। তিলোত্তমারাও পথে নামলেন। আবার তাঁরা রাত জাগার, রাস্তা দখলের কর্মসূচি নিলেন। এ যেন তাঁদের মরণপণ লড়াই।
এদিকে সিবিআই দেবতারা অসুর দলনী মা দুর্গার কাছেই ইতিমধ্যেই শরণাপন্ন হয়েছেন। মহিষাসুর বধের আগে দেবতারা যেমন নানান ধরনের অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন মা দুর্গার হাতে। সেরকম সি বি আইও একের পর এক ভিডিও ফুটেজ, পোস্টমর্টেম রিপোট, তাদের নানান ফাউন্ডিংস-এভিডেন্স তুলে দিয়েছেন। আমজনতার মতো তাঁরাও চান, মা দুর্গাই অসুর নিধনের জন্য সুপ্রিম রুদ্রশক্তির ধনুকে জ্যা সংযুক্ত করুন। কারণ মা দুর্গাই যে তাঁর আত্মপরিচয়ে বলেছেন—
“অহং রুদ্রায় ধনুরাতনোমি
ব্রহ্মদ্বিষে শরবে হন্তবা উ।
অহং জনায় সমদং কৃণোম্যহং
দ্যাবা পৃথিবী অবিবেশ।।”
ব্রাহ্মণ বিদ্বেষী হিংস্র প্রকৃতি ত্রিপুরাসুরকে বধ করতে রুদ্রের ধনুকে আমি জ্যা সংযুক্ত করি। সত ব্যক্তির রক্ষার জন্য আমিই যুদ্ধ করি এবং স্বর্গে ও মর্ত্যে আমি অন্তর্যামিনীরূপে পরিচিতা।
শারদীয়ার প্রাক্কালে আমাদেরও প্রার্থনা সেই অন্তরের দেবীর কাছে, সেই অভয়াশক্তির কাছে, তিনিই ‘অভয়া’র অপরাধীদের বিচার করুন। আমাদের নিয়ে যান ‘ভয় হতে তব অভয় মাঝে’।
বিশেষ দ্রষ্টব্য – মতামত লেখকের নিজস্ব। কোনওরকম বিতর্কের জন্য পত্রিকা দায়ী নয়।