কালিদাসের ‘মেঘদূত’ একটি বাজে লেখা। কথাটা রবীন্দ্রনাথের। অবশ্য ‘বাজে’ লেখা বলতে মহাকবি রবীন্দ্রনাথ যেরকম রচনাকে বুঝতেন, তারই নজির হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মেঘদূতকে টেনেছেন। শুনে প্রথমে থতমত খেয়েছি আমরা! ভেবেছি, একী কথা বলছেন কবি! অত বড় মহাকাব্য, তা কিনা বাজে কথার দৃষ্টান্তস্থল! তবে হ্যাঁ, বাজে কথা— এই কথাটাকেই ওই ‘বাজে কথা’ নামের ক্ষুদ্র রচনায় ভাল করে বাজিয়ে দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
লেখাটির শিরোনাম দেখেই প্রথম আমার চোখ দুটি বড্ড টেনেছিল, আমার বেশ মনে আছে। কিন্তু প্রথম বাক্যটিই চমকে তোলার মতো সত্য। সে কথাও ভুলিনি। বিস্ময়বোধ আর সত্যবোধকে একাকার করে দিতে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পারঙ্গম আর কে আছেন! যাকে বলে সত্য-বিস্ময়, তাই ছয়লাব হয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে।
আসলে সংসারে সমস্যা হয় মানেওয়ালাদেরকে নিয়ে। নদীর কলধ্বনি শুনে তারা নদীর কাছে জানতে চায়, এত কুলুকুলু করবার মানে কী? নদী এ কথার জবাব না দিলে এরা নদীর উপর রেগে যায়। তাঁদের এই কথাটার উপর বিশেষ কোনও আগ্রহ দেখা দেবে— যদি বলা যায়—‘অন্য খরচের চেয়ে বাজে খরচেই মানুষকে যথার্থ চেনা যায়।’
তারপরই যদি বলা হয়, ‘যেমন বাজে খরচ, তেমনি বাজে কথা।’ এবং তারপরই সত্য-বিস্ময়, ‘বাজে কথাতেই মানুষ আপনাকে ধরা দেয়।’
বাজে কথার ব্যাপারে বলতে বসে রবীন্দ্রনা্থের যে এ রকম সিরিয়াস কথা শোনাবেন, তা মোটে ভাবিনি আমরা। কবি এক জায়গায় লিখলেন, ‘যে লোক একটা বলিবার বিশেষ কথা না থাকিলে কোনও কথাই বলিতে পারে না, হয় বেদবাক্য বলে, নয় চুপ করিয়া থাকে, হে চতুরানন, তাহার কুটুম্বিতা, তাহার সাহচর্য, তাহার প্রতিবেশ—‘শিরসি মা লিখ, মা লিখ, মা লিখ।’ এই এরাই সম্ভবত মানেওয়ালা।
কিন্তু তারপরই একটি সত্য-বিস্ময় রচনা করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘পৃথিবীতে জিনিস মাত্রই প্রকাশধর্মী নয়। কয়লা আগুন না পাইলে জ্বলে না, স্ফটিক অকারণে ঝকঝক করে। কয়লায় বিস্তর কল চলে, স্ফটিক হার গাঁথিয়া প্রিয়জনের গলায় পরাইবার জন্য। কয়লা আবশ্যক, স্ফটিক মূল্যবান।’
মানুষের সাধারণ এই পার্থিব যুক্তিটাই মানেওয়ালাদের বোঝানো যায় না। সবকিছুকেই তারা দরকার দিয়ে মাপে। কয়লা কাজে লাগে। কিন্তু সোনা তো কাজের জিনিস না। তবু মানেওয়ালারা সোনাভক্ত এই জন্য যে, ওই জিনিসের বাজার দর সবচেয়ে কড়া। এই মানেওয়ালাদের কাছে মকবুল ফিদা হোসেনের চিত্রকলার দাম আছে, কেননা তার আন্তর্জাতিক বাজারে দরদাম ভাল, কিন্তু মহাকবি জীবনানন্দের কবিতার কদর তারা বোঝে না, কেননা বাংলা বাজারেও ওই কবিতার দর এখনও ওঠেনি। ওরা সব সময়ই জীবনকে নাফা দিয়ে মাপে এবং কথার সব সময় মানে চায়।
একবার এক মানেওয়ালাকে কী মরতে ফস্ করে বলে ফেলেছিলাম, ‘জানেন তো কমরেড, শব্দ নয় ঠিক, সাহিত্য বা কবিতা লেখা হয় ধ্বনি দিয়ে। ধ্বনিই আসলে সংগীতের উৎস। কবি জীবনানন্দ আসলে ধ্বনিময় গান দিয়ে তাঁর কাব্য রয়েছেন। শুনে মানেওয়ালা বলে উঠলেন, আপনার কথা কিছুই বোঝা গেল না। মাথাটা গেছে আপনার। কথাটা যা বলেন, সহজ করে বলতে পারেন না?’
লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে রইলাম।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সাহিত্যের যথার্থ বাজে রচনাগুলি কোনও বিশেষ কথা বলিবার স্পর্ধা রাখে না। সংস্কৃত সাহিত্যে মেঘদূত তাহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাহা ধর্মের কথা নহে, কর্মের কথা নহে, পুরাণ নহে, ইতিহাস নহে।’
রবীন্দ্রনাথও এই মানেওয়ালা প্রয়োজনবাদীকে সতর্ক আক্রমণ করে লিখেছেন, ‘কাব্য দেখিলে ইঁহারা প্রশ্ন করেন ইহার মধ্যে লাভ করিবার বিষয় কী আছে’… যাহা অকারণ, যাহা অনাবশ্যক, তাহার প্রতি ইঁহাদের কোনো লোভ নাই।’ না, কথাটা পুরো ঠিক নয়। সোনা অনাবশ্যক জেনেও সোনার প্রতি এদের লোভ ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা। কিন্তু সমস্যা এখানে যে, সোনা অনাবশ্যক একথা ইঁহাদের বোঝানো যায় না, কারণ সোনাই নাকি অর্থনীতির স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করে। এ কথা প্রযোজনবাদীরা আমার চেয়ে ভাল করে জানে।
বাস্তবিকই অপ্রয়োজনের আনন্দ যে কী পদার্থ তা এই মানেওয়ালাদের বোঝানো গেল না কোনও কালে। এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপের শেষ নেই। এ আক্ষেপ সব যুগের সব বড়ো কবিই করেছেন। রবীন্দ্রনাথই বরোরুচির উক্তি এ ব্যাপারে কী, সে কথা উদ্ধৃত করেছেন। সে কথা থাক। রবীন্দ্রনাথ যে সংস্কৃত শ্লোকের মর্মার্থ দিয়ে কথা পাকা করেছেন, সেইটে বলি, যে-পাঠক সেই শ্লোকার্থ জানেন, তিনি আর একবার শুনুন আর যাঁর জানা নেই, তিনিও শুনুন। শ্লোকে বলা হচ্ছে— সিংহনখরের দ্বারা উৎপাটিত একটি গজমুক্তা বনের মধ্যে পড়িয়াছিল, কোনো ভীল রমণী দূর হইতে দেখিয়া ছুটিয়া গিয়া তাহা তুলিয়া লইল, যখন টিপিয়া দেখিল তাহা পাকা কুল নহে, তাহা মুক্তামাত্র, তখন দূরে ছুড়িয়া ফেলিল।’ এই বর্বর নারীর সঙ্গে অরসিকের তুলনা করেছেন কবি বরোরুচি।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন? বলছেন, ‘আমাদের বিবেচনায় কবি (বরোরুচি) ইঁহাদের সম্বন্ধে নীরব থাকিলেই ভাল করিতেন— কারণ, ইহারা ক্ষমতাশালী লোক, বিশেষত বিচারের ভার প্রায় ইঁহাদেরই হাতে। ইহারা গুরুমশাইয়ের কাজ করেন।’
এই গুরুমশাইরাই মানেওয়ালা। ইদানিং এঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে অবস্থান করেন।
যা হোক কথা শেষ করি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সাহিত্যের যথার্থ বাজে রচনাগুলি কোনও বিশেষ কথা বলিবার স্পর্ধা রাখে না। সংস্কৃত সাহিত্যে মেঘদূত তাহার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাহা ধর্মের কথা নহে, কর্মের কথা নহে, পুরাণ নহে, ইতিহাস নহে।’
তাহলে মেঘদূত কী?
রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘যে-অবস্থায় মানুষের চেতন-অচেতনের বিচার লোপ পাইয়া যায়, ইহা সেই অবস্থার প্রলাপ। ইঁহাতে যদি কেহ বদরীফল মনে করিয়া পেট ভরাইবার আশ্বাসে তুলিয়া লন তবে তখনই ফেলিয়া দিবেন। ইহাতে প্রয়োজনের কথা কিছুই নাই। ইহা নিটোল মুক্তা, এবং ইহাতে বিরহীর বিদীর্ণ হৃদয়ের রক্তচিহ্ন কিছু লাগিয়া আছে, কিন্তু যেটুকু মুছিয়া ফেলিলেও ইহার মূল্য কমিবে না।’
এমন প্রলাপ জীবনানন্দেও বিস্তর।