নূতনেরে দিল ডাক

বৈশাখ মানেই বাঙালির নববর্ষ এবছর হল ১৪৩২সুখে দুঃখে, আনন্দে বেদনায়, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে গত বছরটি কেটে গিয়েছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে এই নতুন বছরেও। শুধু কি এই বছরে? এমন ঘটনা ঘটবে বছরে বছরে। বাঙালির অনুভূতিতে পয়লা বৈশাখ এক নতুন দিন, নতুন বিশ্বাসে জেগে ওঠার দিন। এই দিনটি আত্মজাগরণের দিনও বটে নতুন শপথের, নতুন অঙ্গীকারের। পার হয়ে আসা বছরের ভুল ত্রুটিকে জীবনের খতিয়ান থেকে মানুষ মুছে ফেলতে চায়।

বাঙালির নববর্ষ পালনের ইতিহাস খুব একটা পুরাতন নয়। এ ধারাটি এসেছে মূলত ইংরেজদের নিউ ইয়ার উদযাপন দেখে। ইংরেজরা যে পরিমাণে হুল্লোড়বাজি করে থাকে নিউ ইয়ারে, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাঙালি জমিদার বাড়িগুলিতে নববর্ষ উদযাপনের যাত্রা শুরু হয় মূলত পলাশীর যুদ্ধের পরে শহরের ধনী সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে বাবু-সংস্কৃতির আমদানি ঘটে যায় অনায়াসে। বছরের প্রথম দিনে জমিদার বাড়িগুলিতে পূজা পার্বণের পালা চলত। সন্ধ্যায় ঘুঙুরের বোলে রঙিন হয়ে উঠত বাহিরমহল। বিমল মিত্রের উপন্যাসগুলিতে তার পরিচয় আছে।

পয়লা বৈশাখ মানে নতুন গানের প্রকাশ, নতুন সিনেমা শুরু, নতুন জামা কাপড় পরার আয়োজন বইপাড়া জমজমাট নতুন গান অবশ্য এখন আর প্রকাশিত হয় না তবে বইপাড়া তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে মিত্র ও ঘোষের মতো বহু সংস্থা একটা খাতা খুলে রাখেন অতিথি যাঁরা এসেছেন তাঁরা তাঁদের মন্তব্য লিখে রাখতে পারেন এই খাতায় প্রতিবেদক এ বছরে হাজির মিত্র ও ঘোষ, দেব সাহিত্য কুটীর, লালমাটি প্রকাশন, শশধর প্রকাশনী, কিশলয় প্রকাশন, শিক্ষাতীর্থ, দে বুক স্টোর প্রভৃতি প্রকাশকদের ঘরে ঘরে অবশ্যই নিমন্ত্রণের সূত্র ধরে। বহু লেখকের আনাগোনা ঘরে ঘরে অঢেল মিষ্টি ও ঠান্ডা পানীয়র ব্যবস্থা কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ার বর্ষীয়ান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম সবিতেন্দ্রনাথ রায়। ভানুদা নামেই কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ায় তাঁর পরিচিতি। তিনিও এই অশক্ত শরীরে হাজির ছিলেন তাঁর প্রকাশন সংস্থায়। এই দিনে পঞ্জিকা বিক্রিও দেখার মতো। বিশুদ্ধ  সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই হোক অথবা বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকাই হোক। নতুন বছরেও বই প্রকাশিত হয়েছে এই প্রতিবেদকের হাত দিয়েই ভূদেব চন্দ্র ভৌমিকের লেখা ‘মরুদ্যানে শ্বেতপদ্ম’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে লালমাটি প্রকাশনের ঘর থেকে।  

আর নতুন বাংলা বছরে সিনেমাতো মুক্তি পাবেই। এ বছরের দুটি আলোচিত ছবির মুক্তি ঘটল এই সময়ে। সুমন ঘোষ পরিচালিত ‘পুরাতন’ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত প্রযোজিত সেই ছবিতে ১৪ বছর বাদে বাংলায় অভিনয় করতে এলেন শর্মিলা ঠাকুর। মা ও মেয়ের গল্প সেই দুই চরিত্রে শর্মিলা ও ঋতুপর্ণা অন্য ছবিটি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘কিলবিল সোসাইটি’ দর্শকদের মনোরঞ্জনে কতটা সফল হয়েছে ছবি দুটি সেটা একটা বড় প্রশ্নই বটে।।

অথচ এক সময় এই নববর্ষে মুক্তি পাওয়া কিছু ছবির নাম বললেই বোঝা যাবে যে, কতখানি আকর্ষণীয় ছিল সেইসব ছবিগুলি যার মধ্যে রয়েছে বসু পরিবার, পঞ্চতপা, মেঘে ঢাকা তারা, জিঘাংসা, অগ্নিসংস্কার, স্বরলিপি, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, চারুলতা, জীবন মৃত্যু, ছুটি, পিতা পুত্র, অনিন্দিতা, মোহনবাগানের মেয়ে, আমি সে ও সখা প্রভৃতি ছবিগুলি। বাংলা ছবির শুভ মহরৎ ঘটত এই পয়লা বৈশাখের দিনে। অঞ্জন চৌধুরী পরিচালিত ‘মুখ্যমন্ত্রী’, স্বপন সাহা পরিচালিত ‘বাবা কেন চাকর’ -এর মত সুপারডুপা টহি  লায়ছবির মহরৎ ঘটেছিল এই প বৈশাখের দিনেই।

১৮৭২ সালের প্রকাশিত হয়েছিল পয়লা বৈশাখের দিনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাটি। বাংলা বছরের প্রথম দিনটি শুভ এই কথা মনে রেখেই বিদ্যাসাগর মশাই এর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বর্ণ পরিচয়’-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। পয়লা বৈশাখে পথ চলা শুরু হয়েছিল উপেন্দ্র রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল সুরেশ চন্দ্র সমাজপতির ‘সাহিত্য’ এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’ পত্রিকারতাদেরও যাত্রা শুরু পয়লা বৈশাখে।

তবে নানান দিক থেকে বাঙালি আজ বিভ্রান্ত কোন দিকে যাবে, কোন পথে যাবে, কোন ধর্মমতকে অবলম্বন করবে এই নিয়েই বাঙালি বিভ্রান্ত। তবে বাঙালিকে মনে রাখতে হবে যে এই দিনটি কিন্তু বাঙালির নিজের অস্মিতাকে ফিরে পাওয়ার দিনও বটে সেটি ভুলে গেলে কিন্তু মহাকবি কালিদাসের মতই হবেযে ডালে বসে আছি সেই ডালটা কেটে আত্মহননের পথে হেঁটে যাওয়ার উপক্রম হবে। যা কিছু জীর্ণতা, যা কিছু দীনতা, সবকিছু পিছু ফেলে রেখে বাঙালিকে নতুন উদ্যমে জেগে উঠতে হবে। এই নববর্ষ সেই শপথ নেওয়ার, সেই অঙ্গীকার করার দিনও বটে।