কদাচ মত্ততা আসে আমাদের মামুলি জীবনে;
ভুলে গিয়ে আপনার সুখ-দুঃখ অভাব-বেদনা
ধরণীর ধুলিধূম্র ভুলে গিয়ে ক্ষণ-বিস্মরণে
অসীম উদার নভে থরে থরে কুসুম-রচনা।
আমাদের চারিদিকে ক্ষুব্ধ সিন্ধু উদ্বেল নিয়ত,
অবিশ্রাম করে তাড়া আগে পিছে হাঙর কুমীর;
গায়ে লাগে জেলিমাছ, জ্বালা করে, ক’রে যায় ক্ষত,
ভাসি আর দিই ডুব- পণ্ডশ্রমে থাকি যে অস্থির।
তীরে উঠি সেখানেও আমাদের নাহেক বিশ্রাম,
তপ্তবালি মরুভূমি ধুধু করে দিগন্ত জুড়িয়া—
পাগলের মতো ছুটি, সারা অঙ্গে ছুটে কালঘাম,
মৃত্যুদূত শকুনেরা ডাক দেয় উড়িয়া উড়িয়া।
পাশাপাশি কেহ নাই, দূরে দূরে ভাসিতেছি সবে,
ছুটেছি কাঙাল যেন ধরণীর উচ্ছিষ্ট উৎসবে।
ক্ষুধার্ত কাঙাল চক্ষে গত রাত্রে লেগেছিল ঘোর,
মত্ততা আসিয়াছিল নেশাছুট জীবনে মোদের –
গরিবের কুঁড়েঘরে চুপি চুপি এসেছিল চোর,
খোয়া গিয়েছিল কিছু গৃহস্থালী—সমাজবোধের।
বাদশাহী মসনদে বসেছিনু আবুহোসেনেরা,
কাব্য-পরী-হুরীদল করেছিব নৃত্য চারিপাশে—
স্বল্পমূল্য আসবের দুই পাত্র অমৃতের সেরা,
নন্দনের ইন্দ্রসভা রচেছিনু মনের আকাশে।
ধরণীর ধূলিযজ্ঞে আবির্ভূতা কবিতা-পাঞ্চালী
পঞ্চ পাণ্ডবের কন্ঠে দিয়েছিল বরমাল্যখানি,
এক রাত্রে জীবনের পানপাত্রে স্বপ্নসুরা ঢালি
বারংবার করি পান, উল্লাসেতে ফেলে দিই টানি।
ক্ষুধার্ত কাঙাল মোরা, মেতেছিনু বাহুল্য-উৎসবে,
করি নাই কোলাহল, কাব্য–স্বপ্নে মত্ত ছিনু সবে।
দরিদ্রেরে রাজ্যখণ্ড তুমি দান করিয়াছ কবি,
সংসারের কোলাহলে ভুলে যাই, করি না স্বীকার—
ক্ষণে ক্ষণে উর্ধ্বে উঠি, অকস্মাৎ সে স্বরাজ্য লভি
চকিতে বিস্ময় মানি লভিয়া বিপুল অধিকার।
কেবা রাজা ভুলে যাই, প্রজাদলে কে করে পীড়ন,
শাসন-শৃঙ্খল-ভার মন-বহ্নি করে ভ্স্মসাৎ—
রাজ্য নিয়ে কাড়াকাড়ি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বাধে ঘোর রণ,
মানুষের অধিকারে মানুষেই হানে সে আঘাত।
আমাদের রাজ্যখণ্ডে সে অশান্তি করে না প্রবেশ,
হে সম্রাট গত রাত্রে পশিলাম সাম্রাজ্যে তোমার —
ভুলে গেনু উর্ধ্ব অধঃ, ভুলে গেনু স্থান কাল দেশ,
কোথায় পাতালগর্ভে ডুবে শব্দ মারণ-বোমার
কাব্যমদে মত্ত মোরা এক সন্ধ্যা নিশ্চিন্তে ছিলাম,
সবাই স্বাধীন- শুধু ভালোবেসে লই তব নাম।
মানুষের স্বার্থ, তার বহু উর্ধ্বে মানুষের প্রেম,
কাব্যের আকাশে শুধু সেই প্রেম নিত্য জেগে রয়।
কল্পনা-পাখায় উড়ি মোরা সেথা ভাসিয়াছিলেম,
পিছনে পড়িয়াছিল ধরণীর দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভয়;
দেখিলাম, শূণ্যে শূণ্যে লক্ষ লক্ষ আত্মীয় আত্মার
অবাধে ভ্রমিয়া ফেরে, কহে কানে আশ্বাসের বাণী,
বহুশত যুগান্তের মানবের প্রেম-সমাচার,
বিচিত্র ভাষায় ছন্দে শুনাইল কন্ঠে কন্ঠে আনি।
এ যুগের প্রেম–কথা আমরাও শুনানু তাদের,
কহিলাম, আমাদের চিত্তে তবু জাগে যে সংশয়–
ধূলার ধরণী হতে আর্তস্বর যে প্রতিবাদে
আজো ভেসে আছে শূণ্যে মানুষের বাণী তাহা নয়।
সংশয়-তিমির–ছেঁড়া রৌদ্রালোকে অনির্বাণ–হাসি,
শুনিলাম কন্ঠে কন্ঠে এক বাণী—“তবু ভালবাসি”।
ভালবাসি,ভালবাসি—ধরাবাসী মোরা ভীরু প্রাণী,
একান্তে নিকটে পেয়ে ভয়ে মরি কখন হারাই–
প্রেমের বিজয়-ধ্বনি নহে তাই আমাদের বাণী,
বুকে টানি ভালোবেসে, ঘৃণাভরে তখনই তাড়াই।
মানুষের ভালবাসা আজো ধরে হিংসা-হত্যারূপ
প্রেমের আকাশ আজো অবিশ্রাম শোণিত-বন্যায়,
সাগর-বেলায় মোরা খনিতেছি সংশয়ের কূপ—
অতল শান্তির বুকে জাগে ভাঙে বুদ্বুদ–অন্যায়।
এত বাধা ভেদ করি মানুষের প্রেমের প্রয়াস,
তাই এত সুদুর্লভ আমাদের ভালবাসাবাসি—
সে প্রেমে সুলভ করে ক্ষণিকের কাব্যের বিলাস,
মত্ততা–তরঙ্গে কাল দ্বিধা দ্বন্দ্ব গিয়াছিল ভাসি।
ধরার ক্ষুদ্রতা ছাড়ি গত রাত্রে উঠিয়াছিলাম,
দেখেনু আকাশ-ভালে ধরার মহৎ পরিণাম।
—-
শনিবারের চিঠি, আগস্ট, ২০১৪