bhanu bondopadyay

বাবা ও আমি

আজকে বাবার সাহচর্যে আমার বড় হওয়ার গল্প শোনাই।

শুনেছি আমি জন্মাবার পর থেকে বাবা সাফল্য লাভ করতে শুরু করেন। আমার স্কুল জীবন বাবার সঙ্গে তেমন করে কাটানো হয়নি, কারণ বাবার কর্মজীবন তখন ব্যস্ততার তুঙ্গে। আমার মনে আছে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কোন ক্লাসে পড়ি, বাবা ভুল ক্লাস বললেন। 

আমার অভিনয় জীবন কিন্তু বহু ছোট বয়স থেকে শুরু। আমার যখন মাত্র আড়াই বছর বয়স তখন আমি ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ও ‘শুভরাত্রি’ বলে দুটি ছবিতে অভিনয় করি। তাও আবার যে সে ব্যাপার নয়, মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ছোট ভাইয়ের চরিত্রে।

বাবা ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার সাধ মেটাতে ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ বলে একটি ছবি প্রযোজনা করেন যাতে আমি বাবার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করি। আমার আশেপেশের লোকেরা আমার পরিবারের লোকের মতো বলেই আমার অভিনয় করতে কোন অসুবিধে হয়নি।

এরপর আমার ১৩ বছর বয়সে তপন সিনহা পরিচালিত রবীন্দ্রনাথের ছবি ‘অতিথি’তে অভিনয় করার সুযোগ আসে। বাবা প্রথমে খুব রাজি না থাকলেও তপন কাকুর ছবি বলে রাজি হয়ে যান। কিন্তু আর নয়, ওখানেই শেষ। 

Basabi Bndopadyay
‘অতিথি’ সিনেমায় বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায়

আমি বড় হচ্ছি, এবার কলেজে ভর্তি হওয়ার পালা। না, বাবা দূরের কলেজে যেতে দেবেন না। তাই বাড়ির সবচেয়ে কাছের কলেজে ভর্তি হই। 

বাবার এক কথা– বেশি পড়াশোনা করে কী হবে, এই তো কিছুদিন পরেই বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু মজার কথা জানেন,বাবার মা ছিলেন তখনকার দিনে সিনিয়র কেম্ব্রিজ পাশ করা ও সেই জমানায় স্কুল ইন্সপেকট্রেস ছিলেন। 

বাবা যখন নিয়মিত মঞ্চে অভিনয় করতেন আমি কিন্তু প্রায়ই বাবার সঙ্গে যেতাম আর পিসী, জ্যেঠু, কাকুদের আহ্লাদ খেতাম। আমার যুবতী বয়েসে আমি বাবার সঙ্গে অনেক ক্যাসেটে অংশগ্রহণ করেছি, এতে অবশ্য আমার মা এর উত্সাহই বেশি ছিল। 

বাবা আমার অনেক ইচ্ছেপূরণ করতেন। যেমন ‘সাগিনা মাহাতো’র শুটিং এর সময় স্টুডিও নিয়ে গিয়ে দিলীপ কুমারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। আমি ওঁর অন্ধ ভক্ত, ওঁকে সামনে দেখতে পেয়ে আমার তো প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অবস্থা। 

বাবা আমাকে কখনো বকতেন না। একবার বম্বে ও কলকাতার শিল্পীদের মধ্যে প্রদর্শনী ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে। খেলা চলাকালীন আমি, উত্তম কাকু ও সোমা (সুপ্রিয়া দেবীর কন্যা) বসে গল্প করছি। যখন বাড়ি ফিরছি, লক্ষ্ করলাম বাবা বেশ গম্ভীর। বাড়ী ফেরার পর মা আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি উত্তম বাবুকে প্রণাম করনি?’ (এটা আমাদের তখনকার দিনে রেওয়াজ ছিল)। 

আমি মা কে বললাম তখন তো আমি উত্তমকাকুকে দেখছিলাম না, একজন মুগ্ধ ভক্তের মতো উত্তমকুমারকে দেখছিলাম। 

Uttam Kumar

এইসব প্রথা, নিয়ম কানুন না মানলে বাবা অসন্তুষ্ট হতেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, বাবা হাতকাটা ব্লাউজ, লিপস্টিক লাগানো এইসব একদম পছন্দ করতেন না।

সময় বয়ে চলেছে, আমি গ্র্যাজুয়েট হলাম, ওই যে বলেছিলাম, বাবা বলেছিলেন বিয়ে দিয়ে দেবেন, ও মা ওঁর দিক থেকে তো কোন উদ্যমই দেখছি না! 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে এম.এ পড়তে শুরু করলাম। আমি তো মহা আনন্দে আছি যে আমাকে তো পুরোটা শেষ করতে হবে না। কারণ, বাবা তো বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু মহাব্যস্ত বাবার দিক থেকে কোন উচ্চবাচ্চ নেই। সময় হল, মা আমায় পাত্রস্থ করলেন।

একদিনের একটা মজার গল্প মনে পড়ল। বিয়ে ঠিক হবার পর একদিন আমি আমার হবু বরের সঙ্গে টেনিস ক্লাবে দেখা করতে গিয়েছি, বাবাকে বসুশ্রী সিনেমা (বাবার আড্ডাস্থল) থেকে তুলে নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা। হলের সামনে গিয়ে দেখি, বাবা রাস্তার ওপর কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু আমি বকুনি না খেয়ে বেচারা ড্রাইভারটা বকুনি খেল দেরি করার জন্য।

ও হো, বলাই তো হয়নি – বিয়ে হয়ে গেল পরে পরীক্ষা দিতে হবে না ভেবে যে আনন্দটা পেয়েছিলাম সেটা পূরণ হলনা, পরীক্ষা দিতেই হল। ডিগ্রিটা পেয়ে অবশ্য মনটা খুশি হয়ে গেল।

বাবার এই উপদেশটা আমায় উল্লেখ করতেই হবে। আমার বিয়ের আগের দিন বাবা আমায় কাছে ডেকে বললেন ‘তোমার মা কোনোদিন শাশুড়ির সম্পর্কে নালিশ করেননি, তোমার থেকেও আমি সেটাই আশা করব’।

আমার বাবা খুব নিশ্চুপে পরোপকার করে যেতেন। উনি মারা যাওয়ার পর কত কলাকুশলী যে আমাদের এসে বলেছেন ‘আমাদের মাথার ওপর থেকে একটা হাত চলে গেল, কোনদিন ওঁর কাছে সাহায্য চেয়ে নিরাশ হইনি।’

বলে রাখি, আমি কিন্তু বাবার ধারা বহন করার প্রচেষ্টায় বাবার কৌতুক নক্সা পরিবেশন করে থাকি। সেটাই বাবার প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ।