Dementia

ডিমেনশিয়া

কীরকম এক হলুদ-আলোর-ভেতরে ডুব-দিয়েছে চারধার…। ধীর-চোখে পার্কের আশপাশে আরও একবার চাউনি-বুলিয়ে-নিল শিমুল। দোলনা, সি-সঅ, স্লিপ-স্লাইডিং…কচিকাচাদের হুটোপাটি। একটু কোণের দিকে সারি-ক’রে সাজানো ঝাউগাছগুলোর পাশে একহাত অন্তর এক-একটা পাথরের বেঞ্চ। বেশিরভাগেই ঘনিষ্ঠ-হ’য়ে-ব’সে যুগলেরা। ঝাউঝোপের দিকে মুখ-ফেরানো। একটা বেঞ্চও খালি নেই আজ। বাচ্চাদের উল্লাসের টুকরো, ঘটিগরমওয়ালার পায়ের ঝমঝম, উঁচু-নীচু স্বরগ্রাম, ছেঁড়া-ছেঁড়া ফিসফাস… অনর্গল বেজে-চলেছে কাছেপিঠে। ঘাসের কার্পেট এখন গাঢ় সবুজ। কথা ভেসে আসছিল।

–তোর দাদা যেভাবে আমাকে দেখছিল না! গিলে খেয়ে নেবে যেন…কাচের চুড়ির মতো ভেঙে-ভেঙে গেল একটা সুরেলা হাসি…। 

শিমুল চুপ। ইচ্ছের প্রতিকূলে গিয়েও কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না কানদুটো। উত্তাল স্রোত নিয়ে ভেসে আসছে কেবল।

–ও’ কাকু-কাকিমাকে বলে দেয়নি এই তিনমাসেও?…উত্তরটা আবছা। গুঁড়ো-গুঁড়ো। কাছাকাছি আসার আগেই দমকা হাওয়া গিলে-নেয় তাদের। শিমুল শ্বাসবন্ধ রাখে।

–হেব্বি ব্ল্যাকমেলিং করতে জানিস, মাইরি!…এই ভিডিওটা দেখিস, এইমাত্তর সেন্ড করলুম হোয়াটস-অ্যাপে। এখন না, পরে দেখিস… রাত্তিরে… তাপ্পর পিং করিস, হুঁউ?

আচ্ছা, পৃথিবীর প্রথম বধির মানুষ কে ছিলেন? তিনি কি হোমো- স্যাপিয়ান্স?… প্রাণপণে ভাবার চেষ্টা করে শিমুল। চোখ বন্ধ। ভ্রূ-ভাঁজে নকশা।… কে আবিষ্কার করেছিলেন হিয়ারিং-এইড? শব্দের গতিবেগ সেকেণ্ডে যেন কত? কত ডেসিবেল মানুষের শ্রুতিসীমার বাইরে প’ড়ে থাকে?…

বিকেলের মরা আলোটি কীরকম গ্যাঁট-হ’য়ে চেপে-বসেছে দ্যাখো, একেবারে রাক্ষুসে-হাওয়ার বুকের ওপরে। এই কালচে-হলুদ-আভায় সমস্তটাই ঘষাকাচের ভেতর-দিয়ে-দেখা বায়োস্কোপের ছবি। বড্ড মায়াবী। অদ্ভুতুড়ে। দৃশ্যরূপ নেই। শুধু জায়গায়-জায়গায় তালগোল-পাকানো ছায়ার পিণ্ড।

–কাল বিকেলে ঝিলপাড় যাবি? কদ্দিন যাইনি বল তো?… 

‘ঝিলপাড়’ শব্দটা ‘ঝিলপরি’-হয়ে ক্রমাগত ডানা-নাড়ায় শিমুলের বাঁ-কানে। উল্টোদিকের কথাগুলো হাওয়া-রাক্ষসই চিবিয়ে নিচ্ছে বুঝি! বোঝা যায় না। ভেজা-ভেজা। ঝুরো। নরম।

–জানিস, তুই যখন ফোন করলি কাল রাত্তিরে, ঠিক তক্ষুনি ‘কিক’ করল মেসি… উফফ… সেই বাঁ-পা… ঘেঁটে ঘ-হয়ে গেল ম্যাচটা পুরো… তখন তোকে সামনে পেলে কী করতুম জানিস তো?… 

না, শিমুল জানে না।

জানা-বোঝার আগেই ডান-কানের-পাশে মেসি। মাথা অল্প-ঝোঁকানো। মণি স্থির। পেনাল্টিতে শট নেবেন এইবারে। দুই-কানের দুই-গর্তে আঙুল-ডুবিয়ে জোরে-জোরে ঝাঁকাতে থাকে সে।

ঝিলপরি যাবে না। ভারী দুষ্টু। ফাজিল। ওই দ্যাখো, হাসছে তো হাসছেই।…

মেসিই বা কম যান কীসে? ধ্যানী বুদ্ধের ঠোঁটে শান্ত থাকতে বলছেন সতীর্থ-খেলোয়াড়দের। এই ‘কিক’ নিলেন বলে…

মাথায় ঝিমঝিম-ঝনঝন। দমকা-লাফে সামনে উঠে এল শিমূল। 

জোড়া-জোড়া অবাক চোখ। পাগল-ছাগল! গাঁজাখোর! খামোখা জাম্প দেয় কেন?

আমাদের পূর্বপুরুষ বাঁদর ছিলেন। বাঁদরের লেজ আছে। বাঁদর লাফাইতে পারে। আলবাত লাফাইতে পারে।… মুখস্থ-করা পড়া যেন! মনে মনে বিড়বিড়োয়। ঝালিয়ে-নেয় বারবার। আচমকা চোখ-ঠেকে-গেল ছাইরঙা-ডাকটিকিটের-মতন আবহটায়। হুঁশ ফিরে আসে।

বিকেলের মরা আলোটি কীরকম গ্যাঁট-হ’য়ে চেপে-বসেছে দ্যাখো, একেবারে রাক্ষুসে-হাওয়ার বুকের ওপরে। এই কালচে-হলুদ-আভায় সমস্তটাই ঘষাকাচের ভেতর-দিয়ে-দেখা বায়োস্কোপের ছবি। বড্ড মায়াবী। অদ্ভুতুড়ে। দৃশ্যরূপ নেই। শুধু জায়গায়-জায়গায় তালগোল-পাকানো ছায়ার পিণ্ড।

সবচেয়ে কাছে বসে আছেন যে বৃদ্ধ— তাঁর জামার রঙটা বোঝার চেষ্টা করল অনেকবার। চোখ কচলে-কচলে। যাচ্চলে, রংকানা হয়ে গেলাম নাকি?…

ঝাউবনে, উঁচুগাছের মাথায়-মাথায় কাঁপন। কিচিরমিচির। চিকিরমিকির। পাখিদের বাসায় ফেরার সময় হল, মনে হয়। শেষ-ফাগুনের ফ্যাকাশে-বেলায় মচমচ-ওঠে ঝরাপাতার শরীরে।

আহ্‌… অসহ্য! ঝপ-ক’রে উঠে দাঁড়াল। চলে যেতে হবে।

ঝাপসা অন্ধকারে বুঝি নড়ে-ওঠে সেই ছায়ামূর্তি দু’জনা। আস্তে-আস্তে শূন্য হয়ে-যাচ্ছে পার্ক। ঝিমিয়ে পড়ছে ঘাড়-গুঁজে। শিশু-গলা সব গেল কোথায়! মাথার ওপর কা-কা-কা। আরে, সেই কাকটা না!

স্নায়ুতে-স্নায়ুতে ঠোকাঠুকি! দু’বার ‘চিড়িক’ ‘চিড়িং’… বৈদ্যুতিন- ছ্যাঁকা … ঘিলুর গভীরে। অন্ধকারে।… সেদিনও ডেকেছিল কাক। নাগাড়ে। নিয়তিপুরুষের কণ্ঠে।

শিমুল শুনতে পায় তরীকে। তরী বলেছিল, ঠিক এই সময়েই, এই সন্ধে-ঘনিয়ে-ওঠার প্রাকমুহূর্তে, এই এখানেই ও’ এসে দাঁড়াবে। শুধু শিমুলের জন্য।

ঘর-পরিজন-বন্ধন সব ছেড়ে নতুনজীবনে ঝাঁপ দেওয়ার আগে কোমর বেঁধেই আসবে। শিমুল-তরী। তরী-শিমুল। এই জীবনের জন্যেই না দিনের পর দিন ধ’রে স্বপ্ন-বুনে-গেছে ওরা! কত কোলাজ। ড্রিম-সিরিজ। বকবকম। তারপর ঠান্ডা-মাথায় পরিকল্পনা-ছকে একরকম বাধ্য হয়েই বেছে নেওয়া হয়েছে এই ঘুরপথ। নির্বাচন করেছে তরী নিজেই। 

আচ্ছা, ও-ই তো গোটা প্ল্যানটা মাথার মধ্যে ক্যালকুলেশন ক’রে সাজিয়ে তারপর শিমূলকে জানিয়েছিল? উপায়ও বাতলেছে ও-ই? তারওপর সেদিনের শিমুল গাছটাকে আগামী বিকেলের অপেক্ষায়-রেখে একপা-একপা-হেঁটে মিলিয়ে-গেছে পার্কের বাইরে। কাকের আর্তডাকে। আলো। ছায়া। রাস্তায়।…

কেন তুমি কোনও নিজস্ব মুঠোফোন রাখোনি, তরী? 

হ্যাঁ, জানি, চড়ুইপাখির অস্তিত্ব-সংকটের এই ‘সো কলড’ স্মার্ট-সময়ে ‘মুঠোফোন’ বস্তুটাকেই রীতিমতো ঘৃণা করতে তুমি। আমাকে… আমাকেও শিখিয়েছিলে ঘেন্না করতে।

তাই, লাস্ট-মিনিট-সাজেশনেও তোমার পরিকল্পনায় রুপবদল ঘটাওনি একচুল। নিখুঁত প্রোগ্রামিং। প্ল্যানিং। তোমার পাশের বাড়ির যে’ বাচ্চাটার কথা তুমি বলতে, বান্টি, যে’ নাকি কম্পিউটার-গেমসের পোকা… এক্কেবারে ওর মেশিনে প্রোগ্রাম-করা থ্রি-ডি-গেম…। সজীব। ঝলমলে। বহুমাত্রিক।

চোখের সামনে নাগরদোলাটা ঘুরতে শুরু করেছে। সাঁই-সাঁই বাতাস কাটে। দ্রুত। আরও দ্রুত।

সত্যিই কি বলেছিলে? সত্যি সত্যিই? নাকি অন্য কেউ বলেছিল, অন্য কারোকে?… অথবা গল্পে পড়েছিলাম? সিনেমার-পর্দায় দেখা?

কলেজ-লাইফের ঘটনা বুঝি? কোন্‌ জীবনের গো!…

ফিলমের-রোলটা ঘুরছে সমানে। বুদবুদের-মতো গড়িয়ে, ফেটে, চুপচাপ মিলিয়ে-যায় দৃশ্যাবলী…। টেনিসবলের-ধাঁচে কয়েকবার ড্রপ-খেয়ে, ধীরে-সুস্থে বেরিয়ে গেল ফ্রেমের চৌখুপী ছেড়ে।

এই কাকটা। হ্যাঁ, এই কাকটাই সেদিন মাথার ওপরে গাছের নিশুত-ডালে ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে শুনেছিল না, বাসা-বাঁধবার সবটুকু গোপনীয় রূপকথা! ঐ কাকটাই, নাকি…না-না, ও-ই, ও ওই শুনেছিল।…আর, পরের সন্ধে-থেকেই, রোজ, এই ঝুপসি সময়টাতে ও’ ফিরে আসে নিজের সংসারে।

শিমুল চেয়ে দেখে। নিঃঝুম। যেন বা মাঝরাতের চিল্ড্রেন্স-পার্ক। যৌবন-খোয়ানো। থুত্থুরে। পিছনদিকের পাঁচিল-টপকে, ঘোরানো গ্রিলগেট ঠেলে টপাটপ ঢুকে পড়ছে কারা। ঝোপে-ঝোপে জ্বলে-ওঠে আগুনের ডেলা। ধোঁয়া। গন্ধ।

কপালের দু’পাশের রগ সজোরে টিপে ধরল সে। টেনিস বলটা কপালের দুই-দেওয়ালে ক্রমাগত ড্রপ খাচ্ছে এখন।… সবই হয়ত বহু জন্ম আগে মুখে-মুখে-শোনা গাঁজা-গপ্‌পো…। জনশ্রুতি। পাদ্রীপাড়ার ওদিকে এরকম কিছু হয়েছিল না একটা?… কিংবা ওর প্রাণের দোস্ত, বুজুম-ফ্রেন্ড শৌভিকের জীবনের ঘটনা?

… আচ্ছা, ও’ শৌভিকের জীবনই কাটিয়ে দিচ্ছে না তো?… অথবা… অথবা… ও-ই কি শৌভিক?… সবকিছু জড়ামড়ি হয়ে যায় ক্রমশ। এটা-ওটা-সেটা একাকার।…

 

দুপদুপদুপ… জানান দিচ্ছে হৃৎপিণ্ড। জামার-কলার-খামচে ঘোলাটে চোখে আরও ঘোলাটে হ’য়ে-যাওয়া নেগেটিভে চোখ রাখে। শ্বাস পড়ছে ঘনঘন… 

ওকি, আবার কা-কা-কা! এই ভর সন্ধেয়ও! একটানা!

শোনো শিমুল, ওই লাস্ট-বিকেলটার পর তোমার গুনে-রাখা উচিত ছিল পরবর্তী বিকেলের সংখ্যাগুলো। তুমি জানো, তারপর কত-কত বিকেল এসে নিভে-গেছে আজকের এই ধুলোর পৃথিবীতে? জানো না, না? ইউ ফুল…

তবুও বকবে তুমি, তরীকে। খুব। খুউব। কেন??

দেখা তো হবেই। একদিন। কোনও একদিন।… নৈহাটি না হালিশহর, ঠিক কোন্‌ শহরে যেন তোমার বাসা ছিল তরী? একশো-এক ধাঁধা। অ্যালজেব্রার জটিল-ফর্মুলা। অগুন্তি ব্ল্যাক-হোল। অনন্ত। অসীম। রহস্যঘেরা মহাবিশ্ব।

… তবু, দেখা তো হবেই। পৃথিবী যে ছোট এত! এইটুকুন…

এই কাকটা। হ্যাঁ, এই কাকটাই সেদিন মাথার ওপরে গাছের নিশুত-ডালে ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে শুনেছিল না, বাসা-বাঁধবার সবটুকু গোপনীয় রূপকথা! ঐ কাকটাই, নাকি…না-না, ও-ই, ও ওই শুনেছিল।…আর, পরের সন্ধে-থেকেই, রোজ, এই ঝুপসি সময়টাতে ও’ ফিরে আসে নিজের সংসারে।

সব পাখি ঘরে ফেরে…। আর তরী, সে ফিরবে না? নিশ্চিত ফিরবে।

শিমুল মনের অতলে হাতড়াতে থাকে। নিশ্চই ফিরবে। কিরে, ফিরবে না?

খসখস… মচমচ… শুকনোপাতার পাঁজর-ভেঙে কে যেন এগিয়ে আসছে…। পা-টেনে। ধীরে…। শিমুলের চোখে আটকে গেছে, ছোটপিসিমার জড়িয়ে-যাওয়া থকথকে মাংসপিণ্ডটা। অ্যাক্সিডেন্টের পরের সন্ধেয় মর্গের-বাইরে অমোঘ প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল ছোটকাকা, ছোটপিসে আর সে। সেই প্রথম ছোটপিসে আর ছোটকাকার সঙ্গে সিগ্রেট-ফোঁকা। বাধো-বাধো ঠেকছিল। কাঁধে আলতো-হাত-রেখে সিগারেটটা ঠোঁটে একরকম গুঁজেই দিয়েছিলেন ছোটপিসে। 

কিছু বলে উঠতে যাবে, মচমচ। যেন বরফে-জ’মে-যাওয়া পা দুটোকে ঘষটে-ঘষটে সিঁড়ি-ভেঙে-এসে দাঁড়াল কেউ। মর্গের পাহারাদার।…

তারপর? মনে পড়ছে না। কিন্তু, শব্দটা ছিল এরকমই।

 

খসখস… মচমচ… পুকুরের জলে রুপোলি মাছটা ঘাই-দেবে-দেবে… তখনই শিরাপাকানো একটা হাত লাঠিতে-ভর-রেখে দাঁড়ায়। মাথা তুলল। বিরলকেশ-কপালের প্রান্ত-ঘেঁষে খোঁচা-খোঁচা সাদা তুলো। এতক্ষণে জামার রঙটা বোঝা যাচ্ছে। জামা নয়তো, ব্লেজার! ফ্যাটফ্যাটে-ধূসর। রক্তহীন।

তোবড়ানো গালের চোয়াল-দুটোয় ঢেউ-তুলে কিছু বললেন বৃদ্ধ। শিমুল কান পাতে।

–আচ্ছা ভাই, মনে করবেন না কিছু, পরশু বিকেলে আপনাকে দেখলুম না ঘোষপুকুর শিশু উদ্যানে? আপনি বেঞ্চে বসেছিলেন… 

এইভাবেই…শিমুল বুকের-আঁধারে কথা নিয়ে লোফালুফি করছে। বাঁদিকের বুকে ছুঁড়ে দিয়েই ডানবুক দিয়ে লুফে নিচ্ছে। পিছলে প’ড়ে যায় তবু… ভাঙা-ভাঙা… অস্ফুট…। 

ভদ্রলোক বলেই চলেছেন, “আই মে নট রং, তার ক’দিন আগে আপনি বসেছিলেন স্টেশনের ওদিকে… রক্ষাকালী-মন্দিরের- পাশে… মিত্র-পার্কে…”

ভেতরে অক্সিজেন কমছে। হাঁফ-জড়ায়। তাও শব্দ-নিয়ে জাগলিং খেলে শিমুল। ঝরে-ঝরে-পড়া কথাগুলোকে সাবধানে জড়ো করল এবার। একটা বাক্যের আদল ফুটে উঠেছে। মনে-মনেই পড়ার চেষ্টা-করে।

এই তো এই পথটার হাত ধরেছে আর-একখানা গলি… গলিটা ধাক্কা খেয়েছে আরও একটা লেনে…ভেষ্টা পাচ্ছে, ভীষণ। জল। জঅঅল। ঐ তো বাঁপাশেই টিপকল। ঝুঁকে-আছে বৌ মতো-কেউ। বালতি।… সামনে দাঁড়াতেই সটান-হ’য়ে-গেল। ঘোমটার আড়াল ভেদ-ক’রে চোখ তোলে তরী। ছিটকে যায় শিমুল। আবার দেখে। হ্যাঁ, ঠিক, সেই, সে-এই বাঁদিকের গালের জড়ুল…।

একবার। আবার। বুঝতে পেরেছে এতক্ষণ।…কিন্তু, আপনি ওই পার্কগুলোতে কী করতে গেছিলেন মশাই? আমাকে শুধোচ্ছেন যে বড়ো?… এটা প্রশ্নবোধক। বেরিয়ে আসতে-আসতেও বেরোল না। চেপে-রাখা শ্রান্ত-প্রশ্বাস-ফেলে আলগা বুক কুড়িয়ে নিল কথার টুকরোগুলো…। 

বৃদ্ধ প্রায় থটরিডিং-এর ঢঙে ধরে ফেলেছেন জিজ্ঞাসা। ফাঁকা- দাঁতের গর্ত-দিয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন… বিজাতীয়-ভাষার-মতো লাগলেও শিমুলের ইন্দ্রিয় অনুবাদ-ক’রে-নেয় তৎক্ষণাৎ। “আপনি ভাবছেন, আমি রোজ কীকরতে যাই, এক-এক দিন, এক-একটা পার্কে?”

শিমুল ভাবছে না। প্রতিরোধ-ভেঙে কানে জবরদস্তি করছে প্রতিটা শব্দের মাস্তানি। “আরে ভাই, আমার তো বয়েস হয়েছে… ঢের… এইসব পার্কগুলোয় নিজেকেই খুঁজে বেড়াই তাই। বুঝলেন?…” বোঝা না-বোঝার মধ্যবর্তী ধোঁয়াটে-স্পেসে স্থির শিমুলের শ্রবণযন্ত্র…। 

আলোকবর্ষ দূর-থেকে কাঁপা-কাঁপা প্রশ্নচিহ্ন ভেসে-আসে… “আপনি তো অনেক ছোট… প্রায় আমার হাঁটুর বয়সি… আপনি কাকে খোঁজেন এইসব পার্কে- পার্কে? কাকে খোঁজেন, ভাই? কাকে খোঁজেন?”… এক-একটা প্রশ্ন তিরবেগে ফেঁড়ে-ফেলছে কানের পর্দা। ভোঁ-ভোঁ। ভোঁ-ভোঁ-ভোঁ।…

শিমুল ছোট হ’য়ে যায়। ভদ্রলোকের হাঁটুর চেয়েও ক্ষুদ্র। বামনের চেয়েও বামন।… প্রায় ডেঁয়ো পিঁপড়ের সাইজে পৌঁছে গেল। অনেকগুলো হাত-পায়ে সরসরিয়ে পালাতে থাকে। পিছনে তাড়া করছে অট্টহাসি। আকাশ-ফাটানো-অট্টহাসি। বুড়োটা লাঠি দিয়ে পিষে ফেলবে? ঘিলু ফটফটাস্‌!

ছুট-ছুট। পালাও শিমুল। ছোটো। জোরে দৌড়োও স্কাউন্ড্রেল।

… এদিকে, এই ডানহাতি গলিটায় ঢুকে পড়ো। কোথাও তো পৌঁছবে। আজ বা কাল। সব রাস্তাই কোথাও গিয়ে হাঁফ-ছাড়ে।… এই তো এই পথটার হাত ধরেছে আর-একখানা গলি… গলিটা ধাক্কা খেয়েছে আরও একটা লেনে…ভেষ্টা পাচ্ছে, ভীষণ। জল। জঅঅল। ঐ তো বাঁপাশেই টিপকল। ঝুঁকে-আছে বৌ মতো-কেউ। বালতি।… সামনে দাঁড়াতেই সটান-হ’য়ে-গেল। ঘোমটার আড়াল ভেদ-ক’রে চোখ তোলে তরী। ছিটকে যায় শিমুল। আবার দেখে। হ্যাঁ, ঠিক, সেই, সে-এই বাঁদিকের গালের জড়ুল…।

দৌড়-দৌড়-দৌড়।… রাস্কেল, জড়ুল কোথায়, তরীর গালে তো আঁচিল ছিল! মনে করো, আরও থটফুলি… আরও ডিপলি… এবার মনে পড়েছে, বাঁদর? আঁচিল নয়, তিল ছিল তরীর থুতনি ছুঁয়ে… কিন্তু মুখটা… মুখটা কেমন… কেমন দেখতে ছিলে তুমি, তরী?… এক-একটা আবছায়া মুখের ওপরে টুপটুপ জুড়ে-যাচ্ছে জড়ুল-আঁচিল-তিল… কোনটা? কোনটা তোমার?

ঠিক-ঠিক কোনটা, বলো, তুমি?

কলকলিয়ে রাস্তার দু’ধার পেরোয় টিউশন-ফেরতা, অভিসার-ভাঙা মেয়েরা। সাইকেলে। হেঁটে। একা। দলে-দলে।… প্রত্যেকের মুখেই তো তিল… আঁচিল… জড়ুল… কোনজন… কোনজন, তুমি, তরী?… এই পথটাও বুঝি ঠোঁটের নাগালেই আগলে রেখেছে আর-একটা আস্ত, গোটা পার্ক-কে!

বিনয় শিশু উদ্যান? ঘোষবাড়ির পার্ক?… ঠিক কতগুলো পার্ক এখনও জীবিত আছে তোমাদের স্মৃতি-হারানো ছোট্ট মফস্‌সলে? পাঁচিল-ধ্বসা এখানে-ওখানে। ক্ষয়া ইটের ওপাশে লম্বা পা-বাড়িয়ে ঢুকে-পড়ে শিমুল। থেবড়ে বসল মাটিতে। ভেপারের আলোকুচির উঁকিঝুঁকি।

শ্যাডোগ্রাফি। হাঁটু-সমান ঘাস… পেছনে দীর্ঘকায়-বৃক্ষেরা একঠেঙে-দাঁড়িয়ে। ঘন আলকাতরার তরলে কেউ চামচে দিয়ে ঘেঁটে-দিয়েছে দানা-দানা আলোকরশ্মি…। শিমুল যেখানে ব’সে, ঠিক তার হাত-ছোঁয়া-দূরত্বে তেকোনা, চৌকোনা, অন্ধকার। হাঁফাতে-হাঁফাতেই চারদিকে তাকাল। সেই বেঞ্চগুলো কোথায়?

নাগরদোলনা? ঢেঁ-কুচ-কুচ?…অনেকটা ঝুঁকে হাতবাড়িয়ে অন্ধকার-ছুঁতেই ছ্যাঁক-ক’রে-ওঠে তালু। ঠান্ডা… নিস্তব্ধ… পাথুরে… ঘুমন্ত-সাপের-পিঠে হাত রাখলাম, তবে! প্রায় কুঁজো-হ’য়ে গিয়ে গলা বাড়াল। সাদা-সাদা… ফলকের আকার…এগুলো কী? কিছু কি লেখা আছে? গায়ে?… ঝুঁঝকো-আঁধার পেরিয়ে ঠাহর হয় না… অন্ধেরা যেভাবে স্পর্শ-ক’রে-পড়ে… তেমনই ব্যাকুলতায় পরপর ফলকের গায়ে হাত-বোলাতে-থাকে শিমুল।

চেনা… খুব চেনা… স্পর্শেই ধরা দিচ্ছে এক-একটা নাম…পরিচয়… আঙুল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে-পড়ছে… একের-পর-এক… পিটার… ডরোথি…পল… মেরি… রোজমেরি… জেসমিন… জেসমিন… জেসমিন… 

হঠাৎ একমুঠো জুঁইফুলের সুবাস নাকে ঝাপটাতেই চমকে ওঠে।

রক্তের ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে। স্নায়ুতন্ত্রে বিস্ফোরণ!

লাভাস্রোত উপচে-ধেয়ে-আসে ঐ! … কুয়োর-অতল-ছেঁচে বারংবার মুখ- তুলতে-চাইছে কবেকার হারিয়ে-যাওয়া পেতলের ঘটি।… কিন্তু কোথায় কা-কা-কা? কাক ডাকছে না কেন? 

এখন কীকরবে তুমি? কী করবে শিমুল?

পালাও। জাস্ট কেটে পড়ো।…এই শহরের আনাচেকানাচে ওঁৎ-পেতে- আছে শত-শত প্রাগৈতিহাসিক-পার্ক। তোমার কি মনে হয় না, এরকমই কোনও একটা পার্কের গর্ভে একদিন জন্ম হয়েছিল তোমার? অকস্মাৎ?

পালাও… পালাও… জীবন ছেড়ে, স্মৃতি ছেড়ে, বাস্তব ছেড়ে লং-জাম্পে ছুটে যাও যতদূর পারো… দেখো, একদিন না একদিন ঠিক পৌঁছবে কোনও একটা পার্কে… যেখানে রোজ দাঁড়িয়ে থাকে কেউ না কেউ।… যেখানে পাখিরা ঘরে ফিরে আসে। কাক ডাকে। আর হ্যাঁ, কেউ কখনও হারিয়ে যায় না সেইখানে।